সেপ্টেম্বর 1923 : পেনেটির বাড়ীটার দুইদিক ঘেরা টানা বারান্দা। লালমেঝে দুধারে মোটা সবুজ বর্ডার। সেই বর্ডারের ওপর দিয়ে একদল ডেঁয়ো পিপড়ে সদলবলে মার্চপাস্ট করে চলেছে। একটি বছর আড়াই এর বালক গালে হাত দিয়ে তন্ময় হয়ে তা বসে বসে দেখছে। এবাড়ীর হাওয়া এখন শান্ত, স্তিমিত। বালকটির পিতা খুবই অসুস্হ, প্রায় মরণাপন্ন। হাওয়া বদলের জন্য ডাঃ ললিতমোহন ব্যানার্জি এই বাগানবাড়ীতে কদিন এসে থাকার জন্য নিদান দিয়েছেন। গঙ্গার ধারে খোলা আলোবাতাসে রোগীকে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নিলে যদি কিছু উপকার হয়। রোগটি কালান্তক ! ব্ল্যাক ফিভার এর কোনও সঠিক চিকিৎসা এখনো আসেনি এদেশে। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী নামেরএক ব্রাহ্ম যুবক সম্প্রতি চিকিৎসাবিজ্ঞানে বেশ নাম করেছে। সমস্ত পরিকাঠামোগত অসুবিধার মধ্যেই সে নিজের বাড়ীতে ল্যাবরেটরী বানিয়ে এ রোগের ঔষধ আবিষ্কারে আত্মনিয়োগ করেছে।
আজ সকাল থেকে জ্বরটা আসেনি। মুখে কোনও রুচি নেই যদিও। ভৃত্য প্রয়াগ এসে মুসম্বির রস রেখে যায় টেবিলে। ক্ষীণস্বরে একবার খোকা কে দেখতে চায় রোগজর্জর পিতাটি। অসুখের কারণে বালকটিকে রোগীর ঘরে আসতে দেওয়া হচ্ছে না ! কিন্তু সুযোগ পেলেই সে এঘরে চলে আসতে চায়। তার বাবা মানুষটি তার প্রিয়। কদিন আগেও চোখপাকিয়ে, মুখ বেঁকিয়ে আজব ছড়া আর গল্প শোনাত। সবটা তার মনে নেই তবে ‘পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা’ র ছড়াটা শুনলে সে মজা পায় খুব। বাড়ীর বড়রা তাদের বড়দাকে প্রায়ই বলে যে ‘ তোমার ঘরে এই পান্ত ভূতের বদলে এমন ফুটফুটে মানিক এল কি করে?’ তাই শুনে হো হো হো করে সেই উদ্বাত্ত হাসিটি এখন বন্ধ ! রোগশয্যায় তার কন্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্রমশঃ ক্ষীণতর হচ্ছে। দূরে গঙ্গায় পালতোলা একটি নৌকা ভেসে যাচ্ছে। খোকাকে তাই দেখাতে দেখাতে হঠাৎ মাথা ঘুরে বসে পড়েন বিছানায়। তাঁর ছড়ার সেই আজব আবোলতাবোল বইটি এখনো প্রেসে। নিজের হাতে তার প্রুফ কি আর দেখা হয়ে উঠবে ? বিলেতের ফোটোগ্রাফি সংস্হার শংসাপত্রটি কদিন আগেই ডাকে এসেছে মেম্বারশিপ সহ ! কতকাজ বাকী রয়ে আছে এখনো। সবথেকে বড় কাজ খোকার বড় হয়ে ওঠার সাক্ষী হওয়া। মাথার ভিতর আঁধার ঘনিয়ে আসে। গানের পালা সাঙ্গ করে বোধহয় ঘুমের ঘোর ছেয়ে ফেলছে ক্রমশঃ।
——————– মার্চ, 1992
টলমল পায়ে একমুখ হাসি নিয়ে সে ঘরে ঢোকে। ঘরের মধ্যেই মিনি নার্সিংহোম যেন। বিছানায় তার ঠাকুরদা হাতছানি দিয়ে ডাকেন। দীর্ঘদেহী মানুষটি জীবনের উপান্তে এসেও ছোট বড় বহুবিধ পুরস্কারে একজন জাতীয় সম্পদ। তাঁর প্রতিভার অমলদ্যূতিতে বিস্মিত সারা পৃথিবী। তবু তাঁর শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার এই শিশু পৌত্রটিকে দেখলে মন ভাল হয়ে যায় তাঁর। হৃৎযন্ত্রের জটিল অস্ত্রোপচার সেরে সবে মাত্র বিদেশ থেকে ফিরেছেন তিনি। শরীরটা বশে নেই। শেষরাতে বুকের ব্যথাটা ফিরে আসে। ক’বছর আগেও শিস্ বাজিয়ে একটা গোটা কনচের্তো বাজিয়ে দিতে পারতেন ! এখন আর সেই ক্ষমতা নেই। একটি নতুন কাহিনী মাথায় ঘুরছে। একটু উঠে বসতে পারলেই হাত দেবেন। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্হার নীচের অন্ধকার তাঁকে ভাবাচ্ছে। তাঁর সমস্ত সৃষ্টিই জীবনবোধ সঞ্জাতই।
আজ বেশ সুস্হ বোধ করছেন তিনি। পৌত্রটিকে ঘরে ডাকালেন তিনি। সবে আড়াই বছরের পৌত্রটির হাসিতে একরাশ সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে। তবু মনটা একটু বিষণ্ণ লাগে তাঁর। কতকাজ যে বাকী রয়ে গেল। সবচেয়ে বড়কাজ পৌত্রটিকে বড় হয়ে উঠতে দেখা ! সে সময় কি তিনি আর পাবেন !
সামনের জানলার বাইরে কলকোলাহলময় কল্লোলিনী প্রবাহিত। তবু তিনি দেখতে পান খোলা গঙ্গা, সেই পেনেটির মতোই। একখানি পালতোলা নৌকা ভেসে চলেছে অনন্ত পথের উজানে। পৌত্রটিকে যদি তা দেখানো যেত। আফশোষ রয়েই যায় শুধু !