সিনেমার পর্দার বাইরে কারো নাম যে Rambo হতে পারে , আমার ধারণা ছিল না। দিল্লির আই এস টি এমে ( ইনস্টিটিউট অফ সেক্রেটারিয়াল ট্রেনিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট ) ট্রেনিং নিতে গেলে ওখানকার হোস্টেলে দুজনের জন্য একটা ঘর , এটাই রীতি ছিল , নয়ের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত। সে যাই হোক , ব্যাঙ্গালোর থেকে আসা মি : Rambo বেশ আলাপী লোক। ইসরোতে বিজ্ঞান প্রশাসনে ছিলেন তখন , যদিও একদম প্রথম চাকরি ছিল আমার দপ্তরেই , অর্থাৎ আয়কর দপ্তরে।
একথা সেকথায় বুঝলাম , দিল্লিতে এসে ভদ্রলোক খাবার নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছেন – ওঁর বক্তব্য , নার্থ ইন্ডিয়ার লোকেরা রান্না বান্না একেবারেই জানেনা , আর ভ্যারাইটিতো একেবারেই নেই ! আমাকে বললেন , ” সোম , আমাদের এক ধোসাই তো ৩২ রকমের !” নির্বিরোধ আমি বললাম না , তোদের আর ইডলি ধোসা ছাড়া আছে কি ! মেরে পাস্ মা হ্যা হ্যায় , আর মা বহুত আচ্ছা রান্না জানতা হ্যায় !
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, মা একবার শখ করে বাড়িতে ইডলি বানানোর পর ঠাকুমা নাকি বলেছিলেন – ‘ এইটারে নি ইডলি কয় ? আমরা তো এইটারে চিতৈ পিঠা কই !’ চিতৈ পিঠা অনেকদিন খাই না , সুতরাং এর সঙ্গে ইডলির নৈকট্য আমি ঠিক বলতে পারব না
দক্ষিণ ভারতীয়রা দেশজ খাবার নিয়ে বড্ড অবসেশনে ভোগে , বাঙালী যেমন মাছ নিয়ে।তবে বিদেশে এই যে এত এত সফ্টওয়ারের ছেলেপুলে চাকরি করে , তামিলনাড়ু আর অন্ধ্রের ছেলেরা ঠিক সার্বনা ভবন আর উদিপী রেস্টুরেন্ট পেয়ে যায় , বাংলার ছেলেরা ষোল আনা বাঙালী বা ভজহরি মান্নাকে মাথা কুটে মরলেও পাবে না , তাদের শেষ অব্দি ‘ যাদের দাবায়ে রাখা যায় না , সেই বাংলাদেশিদের উপরই নির্ভর করতে হয়
এমনিতে দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে যে খুব গলাগুলির সম্পর্ক তা নয় , তবে জলখাবার বলতে ইডলি ধোসা নিয়ে বেশ ঐক্য দেখা যায় , যদিও রান্নার ধরণ ধারণ, প্রদেশ ও অঞ্চল ভেদে আলাদা। এই খাবারগুলির আবশ্যিক সঙ্গী হল সম্বর ডাল ও চাটনি।নারকেলের এই ঘন চাটনি সকলের এত প্রিয় যে চেন্নাই এয়ারপোর্টে সামোসা অর্ডার করে দেখি , কাগজের প্লেটের উপর টোম্যাটো স্যসের জায়গায় নারকেলের চাটনি !
এক সহকর্মী থাকতেন মেরিনা বীচের খুব কাছে। যখন বললাম , আপনার তো যখন তখন সমুদ্রের ধারে বেড়াতে পারেন। উনি একটু আমতা আমতা করে বললেন , না , খুব ঘন ঘন হয় না , আসলে আমরা যৌথ পরিবার তো , এতগুলো ইডলি করে নিয়ে যাওয়া !আমি মানসচক্ষে দেখতে পেলাম ,দূরে নীল দিগন্তে মিশে যাওয়া সমুদ্র রেখার থেকে উদীয়মান সূর্য যখন মাথা তুলতে বসেছে , হাত ধরাধরি করে যখন তরঙ্গরাশির গর্জন আর উপকূলের বাতাসের শব্দ এক অপরূপ ধ্বনিমালা তৈরী করছে , তখন শতরঞ্চি বিছিয়ে এক দক্ষিণী পরিবার স্টিলের টিফিন কেরিয়ার খুলে ,রেন্ডে ইডলি , মুন ইডলির হিসাব করতে ব্যস্ত!
Rambo বর্ণিত ৩২ রকম ধোসার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও , প্লেন ধোসা , মসলা ধোসা , রাভা ধোসা এগুলো মোটামুটি সকলেরই জানা। তবে প্রথমে পন্ডিচেরীতে , পরে খোদ চেন্নাইয়ের বুকে ‘চিকেন ধোসা ‘ খেয়ে খুব চমৎকৃত হয়েছিলাম , সেই স্বাদ আবার পরখ করতে হবে।
এই দুই কাজিনের মধ্যে ইডলি বোধহয় স্বাস্থ্যের নিয়মে নিরীহতর -ইডলি খেয়ে অন্তত কারো শরীর খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে কখনো তীর্থ করতে বা এমনি ঘুরতে মাদুরাই শহরে গেলে , ‘ ছোট ছোট আকারের ‘মুরুগান ‘ ইডলি খেতে কেউ ভুলবেন না -মীনাক্ষী মন্দিরের কাছেই এই রেস্টুরেন্ট।
তবে ইডলি এমনি সেমনি করে খাওয়া যায় না , খানদানি তামিল বা দক্ষিণেই লোকেরা ইডলি বা তদৃশ কোন খাবার সাধারণত চাটনির সঙ্গে চটকে , গোল্লামত পাকিয়ে , নিখুঁতভাবে মুখে নিক্ষেপ করে খেয়ে থাকে – এটি অনুকরণ করা বোধহয় সহজসাধ্য নয়।
লেখার হেডিং যখন ‘ইডলি ধোসা এবং , সুতরাং তৃতীয় পদটি উত্থাপম জাতীয় কিছু হওয়া স্বাভাবিক – কিন্তু না পরিচয় করে নেওয়া যাক চেন্নাইয়ের ‘চেট্টিনাড স্পেশাল বিরিয়ানির সঙ্গে ‘I
এ সপ্তাহেই অফিস থেকে অন্য কোথাও গিয়েছিলাম , ফেরার পথে খিদে পেয়ে যাওয়ায় একটা মাঝারি রকম রেস্টুরেন্টে ঢুকেছিলাম চট জলদি ডিনার করে নেওয়ার জন্য । অর্ডার দিলাম চেট্টিনাড বিরিয়ানি ( বানান ব্রিয়ানি!) , খাবারটির সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় স্বত্বেও । Rambo- র ফর্মুলা মত দেখলাম এই বিরিয়ানিরও অনেক বৈচিত্র্য – প্লেন বিরিয়ানি , এগ বিরিয়ানি , স্পেশাল বিরিয়ানি !) ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করলাম। প্লেন বিরিয়ানি মানে কি ভেজ বিরিয়ানি ? ওয়েটারের জবার , না স্যার, নন ভেজ!
খেতে গিয়ে দেখি , অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও কোন মুরগী বা মাটনের চিন্হ নেই, একটু ফ্লেভার বা গন্ধ আছে মাত্র ! ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করতে সে অম্লান বদনে বলল , ” দিস ইস প্লেন বিরিয়ানি স্যার !” ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে এরকম রসিকতা !
চেট্টিনাড বিরিয়ানিতে কি ছিল না বললাম, তবে কি কি জিনিস থাকে বলা দরকার।
একটু মোটা ধাঁচের বাদামী রঙের চাল , প্রচুর পরিমানে টোম্যাটো আর কারি পাতা , সঙ্গে মুখে দেওয়ার জন্য টক টক বেগুনের ভর্তা আর রায়তা !
কিছু রেস্টুরেন্ট এই বিরিয়ানি কেজি দরেও বিক্রি করে – এক কেজি হোম ডেলিভারি করলে একটা বালতি ফ্রি !
আজ শনিবার। বাঙালীর ভাল মন্দ খাওয়ার দিন – পাঁঠার মাংস , নিদেনপক্ষে মুরগীর ঝোল কিংবা কোন সৌখিন মাছের পদ – যার মাসান্তেও বেশ সরেস , তারা হয়ত সন্ধ্যেবেলা চাইনিজ বা কন্টিনেন্টাল খাবার পরিকল্পনা করছে – আর বেশি দক্ষিণী খাবারের গল্প করলেই লোক পেটাতে আসবে! কথাতেই তো বলে , One man’s meat is another man’s poison !আমার মত সর্বভুক প্রাণী ছাড়া , লোকে মানেও তাই !