এখন সকাল সাতটা। হাওড়া চেন্নাই এক্সপ্রেস অন্ধ্র প্রদেশে ঢুকে পড়েছে। অপলা চৌধুরী টেম্পোরারি ফ্রেস হয়ে জানালার ধারে নিজের সিটে এসে বসলেন। জানালার বাইরে গুল্মের সবুজ প্রান্তর, তারও দূরে পাহাড় ও ছোট ছোট টিলা গুলো ক্রমশ পিছনে সরে যাচ্ছে। অপলা দেবীর দেখতে ভালই লাগছে কিন্তু শরীর মন সায় দিচ্ছে না। স্থুলবতী অসুস্থ অপলা চৌধুরী অনভ্যাস বশত ট্রেনে নিশিযাপন করে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মনে মনে ভাবছেন এর থেকে কোলকাতায় চিকিৎসা করা ভাল ছিল। পাঁচ জনে ব্যবহার করা বাথরুম, ভাল মন্দ যা খাননা কেন অপরিচিত মানুষ গুলোর সামনে খেতে হচ্ছে, বিরক্তিকর পরিস্থিতি। এ’রি মধ্যে ষাটোর্ধ সুরেন চৌধুরী দুই কাপ চা কিনে এক কাপ চা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন-” চা খাও, শরীরটা একটু ফ্রেশ লাগবে।” কথাটা অপলা চৌধুরীর কানে বেজে উঠল। ওঠাই স্বাভাবিক, যতদুর মনে পড়ছে, তাঁর বিবাহের পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম স্বামী দেবতা তাঁর মুখের সামনে চা এনে খাওয়ার অনুরোধ করলেন। অপলা চৌধুরী অবাক হয়েই চা-টা হাতে নিয়ে জানালার বাইরে মুখ করে বসলেন। দ্রুত গতিতে ট্রেনটি বিশাখাপত্তনমের দিকে এগিয়ে চলেছে। চোখের সামনে পড়া দৃশ্য গুলো সাঁইসাঁই করে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে। অপলা চৌধুরীর মনের গতি ট্রেনের গতির বিপরিতগামী হয়ে উঠল। সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে গেলেন পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই দিনগুলোতে——
মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে এই চৌধুরী পরিবারে বৌ হয়ে এসেছেন। সংসার জীবন সম্পর্কে না বোঝা,না জানা, অনভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হয়ে তাঁর বিবাহ সূত্রে এই রক্ষণশীল পরিবারে পদার্পণ। একান্নবর্তী পরিবার, বাপ জ্যাঠা কাকাদের আদর্শ পরিবারের পুত্র বধু। অন্তঃপুরে সর্বময়ী কত্রী রাশভারী মেজাজী জেঠিমার নিয়ন্ত্রণে বাড়ির মেয়ে,বউ,এবং ছোটদের অলিখিত রুটিন অনুযায়ী সূর্যদয় থেকে রাতে বিছানায় যাওয়া অবধি চলতে হত। ভারি কাজের দায়িত্ব না দিলেও গল্প গুজব করে সময় কাটাবার সুযোগ ছিলনা। দুপুরে বিশ্রামের সুযোগ ছিল, কিন্তু একা। স্বামী দেবতা তখন কর্ম ক্ষেত্রে। ছুটির দিনে দুপুরে নিজের ঘরে ঘুমানোর অনুমতি ছিল না, তাতে পতি দেবতার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে, আবার এক বাড়ি লোকের মধ্যে দিনের বেলা দৃষ্টিকটুও লাগে। ফলে স্বামী দেবতার দর্শন পেতেন রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে সর্বোচ্চ কম পাওয়ার বাল্বের আলো আঁধারেতে, কিছুক্ষণের জন্য। মনের মধ্যে একটা টাইম পিস ঘড়ি ছিল, সেটা ঠিক জানিয়ে দিত কখন ভোরপাঁচটা বাজবে। অপলা চৌধুরী নাম দিয়েছিলেন ‘আতঙ্ক ঘড়ি’। সময় মতো ঘুম না ভাঙলে সাত সকালেই বাক্য বাণ বর্ষিত হত। চলত না কোনো অজুহাত, পাশে পাওয়া যেত না পাশের মানুষটিকেও। তাঁরও পক্ষ পাতিত্ব্যের অধিকার ছিলনা। পরিবারে অধিকারের সীমা রেখা কার কতটুকু, সে বিষয়ে সকলেই ওয়াকিবহাল ছিল। ‘স্ত্রী ঘরের লক্ষ্মী’ সেটাও তখনো হয়ে উঠতে পারেননি। তখন স্ত্রী মানে বিনামূল্যের গৃহ পরিচারিকা, এবং উত্তরসূরীর আধার। স্বামী মানুষটি অপলা দেবীর চোখে কেমন যেন গোলমেলে। পরিবারের ট্রাডিশন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। ভলোলাগা, ভালোবাসা, ইচ্ছা, আকাঙ্খা কিছুই তাঁর মধ্যে উঁকিঝুঁকিও মারতে দেখেননি। দশ বারো বছরের বড়ো স্বামী দেবতাটির সাথে কখনো প্রাণ খুলে মজা মশকরা করতেও পারেন নি। এই পরিবারে যখন প্রথম পুত্র সন্তান এল বাড়িসুদ্ধ লোকের সে কি আনন্দ, অথচ তিনি একদিন গেলেন নার্সিংহোমে, আর ষষ্ঠী পুজোর পর একদিন ঘরে। অপলা চৌধুরী জানতে চেয়েছিলেন পুত্র হওয়ায় তিনি খুশি কিনা, তার কোনো সদুত্তর পাননি। সন্তানকে কোলে নিতে বললে অত ছোট পারবেন না জানিয়ে দিয়েছিলেন। অপলা চৌধুরী ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি ছিলেন ছয় মাস। ছয় মাসে একবার স্বামী দেবতা শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলেন। তাঁদের শিশু সন্তান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
জ্যাঠা শ্বশুর, জেঠিমা শাশুড়ী গত হওয়ার পর একান্নবর্তী পরিবারে ভাঙনের চোরা স্রোতটা সকলের অজান্তে কখন পরিবারে ঢুকে পড়েছে কেউ টেরও পায়নি। শ্বশুর ও কাকা শ্বশুর গত হওযার পর স্বার্থপরতা পরশ্রীকাতরতা যেন প্রকট হয়ে উঠল। অপলা চৌধুরীর স্বামী সুরেন চৌধুরী ভাঙন আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু পারেননি। আজ প্রায় পনের বছর অপলা চৌধুরী সংসারের কত্রী, কিন্তু ওই সংসারের অবস্থান অনুযায়ী,বাস্তবে নয়। বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারের ট্রাডিশনটা সুরেন চৌধুরী এখনো ধরে রেখেছেন। অন্দর মহলের কোন কাজ যা মহিলা কতৃক সম্পন্ন হয়, সেটাতে তিনি দৃষ্টিপাত করেন না। অন্দরমহলের কোনো কাজের জন্য তাঁকে অনুরোধও করা যায় না। আবার অন্দর মহলের বাইরের কোনো কাজ ঘরের মহিলারা করবে, এটাও তিনি পছন্দ করেন না। ফলে অপলা চৌধুরীর সংসারে কর্তৃত্ব না দেখানোর এতো দিনের অভ্যাস, আবার বয়সের ভারে, সব কিছু সয়ে গেছে, অসুবিধা হয় না। ছেলে, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তাঁর এখন ঝাড়া হাত-পা। বৌমার উপর কর্তৃত্ব প্রদর্শনের ইচ্ছে তাঁর বিন্দুমাত্র নেই। আধুনিক যুগের শিক্ষিত মেয়ে,ওদের জীবন ওরাই গুছিয়ে নিক। দৃষ্টিকটু কিছু যেন না ঘটে সেইদিকে নজর রাখলেই হল। তবে আজকের দিনের স্বার্থ কেন্দ্রীক পরিবার গুলোর অবস্থা দেখে অপলা চৌধুরী উপলব্ধি করেছেন, পরিবারকে একসূত্রে গেঁথে রাখতে জেঠিমা শাশুড়ির মত মানুষদেরই প্রয়োজন।
অপলা চৌধুরীর সম্বিত ফিরল আই আর সি টি সি ডেলিভারি বয়ের ” ভেজ স্যান্ডউইচ ” চিৎকারে। সুরেন চৌধুরী বললেন-” কাল সকাল পর্যন্ত ট্রেনে থাকতে হবে, টাইম টু টাইম কিছু তো খেতে হবে। স্যান্ডউইচ কিনি?” অপলা চৌধুরীর ওই পরিবেশে খেতে ইচ্ছা না করলেও পতির আহারের কথা ভেবে সম্মতি দিলেন। দুপুরে খাবার দেওয়ার পর সুরেন চৌধুরী খাবারটা গুছিয়ে অপলা চৌধুরীকে বললন-” একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও, রাতে হালকা কিছু খেয়ে নেব, তারপর ঘুম ভাঙলেই তো নামতে হবে।” অপলা চৌধুরী খাবেন কি স্বামীর বাম ধারার আচরণ দেখে তাঁর নিজের মুখ থেকে কোনো কথা সরছে না। সংসারের কাজ তো দুরস্ত, মিতভাষী মানুষটা পঁয়ত্রিশ বছরে কথার উত্তরে হ্যাঁ আর হুঁ ছাড়া কিছু বলতে শোনেননি। মনেমনে ভাবছেন এমন আচরণ কি অপলা চৌধুরীর শরীর খারাপের জন্যে, কিন্তু তিনি তো রোগে শয্যাশায়ী নন।
পর দিন, এস রাম চন্দ্রন হসপিটালের পাশেই একটা লজে এসে উঠতে সুরেন চৌধুরীদের সকাল আটটা বেজে গেল। বাঙালী মালিক বিজয় দাস, অমায়িক আচরণ, ঘর খুলে সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে বললেন, তাঁরা যেন একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে হসপিটালে চলে আসেন। তিনি পেশেন্টের নাম এন্ট্রি করে অপেক্ষা করবেন। অর্থাৎ গাইডের কাজটা ফ্রী অফ কস্টে তিনিই করে দেবেন।
ওয়ান বি এইচ কে সুন্দর লজ। নিজেদের মতো রান্না করে খাওয়া যাবে। আর যাইহোক সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার তো কুইনাইনের মতো গিলতে হবে না। অপলা চৌধুরী সব দেখে শুনে হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। কর্তা গিন্নীতে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সুরেন চৌধুরী অপলা চৌধুরীকে পুনরায় আবাক করে বললেন- “চা কি আমি তৈরী করব?” অপলা চৌধুরী সম্মতি না দেওয়ায় তিনি স্ত্রী’র মেডিকেল ডকুমেন্টস গুছিয়ে নিতে থাকেন। অপলা চৌধুরী দু’কাপ চা করে আনলে,ধূমায়িত চায়ের কাপে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়েই সুরেন চৌধুরী পরম তৃপ্তিতে বললেন-” আঃ, মনে হচ্ছে কতোদিন পরে যেন তৃপ্তি করে একটু চা পান করছি।”
ডাক্তার অপলা চৌধুরীকে চেক-আপ করে সন্দেহ দুরিকরনের নিমিত্তে ল্যাক্টোস্কপি ও কোলনস্কপি করতে দেন। বিজয় বাবু জানালেন পরের দিন টেস্ট গুলো হবে। তার জন্য আজ কিছু ঔষধ খেতে হবে। ঔষধ গুলোর কাজ পায়ু নালী পরিষ্কার করা, আর শরীর যাতে দুর্বল না হয় সেদিকে নজর রাখা। সুতরাং আট দশবার বেগ আসবে, ভয় পাওয়ার কারন নেই।
বিকাল পাঁচটার পর ওষুধ পেটে পড়তেই শুরু হল বমি। বিছানা থেকে উঠে বেসিন অব্দি আসার সময় দিল না। সমস্ত ফ্লোরে হজম না হওয়া খাবারে ছড়াছড়ি, সেই সাথে বিশ্রী উৎকট গন্ধ। অপলা চৌধুরীর তখন কোনো সেন্স কাজ করছে না। হড়হড় করে বমি হয়ে যাচ্ছে। বেসিনটা ধরে কোনো মতে তিনি দাড়িয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। শরীর ছেড়ে দিয়েছে, এই বোধ হয় তিনি পড়ে যাবেন। সারা মেঝেতে নোংরা। এই পরিস্থিতিতে স্বামীকে ডাকবেন কি ডাকবেননা ভাবছেন, ঠিক তখনই পিছন থেকে এসে সর্ব শক্তি দিয়ে তাঁকে ধরলেন সুরেন চৌধুরী। বেসিন ভর্তি নোংরা, জলে খাদ্যকনা আটকে গেছে, জল সরছে না। অপলা চৌধুরীর বমি আপাতত বন্ধ হয়েছে। সুরেন চৌধুরী ওনাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে চোখ,মুখ,ঘাড়ে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ করে ধীরে ধীরে বিছানায় এনে বসালেন। সুরেন চৌধুরী যতই কাছের মানুষ হন না কেনো অপলা চৌধুরীর নিজেকে খুব ছোট লাগছে। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। লজ্জাবোধ থেকে তিনি আস্তে আস্তে বললেন-” তুমি বাইরে গিয়ে দাড়াও, আমি একটু বিশ্রাম নিয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছি।” অপলা চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুরেন চৌধুরী কোমর বেঁধে ঘর পরিষ্কার করার কাজে নেমে পড়েছেন। শুধু চারটি শব্দ ব্যবহার করলেন-” চুপ করে শুয়ে থাক।” অপলা চৌধুরীর তখন বেশি কথা বলার ক্ষমতা নেই। অর্ধ মেলিত চোখে দেখলেন, পটু সেবকের মতো ঘরের মেঝে পরিষ্কার করে ফিনাইল দিয়ে মুছে বেসিনের নোংরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিষ্কার করছেন। তারপর এক সময় অপলা চৌধুরী দুর্বলতার কারনে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘন্টা খানিক পর ঘুম ভাঙল সুরেন চৌধুরীর ডাকে। উঠে বসে যা দেখলেন তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। একটা থালায় অল্প গলা ফ্যান মাখানো ভাত, তার উপর একটু ট্যালটেলে ডাল, সঙ্গে একটা সেদ্ধ আলু। একটু সহানুভূতির সুরে বললেন-” ভাল রান্না করতে পারিনি, ওষুধ খেতে হবে, খেয়ে নাও।” অপলা চৌধুরীর চোখ জলে ভরে গেল। এই মানুষটাকে এতোদিন তিনি নির্দয় পাষণ্ড ভেবে এসেছেন!! আত্ম সঙ্কোচে তাঁর মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। মুখ থেকে বেরিয়ে গেল-” আপনি!!” –“ও সব কথা পরে হবে, আগে খাও দেখি, আমার অনেক কাজ আছে।”
রাত তিনটে থেকে লুজ মোশান শুরু হল। বারবার যাওয়া আসা, ছাড়া পরিধানও জমলো অনেক। ভোর পাঁচটা থকে সাতটা পর্যন্ত অপলা চৌধুরী একটা স্বস্তির ঘুম দিয়ে উঠে দেখলেন সুরেন চৌধুরী তাঁর রাতের ছেড়ে রাখা নোংরা কাপড় গুলো কেচে শুকাতে দিয়ে দুপুরের রান্না করছেন। অপলা চৌধুরী স্বামীর কর্মকাণ্ড দেখে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, সুরেন চৌধুরী কথা না বলতে দিয়ে বললেন–” কোনো কথা না, ফ্রেশ হও টেস্ট গুলো করতে যেতে হবে, শুধুমাত্র জল খাবে আর কিছুনা।” অপলা চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন-” ঠিক আছে তা না হয় হলো, কিন্তু সকালে আপনার চা ব্রেকফাস্ট!!” সুরেন চৌধুরী ভাত উবুড় দিতে দিতে বললেন-” তোমার টেস্ট গুলো হয়ে গেলে বিজয় বাবুকে নিয়ে হসপিটাল ক্যান্টিনে টিফিন করে নেব। সুরেন চৌধুরী চা টিফিন না খাওয়ার মূল কারনটা অপলা চৌধুরী অনুমান করলেন। বাথরুমে গিয়ে কলের তলায় দাঁড়িয়ে আবেগঘন অবস্থায় চোখের জল আর সাওয়ারের জলে শরীর ও মন সিক্ত করতে থাকেন– যে মানুষটা কে কখন খেল না খেল কোনোদিন তার খোঁজ রাখেননি,এমন কি ছোটোখাটো অসুখেও কাছে এসে খোঁজখবর নেননি। আর আজ তিনি খেতে পারবেন না বলে সেই মানুষটি দীর্ঘ দিনের অভ্যাস সকালের চা টুকুও খেলেন না!! সাউথ ইন্ডিয়ার হসপিটালে কাজকর্ম সময় মেনে সিস্টেমেটিক হওয়ার জন্য এগারোটার মধ্যে টেস্ট কমপ্লিট হয়ে গেল। তারপর ক্যানটিনে বসে চা উপমা খেতে-খেতে বিজয় বাবু জানালেন তিনটের মধ্যে রিপোর্ট সম্ভবত দিয়ে দেবে। সুরেন চৌধুরীরা লজে ফিরে স্নান খাওয়া করে বিশ্রাম নিতে পারেন। চারটা পর্যন্ত ডাক্তার থাকবে, সম্ভব হলে আজই রিপোর্ট দেখিয়ে নেবেন। এবং যদি সেটা সম্ভব হয়তো ফোন করে ডেকে নেবেন।
লজে এসে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে সুরেন চৌধুরী খাবার রেডি করতে রান্নাঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন, সেটা বুঝে অপলা চৌধুরী বারণ করলেন। সুরেন চৌধুরী একটু হেঁসে বললেন-” থাকনা, তোমার শরীর এখনো সুস্থ হয়নি, আর আমার তো অভ্যাস হয়ে গেছে।” বিজয় বাবু ফোন করে ইমিডিয়েট হসপিটালে আসতে বললেন। ডাক্তার বাবু আছেন এবং এখনি দেখবেন। টেস্ট রিপোর্ট দু’টোই নেগেটিভ হওয়ার ফলে এক মাসের ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা পর্ব চুকিয়ে ফেললেন। সুরেন চৌধুরী ভাবতেও পারেননি দু’দিনে সব কমপ্লিট হয়ে যাবে। তবে ক্রেডিট সম্পূর্ণভাবে বিজয় বাবুর প্রাপ্য।
আজ অপলা চৌধুরী মানষিক ভাবে সুস্থ বললে ভুল হবে, অতি সুস্থ। সুরেন চৌধুরী বেশী বেশী বাজার করে এনেছেন, ইচ্ছে একটু ভাল করে রেঁধে খাওয়ার।সুরেন চৌধুরী চা পান করতে করতে অপলা চৌধুরী কে বললেন-” ঈশ্বরের অপার কৃপায় দু’দিনে কাজ মিটেগেল। কাল ভোরে গিয়ে তত্কাল টিকিট কেটে নেব।” অপলা চৌধুরী সব্জি কাটতে কাটতে আলটপকা বলে ফেললেন-” আর কটা দিন থেকে গেলে হত না?” এবার সুরেন চৌধুরীর অবাক হওয়ার পালা, যাকে চিকিৎসার জন্যে প্রায় জোর করে চেন্নাইতে আনা হল, কত দিনে কাজ মিটবে সেটা নিয়েই সন্দিহান ছিলেন। তার উপর শারীরিক অসুস্থতা। সব যখন ভালোয় ভালোয় মিটে গেল, তখন কিনা আরো কিছুদিন থাকতে চাইছেন!! এটা ভাবতে ভাবতে সুরেন চৌধুরীর মস্তিষ্কে অনেক ভাবনা এসে উঁকি মারল। এটা’ত সত্যি যে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রৈণ হতে পারেননি। শুধু তাই নয়, স্ত্রীকে একান্তভাবে কখনোও সেভাবে সময় দেননি। আজ তিন কাল পূর্ণ করা জীবনে এটুকু ইচ্ছে পুরন করা উচিত নয়কি? অপলা চৌধুরীকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে সুরেন চৌধুরী বললেন-” ঠিক আছে এক সপ্তাহ বেশী থেকে কাছাকাছি মেরিনা বিচ, ও অন্যান্য কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখে বাড়ি ফিরব।”
অপলা চৌধুরী ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ভাবলেন, স্নান সেরে চা করে তারপর পতি দেবতার নিদ্রা ভঙ্গ করবেন। বেচারা দুই দিন কর্তব্য রক্ষার্থে যা পরিশ্রম করেছেন তাতে অপলা চৌধুরীর পঁয়ত্রিশ বছরের ভুল ভাবনার পাহাড়টা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এদিকে সুরেন চৌধুরীরও ঘুম ভেঙে যায়, তিনি নিছক কৌতুহল বশত ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকেন।
অপলা চৌধুরী স্নান সেরে রুমে টানানো একটা ঠাকুরের ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে বললেন-” মা-গো, তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ, আমার অসুখ সারাবার জন্য নয়, অসুখ হওয়ার জন্যে। অসুখে যে এত সুখ লুকিয়ে ছিল সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রকৃত মানুষটাকে তুমি আজ চিনিয়ে দিলে। আমি আর কিছুই চাই না, তোমাকে শত কোটি প্রনাম। কৃতজ্ঞতা জানানোর শেষে অপলা চৌধুরী ক্যালেন্ডারে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মনেমনে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকলেন।
সুরেন চৌধুরী ঘাপটি দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন, হঠাৎ খেয়াল করলেন মুদিত দুই চোখের অশ্রু ধারায় কখন মাথার বালিশটা ভিজে গেছে।