“ দাদুভাই রথের দিন ঠাকুর মাসীর বাড়ি যায় কেন? ” একমনে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাগজ পড়ছিলেন অবিনাশ। আচমকা প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যান। তারপর সামলে নিয়ে প্রশ্ন করেন, “ তোমার আজ স্কুল ছুটি নাকি দাদুভাই?” ঘাড় নেড়ে’ না ‘ বলে একেবারে দাদুর কোলে উঠে বসে তিতাস। “ তাহলে স্কুলে যাও নি যে বড়?” “ মাম্মা বলেছে আমার গা গরম। অল্প জ্বর। তাই।” “ তাই নাকি ! দেখি দেখি ! ” এবার সত্যিই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন অবিনাশ। “ আহ্! পরে দেখবে। আগে তুমি বল মাসীর বাড়ি যায় কেন ঠাকুর? মামার বাড়ি যায় না কেন ?” একটু ফাঁপরে পড়েন অবিনাশ। পাঁচ বছরের শিশুকে কিভাবে কতটা বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তাই মুখে যা আসে সেটাই বলে দেন। “ মামার বাড়ি নেই ঠাকুরের। সবার কি আর তোমার মত মামার বাড়ি থাকে?” “ তাই বুঝি? আহারে ! তাহলে তো ঠাকুরের খুব কষ্ট !” “ তা বটে। খুবই কষ্ট।”সায় দেন অবিনাশ। “ দাদু ভাই আমি রথ টানব।” “ অ্যাঁ! ” “ হ্যাঁ। আমি রথ টানব। ঠাকুরকে মাসীর বাড়ি নিয়ে যাব।” বুকের ভেতর যেন দ্রিমি দ্রিমি মাদলের শব্দ! আড় চোখে ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে নেন অবিনাশ। পিয়ালী শুনছে কি? শেষে আবার বলে বসবে এসব মতলব শ্বশুরমশাই ই দেন। “ কি হল দাদু ? আমায় রথ এনে দাও। আমি রথ টানব। এবার সত্যি সত্যি প্রমাদ গণেন অবিনাশ। ভীষণ জেদ তিতাসের। একবার বায়না ধরলে থামানো মুশকিল। ঠিক ওর বাবার মত। রথ একটা দেওয়াই যেতে পারে কিন্তু টানবে কোথায়? এই ছয়তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে? তারপর রথ দিতে পিয়ালী অ্যালাও করবে কি ? শেষে বকুনি খেয়ে মরবে বাচ্চাটাই। তাই অন্য পথ ধরেন অবিনাশ। “ রথ নিচে রাস্তায় টানতে হয় দাদুভাই। আর তোমার জ্বর না? মাম্মা রাজি হবে না। বকা দেবে। ” “ আমি রাস্তাতেই টানব। আমাদের নিচের ওই গেটের সামনে। ও দাদুভাই একটা রথ দাও না।” “ কি বায়না হচ্ছে দাদুর কাছে ?” শ্বশুরের জলখাবার নিয়ে পিয়ালী এসে দাঁড়িয়েছে। অকূলে যেন কুল পান অবিনাশ। “তার এখন রথ চাই। বায়না জুড়েছে। আবার বলে নিচে গিয়ে গেটের সামনে রাস্তায় চালাবে।“ “ চালাবই তো। দেখছ না ওরা চালাচ্ছে। ওদের সঙ্গে চালাব।” আঙ্গুল দিয়ে নিচের দিকটা দেখায় তিতাস। দেখে ভির্মি খান অবিনাশ। এই বার তলা বিল্ডিংয়ের উল্টোদিকেই একটা বস্তি। ঠিক পার্কের পিছনে। বড় বেমানান। কিন্তু বিরাজমান। ঠিক যেমন আলোর নিচে অন্ধকার। চাঁদের বুকে কলঙ্ক! তেমনি। শোনা গেছে এদের তোলার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু পারা যায়নি। এখন তিতাস সেদিকে আঙ্গুল তুলেই দেখাচ্ছে। ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চা রথ বার করেছে। টানছে। মাঝে মাঝেই টানার প্রবল বেগে ঠাকুর সম্ভবত উল্টে পড়ে যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে তাকে সোজা করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।তার মধ্যেই হাতের পেছন দিয়ে নাক মুছছে।থেকে থেকেই খুলে যাওয়া ঢলঢলে প্যান্ট তুলছে কোমরে। উস্কোখুস্কো চুল। অপরিষ্কার মুখ। কিন্তু হাসি অনাবিল। পিয়ালীর ভ্রু কুঁচকে উঠে আবার সোজা হয়। “ অন্যায় বায়না কর না। এখন এই রোদে দাদু রথ কিনতে বেরোবে?” নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না অবিনাশ। পিয়ালীর গলায় প্রশ্রয়ের সুর না? আর সেটা বুঝে ফেলে হঠাৎই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কথাটা “ রথ তো ঘরেই আছে। কিনতে হবে কেন?” “ ইয়া ! কি মজা ! ও দাদুভাই কই রথ ? দেখাও। দাও।” দুহাত দিয়ে অবিনাশকে ঠেলতে থাকে তিতাস। বিস্ময় পিয়ালীর চোখেও। ঘরে উঠে যান অবিনাশ। চাবি দিয়ে খোলেন শান্তির পুরনো বড় কাঠের আলমারি। “ এটা কার দাদুভাই?” “ তোমার বাবার। সেই ছোট্ট বেলার। ঠামি যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। তোমার জন্য।” দুহাতে তুলে রথটাকে বার করে নিয়ে আসেন অবিনাশ। সনাতন ছুতোরের হাতের কাজ। “ বার বার কিনবেন ক্যান কত্তা। একখান এমন বানাইয়া দিমু যে রথ চলতেই থাকব।“ “ বাবাই রথ চালাতো !” বিস্ময় উপচে পড়ে তিতাসের দুই চোখে। এখনকার গম্ভীর চশমা চোখের ব্যস্ত বাবার সাথে রথ চালানো বাবাকে মেলাতে পারছিল না ও। মৃদু মৃদু হাসছিলেন অবিনাশ। সবুজ আর হলুদ রং করা সেগুন কাঠের রথ। এতটুকু জেল্লা নষ্ট হয় নি এখনো। ভেতরে কাঠের জগন্নাথ, বলরাম সুভদ্রা আজও তেমনি অম্লান। মাঝে মাঝেই বার করে মুছতে দেখেছেন শান্তিকে। প্রশ্ন করলে বলতো আমার বুবুনের ছেলে খেলবে। তিতাসের দিকে চেয়ে একটা নিশ্বাস ফেলেন অবিনাশ। তিতাস এল। কিন্তু শান্তি দেখল না। “ কি সুন্দর দাদুভাই। মাম্মা সাজিয়ে দাও ফুল দিয়ে। আমি নিচে গিয়ে রথ চালাবো।“
” বিকেলে। এখন না। রোদ পড়ুক। তখন। এখন এসো।” “ ঠিক বিকেলে যাবে তো ? দাদুভাই ?” মায়ের পিছু পিছু যেতে যেতে করুন চোখে চায় তিতাস। সেদিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে রাশি রাশি স্মৃতি ঠেলে ওঠে। কি সব দিন ছিল! রথ মানে এক সপ্তাহ আগে থেকেই উন্মাদনা। কে কত ভালো করে সাজাতে পারে। নিজের হাতে রঙিন কাগজের শিকল তৈরি করে ঝোলানো। এর ওর বাগান থেকে তুলে আনা ফুল। আর রাস্তায় বেরোলে পয়সা রোজগারেরও একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা। যদিও সেসব পয়সা কখনো জগন্নাথের ভোগে লাগতো না। নিজেদেরই ফুচকা, আলুকালি ঘুগনির পেছনে খরচ হোত। আর ছিল রথের মেলা! সেই বাঁশি কিনে ঢাক বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফেরা! বুবুনও ছোটবেলায় তার মতই ছিল। রথের দিন অফিস থেকে সকাল সকাল ফিরতে হোত তাকে। নিজের হাতে ছেলের রথ সাজিয়ে দিয়ে বেরোতে হোত।অন্তত একদিন রথের মেলায় না নিয়ে গেলে ছেলের মুখ ভার হোত। দেখে খুব আনন্দ পেতেন অবিনাশ। ছেলের শৈশবের মধ্যে দিয়েই যেন নিজের ছোটবেলা দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসত। হাসতো শান্তি। তার পরিপাটি করে রথ সাজানো, ছেলের হাতে দড়ি ধরিয়ে টানানো, ঠাকুরের মিষ্টির জোগাড়, সব কিছুর মধ্যে দিয়ে তার নিজের ছেলেমানুষী যে কতটা প্রকাশ হয়ে যেত সেটা একমাত্র বুঝত শান্তি। তবে খুব বেশিদিন নয়। ক্লাস সেভেন থেকেই কি ভীষণ গম্ভীর আর পড়ুয়া হয়ে উঠল বুবুন। আর এসব দিকে ফিরেই তাকাতো না। রথের দিনগুলোতেও ওর কোচিং ক্লাস, গ্রুপ স্টাডি। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে বসে অপেক্ষা করতেন অবিনাশ। নাহ ! বুবুন আর রথ টানতে আসে নি। অপেক্ষা করতে করতে একদিন বড় হয়ে গেল ও। আর অপেক্ষাটাই অভ্যাস হয়ে গেল অবিনাশের কাছে। স্মৃতির তারে মরচে ধরে গেল। শান্তিও চলে গেল। তারপর থেকে তো জীবনের ক্যালেন্ডারে কত রথযাত্রা এলো গেল। হিসেব রাখতেই ভুলে গেছেন অবিনাশ। তবু আজ এতদিন পর তিতাসের মুখে রথ কথাটা শুনে যেন উপচে উঠছে স্মৃতির ঝাঁপি। বিহ্বল চোখে রথটার দিকে তাকালেন অবিনাশ। তারপর নিজেই এক টুকরো কাপড় নিয়ে বসলেন পরিষ্কার করতে। দুই “ ওদিকে না তিতাস। এইখানে এই রাস্তায় টানো। আমি ধরে থাকি হাত।” “ আমার ওটা কই দাদুভাই?বাজাবো কি?” তিতাসের হাত লক্ষ্য করে চেয়ে দেখেন অবিনাশ। ওই সকালের বাচ্চাগুলো আবার এবেলা বেরিয়েছে। দাঁড়িয়েছিল এসে তার কাছেও। দশ টাকার একটা নোট দিয়েছেন। এখন পার্কে অনেক লোক। বাচ্চা গুলো টাকার আশায় আবার বেরিয়েছে। ওদের হাতে কাঁসর ঘণ্টা। সেটার দিকেই এখন তিতাসের চোখ। বিপদে পড়লেন অবিনাশ। শান্তি বেঁচে থাকতে ঠাকুরের বাসন কোসণের মধ্যে কাঁসর ঘণ্টা একটা ছিল। এখন সেটা কোথায় আছে জানেন না। কারণ পুজো আর্চার পাট বাড়িতে আর নেই। কোথায় খুঁজবেন এখন? “ দাদুভাই ওদের বল না আমার কাছে বাজাতে।” তিতাসের মুখের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবলেন অবিনাশ। তারপর হাতের ইশারায় ডাকলেন ছেলে মেয়ে গুলোকে। ছুটে এলো ওরা। কথাটা বলতেই ড্যাং ড্যাং করে বেজে উঠল কাঁসর ঘণ্টা। তিতাসের হাতের সাথে দড়ি ধরে নিল আরো কয়েকটা কচি হাত। ছুটল রথ। দু চোখ ভরে দেখছিলেন অবিনাশ। দেখছিলেন তার ছেলেবেলকে ।