ফেসবুক ফাঁদ
সলিল চক্রবর্ত্তী
রবিবার বিকালে আমি আর আমার স্ত্রী ড্রইং রুমে বসে কফি খেতেখেতে টিভি দেখছিলাম। টিভিতে তখন ডিসকভারি চ্যানেল ওপেন ছিল। যে দৃশ্যটা দেখছিলাম-
একদল হরিণ লেজ নাড়াতে নাড়াতে নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খেতেখেতে সম্মুখে এগিয়ে চলেছে। কিছুটা দূরে একটা চিতা শিকারের লালসায় লোলুপ দৃষ্টিতে দলটির উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেছে। এমতাবস্থায় একটা হৃষ্ঠপুষ্ঠ হরিণী দলছুট হয়ে পড়ে। এবং চিতাটি তাকেই লক্ষস্থির করে। শুরু হল মরিয়া চেষ্টার দৌড়, একটি প্রাণী আত্মরক্ষার্থে, অপর প্রাণী ক্ষুদা নিবৃত্তে। মিনিট দুই তিনেক দৌড়দৌড়ির পর হাঁপিয়ে ওঠা হরিণীটি এমনি এক স্থানে এসে ঘাতক চিতার কাছে আত্ম সমর্পণ করল, যেখানে দুর্বল অসহায় হরিণীটিকে ঘিরে আছে প্রায় চারশো কেজি ওজনের গোটা দশেক বাইসন। যাদের মধ্যে একটি বাইসন রুখে দাঁড়ালে চিতা পালাবার পথ পাবে না। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। চিতা নির্বাধায় হরিণীর গলার টুটি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাইসন গুলোর মধ্যে থেকে বার করে নিয়ে গেল। স্ব-শক্তি না বোঝা বাইসনগুলো অসহায় ভাবে পাশবিক দৃশ্যটি ফ্যালফ্যাল করে দেখতে থাকল।
ঘটনা এইটুকুই, যেটা জঙ্গলে খাদ্য শৃঙ্খলের সমতা রক্ষার্থে পাশবিক নিয়ম অনুযায়ীই অহরহ ঘটেই থাকে। ঠিক পরদিন সকালে আমি হাঁটতে বেরিয়ে এই সভ্য সমাজে একটা ঘটনা চাক্ষুষ করলাম। ঘটনাটা বলি , পড়ে দেখুন, প্রকৃতির নিয়মে জঙ্গলে ঘটা ঘটনার সাথে মনুষ্য সমাজে কৃত্রিমতায় ঘটা ঘটনার কোনো মিল খুঁজে পান কিনা।
বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলাম মাঠকল স্ট্যান্ড থেকে। উদ্দেশ্য কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগস্থল ছুঁয়ে দুর্গানগরের ঢালাই কারখানা অবদি যাব। আবার ওই রুটেই ব্যাক করব।
যাই হোক, হাই রোডে উঠেই একটা চায়ের দোকান পড়ে, দেখলাম সেখানে কিছু মানুষ চা খাচ্ছে। কাছাকাছি একটা প্রাইভেট কারের সামনে দাঁড়িয়ে বছর পঁচিশের এক ভদ্রমহিলা ফোনে কথা বলছেন। একটু এগুতেই মনে হলো, তিনি ফোনে কাউকে ধরার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেনা। সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, শাড়ি পরিহিতা লাবণ্যময়ী রমণীর কাছাকাছি যেতেই তার সাথে চোখে চোখ পড়ে গেল। এবং আমার মনে হলো রমনী যেন আমার কাছে কিছু জানতে চাইছেন। অচেনা অজানা মহিলা বলে তার ঈশারায় সাড়া না দিয়ে আমি পাশ কাটিয়ে আমার গন্তব্যস্থলের দিকে চলে যাই। মিনিট কুড়ি হেঁটে আমি যখন সেই রুটেই ফিরছি তখন হাইওয়ের একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি অনতিদূরে সেই রমণী বছর তিরিশ পয়ত্রিশের একটি যুবকের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। আমি কাছাকাছি যেতেই যুবকটি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি গৌরাঙ্গনগর জায়গাটা চিনি কিনা। প্রত্যুত্তরে আমি ওই এলাকার লোক নই, ফলে আমার জানা নেই বললাম। আমার কথা শেষ করতেই যুবক বললেন “দেখুনতো এই ভদ্রমহিলা কি বিপদেই না পড়েছেন। ওনার স্বামী এই অচেনা অজানা জায়গায় ওনাকে ছেড়ে চলে গেছেন।” দাম্পত্যকলহ, এর মধ্যে না থাকাই ভালো, কিন্তু একি সারমেও যে রাস্তায় ফেলে যাবে! পাশ কাটাতে পারলাম না। ততক্ষণে ওই রমণী স্বামীর ফোন নাম্বারে ফোন করে যাচ্ছে এবং নিরাশ হচ্ছে।
সাহায্যে এগিয়ে আসা ছেলেটি লোকাল, নাম বাপ্পা। কথাবার্তায় মনে হলো তিনি বর্ষান কম গর্জান বেশি। কারন উনি লোকাল কাউন্সিলারের ডানহাত। রমণীর সাথে সে -ই কথা বলছে। কথপোকথনে আমি যা বুঝলাম সেটিই একটু সাজিয়ে গুছিয়ে বলছি———
অসমের তেজপুর দরং জেলার রাঙাপাড়া নামক অখ্যাত গ্রামে নিন্মবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা রমণীর নাম চামেলি। মাধ্যমিক পাশ, অভাবের সংসারে আর পড়াশোনা হ’য়ে ওঠেনি। কাজ করে চা বাগিচায়। বিশ্বায়নের যুগ, আর্থিক অবস্থা যাইহোক না কেন হাতে দশ বারো হাজার টাকা দামের স্মার্টফোন, চোখে রঙিন স্বপ্ন। ফেসবুকে পরিচয় হয় রাজু নামে এক যুবকের সাথে। বাংলা জানায় চামেলির প্রণয় প্রগাঢ় হতে সময় লাগেনি। কোলকাতার ছেলে রাজু তার কচি মনের রঙিন স্বপ্নকে কথার যাদুতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে তোলে। তারপর একসময় রাজুর দিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব। চামেলি তেজপুর জেলার বাইরে কখনো যাইনি, কোলকাতা তো তার কাছে লণ্ডন। এ যেন স্বপ্নের দেশের রাজ কুমার এসে তার পানিগ্রহণ করতে চাইল।
চামেলি তার মা বাবাকে সবিস্তারে জানাল। বাবা রাজি হলেন না। গরিব মানুষ হতে পারেন কিন্তু তাতে সন্তানের স্নেহ কি কমে? ভিন রাজ্য, তারপর ছেলেটির সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি রাজুকে তাঁদের বাডিতে আসতে বললেন। কিন্তু চামেলির বাবার প্রস্তাব শুনে রাজু চামেলিকে বোঝাল, প্রেম যদি সামাজিকতায় মোড় নেয় তবে সেটা আর বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। আমরা বাঙালি, তোমরা অসমিয়া, তোমার পরিবার রাজি হলেও,আমার পরিবার রাজি না হতেও পারে। তাই বলে কি আমরা আমাদের ভালবাসাকে গলা টিপে মারবো। রাজুর কথা গুলো চামেলির কাছে বেদবাক্য মনে হলো। সে বিয়ের ব্যাপারে রাজুর সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করবে মনস্থির করল। এবং রাজু তৎক্ষনাৎ সুযোগের সদ্ব্যাবহার করল।
এক সপ্তাহের মধ্যে রাজু তেজপুর গিয়ে ডেরা বাঁধল। সেই প্রথম দুজনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হল। চামেলি তো প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ। বাবার উপদেশ তখন চামেলির কাছে গুরুত্বহীন মনে হল। সবকিছু ছেড়ে রাজুর হাত ধরে সে নুতন জীবন গড়তে রাজি। রাজু চামেলিকে বোঝাল কাজে যাওয়ার নাম করে যতটুকু সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে চলে আসতে। তারপর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সোজা কোলকাতা।
ট্রেনে বসে ঝালমুড়ি খেতেখেতে চামেলি রাজুর কাছে জানতে চাইল, বিয়ে বাড়িতে গিয়ে করবে না মন্দির থেকে করে বাড়িতে গিয়ে উঠবে? রাজু বলল, “বিয়েটা অসমের গ্রামে যতটা সামাজিক কোলকাতায় ততটা নয়। মা’কে বোঝাতে পারছি না, তুমি অসমিয়া বলে মা কিছুতেই তোমাকে ঘরে তুলতে চাইছে না। তবে তুমি টেনশন কোরনা, আমার কাছে একদিকে সমস্ত পৃথিবী আর অন্যদিকে শুধু তুমি। বন্ধুদের বলে রেখেছি, ওরা ঘর ভাড়া করে রাখবে আমরা সেখানেই গিয়ে উঠব।” চামেলি মনেমনে ভাবল, সে কোনো ভুল করেনি। ঈশ্বরের অপার কৃপায় এমন শিবের মত সঙ্গী পেয়েছে।
কোলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউনে একটা সাজানো গোছানো ফ্লাটে এসে উঠল রাজু আর চামেলি। ফ্লাট দেখে তো চামেলির মাথা ঘুরে যায় আর কি, তার চোখে বাড়ি’ত নয় যেন প্রাসাদ। হোটেল থেকে খাবার এনে খাওয়া-দাওয়া সারল। খেতেখেতে চামেলি রাজুর সাথে বিয়ের ব্যাপারটা উত্থাপন করল। রাজু বলল-” দেখ বিয়ে মানুষের একবারই হয়। এই ভাবে মন্দিরে নমনম করে বিয়ে না করে মা’কে বোঝাই, মা’কে বোঝাতে পারলে ঘটা করেই বিয়ে হবে, ততদিন এখানেই থাকি।” চামেলি অবাক হয়ে বলল-” সেকি, লোকে কি বলবে?” রাজু হেঁসে বলল-” এখানে কারোর ব্যাপারে কেউই মাথা ঘামায় না। এটা আইনসিদ্ধ, একে বলে লিভ টুগেদার।”
এই ভাবে দম্পতি না হয়েও দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে সপ্তা দুয়েক কাটিয়ে দিল। রাজু বলেছিল ব্যাবসা করে, কিন্তু চামেলি রাজুর কাজ কর্মের কোনো লক্ষ্মণ দেখতে পায় না। মধ্যে এক শুক্রবারে এমন ভাবে সেজেগুজে বার হচ্ছে যেন নমাজপাঠ করতে যাচ্ছে। চামেলির কেমন একটা খটকা লাগল, সে জানতে চাইল কোথায় যাচ্ছে। রাজু প্রশ্ন শুনে এই প্রথম রেগেমেগে বলল-” পুরুষ মানুষ কখন কোথায় যাবে সব কি বাড়ির মেয়েছেলেদের বলে যেতে হবে না-কি?”
চামেলির মনে খটকাটা ক্রমশ ঘনীভুত হতে থাকল। মনে হলো এই দু’সপ্তাহে বন্ধু বান্ধব যাদের দেখেছে তারা কেমন যেন সন্দেহজনক। একটু বেরিয়ে যে খোঁজখবর নেবে, কিন্তু কিছুই তো জানেনা চেনেনা। নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল। মা বাবাকে যে একটু ফোন করে মনটাকে হালকা করবে সে মুখও নেই। কখন তার ডানহাতটা কপাল ছুঁয়েছে সে টেরই পেলনা।
মধ্যে একদিন রাত্রে হোটেল থেকে আনা খাবার খেতেখেতে রাজু জানাল পরের দিন রাতে ডানকুনিতে এক বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ। রাজু’র মুড ভালো আছে বুঝে চামেলি জিজ্ঞাসা করল-” আচ্ছা তোমার সম্পূর্ন নামটা কি?” রাজু এমন একটা আনএসপেক্টেড প্রশ্ন শুনে একটু থতমত খেয়ে বলল “রাজু মল্লিক। “
পরদিন রাজু নিজের মোটরসাইকেলে চামেলিকে নিয়ে ডানকুনি বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছুল। তিন- চার জন বন্ধু তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলো। চামেলির মনে কেমন যেন এক অজানা আতঙ্কের সৃষ্টি হলো। রাজুর উপর থেকে ক্রমশ বিশ্বাসটা ফিকে হতে থাকল। আতঙ্ক এই ভেবে হচ্ছে যে, রক্ষকই যদি ভক্ষক হয় তবে তার পরিণতি কি হবে? অগত্যা তাদের সাথে গিয়ে উঠল পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের চারতলার এক ফ্লাটে। ফ্ল্যাটে ঢুকে অজানা আতঙ্কে চামেলির শরীরে শিহরণ খেলে গেল। সেখানে চার-পাঁচ জন পুরুষ ছাড়া একজনও মহিলা নেই। রাজু বন্ধুদের কাছে জানতে চাইল রাতের ফুর্তির আয়োজন কি। একজন বলল ” বিফ,বিরিয়ানি আর—-।” সকলে হাঁসতে হাঁসতে দারুন দারুন বলে সমর্থন জানাল। চামেলি ওসব দিকে কান না দিয়ে একমনে কামাখ্যা মা’কে ডাকতে থাকল। নিজের জীবনদিয়ে বুঝল কেন মা-বাবার কথা শুনতে হয়। সন্তানের ভাল একমাত্র বাবা-মা ই বোঝে। একমাত্র পথ বাবাকে ফোন করা, কিন্তু এই মুহূর্তে সুদূর অসম থেকে এসে ভগবানেরও সাধ্যি নেই তাকে উদ্ধার করা। অগত্যা বুদ্ধি খাটিয়ে প্রচণ্ড গ্যাস হয়ে গেছে বলে দু’বার পটিতে গেল। কিছুটা সময় ব্যয় করে জোরে জোরে বমির আওয়াজ করল। তার মধ্যে কামাখ্যা মা’কে ডাকতে ভুলছেনা। এমতাবস্থায় ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা মহিলা কন্ঠ শুনতে পেল। চামেলি একটু অভিনয় করে টলমল অবস্থায় বাথরুম থেকে বার হল। এক প্রৌড়া তাড়াতাড়ি এসে চামেলিকে ধরল। একজন যুবক বলল-” নানি তোমার বিছানায় শুইয়ে দাও, একটু ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।” অসুস্থতার দোহাই দিয়ে চামেলি ঘাপটি দিয়ে শুয়ে থাকল। এবং তার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল এটি একটি মুসলিম বাড়ি। এরই মধ্যে রাজুকে বলতে শুনল “গ্যাস হওয়ার আর সময় পেলনা।” চোখ বন্ধ অবস্থায় চামেলি কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে জানেনা।
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে,রাজু’র ডাকে। উঠে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়েই নিউটাউনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। দিল্লিরোড ক্রশ করে যখন বালি ব্রিজে উঠল, চামেলি মা গঙ্গাকে একটা প্রণাম করে রাজুকে বলল-” আমি দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মা’কে পুজো দিয়ে বাড়ি যাব।” শুনে রাজু খুব রেগেমেগে বলল -” অত পুতুল পুজো করার কি আছে, চল বাড়ি চল।” সমস্ত পথে রাজু একটি কথাও বলেনি। এখন যে কথাটি বলল, তাতে রাজু যে মুসলিম তা পরিষ্কার। জাতের নামে বজ্জাতি করে স্বীকার করতে খুব কষ্ট হচ্ছে! দক্ষিণেশ্বর স্কাই ওয়াকের মুখটায় ওদের মোটরসাইকেল একটু শ্লো হতেই চামেলি পূজা দেওয়ার জন্য জেদ করে নেমে পড়ে। ঠিক তখনই রাজু চামেলিকে কিছু স্লাং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে ওকে না নিয়ে বাইক চালিয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এয়ারপোর্টের দিকে চলে যায়। অচেনা অজানা জায়গায় চামেলির পূজা তখন মাথায় থাক, সামনে নিশ্চয়ই বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ভেবে গুটিগুটি পায়ে সম্মুখের দিকে এগুতে থাকল।
দক্ষিণেশ্বর থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টাখানিক অতিক্রান্ত করে সাতটা নাগাদ ঢালাই কারখানার কাছে এসে চামেলি ভয় পেয়ে গেল। তার ধারনা ছিল হাঁটতে হাঁটতে নিউটাউন গৌরাঙ্গ নগর পৌঁছে যাবে, কিন্তু যখন দেখল রাস্তা শেষ হচ্ছে না তখন পথ চলতি বাপ্পার সাহায্য প্রার্থী হল।
চামেলির স্মার্টফোনটা দিয়ে বাপ্পা আর চামেলি পালা করে রাজুকে ধরার চেষ্টা করে চলেছে। চামেলি হঠাৎ অসমিয়া ভাষায় ফোনে কথা বলতে শুরু করল। আমরা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে না পারলেও কিছুটা অনুমান করতে পারছিলাম। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমি কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। কথা শেষ করে চামেলি বাপ্পার হাতে ফোনটা দিয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল-” বাড়িতে এতদিন আমাকে খোঁজাখুঁজি করছিল, ফোন করায় ওরা খুব ভেঙে পড়েছে। মা খুব কান্নাকাটি করছে। বাবা বলল দক্ষিণেশ্বরে দাঁড়াতে উনি আসছেন।” কথাটা মুখে বলা যত সোজা কাজে যে ততটা নয় চামেলি তা বুঝতে পারছে না। বাপ্পা পকেট থেকে পনেরো টাকা বার করে চামেলিকে দিয়ে বলল-” যাও তাহলে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে দাড়াও।”
আমি বাপ্পার কথায় বুঝলাম সে নিজের সম্পর্কে যতই ঢাক পেটাকনা কেন এখন সে এই পরিস্থিতির থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি একা কিছু করতে পারবনা বুঝে ওকে বললাম-“আপনি যেটা বলছেন সেই মত চললে মেয়েটি বিপদে পড়বে। আপনি বরং আপনার কাউন্সিলারের কাছে নিয়ে যান, তিনি পুলিশের হাতে তুলে দেবেন, পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবে।” বাপ্পা দায়িত্ব এড়াতে আমার উপর একটু ক্ষুব্ধ হয়েই বলল-” আরে না না ওসব পুলিশি ঝামেলা অনেক,তারপর——-( চামেলির স্মার্টফোনে রিং হচ্ছিল,অপর প্রান্ত থেকে ‘হ্যালো’ বলতেই বাপ্পাএকটু উত্তেজিত হযে বলল)– “হ্যালো, হ্যাঁ, আরে মশাই স্বামী স্ত্রী-তে ঝগড়াঝাঁটি হতেই পারে, তাই বলে কুকুর বিড়ালের মতো রাস্তায় ফেলে চলে যাবেন? অপর প্রান্ত থেকে পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে এল, “কুকুর বিড়ালের মতো ও রাস্তায় পড়ে মরুক।” বাপ্পা বলল,” তাইত হয়েছে, আপনার স্ত্রী অচেনা অজানা জায়গায় ভয় পেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে, আমরা মোবাইল পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি।” অপর প্রান্ত থেকে খিস্তিখেউড় করে, “আরে যান যান পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে, পুলিশ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।” কথাটা শেষ করেই ফোন ডিসকানেক্ট করে দিল। বাপ্পা চামেলির হাতে ফোনটা ফেরত দিয়ে বলল-” এই জানোয়ারকে বিশ্বাস করে ঘর ছেড়েছ, যাও এখন দক্ষিণেশ্বর গিয়ে দাঁড়াও।” চামেলি অশ্রুসিক্ত লোচনে আমারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একা আমিও অসহায়, বাপ্পার পিঠ বাঁচানো সিচুয়েশনটা, কলকাতা শহরে স্বাভাবিক ঘটনা, অহেতুক পুলিশের ঝামেলা কে ঘাড়ে নিতে চায়! আমিও দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো পকেটে মাত্র একশো টাকা আছে দেখে সেটা চামেলির হাতে দিয়ে বললাম, দক্ষিণেশ্বর গিয়ে না দাঁড়িয়ে থেকে সামনেই পুলিশ কিয়ক্স পাবে, তাদেরকে সব বলবে, ওরা আইনানুগ ব্যবস্থা করবে। দুপুরে এই টাকায় কিছু খেয়ে নিয়ো। অকস্মাৎ চামেলি রাস্তার বিপরিতগামী পথের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল-” ওই যে ও বাইক চালিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দিকে চলে গেল।” আমি জানতে চাইলাম তাকে দেখতে পেয়েছে কিনা, ও বলল সম্ভবত পেয়েছে। এই পর্যন্ত আমার যেটা মনে হল– বাপ্পা ফোন করে চামেলিকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলতে রাজু ভাবল, যদি সত্যিই সেটাই করে তবে পুলিশের হাত থেকে সে রেহাই পাবে না। বরং চামেলিকে ফিরিয়ে আনলে এই মুহূর্তে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যাবে। ফলে রাজু বিপরিতগামী পথে ফিরল, যদি পুলিশ থাকে তাহলে পালাবে,না থাকলে প্ল্যান অনুযায়ী এখানে আসবে। এখন শুধু আসার অপেক্ষায় সময় গোনা। চামেলিকে বললাম, রাজুর সাথে ফিরে যাও তবে এখানে যা কথাবার্তা হল তা খুব প্রয়োজন নাহলে বলবেনা। তুমি নিজেই যেন অন্যায় করেছ এটা রাজুকে বুঝতে দেবে, মুসলিম বলে কোন কিছু বলতে যাবে না, ভাব খানা এমন করবে ওটা যেন কোনো ব্যাপারই নয়। গোপনে বাবার সাথে যোগাযোগ রাখবে, তাঁরা পুলিশের সাহায্যে তোমাকে উদ্ধার করবে। আর হ্যাঁ, তোমার বাবার ফোন নাম্বারটা আমাকে দাও-তো? চামেলি সবেমাত্র নাম্বারটা বার করছিল এরইমধ্যে রাজু মোটরসাইকেলে স্ব-শরীরে হাজির। রাজু আমার আর বাপ্পার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন নিউটাউনে পেলে খুনকরে ফেলত। রাজু’র অগোছালো দাড়িটাই প্রকাশ করছিল সে মুসলিম। প্রেমে অন্ধ অভাগী চামেলি তা টেরও পায়নি।
একটা ছোট্ট ভুলের কারণে গোটা জীবনটাকে খেসারত দিতে হবে। হয়ত, এখন নিউটাউন ফিরে গিয়ে হবে চুড়ান্ত শারীরিক নির্যাতন, পরিশেষে পতিতালয়ের পার্মানেন্টলি কলগার্ল। আত্ম চিন্তিত আমরা দুজন শিকারকে তুলে দিলাম আবার শিকারির হাতে।
#####///////////////#####