তিস্তা পারের রহস্য (দ্বিতীয় পর্ব)
সলিল চক্রবর্ত্তী
১৩-১১-২০২২
সুশোভন মর্নিং শিফ্টে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর, তৃষা অরুন রায়কে কফি আর ব্রেড এনে দিতে বলল।
ফ্লাটের নিচে গ্রোসারি শপ থেকে কফি, ব্রেড কিনে অরুন রায় ফিরে আসছেন ঠিক তখনই সেই লোমশ বাঘের মতো কুকুরটি তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। সেই করুন চাহনি, যেন কিছু বলতে চাইছে, অবলা জীব বলে সম্ভব হচ্ছে না। অরুন রায় কলকাতার ধরন অনুযায়ী এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে কুকুরটার সামনে দিলেন, কিন্তু কুকুরটি শুকেও দেখল না। কেমন মায়াবী দৃষ্টিতে অরুন রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। অরুন রায় কুকুরটির চোখ থেকে নিজের চোখ সরাতে পারছেন না। কুকুরটি যেন ক্রমশ তাঁর উপর মায়া বিস্তার করছে। এবং মায়া বিস্তার ক্রমশই প্রচ্ছন্ন থেকে প্রকট হয়ে উঠছে। অরুন রায় হিপনোটাইজ্ড হয়ে গেলেন। কুকুরটি অরুন রাযের চোখের দিকে লক্ষ্য রেখে এক পা, দু’পা করে পিছতে থাকে একই ভাবে অরুন রায় তাকে অনুসরন করে।
“ও বাবু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” কথাটা শুনে অরুন রায়ের সম্বিত ফিরল। ঘুরে দেখলেন গত পরশুর আগের দিন পরিচয় হওয়া সেই বার চোদ্দ বছরের মেয়েটি, চম্পা। “এই যে কুকুর——” বলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন কোথায় কুকুর, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিস্তা রঙ্গিত নদীর মোহনাস্থিত এক পাথুরে জায়গায়। চম্পা এগিয়ে এসে জানতে চাইল এতো সকালে ঠাণ্ডায় কেন তিনি এখানে এসেছেন। অরুন রায় ঘটনাটা চম্পাকে না বলে বললেন -” এই মোহনাস্থলটা আমাকে খুব টানে। কি সুন্দর একটা নদীর জল কলকল শব্দে আরেকটা নদীতে গিয়ে মিলছে। ভারি মিষ্টি জায়গাটা।” চম্পা সম্মতি জানিয়ে বলে-” যারাই এখানে বেড়াতে আসে, এই জায়গায় আসেই। বাবু আমি বাড়িতে আপনার কথা সবাইকে বলেছি, দাদি তো আপনার কথা শুনেই আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন।” অরুন রায় হাতের ব্রেড আর কফির কথা মনে পড়তেই চম্পার দাদির সাথে পরে দেখা করবেন বলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলেন।
অরুন রায়ের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। কুকুর আর সাধু বাবার উপস্হিতি এবং অন্তর্ধান, এই হিসাবটা তিনি কোনোভাবে মেলাতে পারছেন না। “কে এই সাধুবাবা শুধু তাকে আর তার মেয়েকেই বা কেন দেখা দিচ্ছেন!! তবে কি জ্যাঠামশাই?? না-না তা কি করে হবে, তাঁর তো বেঁচে থাকার কথা নয়, যদিও থাকেন এমন সাবলীল ভাবে চলাফেরা করতে পারার কথাও নয়। আবার প্রবাসী তৃষাকে সুশোভনের অনুপস্থিতিতে কুকুরটি কেন পাহারা দেয়। তাহলে কি বিদেশ বিভূঁইয়ে অরক্ষিত নাতনির রক্ষা কর্তা হয়ে রয়েছেন।” দুশ্চিন্তার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ভাবছেন, কেনই বা তিনি খামখা জ্যাঠামশাইয়ের কথা ভাবছেন! এদিকে চম্পার দাদি কেন তার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন!! যুক্তির প্যাঁচে তিনি এমন ভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছেন যে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। তাহলে তিনি কি সা-ধু-বা-বা ——-। মনের অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সময় নষ্ট না করে, দুপুরে খাওয়ার পর কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লেন তিস্তা পারের উদ্দেশ্যে। যদি কিছু রহস্য উদঘাটন করা যায়।
চলে গেলেন সেখানে যেখানে কুকুরটা তাঁকে সম্মোহিত করে নিয়ে গিয়েছিল। জায়গাটা রঙ্গিত নদী ও তিস্তা নদীর এক পাড়ের মিলন স্থল। নভেম্বর মাস বলে এই স্থানের প্রকৃত রূপ বোঝা যাচ্ছে না। জুন জুলাই মাসে ভয়াল রূপ ধারন করে। কিন্তু কুকুরটা তাকে এই জায়গায় এনে কেন অদৃশ্য হল! নাকি চম্পা তাকে ডাকায় কুকুরটার উদ্দেশ্য ভেস্তে গেল। ভেস্তে না হয় গেল, কিন্তু উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?? অরুন রায়ের মাথায় আবার সব জটিল প্রশ্নের জট পাকাতে লাগল। মাথাটা একটু শান্ত করে তিনি ভাবলেন চম্পা কি কুকুরটাকে সকালে দেখেছিল অথবা কুকুর সম্পর্কে সে কি কিছু জানে!! কথাটা মনে উদয় হতেই ততক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা জানতেই হবে,তা না হলে তিনি যে স্বস্তি পাচ্ছেন না। খোঁজ করলেন চম্পাকে, কিন্তু চম্পাকে সেখানে পেলেন না। এক মহিলা পাথর ভাঙতে ভাঙতে আকার ইঙ্গিতে চম্পার বস্তিটা দেখিয়ে দিল।
অরুন রায় গোর্খা বস্তি এলাকায় গেলেন বটে কিন্তু অত বড় বস্তিতে কোনটা চম্পাদের কুটির সেটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল হল। অল্প হিন্দি বাংলা মিশিয়ে এর ওর কাছে জানতে চাইছেন। অকস্মাৎ বস্তির ভিতর থেকে এক নারী কন্ঠের ডাক শুনতে পেলেন-” এদিকে আসুন বাবু।” ডাকের উৎসে ফিরে দেখলেন, পঁয়ষট্টি ঊর্ধ্বে এক বৃদ্ধা রোদ পড়া সরু গলিতে একটা চেয়ারে বসে আছেন। অরুন রায় গুটি গুটি পায়ে বৃদ্ধার কাছে যেতে, তিনি একটা উৎফুল্লতায় মৃদু হাস্যমুখে অরুন রায়কে বললেন- “চম্পাকে খুঁজছেন?” পরিষ্কার বাংলায় এমন ভাবে বললেন, যেন অরুন রায়কে আগে থেকেই তিনি চিনতেন। তাঁর হ্যাঁ সূচক মন্তব্য শোনার আগেই বৃদ্ধা ঘরের দিকে তাকিয়ে চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-” চম্পা একটা বসবার জায়গা নিয়ে আয় বাঙালি বাবু এসেছেন।”
চম্পা ঘর থেকে একটা চেয়ার বার করে এনে অরুন রায়কে বসতে দিয়ে বলল-” এই যে আমার দাদি, আপনার চিনে আসতে অসুবিধা হয়নি’তো বাবু?” অরুন রায় চেয়ারে বসে মজা করে বললেন-” আমাকে খুঁজতে হয়নি, তোমার দাদিই আমাকে খুঁজে নিয়েছেন।” অরুন রায় চম্পার দাদিকে বললেন-” আপনি আমার সাথে দেখা করতে না চাইলেও আমি আপনার কাছে আসতাম, কারন আমার জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে যে আপনারা বাঙালি না হয়ে, পশ্চিমবঙ্গে না থেকেও কি’করে এতো ভাল বাংলা বলেন।” চম্পার দাদি কিছুক্ষণ মাথাটা নিচু করে চুপ করে থাকলেন, তারপর মাথা তুলে বললেন-” বাবু, সেই কথাই বলব বলে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি।” অরুন রায় অবাক হয়ে বললেন-” কি কথা, যেটা একজন অচেনা অজানা মানুকে বলবেন বলে ঠিক করেছেন!!” বৃদ্ধা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন-” না বলতে পারলে যে আমি নিশ্চিন্তে মরতেও পারব না, প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য উপস্থিতির অনুভূতি আমায় কুরেকুরে শেষ করে দিচ্ছে। যদি আপনাকে বলে কোনো সমাধান হয়! আপনিও তো বাঙালি সেইজন্যই —-“
( এখানে বৃদ্ধার বাংলা, হিন্দি, নেপালি মিশেল সংলাপ শুধু বাংলায় লেখা হল)
আজ থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। আমার বাবা তখন জামা কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করতেন। কাপড় কাচতে যেতাম তিস্তা নদীর পারে। অক্টোবর নভেম্বর মাসে নদীতে তেমন জল থাকে না। কিন্তু সেবার, এক ভরা অমাবস্যায় তিন-চার দিন টানা মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। উঃ সেকি ঠান্ডা,যেন শীতকালকেও হার মানিয়ে দেয়। গরীব মানুষ ঘরে বসে থাকলে তো চলবেনা, চম্পার মাকে সঙ্গে নিয়ে কাপড় কাচতে গিয়েছিলাম তিস্তা পারে। যেখানে রঙ্গিত নদীর জল এসে তিস্তায় মিসছে সেই জায়গায় গিয়ে দেখি এক সাধুবাবা অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। আলগা শরীর, গলায় পৈতে, একটা লেঙট পরা , হাঁটু পর্যন্ত ঠাণ্ডা জলে ডুবে আছে। মনে হল শরীরে প্রাণ আছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি আর চম্পার মা কোনো রকমে পা-টা জল থেকে টেনে তুলে বাবাকে খবর দিলাম। বাবা কয়েকজন গ্রাম বাসির সহায়তায় সাধুবাবকে সেখান থেকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসলেন। বাড়ি আসার সময় শ্মশানের কাছে ছাড়া লাল কাপড় আর একটা সুতির সাদা ঝোলা পেয়েছিলাম। বাবার মনে হয়েছিল জিনিস দুটো সাধু বাবার হবে। সেইজন্য ওগুলোকে নিয়ে নেই।
ডাক্তার এবং ওষুধের গুনে সাধুবাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকলেন। দিবারাত্রি সাধুবাবার সেবা যত্ন আমিই করতাম।
ঠিক সেই সময় আমার বাবার ব্যাবসা ভাল চলছিলনা। বাজারে ধারদেনা হয়ে গিয়েছিল অনেক। হঠাৎই বাবা দুটো ওষুধ কারখানার ধোলাই এ-র কাজ পেয়ে যান। আমাদের পারিবারিক জীবনে শুক সাচ্ছন্দ্য এক ধাপে অনেকটা বেড়ে যায়। বাবা বললেন এ সাধুবাবার কৃপা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এদিকে বছর খানিক সেবা শুশ্রূষার পর সাধুবাবা একদম সুস্থ হয়ে উঠলেন। আমি সেই এক বছর তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকায় বাংলা ভাষাটা অনেকটাই শিখে নিয়ে ছিলাম। তখন প্রতিদিন বিকালে সাধু বাবা আমাদের নিয়ে বসে ধর্ম কথা শোনাতেন। একে একে গ্রামবাসীরাও ধর্ম কথা শুনতে ভিড় জমাতে শুরু করল। আমরা বুদ্ধিষ্ট হয়েও ভগবান বুদ্ধ সম্পর্কে কত কম জানতাম। সাধু বাবার সংস্পর্শে এসে অনেক জ্ঞান লাভ করেছি।
এক দিন ধর্মালোচনার সময় বাবা, সাধু বাবর কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন সেদিন অমন দুর্যোগ পূর্ণ অবস্তায় অসুস্থ শরীরে তিনি তিস্তাপারে এসেছিলেন। সাধুবাবা পরিষ্কারভাবে কিছু না বলে,বলেছিলেন-” আমার শরীরটা বড় কথা নয়,কাজটাই ছিল আসল লক্ষ। আর ওই দিনটাই যে নির্দিষ্ট ছিল। দুর্ভাগ্যবশত শরীর সায় না দেওয়ায় আমি ব্যার্থ হয়েছি। প্রভুর অসীম কৃপায় তোদের হাত ধরে অনেক অপদেবতার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি।”
—-কেন বাবা অপদেবতার হাত থেকে বলছেন কেনো?
—– মৃত্যুর পর মানুষের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়। কিন্তু আত্মার মৃত্যু হয়না। সে তখন এক আশ্রয়স্থল পরিত্যাগ করে অন্য আশ্রয়স্থলের অপেক্ষায় থাকে। তার জন্য প্রয়োজন উত্তরসূরীর দ্বারা পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন করা। অনেক কারনে অনেক সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনা, ফলে সেই অতৃপ্ত আত্মা অপদেবতা রূপে মুক্তির আশায় ঘুরতে থাকে। মাধ্যম পেলে মুক্তির আশায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
—— মাধ্যম কি গুরুজী?
— (কিছুক্ষনের জন্যে চুপ করে থেকে) সব কিছু তোদের না জানাই ভাল। তোরা শুনে সহ্য করতে পারবি না। সাধনার সব কিছু সাধারন গৃহস্থদের জানা ঠিক নয়।
ওই পর্যন্তই, তারপর এক দিন সাধুবাবা বাবাকে ডেকে বললেন, অনেক দিনতো হল আমাকে এবার ফিরতে হবে। সাধুবাবার মুখে ‘ফিরতে হবে’ কথাটা শুনে আমার বাবা ভেঙে পড়লেন। স্বপ্নের মতো সুখ শান্তিগুলো ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাবে না তো? গ্রামের ভক্তকুল সব ছুটে এল। সবার চোখে জল। সাধুবাবা বললেন-” আমাকে আর মায়ার বাঁধনে বাঁধিসনে, আমার যে অনেক কাজ বাকি! যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি সন্ন্যাস গ্রহন করেছি তা যে এখনো সাধিত হয়নি। গত এক বৎসর আমার জীবনে যা ঘটল সেটা আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত।” সাধুবাবার মুখে নিজ পাপ কথাটা শুনে সকলে কানে আঙ্গুল দিয়ে বলল, চুপ করুন প্রভু ও কথা যে কানে শোনাও পাপ। সাধুবাবা মৃদু হাস্যমুখে বললেন-” ওরে, তোরাও মানুষ, আমিও মানুষ, বুঝে না বুঝে আমরা কত ভুল করি,অনেক সময় পরিস্থিতির চাপে পড়েও করি। শাস্তি তো পেতেই হবে। ক্ষিপ্ত হয়ে যে বাক্য প্রয়োগ করি তা পাপ, লোভ তো তিব্র গরলের সমান, অত্যাসক্তি অগ্নিসম, অবিদ্যা জীবনে সর্বাপেক্ষা অন্ধকার বয়ে আনে, যাহারা দান গ্রহন করে পরাঙমুক হন তারা সর্বাপেক্ষা পাপি বলে গন্য হয়। সর্বপরি নিজ স্বার্থে অপরকে দুঃখ দেওয়াও মহা পাপ। তাই পাপ ক্ষমার ঊর্ধ্বে নয়,তার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হয়। আমার এই কথা গুলো মনে রাখিস পারলে মেনে চলবি, তোদের মঙ্গল হবে।”
তত দিনে সাধুবাবা সকলের গুরুজী হয়ে গেছেন। গুরুজী একদিন আমাদের বাড়ির সকলকে একত্র করে বললেন-” তোমরা আমাকে যেতে বাধা দিয় না। আমি তোমাদের না বলে চলে যেতে পারতাম কিন্তু তা আর করব না। তবে কথা দিলাম এক বছর পর আমি ফিরে আসব। নাথুলাপাসে (চিন তিব্বত সীমান্ত) এক ধর্ম প্রাণ লামার সাথে আমার দেখা করা খুবই প্রয়োজন। আমার অভিষ্ট সিদ্ধির স্থল এই শ্মশান সংলগ্ন মোহনা। সুতরাং ফিরতে আমাকে হবেই।
শুধু আমরা নই, গ্রাম সুদ্ধু মানুষ অভিভাবকহীন হয়ে পড়লো। একটা বছর সবাই দিন গুনতে থাকে কবে গুরুজী ফিরবেন! কিন্তু বছর পার হয়ে গেল গুরুজী ফিরলেন না। সবাই ভেঙে পড়লেন, বয়স তো হয়েছিল, খারাপ চিন্তাটাই মাথায় আসা স্বাভাবিক। এই ভাবে আরো ছয় আট মাস কেটে গেল। ততদিনে আমার বাবা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আমার স্বামী তখন এই সংসারের হাল ধরেছে। ঠিক সেই সময় মেঘের ফাঁকে সূর্য কিরণের মতো গুরুজী ফিরে এলেন। আমাদের গ্রামে যেন উৎসব লেগে গেল। ফাটাক মোড়ের ফটোর দোকানের মালিক নিজহাতে গুরুজীর কত ফটো তুলেছিলেন। ফুলের মালায় গুরুজীকে অভ্যর্থনা করে গ্রাম বাসিরা গুরুজীকে অনুরোধ করল, তিনি যেন আর ফিরে না যান। গুরুজী একটু হেসে বললেন-” থাকা না থাকা সবই ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, আমি কে!”
বেশ কয়েক মাস গুরুজীকে কাছে পেয়ে গ্রামের গরীব মানুষ গুলোর ভালই কাটছিল।
প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী এলো জুলাই মাস। রঙ্গিত নদী আর তিস্তা নদীর আসল রূপ এই সময়ে দেখা যায়। তারপর গোন মুখে চলে বৃষ্টির বিরামহীন পতন। সেই রকম এক দিনে গুরুজী আমার স্বামীকে অল্প আটা, চালগুড়ো, কালো তিল, পাকা কলা আরো কি সব এনে দিতে বললেন। কি কারনে এ-সব চাইছেন তা না বলে শুধু বললেন-” আগামী অমাবস্যা তিথি, নিশুতিরাতে আমি মোহনায় যাব। কেউ আমাকে বাধা দেবেনা বা অনুসরন করবেনা। কারন তাতে আমার বা অনুসরন কারির সমূহ ক্ষতি হতে পারে। তোমাদের কথা দিচ্ছি আমার সন্ন্যাস গ্রহনের মূল উদ্দেশ্য সাধন হলে আমি আর একজনের সাথে দেখা করতে যাব। সে যে বহুদিন আমার অপেক্ষায় রয়েছে। তারপর যে ক’দিন বাঁচি তোমাদের মধ্যেই থেকে যাব।”
সেদিন ভরা অমাবস্যা, গুরুজী সারাদিন নির্জলা উপবাস করে আছেন। সকাল থেকে পূজা পাট নিয়েই আছেন, খুব প্রয়োজন না হলে কথাই বলছেন না। বর্ষা কাল, সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। তারই ফাঁকে গুরুজী তিস্তা থেকে এক কমণ্ডলু জল নিয়ে এলেন। সেই জল দিয়ে চালগুড়ো, আটা, তিল, কলা আরো কিছু এক সাথে মেখে রুটির লেচির মতো করলেন। সন্ধ্যা নাগাদ টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে, কথা প্রসঙ্গে আমার স্বামী বলল-” আজ শ্মশানে একটাও ডেড বডি এলো না। ” ঠাকুর ঘরে বসে ছিলেন গুরুজী, কথাটা শুনতে পেয়ে বললেন-” আসতেই হবে!” গুরুজীর গলাটা কেমন ভারি এবং কর্কশ শোনাল। আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম। এর ঠিক আধ ঘন্টার মাথায় শ্মশানে একটা ডেড বডি এলো। সবাই বিশ্বাস করল যা কিছু হচ্ছে তা গুরুজির অঙ্গুলি হেলনে। ডেড বডি আসার পর গুরুজী অতি তৎপর হয়ে উঠলেন। এবং ঘন্টা খানিক পর তিনি বেরিয়ে গেলেন। কারোর সাথে একটি কথাও বললেন না, কারোর প্রশ্নের উত্তরও দিলেন না। আমরা অতি উৎকণ্ঠায় সময় গুনতে থাকলাম। ঘন্টা তিনেক পার হয়ে গেল গুরুজী ফিরলেন না। আমরা গ্রাম বাসিরা কেউ চোখের পাতা এক করতে পারছিনা।
রাত একটা দেড়টা নাগাদ গ্রামের তিনটে ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল, গুরুজী মোহোনার ঘুর্ণিতে তলিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম শুদ্ধ লোক ছুটল রংপো থানায়, বর্ষাকাল অত রাত্রি, থানা থেকে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, ওই জায়গাটা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ছে, তাদের কিছু করার নেই। তখন ছুটলাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কালিম্পং থানার ফাঁড়িতে । তারাও সিকিমের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপাল। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে ছুটলাম রংপো মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যানের কাছে। তাঁর উদ্যোগে দুই থানার পুলিশ ডুবুরি নামিয়ে গুরুজীকে খোঁজার জন্যে তৎপর হল। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কালিম্পং গেটের ওখানে তিস্তা নদীর কিনারায় দুই বৃহৎ পাথরের ফাঁকে আঁটকে থাকা গুরুজীর ডেডবডি পাওয়া গেল।
সরকারি নিয়ম কানুনের শেষে ডেডবডি হাতে পেলাম। তারপর গুরুজীকে চিতায় তোলা হল। গ্রাম সুদ্ধ মানুষ চোখের জলে তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে এল।
অরুন রায় মনদিয়ে সাধুবাবার কথা শুনছিলেন, একটু উত্তেজিত হয়ে বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করলেন-” আচ্ছা সাধুবাবা কেন ওই বিপদজনক জায়গায় গেলেন! এবং ওখানে কিভাবে ঘুর্ণিতে তলিয়ে গেলেন সেই সম্পর্কে কিছু জানতে পারেননি?”
— পেরেছি, পরে গ্রামের ছেলে তিনটি বলেছিল, সেই রাতে শ্মশানে কি ঘটেছিল।
আঠার কুড়ি বছরের ছেলে গুলোর হয়ত গুরুজীর ক্রিয়াকলাপ বুজরুকি মনে হয়েছিল। সেই জন্য গুরুজীর নিষেধ সত্যেও তারা লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিল। যাইহোক তারা যেটা বলেছিল — গুরুজী প্রথমে শ্মশান সংলগ্ন জঙ্গলে গিয়ে মড়া পোড়ানো শেষ হবার অপেক্ষায় থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই শ্মশান যাত্রীরা চলে যেতেই শ্মশান ক্ষেত্র একটা নিস্তব্ধ প্রেত ভূমি হয়ে উঠল। নির্ভয়ে গুরুজী ধীরে ধীরে চিতায় রাখা জলন্ত কাঠগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর শরীরটাকে ওই প্রচন্ড ঠাণ্ডায় বিবস্ত্র করে ফেললেন। শুধু একটা ছোট শালু কাপড়ে লজ্জা নিবারণ করলেন। (যেমন অচৈতন্য অবস্থায় প্রথমে আমরা গুরুজীকে পেয়েছিলাম।) তারপর কাঠের আগুনের পাশে বসে মণ্ডের লেচি গুলো লুচির মতো পাতলা করে জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সেঁকতে থাকলেন। বেশ কয়েকটি সেঁকা হলে তিনি আরো জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে মোহনার দিকে চলে যান। তখন ওই জায়গার নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে এক ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে উঠেছিল, যেখানে তিনটি সাহসি ছেলে একসাথে থেকেও ভয়ে তাদের গা শিউরে উঠেছিল। ওই অবস্তায় গুরুজী আরো জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে খরস্রোতা নদিতে কোমর পর্যন্ত নেমে কিছু একটা করতে গেলেন। তারপর ছেলে তিনটি দেখল গুরুজী ঘুর্ণিজলে তলিয়ে গেলেন।
আমরা তো গুরুজীর অন্তেষ্টির কাজ কিছু করতে পারিনি, কারন আমরা বুদ্ধিষ্ট, নিয়ম কানুন কিছুই জানি না। হিন্দু পুরোহিত বলেছিল বংশের পুত্র স্থানীয় কাউকে লাগবে। ফলে সেটা আর হয়নি। এই ভাবেই কেটে গেল ত্রিশ বত্রিশ বছর।
কিন্তু বাবু গত এক বছর ধরে আমার মনে হচ্ছে তিনি আমাদের ছেড়ে যাননি, এই শ্মশান, বস্তির মধ্যেই ঘোরা ফেরা করেন। সন্ধ্যার দিকে আমি দুই একবার তাঁকে অস্পষ্ট শ্মশানের দিকে যেতে দেখেছি। রাতে গুরুজীকে নিয়ে উদ্ভট উদ্ভট স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে, যা এত বছরে কখনও হয়নি। দিন কয়েক আগে মাঝ রাতে একটা শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল, উঠে লাইট জালিয়ে চমকে উঠলাম। মনেহল গুরুজীর ঝোলাটার ভিতর থেকে একটা কালো হাতের ছায়া সরে গেল। স্মৃতি হিসাবে গুরুজীর ঝোলাটা দেওয়ালে ঝোলানো থাকে। শব্দটাও সেখান থেকে পেয়েছি। কাউকে কিছু বলতে পারছিনা, শুনে বলবে বয়স হয়েছে তো ভীমরতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আপনি তো বাঙালি মানুষ,তারপর কোলকাতায় থাকেন, দেখুনতো যদি কিছু একটা বিহিত করা যায়!!”
এতক্ষন অরুন রায় মনদিয়ে বৃদ্ধার কাছে গুরুজীর করুন পরিনতির কাহিনি শুনলেন এবং স্ব অনুমানের অঙ্কটা মেলাবার চেষ্টা করলেন। তিনি বৃদ্ধার কাছে জানতে চাইলেন,গুরুজীর কোনো ছবি আছে কিনা। বৃদ্ধার নির্দেশে চম্পা ঠাকুরের সিংহাসন থেকে গুরুজীর বাঁধানো ফটোটা এনে অরুন রায়ের হাতে দিল।
ছবিটা দেখে অরুন রায় চমকে উঠলেন। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল, এই ঠাণ্ডায় শিরদাঁড়া দিয়ে গলগল করে ঘাম ঝরতে লাগল। এ- যে-জ্যা-ঠা-ম-শা-ই!!!!!! কয়েক মিনিট পাথরের মতো ফটোটার দিকে তাকিয়ে থেকে অরুন রায় বৃদ্ধার কাছে গুরুজীর ঝোলাটা দেখতে চাইলেন। চম্পা ঘর থেকে ধুলো পড়া পুরোনো ঝোলাটা এনে অরুন রায়ের হাতে দিল। কাপড়ের ঝোলাটাও যেন তাঁর চেনা চেনা মনে হল। সমগ্র চিত্রটি তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
ঝোলার ভিতর থেকে পাওয়া গেল একটা মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, কিছু মলিন কাগজ পত্র, যাতে মন্ত্র তন্ত্র লেখা আছে। আর পাওয়া গেল একটা ডাইরি, এবং দীর্ঘদিনের কালি শুকিয়ে যাওয়া একটি বল পেন। জ্যাঠামশায়ের যে ডাইরি লেখা অভ্যাস ছিল অরুন রায় তা জানতেন, তিনি অনুমান করলেন, ডাইরিতে নিশ্চিত জ্যাঠামশাই সেই সময়ের দিনলিপি লিপিবদ্ধ করেছেন। যেখান থেকে জানা যেতে পারে, একজন কনফার্ম সংসারি মানুষ হঠাৎ করে কিসের প্রত্যাশায় সন্ন্যাস গ্রহন করে গৃহত্যাগী হলেন। অতি উত্তেজনায় ডায়রির পাতা ওল্টাতেই তারিখ মেনশন করা লেখাগুলো চোখে পড়ল ——
(আগামী সংখ্যায় অন্তিম পর্ব)