রবিবারের সকাল। ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরে এসে দাঁড়াতেই ব্যোমকেশের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। গম্ভীর মুখে কাগজ ওল্টাচ্ছে।মুখের ভাব গতিক বিশেষ সুবিধার লাগল না।সম্ভবত রাতের দাম্পত্য কলহের ফল।পাশের ঘর থেকে খানিক খানিক কর্নগোচর যে হয় নি তা নয়। কিন্তু সে কথা সম্পূর্ন গোপন রেখে সামনে গিয়ে বসলাম। কাগজের পরিত্যক্ত অংশ হাতে তুলে নিতে নিতে মধুর স্বরে বললাম, “ সুপ্রভাত।” ব্যোমকেশ নড়ে চড়ে বসল কিন্তু কোন উত্তর করল না। বুঝলাম গতিক বিশেষ সুবিধের নয়। পুঁটিরাম চা রেখে গেল। চা পান করতে করতে ব্যোমকেশের এই কঠিন নীরবতা ভাঙার একটা উপায় মনে মনে ভাবছি এমন সময় আবার পুঁটি রামের প্রবেশ। হাতে দু প্লেটে পরোটা আর আলুর দম। সামনে রাখতেই বিরক্তিতে ব্যোমকেশের ভ্রু কুঁচকে উঠল। “ পরোটা ? এহ ! লুচি করতে পারলি না ?” “ এজ্ঞে মা বললেন তেল কম আছে। লুচি হবে না। পরোটা করে নে।” ব্যোমকেশের মুখ ভ্রুকুটি কুটিল হয়ে উঠল। “ সেই তো। জানে আমি পরোটা দু চক্ষ্রে দেখতে পারি না। তবু –” বেশ লাগছিল। ব্যাপারটাকে আর একটু উপভোগ্য করার আশায় ব্যোমকেশের পক্ষে সায় দিলাম। “ যা বলেছ। রবিবারের সকাল লুচি আলুর দম ছাড়া মানায়? তেল কম তো কি হয়েছে আনিয়ে নেওয়া কি যেত না ?” ব্যোমকেশ শ্লেষপূর্ণ চোখে ভিতরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ তাহলে আর আমার অসুবিধে ঘটবে কি করে?” সবে ঘাড় নেড়ে ব্যোমকেশের কথায় সায় দিতে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি সামনেই সত্যবতী। সম্ভবত ঘরের ভিতরে লুকিয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিল। এখন সামনে এসে বলল, “ তো সকালবেলা তেল আনতে দোকানে কে যেত ঠাকুরপো? তোমার বন্ধু ?” বুঝলাম সত্যবতী রেগেছে। আর দেরি না করে দ্রুত হাতে প্লেট সামনে টেনে নিয়ে পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললাম, “ সত্যিই তো। দোকানে কে যেত ? তোমারও বাড়াবাড়ি ব্যোমকেশ। পরোটাই বা খারাপ কি ? ” সম্ভবত এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা ব্যোমকেশ আশা করে নি। তাই সামলাতে সময় লাগল। পরক্ষনেই রোষ কষায়িত চোখে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যেতেই দরজার ঘন্টি বেজে উঠল। যদি কোন মক্কেল হয়! ব্যোমকেশের মুখে আশা নিরাশার যুগপৎ ছবি খেলে গেল। বেচারি! বেশ কিছুদিন যাবৎ মাথা খাটাবার কোন সুযোগ পাচ্ছে না।আর তাতেই আরো বেশি ক্ষেপে আছে। পুঁটিরাম দরজা খুলতে গেল। আমরা পরোটার প্লেট নিয়ে একেবারে রান্নাঘরে উপস্থিত হলাম। খাবার চিবোতে চিবোতে কান খাড়া করল ব্যোমকেশ। তারপর মৃদু স্বরে বলল “ মহিলা। খুব আস্তে কথা বলেন। সম্ভ্রান্ত ঘরের সম্ভবত। দামী সুগন্ধি।” “ তোমার মক্কেল ?” “ তা আমি কি করে জানব? তাড়াতাড়ি পরোটা গেলো। তারপর চল। ” দাঁত খিঁচিয়ে উঠে জবাব দিল ব্যোমকেশ। নিঃশব্দে হজম করলাম। একটু আগের বিশ্বাসঘাতকতার মধুর প্রতিশোধ। পরোটা শেষ করে তিন কাপ চায়ের হুকুম করে বসার ঘরে পৌঁছে যাকে দেখলাম তাকে দেখে কিছুক্ষণ বাক্যস্ফুর্তি হল না। ব্যোমকেশের কথা একেবারে যথার্থ। মহিলা শুধু সুন্দরী নন অত্যন্ত অভিজাত ঘরের। বয়স অনুমান করা অসম্ভব। তবে তিরিশের নিচে নয়। পরনে হালকা সবুজ দামী শাড়ি। গাঢ় সবুজ ব্লাউজ। ধপধপে ফর্সা রঙে চমৎকার মানিয়েছে। ডান হাতে একটি পাথর খচিত বালা। ঔজ্জ্বল্য দেখে হীরে বলে বোধ হয়।বাম হাতে কালো ব্যান্ডের আধুনিক ডিজাইনের ঘড়ি। কানে ওই পাথরেরই দুল। কোলের ওপর শৌখিন হাত ব্যাগ। ব্যোমকেশ দু হাত তুলে নমস্কার জানালো। থতমত অবস্থা কাটিয়ে আমিও। “ আপনিই নিশ্চয়ই ব্যোমকেশ বক্সি ?” অব্যর্থ ভাবে ব্যোমকেশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মহিলা। কণ্ঠস্বরটিও কান পেতে শোনার মত মধুর। “ হ্যাঁ। আমি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সি। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি ?” নির্নিমেষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন মহিলা। সম্ভবত মন স্থির করতে সময় নিচ্ছেন। মনের ভাব বুঝতে ব্যোমকেশের দেরি হল না। “ আপনি নিঃসংকোচে বলতে পারেন। কোন কথা বাইরে প্রকাশ হবে না। ইনি আমার বন্ধু সাহিত্যিক অজিত বন্দোপাধ্যায়।” “ জানি। ওনার লেখা আমি পড়েছি। যাবার সময় একটা অটোগ্রাফ দেবেন প্লিজ।” সলজ্জ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন মহিলা। আনন্দে বুকের ভেতরটা যেন নৃত্য করে উঠল। গর্বোদ্ধত চোখে ব্যোমকেশের দিকে তাকালাম। ব্যোমকেশ যতটা আমাকে পাঠককুলে অপরিচিত মনে করে আসলে যে ততটা নই তা আজ সবার সামনে প্রমাণিত হল। সব চেয়ে মজার কথা হল এই মহিলা যাকে আসলে উত্তর তিরিশের তরুণীই বলা যায় – তিনি ব্যোমকেশের নয় আমার অটোগ্রাফ চেয়েছেন। মনে মনে ভেবে নিলাম। সত্যবতীর সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করে আজ দুপুরের খাবার টেবিলে ব্যোমকেশকে হেনস্থা করব। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। ভদ্রমহিলা কথা শুরু করে দিয়েছেন। “ আসলে আমার ব্যাপারটা এতটাই গোপন এবং বিশ্রী যে কি ভাবে কোথা থেকে শুরু করব সেটা ভাবতেই সময় নিচ্ছি ” “ আপনি প্লিজ সবটা গোড়া থেকে বলবেন। কিছু বাদ দেবেন না।” “ আচ্ছা। তবে প্রথম থেকেই শুরু করি। আমার নাম মহুয়া সেন। বিয়ের আগে আমি মিত্র ছিলাম। পড়তাম বেথুন কলেজে। আমার বাপের বাড়ি শ্যামবাজার। কলকাতার মেয়ে হলেও আমাদের পরিবার অত্যন্ত রক্ষনশীল। হুটহাট বাইরে বেরোনোর বা যেখানে সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যেত না।বাবা, জ্যাঠামশাই দুজনেই অত্যন্ত রাশভারী।যৌথ পরিবার। ভাই বোনেরা সদা সর্বদা তটস্থ থাকতাম। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুরা কত বলত সিনেমা থিয়েটার যেতে। ভয়ে যেতে পারিনি। যদি কারুর চোখে পড়ে যাই। কিন্তু tao—-” “ তাও –” ব্যোমকেশ কথার রেশ টানল। “ তাও একদিন সর্বনাশ হয়ে গেল।” ব্যোমকেশের মুখে মৃদু হাসি। “ প্রেমে পড়লেন ?” গাল দুটো রক্তিম হয়ে উঠল মহুয়ার। “ হ্যাঁ। অনেক কান্নাকাটি করে বায়না করে কলেজ সোশ্যালে যাবার অনুমতি পেয়েছিলাম।সেখানেই দেখা হল রঞ্জনের সঙ্গে। ও স্কটিশে পড়ত। আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র। সেই আলাপ।” এই পর্যন্ত বলে স্তব্ধ হয়ে গেল মহুয়া।নিমীলিত দৃষ্টি। তদগত মন। অনুমান করলাম বিগত দিনগুলো ওর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যোমকেশ নীরব রইল। আবার শুরু করলেন মহুয়া, “ ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রাণশক্তি ছিল। হৈ হৈ করে কথা বলত, হা হা করে হাসত , যে কোন তর্কে প্রতিপক্ষকে সহজেই পরাস্ত করতে পারত।অত্যন্ত সপ্রতিভ।আমি বরাবরই একটু কম কথা বলি আর সদা সর্বদা কড়া শাসনের মধ্যে থাকতে হোত বলে কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবেরও। ফলে রঞ্জনের এই অতি অমায়িক ব্যবহার, সহজে আপন করে নেবার ক্ষমতা, এত প্রাণশক্তি আমাকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করল। আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। যেদিন আমাকে ও প্রস্তাব দিল আমার তখন আর ভেবে দেখার সময় ছিল না। রঞ্জন আমাকে নিয়ে গেল কফি হাউজে। সিনেমায়, নন্দনে। ভিক্টোরিয়ার খোলা মাঠে। জীবনকে যেন নতুন করে চিনলাম। ও থাকত একটা ভাড়া বাড়িতে। ওদের বাড়ি ছিল বারাসাতে। পূর্ব বঙ্গের রিফিউজি ওর পূর্বপুরুষ। আমাকে অনেকবার ওর ভাড়া বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছে আমি যেতে পারিনি। আসলে যতই হোক একজন একা পুরুষ মানুষের ঘরে যেতে সংস্কারে লাগতো। হয়ত বা ভয়ও করত। কিন্তু এমনিতে মেলামেশা চলতে থাকল। আর কিভাবে যেন আমার বাড়ির লোকের কানে পৌঁছল কথাটা। ফলে যা হবার তাই হল। আমার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হল। ফোন কেড়ে নেওয়া হল।নানা ভাবে বোঝানো, মানসিক চাপ ইত্যাদি তো রইলই সঙ্গে জোর কদমে বিয়ের দেখাশোনা শুরু হল। আমার তখন পাগল হবার দশা। দাদার কড়া পাহারায় পরীক্ষা দিতে যাই আর রঞ্জনকে খুঁজি। যে কজন বান্ধবী ছিল তাদেরকে জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পাই না। যাই হোক এভাবে পরীক্ষা শেষ হল।বিয়ের কথা বার্তাও একরকম স্থির। সে যে কী ভীষণ অবস্থা ব্যোমকেশ বাবু বলে বোঝাতে পারব না। ” “বুঝতে পারছি।স্বাভাবিক।” ব্যোমকেশ সহানুভূতির সুরে বলল, “ তারপর কি হল ? দেখা পেলেন তার ?” আমি চকিতে মহুয়ার সিঁথির দিকে তাকালাম। জ্বলজ্বল করছে রক্তিম আভা। “শেষে একদিন দুপুরে সবাই যখন যে যার ঘরে — কয়েকটা জামা কাপড় ব্যাগে পুরে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ঠিকানা আমার জানাই ছিল। একে ওকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে গেলাম ওর বারাসাতের বাড়িতে।” “তারপর? সে বাড়িতে ছিল? দেখা হল?” দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন মহুয়া।শরীরের কম্পন দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিল অতি কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছেন তিনি। একটু পরে মুখ তুলে ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছে বললেন, “ হ্যাঁ ছিল।একা নয়।সঙ্গে একজন সঙ্গিনীও। আমাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল। বাড়ি থেকে চলে এসেছি শুনে যাচ্ছেতাই করতে লাগল। এই মুহূর্তে বিয়ে করার মত ওর অবস্থা নয় সেটাই স্পষ্ট জানিয়ে দিল।আমি তখন — অথৈ সাগরে। যাকে ভরসা করে বাড়ি ছেড়ে এসেছি সে আমাকে ফিরিয়ে দিল। স্পষ্টই বুঝলাম আমার কয়েক দিনের অনুপস্থিতিতে ওর জীবনে অন্য একজন এসে গেছে। এখন আমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচে।একবার ভাবলাম আত্মহত্যা করব।কিন্তু পরে ভাবলাম । না। বাড়ি ফিরে যাই।” “ বাহ্! আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী।” প্রশংসার সুরে বলল ব্যোমকেশ। “ বাড়ি ফিরে এলাম। মনটা যেন অসাড় হয়ে গেছিল। কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না অনেকদিন পর্যন্ত।শেষে একদিন বিয়ের ঠিক হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে চলে গেলাম সল্টলেক।আমার স্বামী সুপুরুষ, সুচাকুরে। বাড়ির একটি সন্তান। আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন।নতুন করে জীবন শুরু করলাম। স্বামীর ভালবাসা আমাকে আবার জীবনের মানে বুঝিয়ে দিল। আমাদের একটি পুত্র সন্তান হল। খুব ভালো ছিলাম। কিন্তু –” ব্যোমকেশ নড়ে চড়ে বসল।মূল ঘটনা এবার শুরু হবে সম্ভবত। “ কিন্তু কি ?” “ আমার অতীত আমাকে তাড়া করল।” “ কি ভাবে ?” “ একদিন হঠাৎ ফোন পেলাম। রঞ্জন। আমাকে দেখা করতে বলল। জানিনা কিভাবে নম্বর জোগাড় করেছে। আমি অস্বীকার করলাম দেখা করতে। তাতে আমাকে ফোনে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। সেদিন আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া যে ওর কত বড় ভুল হয়েছিল – কি ভয়ংকর শাস্তি যে ও পাচ্ছে তা আমাকে না জানানো পর্যন্ত ও শান্তি পাচ্ছে না। একবার সামনা সামনি দেখতে চায়।ক্ষমা চাইতে চায়। ” “ গেলেন দেখা করতে ?” “ হ্যাঁ। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে শেষে না পেরে গেলাম দেখা করতে।একটা কাফে তে যাবার কথা বলেছিল।আমি একটু আগেই পৌঁছে ছিলাম। ও এলো পরে। দেখে আমি আঁতকে উঠলাম।কি বীভৎস হয়ে গেছে ওর ওই সুন্দর মুখখানা! চামড়া ঝুলে আছে। একটা চোখ সাদা। কুৎসিত কদাকার।দেখে শিউরে উঠতে হয়। বলল কি একটা অ্যাকসিডেন্টে এই অবস্থা।” “ তারপর কি বলল?” “ প্রথমদিকে অনেক আফসোস করল। তারপর জানালো ও নাকি কোন কাজকর্ম করতে পারে না।কষ্টে আছে। আমি যদি কিছু টাকা দি—” “ দিলেন ?” “ হ্যাঁ। পাঁচ হাজার।” “ এখানেই শেষ নয় নিশ্চয়ই।এর পর থেকে এই টাকার তাগিদ চলতেই লাগল। তাই না ?” “ হ্যাঁ ব্যোমকেশ বাবু। প্রথম দিকে কাকুতি মিনতি ছিল। পরে সেটা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের পর্যায়ে পৌঁছে গেল। স্পষ্ট বলল যদি আমি টাকা না দিই ও আমার আর ওর সম্পর্কের কথা আমার স্বামীকে জানাবে।ওর হাতে নাকি এমন প্রমান আছে যা দেখলে আমার সুখের ঘর তছনছ হয়ে যাবে।ভয়ে আমার রাতের ঘুম উড়ে গেল। প্রতি মুহূর্তে কাঁটা হয়ে থাকি। আর মাসে মাসে টাকা গুনে যাই।স্বামীকে কিছু বলতে পারি না ভয়ে যদি ভুল বোঝে?” “ কিন্তু বুঝিয়ে বললে তিনি কি বুঝবেন না ?” “ আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ। সৎচরিত্র। কিন্তু ভীষণ গোঁড়া। আমার ধারণা এসব শুনলে আমার সংসার ভেঙে যাবে। তাছাড়া আমার বাবা আমার পরিবার সবার মাথা হেঁট হয়ে যাবে। এদিকে ক্রমাগত টাকা জোগাতে জোগাতে আমি ক্লান্ত। কি যে করব বুঝে উঠতে পারছি না।” হতাশায় আবার দুহাতে মুখ ঢাকলেন মহুয়া।” “ ঠিক কি ধরনের প্রমানের কথা উনি বলছেন আপনি জানেন ?” মাথা নামিয়ে নিলেন মহুয়া। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ একটা ছবি।” “ ক্যামেরায় তোলা ?” “ হ্যাঁ। ওরই ক্যামেরা।কলেজের ফেস্টিভ্যালের সময় একবার এক দুর্বল মুহূর্তে তুলেছিলাম। ইয়ে – মানে – দুজনে ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে তোলা।” মাথা নিচু করলেন মহুয়া। “আপনার কাছে কোন কপি নেই?” “দিয়েছিল।আমি সেটা নষ্ট করে ফেলেছি। ওর কাছে নেগেটিভ টা রয়ে গেছে। এখন সেটা দিয়েই আমাকে ক্রমাগত ব্ল্যাকমেইলিং করে চলেছে। আমার স্বামী যদি এই ছবির কথা জানতে পারেন –” “ পারলেই বা। বন্ধু হিসেবে ছবি তুলেছেন। তুলতেই পারেন।” “ না ব্যোমকেশ বাবু। ওই ছবি দেখলে যে কেউ বুঝবে এ বন্ধুত্বের ছবি নয়। আর আমার স্বামী কোনমতেই মেনে নেবেন না। বাপের বাড়িতেও আমার জায়গা হবে না ” “হুম। বুঝলাম। কিন্তু আপনি আমার কাছে কি সাহায্য চান ?” “ ওই ছবির নেগেটিভ আপনি আমাকে এনে দিন। আপনার যা পারিশ্রমিক লাগে আমি দেব। ব্যোমকেশ বাবু আমি অল্প বয়সে একটা ভুল করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এখন আমার স্বামীকে আমি খুব ভালোবাসি। তাকে আঘাত করতে আমি পারব না। আমার সন্তান রয়েছে। আমাকে বাঁচান ব্যোমকেশবাবু।” উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়লেন মহুয়া। ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল “ ওটা যে সত্যিই ওর কাছে আছে তার কোন প্রমাণ আছে কি ? এমনও তো হতে পারে যে মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছে আপনাকে?” “ না। আছে। আমাকে দেখিয়েছে।ওর বুক পকেটে রেখেছিল।আমাকে দেখিয়েছে।” “ হুম। সেক্ষেত্রে আপনাকে ওর নাম, পুরো ঠিকানা দিয়ে যেতে হবে। আমি চেষ্টা করে দেখব। এই মুহূর্তে কোন কথা দিতে পারছি না। আচ্ছা নমস্কার।” রাইটিং প্যাড এগিয়ে দিলাম। তাতে ঠিকানা লিখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মহুয়া।একবার কাতর দৃষ্টিতে তাকালেন ব্যোমকেশের দিকে। তারপর মাথা নিচু করে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। “ বিকাশকে একবার ফোন কর তো অজিত?” বুঝলাম ব্যোমকেশ কেসটা নিয়ে ভাবছে। সেই কারণেই বিকাশ। সত্যি সত্যিই বিকাশের মত বুদ্ধিমান আর কর্মঠ ছেলে আর বেশি চোখে পড়ে নি। ডায়াল করে ফোন বাজা মাত্র ব্যোমকেশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্নানের উদ্দেশ্যে ভেতরে রওয়ানা দিলাম। পিছনে শুনলাম ব্যোমকেশ বিকাশকে মহুয়ার লিখে দেওয়া ঠিকানা এবং রঞ্জন বাবুর চেহারার বর্ণনা দিচ্ছে। অর্থাৎ ব্যোমকেশের কাজ শুরু হয়ে গেছে। পুরো মাত্রায় সচল হয়ে উঠেছে ওর মস্তিষ্ক। পিছন ফিরে একবার তাকালাম। এই তো সেই ব্যোমকেশ।তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,দৃঢ়বদ্ধ চিবুক আর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের আসল চেহারা। তৃপ্ত মন নিয়ে স্নানে গেলাম।