“পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে” এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের ‘পরে”- জীবনানন্দ দাশ এখানে ‘পুরোনো পেঁচারা’ বলতে আমরা বুঝবো সেই সব বহুজাতিক সংস্থারা যারা যুদ্ধের সময় মারণ রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করত। তারপর যুদ্ধ শেষে যখন দেখলো মুনাফা সেরকম হচ্ছে না, তখন তারা নেমে পড়লো কৃষি ব্যবসায় – আজকে যেটা সার কীটনাশক। এবং সর্বশেষে জিএমও ফসল বা জিন শস্যের চাষ। আসলে কবিরা অনেকদুর পর্যন্ত দেখতে পান।তাই তাঁদের লেখা কবিতার লাইন কোন না কোনভাবে বর্তমান বা ভবিষ্যতের সমাজের সাথে মিলে যায়। যাইহোক আজকে আমরা বিটি বা জিন শস্য চাষের প্রকৃত বিপদটা ঠিক কোথায় সেটা বোঝার চেষ্টা করবো।
জিন শস্য চাষের বিপদ বহুমুখী। তার মধ্যে বাস্তুতন্ত্রের বিপদটাই হচ্ছে অন্যতম বড় বিপদ। এটা বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রকৃতিতে মিথস্ক্রিয়া বলে একটা ব্যাপার আছে। এটা জৈব বিবর্তনের দ্বারা জীবজগতের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান ও জীবন-যাপনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে।এখন এই ব্যবস্থা তৈরিতে প্রজাতির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ একটি পক্ষ এবং তার চারপাশের জড় ও জৈব পরিবেশ আর একটি পক্ষ। আজকের প্রকৃতিতে মোটামুটি যে শৃঙ্খলা বিরাজ করছে তার জন্য জিনের বিশেষ ভূমিকা আছে। এই শৃঙ্খলাটাই ওলোট পালোট হয়ে যাবে জিন শস্য চাষে। কিভাবে ? আমরা জানি, কোষের মধ্যে জিন থাকে। একটা প্রাণী দেহে অসংখ্য কোষ আছে, সুতরাং অসংখ্য জিন আছে। একইভাবে অন্য একটি প্রজাতি প্রাণীর অসংখ্য কোষ অসংখ্য জিন। এটা উদ্ভিদ জগতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এক একটা প্রজাতির এই যে জিন সজ্জা সেটা স্থিরকৃত হয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, প্রাকৃতিক ভাবে। জীবজগতের স্বাভাবিক নিয়ম হলো এক প্রজাতির সঙ্গে ভিন্ন প্রজাতির জিনের বিনিময় ঘটে না।যেমন ইঁদুরের সাথে কুকুরের বা মানুষের সাথে গরুর। কিন্তু বিজ্ঞান সেটা পারে – ল্যবরেটরিতে।যে বিজ্ঞানের সাহায্যে এই কাজটি করা যায় তার নাম জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জৈব প্রযুক্তি। বিজ্ঞান তার এই কৌতূহল প্রথম মিটিয়ে ছিল তামাক গাছে। জোনাকি পোকার আলো জ্বলার জন্য যে জিনটা দায়ী সেই জিনটা প্রবেশ করিয়ে দেয় তামাক গাছের কোষে। দেখা গেল রাতের বেলায় তামাক গাছটি জ্বলজ্বল করছে। এখন এই ক্রিয়াকলাপ প্রকৃতি এবং প্রাণীজগতের বিপদ কিভাবে ঘনিয়ে আনতে পারে সেটা খুব প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন দুই জন বিজ্ঞানী। প্রথম জন চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী জর্জ ওয়ার্ল্ড বলছেন, – “ডিএনএ টেকনোলজি আমাদের যে সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা শুধু বিজ্ঞানের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর বুকে প্রাণের ইতিহাসেও অভূতপূর্ব। তিনশো কোটি বছরের মধ্যে দিয়ে উৎপাদিত আজকের যে জীব বৈচিত্র্য তাকে ইচ্ছে মতো ভাঙ্গা গড়ার ক্ষমতা মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে এই টেকনোলজি।জীব বৈচিত্র্যের যে প্রাকৃতিক নিয়মে আগে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে যেমন পশুর বা গাছের সংমিশ্রণ, তার সঙ্গে আজকের হস্তক্ষেপ গুলিয়ে ফেললে চলবে না। আগের প্রতিটি কাজের পদ্ধতি ছিল একটি বিশেষ প্রজাতি বা কাছাকাছি দুটো প্রজাতি নিয়ে। এতোদিন আমাদের নৈতিকতা ছিল – প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা যা শিখতে পারি, তার সর্বক্ষেত্রে বিনা বাধায় এগিয়ে যাওয়া। প্রকৃতিকে পুনর্গঠন করার কোন বাজি আমরা খেলিনি। আজকের নতুন ধারণা শুধুমাত্র প্রাগগতার অভাব নয়, এটা বিপজ্জনকও বটে। এটা ক্যানসারের নতুন উৎস, নতুন মহামারীর কারণ হতে পারে। দ্বিতীয় জন ভারতীয়। নাম ড: পুস্প মিত্র ভার্গব।ইনি ছিলেন ভারতের জীব বিজ্ঞান ও জিন প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর সেলুলার আ্যনড মলিকিউলার বায়োলজির অধ্যক্ষ।ইনি কি ভাবে বিপদটা রাখছেন দেখুন, – “কোন জীব প্রযুক্তিতে প্রস্তুত জীব সত্তাকে মুক্ত করে দেওয়া,তা সে ব্যাকটেরিয়া হোক বা উদ্ভিদই হোক – তা একবারেই আলাদা ব্যাপার। তার কারণ হলো,একে একবার মুক্ত করে দিলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। সমস্যাটা সেখানেই। কারখানা চৌহদ্দির মধ্যে জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে একটা ওষুধ তৈরি হলো। ওষুধটা কাজ করলো না। তখন ওষুধটা আর তৈরি হলো না। এখানেই গল্প শেষ। কিন্তু উদ্ভিদের বেলায় তা আর হবে না। আমাদের সামনেই এখন জিএম শস্যের বিপক্ষে অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ এসে গেছে। অনেক সুপরিচিত বিজ্ঞানীদের লেখা এবং অনেক সুবিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িক পত্রে প্রকাশিত এক হাজারের মতো গবেষণা পত্রে জানানো হয়েছে প্রাণীকুলের স্বাস্থ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের উপর, পরিবেশ ও মাটির উর্বরতার উপর জিএম শস্যের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা কিন্তু দেখা যাচ্ছে বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও একশ্রেণীর বৈজ্ঞানিকদের প্রত্যক্ষ্য যোগাযোগ রয়েছে। এদের বাণিজ্যিক বিজ্ঞান সামাজিক বেনিয়মের জন্য দায়ী।এর বিকল্প রয়েছে।” এই দুই জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর বক্তব্যে আমরা স্পষ্টতই বুঝতে পারলাম আগামী কি বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। তাই বিষমুক্ত খাদ্য আন্দোলন সহজ আন্দোলন নয়। এখনো যে কটি দেশি ধান বীজ অবশিষ্ট আছে,জিন শস্যের চাষ বাকিগুলো কেও খতম করবে। শুধু তাই নয়, তাদের তৈরি ‘সবুজ বিপ্লবের বীজ’ও মুছে ফেলবে তারা – এই রকম ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে তারা। সুতরাং এখানেই একটা মঞ্চের উপযোগিতা।আর পত্রিকা হচ্ছে সংগঠনের হাতিয়ার। ধন্যবাদ।