তিস্তা পারের রহস্য (পঞ্চম পর্ব)
সলিল চক্রবর্ত্তী
১৮/০১/১৯৮৬
আজ চার মাস পর দিনলিপি লিখতে বসলাম। চরম অসুস্থতার কারনে যা এতদিনে লিখতে পারিনি। আজও পারতাম না, যদি না এই শ্মশান সংলগ্ন গোর্খা বসতির মানুষ গুলো আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় মোহনার বরফ গলা ঠাণ্ডা জল থেকে তুলে এনে সেবা শুশ্রূষা করে সারিয়ে না তুলত। এরা আমার নব জন্মের অভিভাবক।
সেদিনের ঘটনাটি লিখতে বসেছি ঠিকই, তবে ভাবতে গেলে নিজের উপর অক্ষমতার বিতৃষ্ণা ভোরে ওঠে— চোদ্দই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর কালী মন্দির থেকে বেরিয়ে বৃষ্টি বাদলায় শ্মশানে আসতে রাত আটটা বেজে যায়। শুনশান শ্মশান চত্তর, টিপটিপ বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সঙ্গে জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়ায় কাজে বেশ অসুবিধা হবে বুঝতে পেরেছিলাম। তবুও শব দাহের অপেক্ষায় শ্মশান বেদীর ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। দোঙ-জঙ-পা লামা বলেছিলেন যে, আমি শ্মশানে উপস্থিত হওয়ার পর শ্মশানে শব আসবেই আসবে। তীর্থের কাকের মতো মুক্তির আশায় কতশত আত্মা হয়ত আমার উপর ভরসা করে ছিল। যাইহোক মধ্যরাত্রি পার করে একটা শব এলো। আমি আড়াল হলাম, কারন এত রাতে আমাকে দেখতে পেলে শ্মশান যাত্রীদের অহেতুক কৌতুহল বেড়ে যাবে। ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করে ছিলাম কিন্তু বিধি বাম, এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এই ঠাণ্ডায় আমাকে ভিজিয়ে দিল।
ঘন্টা দুয়েক পর শবদাহ সমাধান করে শ্মশান যাত্রীরা চলে যেতেই আমি আর সময়ের অপব্যবহার না করে চিতার কাছে এসে প্রথমে মন্ত্রবলে নিজেকে বেঁধে ফেললাম। কারন ছোটখাট ভুলেও আত্মারা আমার যেন কোনো রকম ক্ষতি করতে না পারে। গন অন্তেষ্টিক্রিয়ার নিয়মানুগ কাজ গুলো করতে থাকলাম। জল ছিটানো উপর নেভা কাঠের দণ্ড গুলো যখন আবার জ্বলে উঠল, তখন কাজের সাথে আধ ভেজা শরীরে একটা শারীরিক তৃপ্তিও অনুভব করছিলাম। হঠাৎ নিঃস্তব্ধতার মধ্যে বাতাস বইতে শুরু করল। সেই বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজের মধ্যে কিছু শব্দ বন্ধ শুনতে পেলাম–” দেঁ,দেঁ আঁমায় দেঁ; দুঁর- হঁ,দুঁর- হঁ।” ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলাম তারা এসে গেছে, এবং ত্রান গ্রহন করার মতো নিজেদের মধ্যে কোলাহল করে দলে দলে আমার পিছু নিয়েছে। আমি সেই শব্দ কানে নেব না বলে ততধিক উচ্চ স্বরে মন্ত্র উচ্চারন করতে করতে চিতার পাশেই যতটা সম্ভব আদুল হয়ে, ঝোলা কাপড় রেখে পিণ্ড নিয়ে মোহনার দিকে এগুতে থাকলাম। জ্বর গায়ে চরম অস্বস্তির মধ্যে অনুভব করছি আমার পিছনে তারা আসছে। শরীরের অস্বস্তি বাড়তে বাড়তে আমি প্রচণ্ডভাবে দুর্বল হয়ে পড়লাম। তবুও টলতে টলতে মোহোনার কাছাকাছি গেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান যখন ফিরল, অস্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটা ছোট্ট ঘরে চৌকিতে শুয়ে আছি, কয়েকজন নারী পুরুষ উৎসুক নয়নে আমারদিকে চেয়ে আছে। তারা জানেনা, আমি কে? কেনই বা তিস্তা নদীর পারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম। আমি তখনও জানতে পারিনি এরাই বা কারা, পরম আত্মীয়ের মতো আমাকে সেবা শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলেছে।
২৩/১২/১৯৮৬
ধৌত কর্মে জীবনপাত করা দরিদ্র পরিবারটির প্রত্যেকের কাছে আমি ঋণী। অন্তহীন কৃতজ্ঞ গৃহ কর্তা মদন ছেত্রি’র মেয়ে লক্ষ্মী ছেত্রির কাছে। তার নিজের বছর খানিকের শিশু কন্যাকে সামলিয়ে এই বৃদ্ধকে দিন রাত সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলা, মনে হয় পূর্ব জন্মের কোন যোগসূত্র আছে। এবং সেই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে নুতন করে মায়ায় আবদ্ধ হয়ে উঠছি।
২৬/১২/১৯৮৬
আমি যে এই গোর্খা বসতিতে আছি সেটা অনেক দুর পর্যন্ত মানুষ জেনে যায়। ফলে নিয়ম করে তারা সব আসে বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দু ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। আমি দুই ধর্মের মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা করি— সব ধর্মের উদ্দেশ্য এক, মানুষকে এক সূত্রে গেঁথে মঙ্গল সাধন করা, শুধুমাত্র পথগুলো ভিন্ন।
এদিকে আমার উপস্তিতির খবর কালী মন্দিরের ঠাকুর মশায় এবং ভক্তরা যেনে গিয়ে সকলে দল বেঁধে একদিন ছুটে এলেন। তাঁদের বক্তব্য, আমি সাধু মানুষ মায়ের মন্দির থাকতে সংসারের গর্ভে কেন আবদ্ধ থাকব। ওদের কথা শুনে আমার অন্তর আত্মা সজাগ হল। সত্যিই তো! আমি আমার মোক্ষ লাভ থেকে লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমার অভিষ্ট লাভে ব্যর্থতার কারন অনুসন্ধান করতে হবে,সুতরাং ফিরতে হবে চীন তিব্বত সীমান্তের (নাথুলাপাস) ‘চকজুম’ গ্রামের দোঙ-জঙ-পা লামার গুম্ফায়।
ধোপা পরিবারের গৃহ কর্তা মদন ছেত্রির কাছ থেকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ব ঠিক করলাম। আমার গৃহ ত্যাগের খবর পেয়ে লক্ষী ছেত্রির করুন ক্রন্দন আমার মতো পাষণ্ডেরও চোখে জল এনে দিল। কিন্তু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ‘চকজুম’ গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
০২/০১/১৯৮৭
আজ তিব্বত সিমান্তের চকজুম গ্রামের দোঙ-জঙ-পা লামার গুম্ফায় এসে উঠলাম। ললিত বজ্র লামা সহ অন্যান্য আশ্রমিকরা আমাকে পুনরায় সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। আমি ওঁদের অভ্যর্থনায় লজ্জিত হয়ে নিজ কর্মে যে অসফল সেটা জানালাম। ললিত বজ্র লামা আমাকে থামিয়ে বললেন-” হতাশ হওয়ার কোনো কারন নেই। সফলতা নির্ভর করে কর্মের পরিবেশ পরিস্থতির উপর। উদ্যোগটাই আসল, সেখানে আপনি সফল। আপনার বর্তমান শারীরিক এবং মানষিক অবস্থা সম্পর্কে দোঙ-জঙ-পা লামা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। রংপো-তে যা কিছু ঘটেছে সবই তিনি আমাকে বলেছেন। এখন হাত, মুখ ধুয়ে কিছু আহার করে একটু বিশ্রাম নিন, আমি সময় মতো আপনাকে দোঙ-জঙ-পা লামার কাছে নিয়ে যাব।”
২৭/১২/১৯৮৬
প্রত্যুষে ঘন্টার ধ্বনিতে ঘুম ভাঙলে প্রার্থনার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি, কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, আমি যেন এখানেও একা নই। অথচ স্বশরীরে কেউ-ই আমার পাশে নেই। এটা আমি প্রথম উপলব্ধি করি গোর্খা বস্তিতে থাকার সময়। আত্মা নিয়েই আমার চিন্তা ভাবনা কাজ কর্ম, হয়ত তারই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। তবে এটা ঠিক, আমি অনুভব করছি, অসংখ্য আত্মার কাছে আমি নজর বন্দী।
২৮/১২/১৯৮৬
বরফাচ্ছাদিত সুদূরপ্রসারী বৃক্ষহীন প্রান্তরে আজ এখনো সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘড়ি না দেখলে মনে হবে প্রত্যুষেই দিনটা স্থির হয়ে আছে। তীব্র ঠাণ্ডায় একমাত্র শীত নিবারক ভেষজ বটিকাই সম্বল। পিপাসু চক্ষু মেলে প্রকৃতির মায়ারূপ দেখছি আর ভাবছি, মুনি ঋষিরা এই জন্যই হিমালয়কে শিবের আলয় বলেছেন। এবং এখানেই এসে সাধনা করেছেন।
মনাস্টেরির কাজ কর্ম সময় মেনেই চলে। ফলে ললিত বজ্র লামা আমাকে নিয়ে দোঙ-জঙ-পা লামার কক্ষে গেলেন। আমি প্রণাম জানিয়ে তাঁর পদতলে বোসলাম। মুদিত চক্ষু সামান্য উন্মীলিত করে তিব্বতি ভাষায় বললেন-“মঙ্গল হউক।” ললিত বজ্র লামার সহযোগিতায়, এক বছর আগে মনেস্টারি ছাড়ার পর থেকে যা কিছু ঘটেছিল সবই সংক্ষেপে বর্ননা করলাম। তিনি জানালেন, আমি যে সমস্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি সেটা আত্মা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার জন্যে এবং আমি ভীতসন্ত্রস্ত হই-নি বলেই সমস্ত মায়া জালের অবতারণা, এবং আমি সেই সব মায়া জাল স্বচক্ষে উপলব্ধি করতে পেরেছি। শেষে বললেন,আমি আমার অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে পারিনি কারণ শরীর এবং মনকে আমি একাত্ম করতে পারিনি। শরীর হবে মনের বশ। ধ্যানের মাধ্যমে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল। তবে আমার প্রয়াস কে তিনি সাধুবাদ জানালেন।
০৫/০১/১৯৮৭
আজ মনাস্টেরিতে একটা সাজ সাজ ভাব, একজন শ্রমন আমাকে ভেষজ বটিকা দিতে এলে তার কাছে কারন জানতে চাইলে জানলাম, আজকের দিনে এই পূর্ণিমা তিথিতে দাচোকারো গুম্ফার মহাপ্রাণ লামা জন্মগ্রহন করেছিলেন। সবাই আজ সেখানে যাবেন তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।
সকলের মধ্যে আমিও একজন। মহাপ্রাণ দাচোকারোর সম্মুখে সকলেই পদ্মাসনে বসে ধ্যানস্থ হলাম। ললিত বজ্র লামার পাশেই আমি বসেছিলাম। তিনি আমাকে বলে দিলেন আমি যেন ভগবান বুদ্ধের মুখ কল্পনা করে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। সেই ভাবেই ধ্যানমগ্ন ছিলাম। কিন্তু কোন এক অচেনা শব্দে আমার ধ্যান ভঙ্গ হল। সামান্য চোখ খুলে দেখি ছোট্ট মেঝেতে যে কয় জন বসে আছে সকলেই ধ্যানমগ্ন। আমারি ধ্যান ভঙ্গ হল! তাহলে অজানা শব্দটা কি শুধু আমিই শুনেছি। ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ চলে গেল মহাপ্রাণ লামার মুখমণ্ডলের উপর। প্যরাফিন বাতির আলোতে তাঁর মুখ খানি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। আমি চমকে উঠলাম, দেখি দাচোকারোর শুকনো দ্রাক্ষাফলের ন্যায় চক্ষু যুগল সাভাবিক মানুষের মতো জীবন্ত, যেন আমাকে কিছু ইশারা করছেন। যদি ওনার কিছু বোঝানোর ইচ্ছা থাকে তবে নিজের গোষ্ঠীর বাইরে এসে আমাকে ইশারা করবেন কেন? কিছুক্ষণ দাচোকারোর চোখের দিকে আমার চোখ নিবিষ্ট করে রাখার পর হঠাৎ মনে হল, কে যেন আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। ঘাড় ঘোরাতেই কুঠুরির আলোআঁধারিতে হাড়হীম করা এক দৃশ্য দখলাম। সাত আট ফুট লম্বা কাল লোমশ ছায়া মূর্তি আমাদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অক্ষি পল্লব পড়তে না পড়তে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। সকলে তখন ধ্যানমগ্ন। ভাবতে থাকলাম ঈশ্বরসম দাচোকারো কি আমাকে কোনো ঈঙ্গিত দিচ্ছেন!! ব্যাপারটা ভাবনার বাইরে রাখতে পারলাম না। তবে অধিক কৌতুহল বশত এতক্ষণে পাঁচকান করা শ্রেয় নয় মনে হল।
১২/০১/১৯৮৭
শরীরকে মনের বশে আনতে যে অনুশীলনের প্রয়োজন তা আজ ললিত বজ্র লামাকে সামনে রেখে আত্মস্থ করবার প্রচেষ্টায় আছি।
এমতাবস্তায় আত্মা সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমি গত সপ্তাহে দাচোকারো গুম্ফায় চাক্ষুষ করা ঘটনাটা ললিত বজ্র লামার কাছে উত্থাপন করলাম। তিনিও আমার কথা শুনে রীতিমতো অবাক হলেন। খানিকটা ধোঁয়াশায় থেকে বিস্ময়ের সাথে বললেন, “ইয়েতি নয় তো!!!” এবার আমি অবাক হলাম, “বলেন কি?” ললিত বজ্র লামা আমাকে আস্বস্ত করে বললেন, “ব্যাপারটা একদম উড়িয়ে দেওয়ার নয়। মাঝে মাঝে আমাদের মনাস্টেরির আসেপাশে তাকে নাকি দেখা যায়।” প্রশ্ন করলাম, “আপনি দেখেছেন?” উনি বললেন, “না।” ইয়েতি সম্পর্কে আমি একেবারে অজ্ঞ যে নই, সেটা না জানিয়ে তাঁর কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, “ইয়েতি, অর্থাৎ তুষার মানব, যার না আছে কোনো সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, না আছে কোনো তথ্য প্রমান। শুধুমাত্র মনগড়া কাহিনি। নেপালী এবং তিব্বতিয়ান দের মধ্যে এই বিশ্বাস কাজ করে যে ইয়েতি আছে। ফলে অস্তিত্বের যুক্তি না থাকলেও তাদের কিছুই যায় আসে না।
৩২৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট বেরিয়েছিলেন সিন্ধু উপত্যকা জয় করতে। সেখানে এসে স্থানিয়দের মুখে ইয়েতির গল্প শুনে তাঁর ভীষণ ইয়েতি দেখার ইচ্ছা হল। এবং স্থানীয় মানুষের সহায়তা নিয়ে অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও তিনি দেখতে পাননি। তখন হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ” যা দেখা যায়না তাকে এত বিশ্বাস! “
এর প্রায় ২৩০০ বছর পর,১৯৫১ সালে, ব্রিটিশ পর্যটক এরিক শিপটন মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত একটি বিকল্প পথের সন্ধানে রওনা দেন। মাউন্ট এভারেস্টের পশ্চিমে অবস্থিত মেনলুং হিমবাহের কাছে এসে তিনি বরফের উপর একটি অস্বাভাবিক পায়ের ছাপ দেখতে পান, যেটা তেরো ইঞ্চির উপর লম্বা ছিল। সেই ভিত্তিতে তিনি দাবি করেন, ওটাই ইয়েতির পায়ের ছাপ। ওই পর্যন্তই, ইয়েতি নিয়ে অনেক মনগড়া গল্প গাথা হয়ে আছে নেপালী, তিব্বতিদের মধ্যে। “
ইয়েতি যে নয় তাতে আমি একশ শতাংশ নিশ্চিত। তাহলে দাচোকারো গুম্ফার ছায়া মূর্তিটি কি হতে পারে? আবার দাচোকারো মহাপ্রাণ জ্বাজ্জল্য দৃষ্টিতে আমাকে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? কেন আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ছায়া মূর্তিটাকে দেখলাম। আমি স্বস্তি পাচ্ছিনা, আমাকে জানতেই হবে কি এই রহস্য!!”
১৭/০১/১৯৮৭
রাত আটটা হবে,খাওয়া হয়ে গেছে শুতে যাব হঠাৎ দেখি মনাস্টেরির মধ্যে একটা নিঃশব্দ হুটোপুটি শুরু হল। একজন শ্রমন বাইরের দিকে দ্রুত পায়ে যাচ্ছে দেখে তার কাছে কি ব্যাপার জানতে চাইলাম। মৃদুস্বরে সে বলল,” ইয়েতি।” কাল বিলম্ব না করে আমিও ছুটলাম দেখতে, কারন আমাকে জানতে হবে, আমার সপ্তাহ খানিক আগে দাচোকারো গুম্ফায় দেখা ছায়া মূর্তি আর আজকে যা দেখব তার মধ্যে মিল আছে কিনা। তাহলে আমি একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারব।
কিন্তু কোথায় ইয়েতি? জানালা অল্প খুলে দেখা গেল, যতদূর চোখ যায় শুধু তুষার শৃঙ্গ, তার উপর চাঁদের আলো পড়ায় এলাকাটা অস্পষ্ট দৃশ্যমান। দুই একটি ছোটো গাছ বরফে ঢেকে ছায়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। যে শ্রমন প্রথম দেখে অন্যদেরকে ডেকেছিল, সে দাবি করছে, কালো লম্বা ভল্লুকের মতো একটা প্রাণী মনাস্টেরির আনুমানিক তিরিশ পঁয়ত্রিশ ফুটের মধ্যে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন আর দেখা যাচ্ছে না। ললিত বজ্র লামা এগিয়ে এসে বললেন,” হয়তো তুষার আবৃত পাইন গাছ দেখে ভুল ধারনা হয়েছে।”
কেউ কিছু না দেখতে পেলেও আমি যেন কিছু দিন আগে দেখা ছায়া মূর্তির সাথে মিল পেলাম। ফিরে এলাম নিজ কক্ষে। রাতের খাওয়া হয়ে যাওয়ার জন্যে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছে না, ভাবছি, শ্রমন কি এতোটাই ভুল দেখেছে!! নিশ্চই সে কিছু দেখেছে। যেমন সকল চক্ষুর আড়ালে আমিই চাক্ষুষ করেছিলাম সেই ছায়া মূর্তিকে। প্রশ্ন হল ইয়েতির তো অস্তিত্বই নেই, যদি থাকত, লোককথায় আছে তারা হিমালয়ের উচ্চ শৃঙ্গে বিচরণ করে, এবং সাধারনত প্রকৃতির নিয়মে তাদের লোমশ শরীর কালো না হয়ে সাদা হওয়ার কথা, এখানে আমরা দুজনই দেখেছি কালো লোম যুক্ত। প্রশ্ন জাগছে, আমরা তালে কি দেখলাম! আমার আত্মা সন্ধানী মনে একটা খটকা লেগে গেল। তখনি মনস্থির করলাম, সকলের অলক্ষ্যে রাতের অন্ধকারে আমি দাচোকারোর গুম্ফায় যাব।
০২/০২/১৯৮৭
আজ পূর্ণিমা তিথি, ভগবান বুদ্ধের সম্মুখে যেমন সান্ধ্য প্রদীপ প্রোজ্জ্বলন হল, ঠিক একই ভাবে শ্রমনরাও দাচোকারোর গুম্ফায় গিয়ে সান্ধ্য প্রদীপ জ্বালিয়ে এসেছে। দৃশ্যটা খুব সুন্দর, গেরুয়া বসন পরিহিত আট দশ জন শ্রমন গৌর বর্ণ, মুণ্ডিত মস্তকে সার বেঁধে বরফাচ্ছাদিত (তাহশিং নির্দেশিত) সরু পথ ধরে, ত্রিপিটক থেকে ধর্মীয় বাণী সুর করে বলতে বলতে দাচোকারোর গুম্ফায় যায়। সেখানে গিয়ে প্যারাফিনবাতি জ্বালিয়ে মহাপ্রাণকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একই ভাবে ফিরে আসে। অজও অন্ধকার নামতেই শ্রমনরাও মনাস্টেরিতে ফিরে এল। আমিও সময় নষ্ট না করে দাচোকারোর গুম্ফার উদ্দেশ্যে কাউকে কিছু না বলে রওনা হলাম।
সুচালো শলা বিশিষ্ট লৌহ দণ্ডটা নিয়ে, সান্ধ্য হিমালয়ের বুকচেরা সরু পথ ধরে এগুতে থাকলাম। বরফে ঢাকা পিচ্ছিল পথ, ভরসা একমাত্র এক শুল যুক্ত লৌহ দণ্ড। সন্ধ্যার অন্ধকার পুরপুরি ঘনিয়ে এসেছে, পাহাড়ি রাস্তা, চেনা অচেনার পার্থক্য নেই। মাথা হেঁট করে অতি সতর্কতায় এগুচ্ছি। গুম্ফায় পৌঁছুতে আর ফুট চল্লিশেক পথ বাকি, ঘাড় ঘুরিয়ে গুম্ফার দিকে তাকাতেই আমি চমকে উঠি, সেই ছায়া মূর্তি! কাল লোমশ ছয় সাত ফুটের মূর্তিটা আমার দিকে তাকিয়ে দুপায়ে দাড়িয়ে আছে। অন্ধকারে লাল ভাঁটির মতো চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। আমি আতঙ্কে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম, না পারছি এগুতে না পিছতে। মিনিট খানিক এই ভাবে দাড়িয়ে ভাবছি, আমি যা ভাবছি সেটা হলে অসুবিধা নেই, আমি তো সেই জন্যেই এসেছি। কিন্তু যদি ওটা কোনো পাহাড়ি হিংস্র জানোয়ার হয় তো আমাকেই আক্রমন করতে পারে! মৃত্যুটা বড় কথা নয়,আমার কাঙ্খিত পরিকল্পনা সব ভেস্তে যাবে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ভাবছি, হঠাৎ দেখি জন্তুটা আমাকে কিছু একটা ইঙ্গিত করে পিছু হটতে শুরু করল। আমার সন্দেহ আমার অনুকূলে যাওয়ায় আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিছু নিলাম। ফুট তিরিশের দূরত্ব রেখে আমি জন্তুটিকে অনুসরন করতে থাকলাম। জন্তুটা আমার দিকে ফিরে অনায়াসে পিছনে হেঁটে এগিয়ে চলেছে। বুঝলাম, আমাকে নিশ্চয়ই জন্তুটি কিছু ইঙ্গিত করছে। আমি যাতে না হারিয়ে ফেলি সেই জন্য অমন ভাবে হাঁটছে। তথা কথিত ইয়েতি যে নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, হাঁটছি আর ভাবছি এই মায়া বিস্তারের কারন অনুসন্ধান করতেই হবে। কতটা পথ আসলাম তার হিসাব কষিনি, তবে একটা দুর্গম গিরির পাদদেশে এসে জন্তুটা আমার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি উক্ত স্থানে পৌঁছে স্থানটিকে নিরীক্ষণ করলাম। ন্যাড়া গিরিশৃঙ্গ মোটা বরফের চাদরে মোড়া, গাছপালা নেই, এগুতে গেলে এবার পথ তৈরী করতে হবে। আমার মনে হল, নিশ্চই এখানেই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, এবং সেটা আমাকে জানাতেই এই মায়া বিস্তার। একটা জেদ চেপে গেল মনে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় যোগ সাধনার দ্বারা আমি ধ্যানস্থ হলাম, এটা জানবার জন্য যে এই স্থানে অতিতে কখনো কিছু ঘটেছিলো কিনা।
ধ্যান রত অবস্থায় দেখলাম তুষার ঝড় চলছে, সেই সাথে গিরিশৃঙ্গ থেকে ধসে ধসে পড়ছে বরফ খণ্ড। তারই মধ্যে বেশকিছু মানুষও চাপা পড়ছে।
আমার ধ্যান ভাঙল, সাধুবাবা সাধুবাবা চিৎকারে। ললিত বজ্র লামা কয়েকজন শ্রমনকে নিয়ে আমাকে খুজতে বেরিয়েছেন। ওঁরা আমাকে দেখতে পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি রাতের অন্ধকারে এমন দুর্গম স্থানে এলাম কিভবে? আমি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এখানে কি কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল? ললিত বজ্র লামা জানালেন, বছর কুড়ি আগে কিছু পর্যটক হিমালয়ের উচ্চ শৃঙ্গে উঠছিল, কিন্তু পৌঁছানোর আগেই তুষার ধসে সকলের বরফ সমাধি হয়। আপতকালিন উদ্ধারকারি দল বেশিরভাগ মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল, একটি বা দুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। চিরকালের জন্যে তুষারসমাধি হয়ে গেছে।
এখন ছায়া মুর্তি কেন আমাকে দেখা দিয়েছিল সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি ললিত বজ্র লামাকে জানিয়ে দিলাম যে এই স্থানে একটা মৃতদেহ তুষার সমাধি হয়ে আছে, আপনারা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে জানান, তারা মৃতদেহ বার করে প্রশাসনিক নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের হাতে তুলে দিক।
২৭/০৬/১৯৮৭
কিছু তিব্বতি শেরপা পরিবারের লোকজন এসে আমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গেল, কারন তাদের ধারনা আমার জন্যই তারা তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে। যাইহোক আমার এখানকার কাজ প্রায় গুটিয়ে এনেছি, বাকি থাকলো গন অন্তেষ্টিক্রিয়া, ওখানে উত্তীর্ণ হলে সোজা কোলকাতা গুরুদেবের কাছে। তারপর যাব নিজ গৃহে, মনের ইচ্ছাটা লিখতে বসে, চিত্ত যেন এক অজানা প্রফুল্লতায় পূর্ণ হ’য়ে গেল।
২৪/০৮/১৯৮৭
আজ ‘চকজুম’ গ্রাম থেকে রংপোর মদন ছেত্রির বাড়িতে এসে উঠলাম। মদন ছেত্রির অকাল মৃত্যুর কথা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আবার অভিভূত হলাম, যখন গ্রামের আপামর জনতা আমাকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। এমন একটা পরিস্থিতিতে মহা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেছি, বুঝতে পারছি না, এই সব ভাল মানুষ গুলোকে কি করে বলব, আমি অল্প কয়েক দিন এখানে থেকে কৌষিকী অমাবস্যায় আমার নির্ধারিত কার্য সম্পাদন করে কোলকাতা ফিরে যাব।
৩০/০৮/১৯৮৭
লক্ষ্মী ছেত্রিকে আজ আমার কাছে ডেকে বুঝিয়ে বললাম, আমি তাদের কিছু না জানিয়েই ফিরে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা নিমক হারামের সামিল হবে। তারা যেন আমাকে বাধা না দেয়। এটাও বললাম, একজন আমার প্রত্যাবর্তনের আশায় হয়ত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে। আমি একবার সেখান থেকে ঘুরে এসে এই গ্রামের কালী মন্দিরে আমৃত্যু মায়ের চরণে ঠাঁই নেব।
০৩/০৯/১৯৮৭
আজ কৌষিকী অমাবস্যা, প্রত্যুষে তারাই আমার নিদ্রা ভঙ্গ করল, যাদের আজ আমাকে খুব প্রয়োজন। অবচেতনে বন্ধ চোখে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম- হাজার হাজার ছোট ছোট কালো গোলাকার বস্তু আমাকে বৃত্তাকারে ঘিরে “ওঁঠ, ওঁঠ” শব্দে বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল।
যাইহোক, সারাদিন নির্জলা উপবাসে থেকে আমি গন অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ কর্ম গুলো সেরে নিলাম। লক্ষ্মী ছেত্রির স্বামী ও পরিবার আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করছে। আজ নিশীথে মা ভৈরবীর নাম নিয়ে গন অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্যে শ্মশান সংলগ্ন মোহনায় যাব। হয় হাজার হাজার অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা করব, নয়ত নিজেই অতৃপ্ত আত্মা হয়ে মুক্তির জন্যে ইহলোকে ঘুরে বেড়াব।
(অন্তিম পর্ব আগামী মাসে…)
লেখক শ্রী সলিল চক্রবর্তীর “তিস্তা পরের রহস্য ” গল্পটা পড়ে আমি অভিভূত হলাম। অল্প হলেও কিছু রহস্য গল্প আমি পড়েছি কিন্তু এই গল্প সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে লেখা। যেখানে আত্মা, (কিছু অশরীরী ), সাধন প্রসঙ্গ, অশরীরী আত্মার মুক্তি ইত্যাদি যে প্রসঙ্গ লেখক তুলে ধরেছেন সেটা প্রশংসনীয়। বিভিন্ন ধর্মের সার একই, শুধু পথটা আলাদা এই ধর্মীয় বিষয়গুলোর ভিতর দিয়ে তিনি সাম্যবাদ ও তুলে ধরেছেন, যেটা সমাজে খুবই জরুরি।একটা গল্পের মধ্যে দিয়ে তিনি বিভিন্ন বিষয়, যেখানে মানবিক মূল্যবোধের কথাও কিন্তু বুঝিয়েছেন। সব মিলিয়ে রহস্য জনক ঘটনার সাথে সাথে সামাজিক ও মানবিক তথা ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ধন্যবাদ, আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই প্ৰিয় লেখক মহাশয়কে।