ওয়াইফাইটা অন করতেই হুড়হুড় করে মেসেজ ঢুকতে শুরু করল হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে। চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে আড়চোখে একবার অরূপের দিকে চাইল নন্দিতা। টোস্ট অমলেট চিবোতে চিবোতে একমনে খবরের কাগজ দেখছে ও। কোনদিকে হুঁশ নেই আর । অবশ্য থাকেই বা কবে ? অফিস আর কাজ। এই তো ওর জীবন। সকালে বেরোবার আগে এক পলক কাগজে চোখ বুলোতে বুলোতে ব্রেকফাস্ট শেষ করা। তারপর সারাদিনের মত বেরিয়ে যাওয়া। ফিরতে সেই রাত। কর্পোরেট রাজ্যের মানুষ। সারাক্ষণ নজর শুধু ওপরে ওঠার সিঁড়িতে। কিভাবে কাকে পেছনে ফেলে আগে এগিয়ে যাওয়া যায় তারই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়েছে ও অন্য সবার মতই। সেখানে এতটুকু গাফিলতি মানেই নিজের কেরিয়ারের ক্ষতি। টুক করে কেউ পাশ কাটিয়ে ওপরের ধাপে পা দিয়ে ফেলবে। আর প্রাণ থাকতে সেটা হতে দেবে না অরূপ। এই যে কাগজ দেখা এর পেছনেও সেই নিজেরই স্বার্থ। কর্পোরেট দুনিয়ার হাল হকিকৎ কিছুটা হলেও নিজের আয়ত্বে রাখা। অন্য কোন খবর পড়ে না ও। এত যে রাজনীতির উথাল পাথাল , চতুর্দিকে এত সমস্যা এসবের দিকে বিন্দু মাত্রও উৎসাহ নেই ওর। নিজের জগতে নিজেই বুঁদ। সেখানে ওর ফোনের তুচ্ছ এই মেসেজের আওয়াজ যে ওর ওই পেশাদারী কানে পৌঁছবে না তা জানে নন্দিতা। তবু অকারনেই ধক ধক করে ওঠে বুকের ভেতরটা। যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে অরূপ , “ কার এত মেসেজ আসছে ? কে ? দেখি ?” না। কোনদিনই সেরকম হয় নি। হবেও না। জানে নন্দিতা। অত সময় বিয়ে করা বউয়ের জন্য রাখে না অরূপ দত্ত। তবু কেমন একটা ভয় মাঝে মাঝে তাড়া করে ওঠে ওকে। মেসেজ ঢুকলেই ঢেঁকির পাড় পড়ে যেন বুকের মধ্যে। আসলে লুকিয়ে কিছু করেনি তো এতদিন ! হয়ত সেই কারণেই এই আশঙ্কা। মানুষ আর যাই পারুক নিজের মনকে তো আর এড়াতে পারেনা। আজকাল ওর আর অরূপের মাঝে সব সময়ই এক অদ্ভুত গোপনীয়তা খেলা করে। অরূপ ওকে সন্দেহ করে না। অত সময়ও ওর নেই। তবু যদি কখনো জানতে পারে ? এইখানে এসেই থমকায় নন্দিতা। কি হবে জানলে ? খুব রেগে যাবে অরূপ ? কি জানি ? সন্দেহ আছে । সেই টান আজও কি আছে অরূপের ? মনে তো হয় না। কিন্তু যেটা আছে সেটা হল পুরুষের অধিকার বোধ। প্রবল মাত্রায় আছে। সেখানে আঘাত পড়লে যে ওকে ছেড়ে কথা বলবে না অরূপ সে বিষয়ে নিশ্চিত নন্দিতা। হয়ত সেখান থেকেই এই আশঙ্কা। এই ভয়। লুকিয়ে রাখার এই প্রবণতা। কিন্তু কি অপরিসীম নিঃসঙ্গতার মধ্যে যে এতকাল বাস করে এলো নন্দিতা তার বিন্দুমাত্র খবর কি অরূপ রাখে ? রাখে না। ও মনে করে শাড়ি , গয়না আর টাকাই বোধ হয় মেয়েদের সুখের মাপকাঠি। আর সেখানে তো খামতি রাখেনি ও। অনেক বার বোঝাতে চেষ্টা করেছে নন্দিতা। “ কি হবে অরূপ মিছিমিছি টাকার পিছনে ছুটে ? যা আছে যতটুকু আছে এতেই তো আমি খুশি ।তোমাকে কাছে না পেলে শুধু গয়না, টাকা নিয়ে আমি কি করব ? কি হবে এত বেশি টাকা নিয়ে ?” উত্তরে হা হা করে হেসে উঠেছে দুঁদে কর্পোরেট অফিসার অরূপ দত্ত। “ কি যে বল ডার্লিং ! টাকা কি কখনো বেশি হয় ? মানি মানি মানি ব্রাইটার দ্যান সানশাইন সুইটার দ্যান হানি। এ যে আপ্ত বাক্য। শোন নি ?” শোনেনি নন্দিতা। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। মধ্য চিত্তও বটে। শুধু দেখেছে। টাকার নেশায় কিভাবে কতদূরে সরে গেছে অরূপ। আর একাকীত্বের ভার বইতে বইতে — হ্যাঁ। একাকীত্ব ই তো ! তাই তো এমনটা হল ! না হলে যা জীবনে করে নি তেমন কাজ করবে কেন নন্দিতা। আর করার পর ভুগবেই বা কেন এই তীব্র অবসাদে। দুরন্ত অপরাধবোধে ! খুঁজবে কেন পালাবার রাস্তা ? একদিন যা ছিল অমোঘ আকর্ষণ ! আজ সেই মোহ জাল ছিন্ন করার জন্য এমন ব্যকুল হবে কেন প্রাণ ! একদিকে তীব্র আকর্ষণ অন্যদিকে সমাজ সংসার আর সর্বোপরি নিজের মনের অপ্রতিরোধ্য বাধা ! সব মিলিয়ে যেন এক সোনার খাঁচায় আটকে পড়েছে ও। প্রাণ বলে মুক্তি নিলে জীবন বিবর্ণ, অর্থহীন। আর বিবেক বলে শুধু নিজের সুখের জন্য এমন অন্যায় ! দুইয়ের দোলাচলে ক্লান্ত বিপর্যস্ত নন্দিতা আবারও একবার হার মানে মনের কাছে। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে ফোনে চোখ রাখে ও। আজও আবার একরাশ মেসেজ করেছে আনন্দ। সেই অভিমানে ছলছল , দুরন্ত আবেগমাখা একই রকমের মেসেজ ! কদিন ধরে ক্রমাগত এই করে চলেছে ও। কোন বারণ, কোন নিষেধ কানে তুলছে না। জানে নন্দিতা ওগুলো পড়লেই আবার একই ভাবে আগের মতই দুর্বল হয়ে পড়বে ও। কোন মতেই পারবে না এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু আর না। থামতেই হবে এবার। আবার একবার তাকালো ও। আনন্দর নামের পাশে সবুজ আলোটা জ্বলছে। আর একটুও দেরী না করে টুক করে নেটটা বন্ধ করে দিল ও। ওকে অ্যাক্টিভ দেখলে আরো লিখতে থাকবে আনন্দ। তার চেয়ে বন্ধ থাক। কষ্ট পাবে? পাক। অবুঝ হলে কষ্ট তো পেতেই হবে। কিচ্ছু করার নেই। সব জানে। দুদিন আগেই সব কথা হয়ে গেছে। বলে দিয়েছে নন্দিতা। এ হবার নয়। তাও সেই একই ভাবে বারে বারে মেসেজ— ! কিছু বুঝতে চায় না । মানতে চায় না সত্যিটা । সেই কবিতার লাইন তুলে তুলে লিখে পাঠানো— সেই ছেলেমানুষী ! সেই একই রকম পাগলামি ! আবার একবার থমকে যায় নন্দিতা। আজ এমন ভাবছে অথচ এটা সত্যি যে একসময় এগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকতো ও। থরথর আবেগে কাঁপতে কাঁপতে এক আশ্চর্য সুখের সাগরে ভাসতো। কিন্তু এখন যেন আর যেন সহ্য করতে পারছে না ও। জ্বলে যায় সারা শরীর। দিশাহারা লাগে। কি করবে ? ব্লক করে দেবে ? এক সেকেন্ডের ব্যাপার। কিন্তু সেটাই বা পারছে কই ? ভাবতেই যে বুকের ভেতর তোলপাড় ! ভুলবে কি করে ছেলেটাকে ? এই দুটো মাস কি ভোলা যায় ? সে যে এক স্বপ্নের ঘোর ! এক রূপকথার জগৎ ! যেখানে বাস করতে করতে বাস্তব পৃথিবীটাই ভুলতে বসেছিল ও। বিস্মৃত হয়েছিল নিজের আসল অস্তিত্ব ! একটা দমকা পাগল হওয়া ? নাকি এক উন্মত্ত ঝড়ের আবেগ ? কি এতদিন ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল ওকে ? যা থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে বারবার বেসামাল হতে হয়েছে। এমনকি আজও সব বলা কওয়ার পরে পরেও , সব বুঝেও কি নিজেকে দমন করতে পারছে নন্দিতা ? পারছে না তো। পারলে এমন হোত না। বার বার খুলে দেখতে ইচ্ছে হোত না কি লিখেছে ও ? কি করছে ও ? কেমন আছে ও ? দোষ কি শুধু ওর ? নন্দিতা নিজে কেন পারছে না মনকে বশে রাখতে ? যা হয় না , হতে নেই তা জেনেও কেন বারবার বাঁধন ছিঁড়তে চায় মন ? আর সত্যি বলতে কি ভুলটা তো মূলত ওরই। কেন যে মরতে সেদিন মেসেজ করে বসল একজন অচেনা অজানা মানুষকে ! যা কখনো করেনি ও। কত ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, কত মেসেজ রিকোয়েস্ট ! রূপের স্তাবকতা — কোন কিছুই তো কখনো টলাতে পারেনি ওকে। অথচ সেদিন লেখাটা পড়ে নিজেকে কেন যে আর ধরে রাখতে পারল না ? আসলে এত ভালো লেখে ছেলেটা ! গল্পটা পড়ে জাস্ট স্পিচলেস হয়ে গেছিল ও। কমেন্ট করেও যেন মন ভরছিল না। মনে হচ্ছিল এমন যে লেখে তার সাথে দুটো কথা না বললে জীবনই বৃথা। আর সেই জন্যেই আগুপিছু না ভেবে দুম করে মেসেজ করে বসলো ইনবক্সে । আর ওটাই কাল হল। যদি বুঝত আগে । কিন্তু বুঝবেই বা কি করে ? প্রোফাইলে ছবি নেই। শুধু “আমার আমি” । কোন মানে হয় ! এটা একটা নাম হল ? আরে সবাই তো “ আমি “। নিজের নাম আর ছবি দিতে কি যে সমস্যা এদের ? আর দেয় না বলেই তো এত সমস্যা ! কে জানত ! এমন একখানা পরিণত লেখা ওইটুকু ছেলের হাত থেকে বেরিয়েছে ! এ তো অকল্পনীয় ! মেসেজ রিকোয়েস্ট করার সাথে সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে উত্তর। নন্দিতারও প্রতি উত্তর। ব্যস । সেই শুরু। প্রথম দিকে শুধু ‘সুপ্রভাত’ বা ‘শুভরাত্রি’ । তারপর কি যেন হয়ে গেল। কোথা থেকে এত কথা এসে জমা হতে লাগল আঙ্গুলের ডগায় — নিজেই ভেবে কুল পাচ্ছিল না নন্দিতা। এমন অনুভূতি , এত ভাষাও সুপ্ত ছিল ওর বুকের ভেতর ? কই টের পায়নি তো এতদিন ! যখন বুঝল কিরকম একটা নেশা ধরে গেল যেন ! সারাদিন এমনি করে একজনের প্রতীক্ষা করা ! কখন দুপুর হবে ? ছেলে, বর যে যার মত বেরিয়ে যাবে আর ও সব কাজের শেষে এসে মেসেঞ্জার খুলবে। দুরুদুরু বুকে মেসেজ পড়বে আর ভাসবে এক অনাস্বাদিত পুলকে ,এক অজানা সুখের সাগরে ! কি আশ্চর্য রকম লেখা লিখতে পারে ছেলেটা ! দুলিয়ে দিচ্ছে ! নাড়িয়ে দিচ্ছে ! একেবারে উপড়ে নিয়ে আসছে নন্দিতাকে নিজের শিকড় থেকে ! এই বয়সে এসে এমন দোলাচল ! এ তো অন্যায় ! প্রতি মুহূর্তে মনে হোত ও কি ঠকাচ্ছে অরূপকে ? এইভাবে লুকিয়ে অপর একজন অপরিচিত মানুষের সাথে ভাব বিনিময় ! এ কি উচিত ! কিন্তু কিছুতেই নিজেকে দমন করতে পারতো না ও। এক অদ্ভুত ভালো লাগা ওর সারা শরীর জুড়ে ! এক অচেনা সুরে রিন রিন করে বেজে উঠত এই চেনা দেহ , এই চেনা মুখ ! নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করা। কই এতদিন তো এমন করে দেখেনি ও ! ও যে এত সুন্দর! এমন শরীরের বাঁধুনি ! কই আগে তো নজরে পড়ে নি কখনো ! আর সত্যি বলতে কি ওর নিজেরও তো কোন অভাব বোধ হয় নি এতদিন ! দিব্যি তো ছিল। সংসার, স্বামী ,ছেলে ! শূন্যতা ছিল। কিন্তু নিজেকে নিয়ে এমন করে ভেবে দেখে নি কখনো নন্দিতা। বরং অরূপের সুখে সুখী হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিল তো এতদিন একদম বাধ্য অনুগত স্ত্রীর মত। অরূপ সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু নন্দিতাকেও দিয়েছে দুহাত ভরে। দু দুটো কার্ড, ব্যাংকে দেদার টাকা, রাশি রাশি গয়না আর উপচে পড়া ওয়ার্ডরোব। আর এসব নিয়ে কেটে তো যাচ্ছিল ওর দিনগুলো। মানিয়ে নিতে নিতে এককালের সেই রোম্যান্টিক মেয়েটা তো হারিয়েই গেছিল সংসারের এই ঘোলা জলে। তবে কেন হঠাৎ এমন হল ? হঠাৎ কোন পরশ পাথরের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর ? কেন মনে হতে শুরু হল যে নিজেকে ঠকিয়ে এসেছে ও এতকাল ! যা ওর প্রাপ্য ছিল তা পায় নি। দেয় নি কেউ। অরূপ তো না ই । কতদিন সেভাবে পরম আশ্লেষে ওকে আর জড়িয়ে ধরে না অরূপ। বিয়ের পরপর সুন্দরী বউ নিয়ে ওর সেই উন্মত্ততা হারিয়ে গেছে কোথায় ? সময়ের সঙ্গে সব কিছুই ফিকে হয় তা জানে নন্দিতা। কিন্তু একেবারেই কি হারিয়ে যায় ? মানুষ বদলায়। কিন্তু এতটা ? শুধু কেরিয়ার আর লাগামহীন আকাঙ্ক্ষার পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে কেমন একটা যন্ত্রে পরিণত করে ফেলেছে ও। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই সব ছোট ছোট খুশি মাখা দিনগুলো। তখন অল্প টাকা , ছোট বাড়ি, বাসে ট্রেনে যাতায়াত। কিন্তু তবু সেগুলোর মধ্যেও যেন প্রাণের ছোঁয়া ছিল। আর এখন! দিনের পর দিন আদরহীন, অভ্যস্ত সঙ্গম আর সাংসারিক কেজো কথা ছাড়া আর কিই বা আছে ওর জীবনে ? বঞ্চিত, অনাদৃত ,একটা আসবাবের মত শুধু পড়ে থাকা ঘরের কোণে। ছিলও তো তাই। থাকতও হয়ত। কিন্তু হঠাৎ যেন ঘুম ভাঙল সোনার কাঠির ছোঁয়ায়।ভালো লাগতে শুরু করল নিজেকে ! আজকাল নিজেকে আয়নায় দেখতে গিয়ে কেমন বিবশ হয়ে যায় নন্দিতা। শুধু মনে হয় আর একজোড়া ভাবুক, স্বপ্নময়, অতল চাউনি যেন অপলকে দেখছে ওকে ! কেমন শিউরে ওঠে শরীর ! অকারণে বুকে আঁচল টানে ! সারা দিন শতসহস্র কাজের ফাঁকে কেবলই মন ফিরে ফিরে যায় ওই এক জায়গায়। কখন ? কখন ছাড়া পাবে ও ? কখন মিলবে নিজের একান্ত অবসর ? কখন বসবে নিভৃতে ওই একান্ত নির্নিমেষ দৃষ্টির সামনে ? যে চাউনি প্রতিদিন একটু একটু করে নতুন ভাবে গড়ছে ওকে। ওর চোখ, ওর ঠোঁট , ওর সমস্ত শরীর ভেঙে চুরে একেবারে অন্য ছাঁচে তৈরি হয়ে যাচ্ছে রোজ রোজ ! প্রত্যেকটা দিন ! ভেসে যাচ্ছে ও। রূপ , রস ,গন্ধ , আর এক মায়াময় অলীক স্পর্শে হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। । উফফফ ! কি অসহ্য সুখ ! কি অবর্ণনীয় উষ্ণতা ! যার ছোঁয়ায় এই সাতচল্লিশের শৈত্য পলকে উধাও ! টের পাচ্ছিল নন্দিতা। সেই দীর্ঘদিন আগে হারিয়ে ফেলা চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল মেয়েটা যেন ফিরে আসছে গুটি গুটি পায়ে, ভীরু কপোতীর মত আশ্রয় চাইছে একজোড়া বলিষ্ঠ বাহু র বন্ধনে। গলে যাচ্ছিল, মিশে যাচ্ছিল নন্দিতা ওই নব যৌবনের উষ্ণ সান্নিধ্যে। ভুলে যাচ্ছিল নিজের অস্তিত্ব। হয়ত মনেও পড়ত না। যদি না সেদিন জানতে চাইত সত্যটা। একটা ধারণা ছিল। কিন্তু এতটাও ভাবতে পারেনি নন্দিতা। আবার নিজের মনের দিকে চোখ ফেরায় ও। ভাবতে পারেনি ? না ভাবতে চায়নি ? কোনটা সত্যি ? হ্যাঁ হ্যাঁ ভাবতে চায়নি। বুঝেও এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। আসলে ততদিনে যে ওর অস্থি, মজ্জা, রক্তের সাথে মিশে গেছে আনন্দ। ওকে ছাড়া আর কিছু যে তখন ভাবতেই পারছিল না নন্দিতা। নিস্তব্ধ , মনোরম দুপুর, রক্তিম সন্ধ্যা আর নিবিড় রাত্রির আসঙ্গলিপ্সা কী ভীষণ মায়ায় বেঁধে ফেলেছে ওকে। এই ভার্চুয়াল জগৎ ছেড়ে বাইরে বেরোতে উন্মাদ হয়ে উঠেছে মন ! বার বার আহ্বান করছে আনন্দ , “ আর কতদিন নন্দা ? কবে তোমাকে সত্যি সত্যি সামনে থেকে দেখব ? কবে স্পর্শ করব ? কবে ?” সেই ব্যকুল আহ্বান ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে টের পাচ্ছিল নন্দিতা। মুখে ওকে নিষেধ করতে থাকলেও টের পাচ্ছিল বাঁধ ভাঙছে ওরও। এক অবুঝ জৈব তাড়না যেন পাগল করে তুলছে ওকেও! এক তীব্র ইচ্ছার জন্ম হচ্ছে ভেতরে। এই ঘেরাটোপ ছেড়ে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে ওই দূরন্ত যৌবনের বহ্ণিতে। হয়ত দিত। হয়ত দগ্ধ হয়েই যেত। তবু কোথাও একটা বাধা নিজের মনেই টের পাচ্ছিল নন্দিতা। আর তাই সেদিন সোজাসুজি জিজ্ঞেস করে বসল ওকে। সরল মনেই উত্তরটা জানিয়েছে আনন্দ। না। ওর মধ্যে কোন লুকোছাপা ছিল না।শুধু জানায়ই নি স্পষ্ট ভাষায় ওকেও দ্বিধা করতে নিষেধ করেছিল। শুনে শিউরে উঠেছিল নন্দিতা। এ কথা কেন বলল আনন্দ ? তার মানে ও জানে। কি করে জানল ? ওর বয়স তো দেওয়া নেই কোথাও ! তবে কি অনুমান ? ছুটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে ও । বোঝা যায় তাহলে ? এই মসৃণ ত্বক, এই পেলব দেহ ,এই সুন্দর মুখ ছাপিয়েও কোথাও না কোথাও আসলটা ফুটে ওঠে ঠিকই। ওঠেই। না হলে বুঝল কি করে ও ? ইস্ ! কি লজ্জা! এ কি করেছে ও এতদিন ! এই উচ্ছলতা, এই আকাঙ্ক্ষা , এই তীব্র কামনা ওকে মানায় কি ? এই প্রৌড়ত্বের দ্বারে পৌঁছে পারবে কি ও এক উত্তর তিরিশের উদ্ধত , কামনামদির পুরুষের সঙ্গিনী হতে ? পারবে ওই বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধনে ঠিক তেমনি করেই উন্মাদ হতে ? কি করে পারবে ? কি দিয়ে ঘোচাবে এই মধ্যিখানের চোদ্দ বছরের ব্যবধান ? এক অসহ্য যন্ত্রণায় যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছিল ভেতরটা। ছি ছি ! সব জেনে শুনেও আনন্দ ওকে কিছু বুঝতে দেয় নি। আর ও ? কি ভেবেছিল ? আনন্দ বুঝবে না ? ইস্ ! এতদিন কি মায়ায় অন্ধ হয়েছিল ও ? কেন আগে বোঝে নি ? এখন কি করবে ? কেমন করে ফিরবে নিজের বৃত্তে ? কেমন করে কাটবে এই দীর্ঘ ক্লান্ত নিঃসঙ্গ দুপুর? একাকীত্বে ভরপুর বিষন্ন সন্ধ্যা ! তবু পারতে হবে। নিজের জন্য না হোক। আনন্দর জন্য হলেও পারতে হবে। না না। এ অন্যায়। ভীষণ অন্যায়। চোখের জল মুছে আবার ফোন টা অন করে সুনন্দা। চোখের সামনে ফুটে ওঠে লেখাগুলো। যেগুলো দেখবে না বলে সকাল থেকে পণ করেছিল ও। কিন্তু পারল কই ? পারল না তো ! সত্যিটা জানার পরও দু দিন ধরে সেই একই কথা লিখে চলেছে আনন্দ। প্রেম বয়স দেখে হয় না নন্দা। কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছ এভাবে ? ফিরে এসো। তোমাকে ভালোবাসি এটুকুই কি যথেষ্ট নয় ? এখনও কি আমাকে চিনতে পারলে না ? এত ভঙ্গুর তোমার ভালোবাসা ? উত্তর দাও প্লিজ। পড়তে পড়তে এক অসহায়তার কান্নায় ভেঙে পড়ে নন্দিতা। হায় আনন্দ ! তুমি বুঝতে পারছ না। এ হয না। না বুঝে যে ভুল করেছি তার জন্য ক্ষমা কর আমায়। তোমার নবীন জীবন। আমার পড়ন্ত গোধূলি। এই আলোয় সাময়িক মুগ্ধতা আসতে পারে কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয় না। । এ মোহ কাটবে একদিন। সেদিন আমায় দোষারোপ করবে তুমি ! সে আমি কেমন করে সইব ? তার চেয়ে এই ভালো।দূরে থাকা। সরে থাকা। ফিরে যাওয়া নিজের বৃত্তে। ফিরে যাওয়া আবার সেই পুরোনো ছন্দে। এই দুটো মাসের স্মৃতি বুকে নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া বাকি জীবনটা। কষ্ট ? হ্যাঁ সে তো হবেই। অসহ্য, অবর্ণনীয় সে কষ্ট ! এতগুলো দিন , এতগুলো মুহুর্ত যে মধুর রসে বিহ্বল অবস্থায় কেটেছিল তা কি ভোলা যায় ? তবু সব কিছু থেকে দূরে সরে যেতে হবে। ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে বুকের মধ্যে সেই সব সোনা ঝরা দিনগুলোকে। সেই অসম্ভব সুন্দর স্বপ্নমাখা মুহুর্তগুলোকে। কখনো কোনদিন যেন আর বাইরে বেরিয়ে না আসতে পারে ওরা। ঢুকে পড়তে হবে নিজের সেই পুরোনো ঘেরাটোপে। এতদিনের অবহেলায় পড়ে থাকা সংসারকে আবার গুছিয়ে তুলে নিতে হবে নিজের হাতে।। আবার সেই পুরোনো একঘেঁয়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে নিজেকে। সংসার, স্বামী, ছেলে এইটুকু গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে জীবনটাকে। ক্বচিৎ কখনো যদি উচাটন হয় মন কড়া শাসনে বেঁধে রাখতে হবে তাকে। ধীর পায়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় নন্দিতা। শান্ত নীল সন্ধ্যা নামছে দিগন্ত জুড়ে। বাগানের এক কোন ক্লান্ত পতনোন্মুখ চন্দ্রমল্লিকা। হলুদ পাতায় আসন্ন বসন্ত বিদায়ের ইঙ্গিত। এককোনে আমলকী গাছটার নিচে রাশিকৃত ঝরা পাতার স্তূপ। সেদিকে তাকিয়ে মন স্থির করে নেয় নন্দিতা। আর না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। না বুঝে যে দক্ষিণের জানালা কে দুহাত বাড়িয়ে খুলেছিল একদিন আজ এক্ষুনি নিজের হাতে বন্ধ করে দিতে হবে তাকে। যাতে আর কখনো কোন উতল বসন্তের দখিনা বাতাস চঞ্চল না করে তোলে ওকে। ফিরিয়ে দিতে হবে জীবনে হঠাৎ আসা এই অকাল বসন্তকে। চোখ মুছে ফোনটা হাতে তুলে নেয় নন্দিতা।