লোকটিকে বেশ কিছুক্ষনই দেখেছেন অমিতবাবু। পরনে অনেক দিনের পুরনো কুঁচকে থাকা প্যান্ট।এক সময় বোধহয় রংটা নীল ছিল।এখন জ্বলে গিয়ে ফ্যাকাশে।গায়ে একটা সাদা জামা। বহু ব্যবহারে জীর্ণ। মানুষটাও তাই।বয়স হয় তো বেশি নয় কিন্তু একেবারে ভাঙ্গা চোরা চেহারা। দরিদ্রতার ছাপ সর্বাঙ্গে স্পস্ট। সঙ্গে আবার একটি বাচ্চা ছেলে। বছর আট নয় হবে।এরও পরনে রং জ্বলা হাফপ্যান্ট আর গায়ে ঢলঢলে একটা টি-শার্ট।ঢুকলো কি করে এরা এই দোকানে?একটু অবাকই হন অমিত বাবু। ঢুকতে পারার তো কথা নয়। চেহারা পোশাক দেখেই তো গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান ভাগিয়ে দেবে। আজকের দিনে তো শুধু নিমন্ত্রিত অতিথিরাই আসে। আর যদি কেউ কেনা কাটা করার জন্য আজকের দিনটা বেছে নেয় আসে তারাও। একে নিশ্চয়ই এই দোকান থেকে নিমন্ত্রণ করে নি। কিছু কেনার সামর্থ্য আছে বলেও তো মনে হয় না। অথচ কি ভাবে কে জানে সবার অলক্ষ্যে ঢুকে পড়েছে। লোকটা জানেও সম্ভবত সেকথা। তাই অমন সংকুচিত হয়ে একেবারে কোন ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু কেন? হালখাতার মিষ্টির প্যাকেটের লোভে?হয়ত তাই।কিন্তু যে আশায় এসেছে সেটা পূর্ন হবে কি? “ স্যার –” কোল্ড ড্রিংকস সাজানো ট্রে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল দোকানেরই একজন কর্মচারী। আনমনেই একটা গ্লাস তুলে নিতে গিয়ে থমকান। ছেলেটা লোভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে গ্লাস গুলোর দিকে। যে ছেলেটি ড্রিংকস বিতরণ করছে সে কি ওদের সামনে যাবে?চুমুক দিতে পারেন না আর। চেয়ে থাকেন ওদিকেই।যা ভেবেছেন ঠিক তাই। কর্মচারীটি ওদিকে আর গেলই না। সম্ভবত চেহারা দেখেই আন্দাজ করেছে কিছু।গিয়ে বলবে হয়তো মালিকের কাছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন। সামনের সাজানো গোছানো টেবিলের ওপারে যিনি বসে আছেন তিনিই দোকানের মালিক শিবতোষ মল্লিক। আজ থেকে নয় প্রায় বিশ বছর এই দোকানের সাথে সম্পর্ক অমিতবাবুর। শমিতা, তার স্ত্রী এই দোকান ছাড়া গয়না কেনে না। ভারি, হালকা সব রকমের অলংকার এই দোকান থেকেই তার বাড়িতে যায়। বছর দুয়েক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। যাবতীয় গয়না তো এখান থেকেই কিনেছেন। সেই হিসেবে একটু বাড়তি খাতিরই পেয়ে থাকেন প্রত্যেকবার। যদিও নিজে আসেন না বিশেষ। শমিতাই করে এসব। তবু বেশ কয়েকবার আসতেও হয়েছে। আর সেই সুবাদে চেনা শোনাও। হালখাতায় অবশ্য এই প্রথম এলেন। শমিতার শরীরটা কাল থেকে বিগড়েছে। এদিকে দোকানের মালিক শুধু কার্ড পাঠিয়েই নিরস্ত হন নি।ফোনও করেছেন বার দুয়েক। অতএব শমিতার হয়ে তাকেই আসতে হয়েছে। ভেবেছিলেন একবার দেখা দিয়েই চলে যাবেন।কিন্তু পারলেন না।শিবতোষ বাবু ছাড়লেন না। একটু বসে যেতেই হবে।নাহলে নাকি দোকানের অমঙ্গল!অগত্যা। ওই বসা অবস্থায়ই লোকটা আর বাচ্চাটাকে নজর করেছেন। কিন্তু ঠান্ডা পানীয় পরিবেশন করার ছেলেটি গেল কোথায়?এদিকে আর এল না তো!যাক গে!একটু দাঁড়িয়ে ভাবলেন অমিত বাবু। তারপর পায়ে পায়ে গ্লাসটা নিয়ে নিজেই বাচ্চাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এগিয়ে ধরলেন তরল রঙিন পানীয়, “ এই নাও। ” আশা পূরনের আহ্লাদ আর শঙ্কা যুগপৎ খেলে গেল ছেলেটির চোখে মুখে। হাত বাড়াতে গিয়েও কি ভেবে থেমে গিয়ে তাকালো সঙ্গের লোকটির দিকে। কুণ্ঠিত মুখে বাধা দিলেন তিনিই, “ আপনি ব্যস্ত হবেন না। ওরা দেবে। আসবে তো এদিকে। দেবে’খন — হয়ত খেয়াল করে নি আমাদের।” প্রথমটায় একটু থমকে যান অমিত বাবু। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। ওরা যে এদিকে এসেও না দিয়ে চলে গেছে সেটা কি উনি বুঝতে পারেন নি?নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন? কোনটা? ভদ্রলোক কি তার হাত থেকে নিতে সংকোচ বোধ করছেন? কিন্তু উপায়ই বা কি? সত্যিটা তো আর কোনোমতেই বলতে পারবেন না। তাই হেসে বলেন, “আসলে আমি ঠান্ডা খাই না তো তাই ভাবলাম –- কি খোকা? খাবে?” চোখের পলকে হাত বাড়িয়ে দেয় ছেলেটা। আর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চুমুক দেয় গ্লাসে।সেদিকে চেয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলেন অমিত বাবু।তিনি কবি নন। আবেগ প্রকাশ করার মত ভাষার জোরও তার নেই।থাকলে হয়ত ওই মুখে উপচে ওঠা খুশির সাথে হাজার সূর্য কিরণের তুলনা করে বসতেন। তাই শুধু চেয়েই থাকেন। “ ছেলেটা বড্ড বায়না করছিল জানেন?খালি বলে চল না বাবা ওই দোকানে লাল লাল মিষ্টি সরবত দেবে। মিষ্টির প্যাকেট। আমি বললাম দোকান থেকে দুটো মিষ্টি কিনে দিই। তো কিছুতেই শুনবে না। এখানেই আসবে। আচ্ছা বলুন তো এসব জায়গায় আমাদের কি আসতে হয়? কিন্তু এমন বায়না করে – তাও আমি এনেছি। কুড়িটা টাকা এনেছি।এইটে জমা রেখে যদি — আপনার কি মনে হয় টাকাটা জমা দিলে — “ দুটো নিদারুণ অসহায় চোখ মেলে তাকায় লোকটা।উত্তরে কিছু বলে উঠতে পারেন না অমিত বাবু। গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে ওঠে একটা যন্ত্রণা। কে যেন হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় পেছনদিকে। সেই ছোটবেলার দিনগুলোতে। “ দেখো বাবা কি সুন্দর সাজিয়েছে দোকানটা টুনি লাইট দিয়ে! চল না বাবা! ওই যে কেমন লাল নীল সরবত দিচ্ছে সবাইকে। আবার মিষ্টির প্যাকেটও দেয়। আমাদের ক্লাশের অনিল বলছিল ওরা তিন চার জায়গায় যাবে।ওদের নেমন্তন্ন হয়েছে। চল না বাবা।” ছেলেটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন অমিত বাবু। চিনতেও পারছেন দিব্যি। বাবার হাত ধরে ঝুলছে। দু চোখে কাতর বায়না। “ আজকের দিনে নেমন্তন্ন না করলে যেতে নেই খোকা। ” অসহায় চোখে ছেলেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন বাবা। “আমাদের কেন কেউ নেমন্তন্ন করে না বাবা হালখাতার দিনে?” নিরুত্তর বাবার দু চোখে চিকচিকে অশ্রু।আশ্চর্য ! আজও মনে আছে! কি করে? এখন তো অনেক বিলাস বহুল জীবনে অভ্যস্ত তিনি। তবু আজও কেমন করে চোখের তারায় ভেসে উঠল সেই নিরুপায় পিতার দু ফোঁটা অশ্রু! ভুলে ছিলেন তো। কিন্তু আজ কেমন করে সামনে এসে দাঁড়ালো সেই দিনটা? “ স্যার –” কার যেন ডাকে চমক ভেঙে তাকান অমিতবাবু। সামনে নম্রভাবে দাঁড়িয়ে অল্পবয়েসী কর্মচারী ছেলেটি, “ আপনাকে মিস্টার মল্লিক ডাকছেন। ” “ ও। ” যেতে গিয়েও কি ভেবে ছেলেটির হাতের দিকে তাকান অমিত বাবু। দুহাতে বড় বড় মিষ্টির বাক্স। বিলি করতে শুরু করেছে সম্ভবত। কিছু বলতে যাবেন তার আগেই চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটি, “এই তুমি কে? কি করে ঢুকলে এখানে? ইস্! কি সাহস দেখো! নির্ঘাত লুকিয়ে ঢুকেছ? বেরোও বেরোও। ” চকিতে পিছন ফেরেন অমিতবাবু। হ্যাঁ ঠিক তাই। ওই ভদ্রলোককেই উদ্দেশ্য করে চেঁচাচ্ছে ছেলেটি। লোকটি হাত তুলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই আবার ধমকায় ছেলেটি, “ এখনও দাঁড়িয়ে আছো? ডাকবো দারোয়ানকে? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করলে ভালো হবে। তাই না?” “ দাঁড়াও ”,আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না অমিতবাবু। বাধা দিয়ে উঠিলেন।তার স্বভাবমাফিক মৃদু স্বরে নয় বরং একটু মাত্রাতিরিক্ত জোরেই। “ কাকে কি বলছ ? উনি আমার সঙ্গে এসেছেন। আমার বন্ধু। যাও তোমাদের মালিককে গিয়ে বল। যদি ওনাকে চলে যেতে হয় তাহলে আমাকেও যেতে হবে। ” “ আরে না না। আজকের দিনে সবাই অতিথি। ” কখন চেঁচামেচিতে আকৃষ্ট হয়ে শিবতোষ মল্লিক নিজে উঠে এসেছেন খেয়ালই করেন নি অমিত বাবু। “ দাও দাও। ওনার হাতে মিষ্টির প্যাকেট দাও। হাঁ করে দেখছ কি ? বাচ্চাটার হাতেও দাও আর একটা। আসুন অমিত বাবু। আমরা ওদিকটায় গিয়ে বসি।” সাদরে আমন্ত্রণ জানান শিবতোষ মল্লিক। “ ধন্যবাদ। চলুন।” যেতে গিয়েও পিছন ফিরে তাকান অমিতবাবু। ভদ্রলোকের দু চোখ চিক চিক করছে দু ফোঁটা অশ্রু। চিনতে ভুল হল না। এ সেই অশ্রু। বহুবছর আগে আর এক অসহায় বাবার চোখে জমে উঠেছিল যা। সে ছিল বেদনার। আর আজকেরটা আনন্দের, কৃতজ্ঞতার। তফাৎ শুধু এটুকুই।