নিশি ডাক
শ্রী নীলকান্ত মণি
বাঁশী, বাঁশীর সুর আর বাঁশুরিয়া এরা তিনজন পথ হাঁটছে ! বাঁশুরিয়া ফুঁ দিয়ে দিয়ে বাঁশীতে যে সুর তুলছে, বাতাসে সে সুর দুলছে ! সে সুরের দোল প্রকৃতির চোখে মুখে, থেকে থেকে তার দ্যুতি, ঝিকমিক করে উঠছে, অশ্রুত ধ্বনি কোথায় না জানি বাজে, কেন বা কে জানে মন-অঙ্গনে হাসির ফোয়ারা ছুটছে! বনবীথি বাতাসের দোল গায়ে মেখে বনজ্যোৎস্নার গায়ে অকাতরে ঢলে পড়ছে!
সুপ্ত রাতের সুর ভরপুর মোহনবাঁশি অনুভব করে বুকে! কেমন সে সুখ, ঢেউ যার এখনও উঠছে এবং পড়ছে, বোঝাবে কেমন করে, তারই পথ খুঁজে এখনও সে তাই পথে পথে ঘুরে ফিরছে! তার কোন ভয় আর নেই চললেও চোখ বুজে! দূর থেকে বাঁশী ডাকছে, খইফোটা মন তারই পানে তাই ধাইছে! যার খোঁজে পথে পথে ঘুরছে সে এতোদিন যেন আজকে পেয়েছে তাকে, মন বলছে! যেন অভীষ্ট সেই লক্ষ্যেই আজ প্রায় সে পৌঁছে গেছে, বাকী আছে শুধু ছুঁতে!
এখন অনেক রাত ! আস্তে আস্তে বিছানার ’পরে সে উঠে বসে ! দাঁড়াল সে খোলা ছাদে! অতি সন্তর্পনে পা টিপে টিপে এসে ! রাতের আকাশ একা, বাগিচা-পাঁচিল একলা যেথায় আজো বসে আছে জেগে, মন চুপি চুপি সেখানে এগিয়ে আসে! আধপাকা ধানক্ষেত জেগে আছে বুক পেতে ! গ্রাম ! তার উত্তরে ঘন বন ! চাঁদের হাসির আবছায়া বন্যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডুবছে ! তারই ভিতর দিয়ে অল্প অল্প দেখা যায় নদী-জল! ঝিকমিক জল কতো আঁকিবুকি কাটছে ! বন-রেখা পরপারে ! কোন এক ভাবী কাল, সৃষ্টির রূপরেখা অস্ফুট, বিরাট রাত্রী-গর্ভের মাঝে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে, নিষুতি-নিশীথ-নিষেক তখন নিষেবিত মন নিষ্কন্টক নিষ্কম্প নিষ্কর নিষ্কল ফুল তুলছে !
নিশি ডাকছে ! সে মোহনবাঁশি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছে!
সে সামনে তাকায় ! অনুভব করে ! সামনেই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে তারই মতো মেয়ে রূপবতী বেশ তারই নিজের দেশে ! সে ছিল তখন আপন আঙিনা কোনে আনমনা ! আজকে হঠাৎ অজানার দিকে ডাক পড়েছে যে কেন তা সে জানে না! পেলো না সময় কোন কিছু ভাববার ! সামনে অন্ধকার ! সবুর সয়নি তার সে আঁধার পথে একটিও দীপশিখা ক্ষণতরে জ্বালাবার !
নাঃ, এ তো মাতা নয়! সন্তানে স্তন দিতে হবে যার! বড়ো কি অন্ধকার! প্রদীপ জ্বালাতে হবে! ঘরে ধুলো যতো সব ঝাঁট দিতে হবে! না, না, এসব কিছুই নয়! তবে! ও আজ অভিসারিকা! এ অভিসারে যতো দূর যেতে চাওয়া সেইখানে যেখানে সে ঘর ছেড়েছে, কাজ ভুলেছে, পারে নাকো যেতে দূর অতিদূর তার পারে! কেবল আবেগ অন্তহীন অঙ্গহীন সে সঙ্গী এ যাত্রায় আছে জেগে! সেই অবেগে সে চলেছে মাত্র, পথে কি কোথায় রয়েছে, তার প্রতি কোন খেয়ালই নেই! ভাসছে না এসব কোন কথাই এখন তার মনে! মনের আকাশ আজ যেন নির্ভার!
রাত্রী! সেও চলেছে ওর সাথে! অভিসারকের বেশে! আঁধার রাত্রী রূপে! ঘর হারিয়েছে তার! পথও হারিয়েছে! উপায় এবং লক্ষ্য দুইই এখন ঝাপসা হয়ে গেছে! আবেগ আর চলা এরাই কেবল আছে!
ওরে নিশাচরী, রাত যখন রাঙা হয়ে পোহাবে তখন ফেরবার পথের কোন চিহ্ন কি রবে! দেখতে পাবিনে পথ, ফিরবি কেমন করে!
অন্ধকারের বাঁশী! মোহনবাঁশির সর্বনাশ যদি সে করে, যদি সে বাকি কিছুই না রাখে, তবে আর ভাবনা কিসের! সব যাবে! কণামাত্রও থাকবে না, থাকবে না কোন চিহ্নও! ভাবী কাল কালোর মধ্যে সব কালো একেবারেই যায় যদি মিশে তবে তারপরে কোথায় রইবে ভালো আর কোথায় রইবে মন্দ! কোথায়ই বা হাসি, কোথাই বা আর কান্না! মোহনবাঁশির মন-বাঁশরী ছুটছে তখন হাওয়ার আগে আগে সুরে সুরে অন্ধকারে বাঁশী যেথায় বাজে!
ওরে মন পবনের নাও তুমি যেদিক পানে বাও সুখদুঃখের হাওয়ায় হাওয়ায় সওয়ারী ওগো এ জীবন-তরী কোথ্থাও কেন থই নাহি তুমি পাও! ধ্যান দৃষ্টির রথে রহস্যেতে ভরা এই যাত্রা পথে তুমি যেই দিলে পাল তুলে অমানবীয় সুন্দর এক ভাণ্ডার গেল খুলে! যদি এই বুকে মাথাটি তোমার রাখো, যদি চোখ বুজেও থাকো হয়তো কিছু আভাস তার পেলেও পেতে পরো! তুমি চাইলে বলতে পারে এমন অনেক অনেক কথা আরো! বলার মতো অনেক কথাই ছিল!
মন তো যন্ত্র নয়! যন্ত্রের আবিস্কারক! উন্নাসিকে মূল্য কি তার বোঝে!
ওরে ও মন নাবিক কোথায় ফিরিস কোন আবাগীর টানে! সে কি জানে ভালোবাসা কথাটার কি মানে! এই জীবন-প্রবাহ-অঙ্গনে কান্না-হাসির দোদুল-দোলায় দুলে যাবি তুই কোনখানে!
এখনও গভীর রাত! রাতের গহিন বুকে হাপরের শ্বাস ওঠে! ঠকা ঠাঁই ঠাঁই কতো শত রব ওঠে যেন কোথা হতে! ব্যথার আগুন ঢলে ঢলে পড়ে ঘুমে! কর্ম-সাঁড়াশি চাপে ক্লান্ত পথিক শ্রান্ত চরণ আলগোছে পথ চুমে! হে জীবন-বাঁশী, এসো তবে, যতো কাজ আজ ভোলো, তোলো গো যন্ত্র তোলো! হৃদয় সান্ত্রী আজকে সে ফের যাবে অভিসারে মন্দ্র বাঁশীর রবে!
সে কি হাসে! সে কি কাঁদে! জলে কি ভেসেছে ডাগর কাজল নয়ন কোন! জল-ভরা তার দুই নয়নের আশা কখনো কি দীপ্ত ঝিলিক হানে! হাসির দমক দেয় কি চমক ওষ্ঠের বিস্তারে! বাণী স্রোত আভাসে কি ভাসে শুভ্র মুকুর দন্ত-মুকুল কূলে! দিকনির্দেশ পেয়েছে কি তার! এ কোন জাদু ইঙ্গিত, অজানিত! হয়েছে কি আঁখি লাজে অবনত! সে কি এখন থাকি থাকি শাড়ির আঁচল প্রান্ত জড়ায় কনকাঙ্গুলি মূলে! লুকায় অধর মূল সচল বাতাসে অঞ্চল খানি তুলে! সে কোন অসীম বেদনা বিভাস আননের অবভাসে শত সহস্র নিমেষ জুড়ে যে থাকে তুমি কি দেখেছো তাকে! বলতে কি পারো সে আজকাল কোন অলকায় থাকে!
ওই একই পথে শত সহস্র লোকে হাঁটে! সময়ের নির্ণয়ে মন-আঙিনায় শত শত ফুল ফোটে, শত ফুল যায় ঝরে! তার কোন ফুল বেলা-অবেলায় কোনো সে মালায় হয়তো বা পেলো ঠাঁই! হোক বনফুল সেই সুখ অভিঘাত হয়তো কাঁদায়, হয়তো হাসায়, হয়তো বা চেয়ে থাকে দূর দূরান্ত পানে নির্ণিমেষে, খুঁজে পায় যদি একটুও অবকাশ, চায় আয়নার অবভাসে দেখে নেয় আপনার নিজ মুখ! ফেরার বেলায় কেউ হাসে, কেউ কাঁদে! গাঁঠে কড়ি বাঁধে হয়তো কেউ ভুলে, এই ভেবে, যদি বা চলার পথে তারা কোনভাবে আনমনা তার কোন কিছু কাজে লাগে! পথের হাওয়ায় জীর্ণ বস্ত্র ভার একে একে খসে পড়ে! সময়! রয় সে নির্বিকার! সঞ্চয় শুধু কর্মের ফল, নয়কো সে অধিকারী, পড়ে থাকে নদী তীরে! নদী নীর তিরতির করে বয় সমুদ্র অভিসারে!
ওগো রাখালিয়া বাঁশী, ক্ষয় হয়ে হয়ে তোমার বুকের হাড়ে যে সুর উঠেছে বেজে, সেই কান্নার হাসি, হাসির সে কান্নারা তাদের কুড়িয়ে পাওয়া, বুকে করে তুলে রাখা, যেতে যেতে পথে অবহেলে ফেলে যাওয়া এ কেমন পথ বাওয়া বুঝি না যে! তুমি কি সঙ্গী হারা! মন বিবাগী কি তুমি! জ্যোৎস্না রাতের ঝরানো শিশির তোমার অশ্রু সে কি! ওগো বৈরাগী সুর তুমি, রাগে অনুরাগে কার সে ছোঁয়ায় ধাইছো অকূল পানে! কেউ কি তোমার নেই, আপনার জনে আপনার করে যে বাঁধে! সাধন সে যে মায়ার বাঁধন তা কি তোমার নেই! তোমার পথ-বিবাগী মন পথের টানে কেন বাজায় বাঁশী! কি কথা সে কয় একেলা আনমনে, কেউ কি সে কথা জানে!
মোহনবাঁশি তোমার টানে পথে পথে কেন এ পথ সে পথের সন্ধানে এমন বাহির হয়! শূন্য সে বুক তোমার, ওগো মোহনবাঁশি, সেথা মাতাল পবন তুললো যখন ঢেউ সেই সে ভাঙ্গন কূলে ব্যথা-বকুল ছড়িয়ে কেন রয়! তুমি যাবে যখন চলে, বেভুলে যদি কুড়িয়ে নাও, কিছু সেই ঝরা ফুল, আশায় আশায় কেনই বা সে থাকে! জ্যোৎস্না-স্নাত রাতি সবাই যখন গেল বনে কেন তবে একলা বসে থাকা, পথের পানে চেয়ে এমন করে জাগা, তাও তুমি বোঝো না কি!
জলভরা দুই আঁখি জাগে কেবল একা; থাকে বসি! ব্যথা-দীপের দীপ্ত আভা ফোঠায় মুখে হাসি! আঁশু ভেজায় আঁখিপাতা, নিঃশব্দ বাতাস পদসঞ্চার তার গাঁথে গল্পগাথা! তারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় চুপি চুপি সেথা আসি!
ওগো ব্যথার সাথী তুমি কোন পথে বেড়াও! যে বসে রয় তোমার খোঁজে তারে কেন এমন করে অঝোর ধারায় শুধুই কাঁদিয়ে যাও! তার কানের দুল, তার নাকের ঐ নাকছাবি, মাঝ কপালের টিপ সূর্য সম জ্বলতো যে দিনকালে, তারাই এককালে চলার পথে আলো তুলতো ধরে! দিতো চলার পথের শ্রমে লাঘব করে! কবেই তা খুলেছে, মুছেছেও! শুধু ঐ দৃষ্টি-দীপ জ্বলে আজও তোমারই পথ চেয়ে! চাইছে এখন আশার এ পথ চলা এখানেই শেষ হোক! পথের শেষে তুমি তাকে তোমার করে নিও! অবিশ্যি, যদি তুমি তা চাও তবেই তা সম্ভব! মন হয়তো বা তবে কভু হতে পারে বীতশোক!
পঞ্চমে সুর বাঁধি যে সুর গেলে সাধি সেই সুরের কিনার ধরে একলা সে পথ হাঁটছে ধীরে ধীরে! পাছে হারায় তোমার খেই পথ ঘুমের মধ্যে জাগে! আশেপাশে কেউ কোথ্থাও নেই! অবাক হৃদয় নয়ন মেলে দেখে পাশে এসে হাসছে তোমার মোহনবাঁশি, বুকে সুরের ঢেউ! ভাবনা গেলো ঘুচে! পথ ও পথের-মন মন বাঁধলো তোমারই ঐ মন-বিবাগী সুরে! তোমার গায়ের মিষ্টি গন্ধ বাতাসে আজ ভাসে! তারই ছায়ায় রাতের আকাশ তারার হাসি হাসে! যতোই চাও, এখন কি আর তুমি পারবে যেতে দূরে!
দল-ঝরানো ঝরা গোলাপ মাটির বুকের ’পরে! মলয় পবন মৃদুল চরণ চুপি চুপি এসে হাত বুলিয়ে গায়ে চলে গেল একটু মুচকি হেসে! ঝরা গোলাপ কেই বা নেবে বলো! সময় ধরে ধরে ঋতুর ডালা ভরে কান্না-হাসির সুরে সুরে পথ চলেছে পথে! পথিক বঁধু তুমি! তোমার সুরের ঝাঁপি বুকের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে ওষ্ঠে দিলো চুমু! ঘুম চমকে উঠে মেলে সজাগ আঁখি! কে এলে ভাই তুমি! এমন করে জাগিয়ে দিলে, ভেঙ্গে দিলে সুখের স্বপ্নলোক, আনলে শেষে মাটির ’পরে টানি!
মূল হারা গাছ ফুল ফোটাতে নারে ফোটার আগেই মুকুল যে যায় ঝরে! শরৎ শেফালিকা, ঝরা বকুল ফুল এরা বড্ডো একা! একা একাই ঝরে যে হায় তারাই ভরায় মাটি-মায়ের শূন্য বুকের কোল, মায়া-কাজল টানি শূন্য সে তার আঁচল খানি অবিরত দেয় ভরে!
ওগো শেফালিকা, শরৎ-শিশির মাখছো তুমি গায়! পড়ছো ঝরে গায়ে-হলুদের রাতে! স্নিগ্ধ ভোরের হাওয়ায় হাওয়ায় মেতে মখমলী তৃণবুকে মুখ রেখে ঘুমাচ্ছো অবশেষে! ওগো বকুল গন্ধে মাতাল যাত্রা-পথের বেভুল যাত্রী তুমি! পড়ছো ঝরে চৈত্র-দুপুর স্তব্ধ-মেদুর পথে! নত মুখে পুছলো যখন কেউ, কই গো আমার বকুল ফুল কই! মুখ তুলে চেয়ে দেখে, তুমি তেমনি করে আর সেখানে নেই! দূরের হাওয়া বাঁশীর সুরে সুরে কাঁদন-ডাকে থেকে থেকে ডাক পাঠিয়ে বলেঃ আয় চলে আয় তবে! আমিই না হয় হবো রে তোর সই!
স্বপন-মায়া নিদয়-কায়া সজল চোখের চাউনি দিয়ে মন কেন ভুলায়! হায়! পথ পথের মায়া কেন এমন করে যখন তখন ডাক দিয়ে সে যায়!
সুখ-পাখিটার মনের আকাশ আজ খুব হাসমুখ! বাজায় সে ঝুমঝুমি! কে দিল তায় চুমি! আরশি দিঘল দীঘি সেখানে আজ পড়েছে যার মুখের ছায়া, তাকে ধরবে তুমি! সে এক অসম্ভবের খেয়া! পার যায় না দেখা! মোহনবাঁশি চোখ পাকিয়ে বলে! বলেই হেসে গড়িয়ে পড়ে!
জ্যোৎস্না সে আবছায়া, পথ মায়াতে ঢাকা! সেই ছায়াপথ কেটে বিরাম বিহীন আমার যে পথ চলা! স্পষ্ট আমায় যায় নাকো তাই দেখা! হাঁদারাম, সেই কথাটাই বুঝলে নাকো তুমি! বোঝাতে না পেরে গহন মোহের নিশিথ রাতের আড়াল ধরে তোমার দুপুর রাতের ঘুম আমি ভাঙ্গিয়েছি সুরের মায়া টানে! তাই তো এতো কথা সাদা পাতার বুকে আঁচড় কেটে কেটে পাঠিয়ে দিলুম তোমার কাছে! তোমার মোহন মায়া ঘিরে বাকি রাতটুকু ছিঁড়ে গায়ে পড়েই যদি তোমায় জাগিয়েই রেখে থাকি সেই সুখে তাতে এমন কি দোষ করেছি তোমার কাছে যে তুমি চেয়ে আছো আড় চোখে!
আছে আছে! সব তেমনিই ধরা আছে তোমার কোলের কাছে! পারো যদি ভালোবেসো অকাতরে! স্নেহের পরশ দিয়ে তাকে এমনি জাগিয়ে রেখো! অবনত মুখ তোলো! দেখো কে এসে ফিরে গেলো!
যদি মনে রাখো, যদি কাছে ডাকো, তবে, নব জীবনের টানে বর্ষা-দিনের তানে উঠবো সুরে বেজে, বুকের বীণার তারের কাঁপন রাখে যেন তায় ধরে! নিদাঘ নিঝুম বৈকালী সন্ধ্যায়, বরষা মেদুর রাতে, শেফালির ঝরে পড়া বেদনায়, তার স্নিগ্ধ মেদুর গন্ধ মাতানো বায়, শিশির ভেজা ঘাসে, যবে কুয়াশায় আকাশের মুখ হৈমন্তিকা ঢাকে, জুড়িশুড়ি শীতবুড়ি নকশি-কাঁথাটি তার বিছায় মাঠের গায় গভীর সোহাগ ভরে, তেমনি করেই পথ হেঁটে হেঁটে তোমাকেই চেয়ে যাবো! ফাগুন দিনে পারো যদি এসো ফিরে! কান্না ভেজা সুরে তানে ভালোবাসা তুমি আঁখির বুকে আখর এঁকে রেখো!
রাত্রি এখন ভাঙ্গছে! পাতলা আলোর স্বচ্ছ চাদর আড়মোড়ে ঢেউ তুলছে! তার কিছু অবলম্বন চাই, বন্দিনী সে মোহনবাঁশি ছাদে আলসের ’পরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে! মন সে মুক্ত আকাশ-বিহগ পাড়ি দেয় অজানায়! ভোরের আকাশ উঁকি দিয়ে বলে একটু সবুর করো আঁধারের পথ ঠেলে মেলে দিয়ে তার আঁধার আবছায়া এলো চুলে ঊষা ঐ এলো বলে!
পিলু, গভীর রাতের সে যে ভৈরবী, যখন পড়লো ঢুলে, মোহনবাঁশি, ভোর-ভৈরবী সুরে চঞ্চল হয়ে পড়ে! দাঁড়ায় সে গা ঝেড়ে! ঋজু পায় রোজকার মতো সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে নামে! ঘরে এসে পৌঁছায়! দিনের কাজের মাঝে রাতের সুরের ডাকের কথা সে বেমালুম যায় ভুলে! শিশিরেতে স্নান সারে, লালপেড়ে টকটকে শাড়ীখানি তার পরে, আকাশ-কপালে তার ভোরের রবির সিঁদুরের টিপে ভরে! শ্রবনে দোলায় ঝুমকো লতার ফুল, নাকে নাকছাবি গুল্মলতার কুঁড়ি, চন্দ্রমণির হার গলায় সে তার পরে! কৃষ্ণপক্ষ একফালি এয়োদশী চাঁদ আবছায় যেন ভাসে আকাশের গায়! উঠে পশ্চিমে শুকতারা ঝলমল চোখে চায়! অল্প সময় থেকে সে ফিরে আলোক সমুদ্রে ডুবে যায়!
কোন এক রাতে হয়তো বা প্রতিরাতে গিয়েছিল অভিসারে! তারে মনের গহন তলে এমনি সে ডুবিয়ে রাখে যে তারা সবে রয়ে যায় অগোচরে! কালো রাত্রীর খাম ঝিমধরা আবছায়ে শ্রান্তির ঘাম মোছে! বুকের আঁচল ঘুমে ঢলে ঢলে পড়ে! আধো-ঘুমে আধো-জাগরণে হৃদয় গহনে বসে হয়তো বা কেউ ঘোমটা আড়াল থেকে আলগোছে শ্বাস নেয় শ্বাস ফেলে! প্রকৃতির কোলাহল আরো চঞ্চল হলে শুষ্ক অশ্রু-রেখা কপোলেতে চিক কাটে!
অশ্রুর স্রোত অতৃপ্ত বাসনায় যতো ছবি আঁকে তারা বারবার ভেসে যায়! কদম্ব বনছায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁশী মন কাড়া সুরে আজও একান্ত বেজে বেজে অসীমের পানে ধায়! মন চায় তার সে সুরের টানে সীমার বাঁধন ছিঁড়ে তারি পিছুপিছু যায়! সজাগ দিনের আঁখি থাকে পাহারায় পাহারায় তার সে চলার পথে যতেক কাঁটা বিছায়! ভয়ে ভয়ে থাকা সে মোহনবাঁশী হারানোর সুরে সুরে মনের নয়ন পথে আসে আর ফিরে যায়! চলে যেতে যেতে বেদনার অভিঘাতে গোপনে শ্রবনে আনমনে কতো কথা কয়ে যায়! লেখনির মুখ তারই কিছু ছবি ধরে পাঠায় যেথা উন্মুখ কোন এক অচীন একটি বুক থাকে সুখেদুঃখে অবিচল অনাবিল, মুখে নিয়ে হাসি চোখে নিয়ে জল একাকী দিন কাটায়!
তটিনীর বুকে তরঙ্গ দোল খায়! দিনে রাতে ঝিকিমিকি চিক কাটে রবির রশ্মি চাঁদের কিরণ তায়! স্পর্শ সে সুখে সে হৃদয় নদী বারে বারে হেসে ওঠে বিষণ্ন বেদনায়!
ওগো সুদুরের বাঁশী বিভোর যে প্রান এসেছিল ছুটে সকল বাঁধন টুটে বিধুর সুরের তানে, তোমার সুরের দোল পরালো যে মালা গলে হৃদয়ের দ্বারে দ্বারে তারা সুর ঝঙ্কার তোলে! সে ঢেউ ভাঙ্গন কতো না ব্যথার অঙ্গনে অঙ্গনে আনমনা ছবি আঁকে! আঁকা ছবি তার সে ঢেউ মাতনে বারবার মুছে যায়! তবুও তোমার সুর-মন্দির সব হারানোর সুরে কাঁদনের টানে নব পরিচয়ে তাদের ফিরিয়ে আনে! তোমাকেই আঁকে মোছে ফিরে ফিরে নীবিড় তুলির টানে ব্রাত্য সে এক বুক হারিয়ে পাওয়ার পেয়ে হারানোর আনন্দ-বেদনায়!
গোপন দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে বুক বাঁশরী-হৃদয় ফুকারি পুকারি ওঠে!! বাঁশীর বুকের হাড়ে হাহাকার ওঠে পড়ে! তারি সে কাঁপন শ্রুত বাণীরূপ ধরে সুর হয়ে সেথা ঝরে! তুমি একটু সময় রেখো সেই অভাগার তরে তোমার মনের আড়ালের পথ ধরে আজিও যে পথ হাঁটে! সে হৃদয় বাঁশি মোহনবাঁশীর হৃদয় যেথায় ফুল হয়ে ফুটে থাকে!
চাঁদের সে মায়া কোলে তোমার দুলকি চালে তুমি বেশ হাঁটছিলে! ঠেকলো যখন চাঁদ ধরনীর এই কূলে অমনই দেখি তুমি কোথ্থাও আর নেই! সুরের এ সাম্পান অমনি উঠলো দুলে! স্বপ্নে মেলা পাখা হয়ে গেলো খানখান! ব্যথা, নয়ন তুলে ভাবছে তখন এলো সে কোন কূলে! হয়তো বসে ভাবছে এখন আথাল-পাথাল গালেতে হাত দিয়ে, এলে যদি তুমি তবে এসে কেন ফিরে গেল মুখে কিছু নাহি বলে! তবে আকুল হাওয়ায় হাওয়ায় আশাহত প্রাণ বাড়ালে যে হাত এইমাত্তর বলো না সে কাকে চেয়ে!
সবুজ প্রাণের অবুঝ বৃক্ষ শাখা চেয়ে থাকে বৃথা, অপেক্ষা অনিঃশেষ, বাতাস কেবল সেথা দীর্ঘ নিশাস ফেলে আসে আর যায় ফিরে! তুমি আর আমি দুই তীরে দু’জনায়, মাঝে সে অকূল প্রেম যমুনার বারি তিরতির বয়ে যায়, অনন্ত বেদনায় লেখে সেই রূপকথা!
—ooXXoo—
[নিষুতি = (১)গভীর নিদ্রা, (২) শব্দহীন, গভীর নিদ্রায় মগ্ন, নিস্তব্ধ, নিষুপ্তি শব্দজ। নিষেক = বর্ষণ, ক্ষরণ, সেচন; আধান; গর্ভাধান। নিষেবিত = পূজিত, শুশ্রূষাকৃত; সেবিত। নিষ্কন্টক = শত্রুশূন্য, কন্টকশূন্য; নিরাপদ। নিষ্কম্প = কম্পহীন, স্থির। নিষ্কর = লাখোরাজ, যার জন্য খাজনা দিতে হয় না এরূপ। নিষ্কল = অখণ্ড; অংশ বা কলাবিহীন; পূর্ণ।]