ব্যোমকেশ আগেই বলে রেখেছিলো। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে আটটার মধ্যে বেরোতে হবে। সেই মত সকাল সকাল দুজনেই খেতে বসে গেলাম। সত্যবতী আন্দাজ করেছিল বার বার প্রশ্নও করছিল কিন্তু ব্যোমকেশ নিশ্চুপ রইল।সত্যবতী মুখ ভার করে পরিবেশন করল। আমরাও দুজনে দ্রুত খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি সে ব্যাপারে ব্যোমকেশ একটি কথাও বলল না।গতকাল রাতে বিকাশ এসেছিল। ব্যোমকেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রঞ্জনবাবুর ঘরটার বিবরণ শুনতে চাইল। বিকাশ বললও। ব্যোমকেশ উৎকর্ন হয়ে শুনল।পাড়া প্রতিবেশী দের সঙ্গে ভদ্রলোকের কোন সম্পর্ক নেই। কারুর সাথে মেশেন না। কথাও বলেন না। মুখের এক পাশ মাফলার জাতীয় একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢেকে রাখেন।প্রত্যেক মাসে চারদিন করে বাইরে বেরোতে দেখা যায়।ব্যোমকেশের ধারণা ওই চারদিনই রোজগার করতে বেরোয় লোকটা। ভদ্র ঘরের মেয়েরা যারা এক সময় ভুল করে ওর ফাঁদে পড়েছিল তারাই ওর মক্কেল।এদের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে মোটা টাকা রোজগার করে স্কাউন্ড্রেলটা। এই মহুয়া সেনের মত।সুশান্ত জানিয়েছে কোন পুলিশ রেকর্ড নেই।আর ব্যাংকেও কোন একাউন্ট নেই বা লকার নেই। অর্থাৎ ছবিটা ঘরেই আছে। কিন্তু কোথায়? আজকের অভিযান সম্ভবত সেই কারণে। কিন্তু ব্যোমকেশের মনের মধ্যে কি চলছে তা বোঝা খুব শক্ত। বিকাশ সেদিন এসে বলল সম্ভাব্য সব জায়গায় ও খুঁজে দেখেছে।তাহলে? বড় রাস্তায় এসে অতি সহজেই একটা ট্যাক্সি ধরে ফেলল ব্যোমকেশ। তারপর ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে চোখ বুজে পড়ে রইল সিটে মাথা হেলান দিয়ে। দু একবার এটা সেটা বলে কথা চালাবার চেষ্টা করে শেষে হল ছেড়ে দিয়ে সন্ধের কলকাতার দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। ব্যোমকেশ কথা না বললে কার সাধ্য ওকে কথা বলায়।তবে সম্ভবত গভীর ভাবে ভাবছে কিছু। এখানেই ব্যোমকেশের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য। ও বলে ” তুমি দেখো অজিত আর আমি পর্যবেক্ষন করি।” যথার্থ। আমি নিশ্চিত আজ রঞ্জন বাবুর ঘরেও সেরকমই কিছু মিরাকেল ঘটবে।সকালেও একবার বেরিয়েছিল ও। কোথায় গেছিল জিজ্ঞেস করেছিলাম। ব্যোমকেশের যেমন রীতি। আবোল তাবোল থেকে আউড়ে দিল। “ আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্ত সাগর পার কাতু কুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার।” কবে সেই কোন ছোট বেলায় খোকাকে একখানা আবোল তাবোল কিনে দিয়েছিলাম। তার রেশ এখনো চলছে। আর রাগ করে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। ভাগ্যক্রমে রাস্তায় তেমন জ্যাম ছিল না। পৌনে নটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট জায়গায়।ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে এগোলো ব্যোমকেশ। বিকাশের কথা মত বড় রাস্তা ছেড়ে একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। এখান থেকে গুনে গুনে তিনটে বাড়ির পরেই আমাদের লক্ষ্যস্থল।বিকাশ বলেছিল ঠিক নটা নাগাদ লোকটা খেতে বেরোয়। ব্যোমকেশ কি ওই সময়ই ওর ঘরে ঢুকবে? কিন্তু আশেপাশের কেউ যদি দেখে ফেলে? চারদিকে একবার চোখ চালিয়ে দেখে নিলাম। শীতের রাত। সব বাড়িরই জানালা দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত নটা। ব্যোমকেশের সাথে অনেক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছি। এর থেকে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু এখনও এইরকম অবস্থায় এলে আমার বুক দুরদুর করে। ব্যোমকেশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। শান্ত কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।মাত্র কয়েক ফুটের দূরত্ব। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ।মনে হল দরজার ছিটকিনি খোলার আওয়াজ। এরপর ব্যোমকেশ যা করল তা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। বিন্দুমাত্রও প্রস্তুত ছিলাম না এর জন্য। দরজা খোলা মাত্রই ব্যোমকেশ সামনে গিয়ে খোলা দরজায় পা বাড়িয়ে দিল। ঘরের আলোতে স্পষ্টই লোকটার মুখের এক পাশ দেখতে পাচ্ছিলাম। রীতিমত হতভম্ব অবস্থা। “ আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।” বলতে বলতে ব্যোমকেশ যেন খানিকটা গায়ের জোর দেখিয়েই লোকটাকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আমি দ্রুত গিয়ে ব্যোমকেশের পাশে দাঁড়ালাম। “ কে আপনারা? কি চান?” “ বলছি বলছি। আসুন একটু বসা যাক। অজিত দরজাটা বন্ধ করে দাও” “ মানে? এ কি মগের মুলুক নাকি! আশ্চর্য লোক তো আপনারা! বলা নেই কওয়া নেই দুম করে ঘরে ঢুকে পড়লেন! বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যান বলছি।” ব্যোমকেশ মধুর হেসে বলল, “ ভয় কি? আমরা পুলিশের লোক নই।” কথাটা উচ্চারণ করা মাত্র যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল। লোকটা যে ভয় পেয়েছে সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে নারাজ। “ পুলিশ! ক – কি আশ্চর্য! পুলিশের কথা আসছে কে – কেন?” “ আসছে এই কারণেই যে আপনি ভদ্র ঘরের মহিলাদের দুর্নামের ভয় দেখিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেল করে টাকা নিচ্ছেন।” “ কে বলেছে? আপনারা কে ? কে পাঠিয়েছে আপনাদের?” “ দাঁড়ান। দাঁড়ান। একসঙ্গে এত প্রশ্নের উত্তর কেমন করে দিই?” ব্যোমকেশ ধীরে সুস্থে সিগারেট বার করল। তারপর ধরিয়ে তাতে একটা টান দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “ আপনি লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোক।স্কটিশে পড়েছেন।এ কিরকম প্রবৃত্তি আপনার?” “ আপনি কি বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।” “ বটে! বুঝতে পারছেন না ? ব্ল্যাকমেল করছেন না আপনি?” “ মিথ্যে কথা। সব মিথ্যে কথা। জোর করে ঘরে ঢুকে আপনারা আমাকে অপমান করছেন। জানেন আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারি।” ব্যোমকেশের দু চোখ কৌতুকে নৃত্য করে উঠল, “ তাই নাকি!পারেন? বেশ তো করুন না।চাইলে পুলিশও ডাকতে পারেন।” “ কি চান আপনারা ? কেন আমাকে এভাবে অপদস্থ করছেন ?” “ছবির নেগেটিভ টা কোথায় রেখেছেন ?” ব্যোমকেশ গুলির মত প্রশ্ন করল। কিছুক্ষণ স্থির চোখে ব্যোমকেশের দিকে চেয়ে থাকল লোকটা। তারপর বিদ্রুপের হাসি হাসল। “ ও।তাই বলুন।মহুয়া পাঠিয়েছে বুঝি?তার মানে এর আগে যেদিন আমার ঘর লন্ডভন্ড হয়েছিল সেটাও আপনাদের কীর্তি? তা আপনার পেশাটা কি? চোরের ওপর বাটপাড়ি?” “ তা কিছুটা বলতে পারেন।” ব্যোমকেশ অম্লান বদনে স্বীকার করে নিল। “ যেন তেন প্রকারেন সত্য অন্বেষণ করাই আমার কাজ।” “ তো কোন সত্যের সন্ধানে আমার ঘরে ঢুকেছেন?” “ ওই যে বললাম ছবির নেগেটিভ। আপনি ভালোয় ভালোয় দিলে ভালো না হলে —” “ না হলে —?” “ খুঁজে আমি বার করবই।কিন্তু তার পরের ফল কিন্তু ভালো হবে না।” “ ভয় দেখাচ্ছেন ?” “ না। সাবধান করছি।শুনুন রঞ্জন বাবু।কেন এসব করছেন?মহুয়ার মত একটা ভালো মেয়ের কেন এভাবে সর্বনাশ করার চেষ্টা করছেন?মহুয়া তো আপনাকে ছেড়ে যায় নি। আপনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর আজ যখন সে স্বামী ছেলে নিয়ে সংসার করছে কেন তার সুখের ঘর ভেঙে দেবার চেষ্টা করছেন?” “ হা হা হা।” উচ্চস্বরে হেসে উঠল লোকটা।“ মহুয়ার মত এরকম দুগ্ধবতী গাভী না থাকলে আমার চলবে কি করে বলুন তো?আপনি তো সবই জানেন দেখছি। তার মানে এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে আমার এখন এটাই রোজগার?” “ অর্থাৎ আপনি ছবিটা দেবেন না। তাইতো? –” “ না।” আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। পরস্পর পরস্পরের দিকে চক্ষু নিবদ্ধ। যেন নিঃশব্দে বুদ্ধির লড়াই চলছে।রঞ্জন বাবুর চোখে এক অঘোষিত চ্যালেঞ্জ। আর ব্যোমকেশের চোয়াল শক্ত। চিবুকে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। “ আমি জানি ছবি এই ঘরের মধ্যেই আছে।” “ লোক দিয়ে সার্চ করিয়েছিলেন তো।পান নি ?” তীব্র বিদ্রুপ রঞ্জন সরকারের গলায়। ব্যোমকেশ নীরব। “হা হা হা।বেশ।আমি বলছি এই ঘরেই আছে।বার করুন খুঁজে। দেখি আপনি কত বড় সত্যান্বেষী!” ব্যোমকেশের মুখে চকিতে স্বস্তির হাসি খেলে গেল। বেশ অবাক হলাম। এই অবস্থায় হাসি এল কেন ব্যোমকেশের ঠোঁটে ! আর এই লোকটিও বলিহারি! এরকম নির্লজ্জ মানুষ আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। গলা বাজিয়ে স্বীকার করছে ব্ল্যাকমেইলিং করে!একটা অদ্ভুত টেনশন তৈরি হচ্ছিল ভেতরে। সেটা কাটাতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে ধরালাম। হাতের কাঠিটা ফেলতে না ফেলতেই ব্যোমকেশ চিৎকার করে উঠল “ কি করলে অজিত কি করলে? কোথায় ফেললে? আগুন ধরে গেল যে !” কথাটা শুধু বলার অপেক্ষা। রঞ্জন সরকার লাফিয়ে উঠল। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই দ্রুত ছুটে গেল দেয়ালের দিকে। আমি হতভম্ব চোখে দেশলাইয়ের কাঠি খুঁজছি। দেখি ব্যোমকেশ বাঘের মত লাফিয়ে উঠে শক্ত সুপুষ্ট কব্জিতে চেপে ধরেছে রঞ্জন সরকারের কাঁধ। আর হাত গলিয়ে দিয়েছে দেওয়ালে টাঙানো ছবির পেছনে। প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে রঞ্জন সরকার। তার মধ্যেই ব্যোমকেশ নিজের পকেট দেখিয়ে ইশারা করল। হাত গলিয়ে দেখি একটা বাঁশি। আগুপিছু না ভেবেই বাজিয়ে দিলাম। নিমেষের মধ্যে দরজা সশব্দে খুলে গেল। তাকিয়ে দেখি বিকাশ আর তার দলবল। “ এসো বিকাশ।অবশ্য কাজ হয়ে গেছে। তবু যদি কিছু বাড়াবাড়ি করে তাই তোমাদের থাকতে বলেছিলাম।” দেখলাম বিকাশের সঙ্গের দু তিনটি ছেলের পেশীবহুল চেহারার দিকে সন্ত্রস্ত চোখে তাকাচ্ছে রঞ্জন সরকার। “ একটু উচিত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিও। পুলিশে দেওয়াই উচিত ছিল কিন্তু আমার মক্কেলের সম্মানের এবং ভবিষ্যত জীবনের কথা ভেবেই চুপ করে যেতে হল। চল হে অজিত। রাত অনেক হল। সত্য ভাববে।”