মর্ত্যের মা
সলিল চক্রবর্ত্তী
অভাগী পুষ্পর স্বামিটা সংসারে দুটো টাকা বেশি রোজগারের আশায় মুম্বাই গেল জরির কাজ করতে। সেই শেষ যাওয়া, আর ফিরল না। কেউ বলে – মুম্বাইয়ে আবার বিয়ে করে সংসারী হয়েছে, কেউ বলে দুইহাজার কুড়ি সালে লকডাউনের সময় হেটে বাড়ি ফিরছিল, রাস্তায় মারা গেছে। যে ঘটনাটাই ঠিক হোকনা কেন পুষ্প এখন বারো বছরের একটি মেয়ে ‘চম্পা’ আর ছয় বছরের একটি ছেলে ‘দিপু’কে নিয়ে কোনো রকমে বেঁচেবর্তে আছে। এখন সে না বিধবা, না সধবা। প্রথম প্রথম আত্মীয় প্রতিবেশীরা একটু আধটু খোঁজ খবর নিত, কিন্তু ওই পর্যন্তই, স্থায়ীভাবে কে কার খোঁজ খবর রাখে! ফলে নিজের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। মেয়েটি ক্লাস ফোরে পড়তে পড়তে সেই যে লকডাউনে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল, ওই অবদি , পরে স্কুল খুললে আর যেতে পারেনি। এখন ভাইয়ের দেখাশোনা করে। ভাইটি ক্লাস ওয়ানে পড়ে। প্রতিদিনের অন্ন সংস্থানের জন্য সূর্য উদয়াস্ত পুষ্পকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। জাগন্ত ছেলেকে দেখেতে পায় খুব কম। সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। ফলে দিদিই শিশুটি কাছে মায়ের মতো, উল্টো দিকে ভাইও দিদর প্রাণ।
প্রতিবেশী শ্যামলীদির সাহায্যে ছোট নীলপুরে তারামা রাইস মিলে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। প্রায় সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। মজুরি খুবই সামান্য। ছুটি বলে কোন দিনক্ষণ নেই , নো ওয়ার্ক নো পে সিস্টেম । তবুও নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। ফলে গুছিয়ে সংসার না চালাতে পারলেও টেনেটুনে চলে যায়।
পরেশ মহান্তি, তারামা রাইস মিলের মালিক। হাড়কৃপণ প্রৌঢ়,সাত সকালে মিল খুলবে,দুপুরে বাড়ি যায়না,কর্মীরা যদি ফাঁকি মারে। ছুটির পর মিল বন্ধ করে বাড়ি যায়। দুপুরের খাবার আসে বাড়ি থেকে, এককাপ চাও কিনে খায়না। যে কাজে পুরুষ না হলেই নয় সেখানেই পুরুষ, বাকি সব মহিলা শ্রমিক, কারণ হল স্বল্প মজুরিতে কাজ উদ্ধার। অবশ্য তাঁর একটা সিস্টেমের জন্য কম মজুরিতেও শ্রমিকের অভাব হয় না। পরেশ বাবু প্রতিদিন কাজের শেষে দিনের মাইনা দিয়ে দেন। এক টাকাও বাকি রাখেন না।
নিঃসন্তান পরেশ মহান্তির মিলটি ছোট, বড় মিলের আন্ডারে কাজ চলে। অতি হিসেবি মানুষ হওয়ার ফলে, মা লক্ষীর ভান্ডার উপছিযে পড়ছে। হলে কি হবে, গরীব শ্রমিকদের প্রতি তার কোন সহানুভূতি নেই।
গত দুই বছর করোনা কারণে সরকারি বিধি নিষেধ আরোপিত হওয়ায় বারোয়ারি দুর্গা পূজা কমিটিগুলি নমনম করে পূজা সেরেছিল। এবার বর্ধমান অঞ্চলে ধুমধাম করে দুর্গোৎসব পালিত হবে। ছোট নীলপুরের পল্লিমঙ্গল সমিতির দুর্গা পূজার জন্য দুই লরি বাঁশ পড়ে গেছে। এবার নাকি আইফেল টাওয়ারের আদলে প্যান্ডেল হবে।
প্যান্ডেল শুরু হতেই এলাকার কচি কাচাদের ক্রীড়াঙ্গন হয়ে গেছে ওই প্যান্ডেল। বিকালের দিকে তো মেলা বসে যায়। পুষ্পর ছেলে ছোট্ট দিপু সুযোগ পেলেই দিদি চম্পাকে লুকিয়ে পেন্ডেলে চলে আসে। বাঁশ ধরে ঝোলা সমস্ত শিশুদের কাছে পুজোর থেকে বেশি আনন্দের।
চালকলের বারচোদ্দ জন মহিলা একত্রিত হয়ে গেল পরেশ মহান্তির অফিস ঘরে। চালাক পরেশ মহান্তি পুজোর সমই একসাথে দরবার করার অর্থ অনুমান করে ব্যাঙ্গের সুরে কিছু বলার আগে প্রশ্ন করে বসল—
“কি ব্যাপার, কাজকর্ম শিকেয় তুলে কোন ক্লাবের হয়ে দরবার করতে এসেছিস?”
শ্যামলী এগিয়ে এসে বলল-” বাবু, পুজো তো এসে গেল।”
–হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে? আমি কি ধেইধেই করে নাচব?
–না মানে আমাদের পুজোর বো- না- স—–
দাঁতমুখ বিকৃত করে— আমি কি বোনাস পাই, যে তোদের বোনাস দেব।এমনিতে লকডাউনের পর থেকে ব্যাবসার হাল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই যে রোজ মজুরি পাচ্ছিস এটাই অনেক। পোষালে কাজ কর, না পোষালে যেখানে পোষায় সেখানে যা।” জোরে প্রতিবাদ করার সাহস কারোর নেই, ফলে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না।
রাতে বাড়ী ফিরে পুষ্প ও চম্পা খেতে বসেছে। দিপু অকাতরে ঘুমোচ্ছে। চম্পা বলল-” জানো মা ভাই ঘুমালে আমার খুব কষ্ট হয়, সারাদিন পাড়াতে টইটই করে বেড়াবে, কথা শোনেনা, বকা খায়। এখন আবার সারাক্ষন পূজা মণ্ডপে থাকবে, ডাকলেও আসে না। ঘুমুচ্ছে দেখ যেন ওর মতো শান্ত ছেলে আর হয়না।” পুষ্প মেয়ের আদর মিশ্রিত শাসনের বহর দেখে একটু মুচকি হেসে বলল -” মা-রে ওই আমাদের সব। ওর পড়াশুনার দিকে খেয়াল রাখবি। বড় হয়ে চাকরি করে ও আমাদের অভাব ঘোচাবে। তবে কারোর বাড়িতে এখন না যাওয়াই ভাল। পুজোর সময় তো কেউ কিছু দিতে পারে। ওর নেই বলে নিয়ে নেবে, কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়, পেলে মানুষের লোভ বেড়ে যায়। লোভ এমন জিনিস কমে’ত নাই, এক জায়গাতেও দাঁড়ায় না, শুধু বাড়তে থাকে। এতে মানুষের স্বভাব খারাপ হয়ে যায়।” পুষ্প কথাগুলো চাম্পাকে শেখানোর জন্য বলল। চম্পা মায়ের মতো,ছোট হলেও খুব সচেতন। সে কিছু একটা বুঝে মাকে বলল -” মা পূজাতে আমাদের জামা কাপড় হবে না!!” খাওয়ার পর হাত ধুতেধুতে একটা দীর্ঘ নিঃস্বাস ফেলে বলল-” দেখি, যা কিপটে মালিক, বোনাসের কথা বলতেই অফিস ঘর থেকে আমাদের এমন ভাবে তাড়াল, লোকে কুকুর বিড়ালকে ও ওই ভাবে তাড়ায় না। ঠিক করেছি, একা গিয়ে একদিন কিছু এডভান্স চাইব। যদি পাই তো ——“
মিলে কাজ চলছে। বারোটা নাগাদ পুষ্প সহকর্মী রূপভানকে নিয় পরেশ মহান্তির অফিসে ঢুকল। মালিকের স্ত্রী সেখানে উপস্থিত।
“বাবু আসব?” পুষ্প দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতেই, পরেশ মহান্তি একটু বিরক্ত হয়ে–” আয়, কিন্তু কাজ না করে কি ব্যাপার? মালিকের স্ত্রী থাকায় পুষ্পর কথা বলতে একটু সুবিধা হলো–” যদি কিছু এডভান্স দেন, ছেলে মেয়ের জামা কাপড় কিনব। ওদের বাবা থাকলে আমার এত চিন্তা করতে হত না। পরেশ মহান্তি পুষ্পর পারিবারিক পরিস্থিতি জানে,এদিকে পাশে স্ত্রী,একটু ভেবে নরম সুরে বললেন-” শোন পুষ্প টাকা এডভান্স নিয়ে হেডক বাড়াসনে, বরং সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী দশমী এই ছুটির চারদিনের তিনদিন তুই হাফ কাজ কর। আমি নবমীর দিন তোকে একসাথে চার দিনের ডাবল পেমেন্ট দিয়ে দেব। তোর আর চাপ থাকলনা। মনের আনন্দে পূজো কাটালি।” পুষ্প নিতান্ত বাধ্য হয়েই রাজি হল। পাশ থেকে রূপভান বলে উঠল-” বাবু, আমি রাজি!” পরেশ মহান্তি তাচ্ছিলের সুরে বললেন-” তুই রাজি মনে, তুই কি হিন্দু??” রূপভানও দমবার পাত্র নয়, সে পরেশ মহান্তির মুখের উপর বলল-” ধর্মটা আলাদা হতে পারে, উৎসবটাতো সবার।”
আজ মহালয়া, পল্লিমঙ্গল সমিতির দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি আশি শতাংশ সম্পূর্ণ। মহালয়ার প্রত্যুষে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুর মর্দিনী দিয়েই পুজোর সূচনা হল। পুজো কমিটির লাগানো মাইকের আওয়াজে চার দিক মুখরিত।দীপু, চম্পা মহালয়ার শুরুতে একবার ঘুম থেকে জেগে ওঠে, আবার কখন ঘুমিয়ে পড়ে তা ওরা জানেই না। তারপর যখন ঘুম ভাঙে মহালয়ার তখন যবনিকা পতনের সময় হয়ে যায়। তখনো সূর্য না উঠলেও, শরতের ভোরের হালকা আলো আর শিউলি ফুলের গন্ধে চারদিকে মা আসছে,মা আসছে ভাব। দিপু চম্পা চটি বিনা চরণে হালকা শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে ছুটে শিউলি তলায় যায় শিউলি ফুল কুড়াতে।
পুষ্পর স্বামীর বন্ধুস্থানীয় পটলা দাস, সে আবার পল্লিমঙ্গল সমিতির পূজা কর্মকর্তাদের একজন। পটলা পুস্পদের পারিবারিক অবস্থার কথা সব জানে। এ-ও জানে যে পুষ্প নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কারোর কাছেই সাহায্য চায় না। সেই জন্য পটলা আগ বাড়িয়ে কোনো সাহায্য করতে যায়না। উপকার চাইলে চেস্টা করে। সপ্তমীতে পূজা কমিটি মহিলাদের শাড়ী দেবে, পটলা সেখানে পুষ্পর নামটা এন্ট্রি করে দিয়েছে। লকডাউনের সময় এন জি ও, সরকারি, ব্যাক্তিগত উদ্যোগ যারাই সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে পুষ্পরা যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে সাহায্য পেতে পারে পটলা তার ব্যবস্থা করেছে।
আজ সপ্তমী,ঢাকের আওয়াজ আর চন্ডীপাঠে চারদিক মুখরিত। মা দুর্গা এসেছেন মর্তে, এদিকে মর্তের মা পুষ্প খুব সকালে উঠে ভাত, ডাল, আলুসিদ্ধ করে ছুটছে কাজে যদি তার সন্তানের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারে। নিশ্চিত নয় বলে জামা প্যান্টের কথা ছেলে মেয়েকে কিছু বলেনি। কাজে বার হবার সময় দিপু বললো-“জানো মা, ওই বাড়ির সৌম্যর পাঁচটা জামা প্যান্ট হয়েছে, আমাকে নতুন জামা প্যান্ট দেবে না?” দিপুর কথায় পুষ্পর চোখ জলে ঝাপসা হয়ে গেল। পাশে দাঁড়ানো একটু বুঝো চম্পা , মায়ের অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝে ভাইকে অন্য মনস্ক করে দিতে কাছে টেনে বলল-” দিপু মা বেরিয়ে গেল আমি আর তুই পুবের মাঠে কাশ ফুল তুলতে যাব।” পুষ্প দিপু ও চম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-” চম্পা, মা দেখিস ভাই যেন এ-কদিন কারোর বাড়িতে না যায়। দুপুরের রান্না করা খেয়ে নিস। আমি আজ তাড়াতাড়ি ফিরব, বিকালে ছুটি।”
পুষ্প কাজ থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। বাড়ি এসে দেখে দরজায় শেকল তোলা, ছেলেমেয়ে নেই। সে পূজা মণ্ডপে যায়,ঠিক যা ভেবেছে তাই- দুটো চেয়ারে দুজনে বসে পা ঝুলিয়ে ফল প্রসাদ খাচ্ছে। কাছে যেতেই চম্পা বলল -” পটলা কাকা দিল যে!!” দূর থেকে পটলা পুস্পকে দেখতে পেয়ে বলল-” বৌদি সন্ধ্যায় একটু মণ্ডপে আসবেন।” পুষ্প মুচকি হেসে সম্মতি জানায়।
পুরোনো মলিন জামাকাপড় পরে থাকার জন্য পুষ্প ঠিক করল, রাতের দিকে মণ্ডপে যাবে না। গ্রামের অনেক মানুষ সেখানে থাকবে, নিজেরই খারাপ লাগবে। সন্ধ্যার পর দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে খাটে বসে নিজের ছোট বেলার পূজোর দিনগুলো কেমন কাটত সেই গল্প করছে। এমন সময় পূজা মণ্ডপের মাইকের শব্দ কানে এল-‘ পুষ্প মন্ডল আপনি আপনার শাড়ি নিয়ে যান’। পুষ্প বুঝতে পারল কেন পটলা ঠাকুরপো তাকে সন্ধ্যার পর মণ্ডপে যেতে বলেছিল। সে মেয়েকে অন্য মনস্ক করতে জোরে জোরে গল্প করতে থাকল। শাক দিয়ে কি আর মাছ ঢাকা যায়! মেয়ে মাইকের ঘোষণা শুনে মাকে বলে- ” মা তোমাকে শাড়ি নিতে ডাকছে।” পুষ্প তো অপত্য স্নেহি মা , তাদের যখন পূজায় জামা প্যান্ট হয়নি সে কোন মানসিকতায় নিজে হাতে শাড়ি নিতে যাবে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে পুষ্প বলল-” পুষ্প কি গ্রামে আমিই আছি! অন্য কেউ হবে।” কিছুক্ষন পর শেফালী একটা শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে-” কি রে পুষ্প, কখন থেকে শাড়ি নেয়ার জন্য তোর নাম ধরে ডাকছে। তুই গেলিনা বলে পটলাদা আমার হাতে দিয়ে দিল।” দিপু ও চম্পা ছুটে এসে শেফালির হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে নুতন শাড়ির গন্ধ ভাগাভাগি করে শুকতে থাকল। পুষ্প মাথা নিচু করে বসে থাকল। কারণ সে মনথেকে শাড়ি টা পেতে চাইনি।
আজ অষ্টমী, কাজে যাওয়ার আগে পুষ্প পরোটা করল, তেলের যা দাম তাতে লুচির খরচ অনেক। আলুর মাখা মাখা তরকারি করে চাম্পাকে জানিয়ে দিল মিটসেভের ভিতর চারটে ল্যাংচা আছে, দুপুরে দুই ভাই বোন যেন ভাগ করে খেয়ে নেয়।
দিপু আজ দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। বাক্সে তোলা একটা জামা ছিল সেটাই আজ পড়লো। এতেই তার আনন্দ। চম্পার বড় কষ্ট হয়, ঠাকুর ভাইকে যদি একটা জামা প্যান্টের ব্যাবস্থা করে দিত। প্রতিটা ঘরে আজ ভিন্ন ভিন্ন পদের নিরামিষ রান্না বান্না হচ্ছে। চারদিকে লুচি বেগুন ভাজার গন্ধ ম- ম করছে। চম্পা খুব সতর্কতার সাথে ভাইকে আগলে রাখে, পাছে ভাই কারোর বাড়িতে চলে যায়।
পুষ্প দুপুরের পরে বাড়ি ফিরে দেখে, দুই ভাই বোন বিছানাতে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। দুপুরের খাবার যেমন করে রেখে গিয়েছিল তেমনি পড়ে আছে। পুষ্প অবাক হয়ে চম্পাকে ঘুম থেকে তুলে ব্যাপারটা জানতে চাইল। চম্পা বলল পটলা কাকা ঘন্টা খানিক আগে অষ্টমীর ভোগ দিয়ে যায়। পুষ্প পটলা দাসকে দূর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানায়। না চাইতে সে যা করে সেটা তার মনুষ্যত্বের পরিচয়।
আজ নবমী, আজও সকাল সকাল রান্না করে পুষ্প চম্পাকে বুঝিয়ে দিয়ে কাজে বেরিয়ে গেল।
পুষ্প আর রূপভান দুজনে কাজে আসে। পুষ্পর মনে ভিতর একটা আনন্দ বিরাজ করছে, আজ হয়ত তার ছেলে মেয়েকে না বলা ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারবে। পরেশ মহান্তি অফিস ঘরে কাজ করছে। পুষ্প রূপভানকে বলল যে, আজ তারা তাড়াতাড়ি কাজ ছেড়ে মালিকের কাছ থেকে হিসাব বুঝে নিয়ে বাড়ি যাবে।
খাদ্য শৃঙ্খলের মিয়ম অনুযায়ী যেখানে ধান চাল থাকে সেখানে ইঁদুর থাকে, আবার যেখানে ইঁদুর থাকে সেখানে সাপেদের আনাগোনা চলে। পরেশ মহান্তি অফিস ঘরের চৌকির নীচে পুরনো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে কিছু একটা খুঁজছিল। হঠাৎ ‘আঃ’ বলে চিৎকার করে উঠল। পুষ্প রূপভান চিৎকার শুনে ছুটে গেল অফিস ঘরের দিকে। ওরা দেখতে পেল, একটা প্রমান সাইজের কেউটে সাপ দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকে দেখে পরেশ মহান্তির পায়ে সাপে ছোবল মেরেছে। পুষ্প কাল বিলম্ব না করে রূপভানকে পাঠাল পরেশ মোহান্তির স্ত্রী কে খবর দিতে। আর নিজে তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল ছিড়ে সাপের কামড়ের উপর দিকে টাইড করে বেঁধে পাশে থাকা ভ্যান রিক্সায় তুলে নিজে টেনে সোজা বর্ধমান মেডিকেল কলেজের দিকে রওনা হল।
ডাক্তার বাবু পরেশ মহান্তির স্ত্রীকে বললেন আর ভয় নেই। ইমিডিয়েট হসপিটালে এনে সাপের নামটা বলতে পারায় আমরা ঠিকঠাক চিকিৎসা করতে পেরেছি। যান ওনার সাথে দেখা করে আসুন। তবে বেশি কথা বলবেন না। ডাক্তার বাবুর কথা শুনে পুষ্প একটু সস্তি পেল, কারণ সেই তো নিজে হাতে যা করার করেছে। কিন্তু মনের মধ্যে অস্বস্তি পুরোপুরি কাটলো না। এই অবস্হায় সে কি করবে বুঝতে পারছে না। আজ যে তার পাওনা গন্ডা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা। ছোট ছেলেমেয়ে দুটো তার ফেরার পথ চেয়ে বসে আছে। পরেশ মহান্তির বেডের পাশে সবাই এসে দাঁড়াল। পরেশ মহান্তির চোখ অশ্ৰুপূর্ণ। আস্তে আস্তে পুষ্পকে উদ্দেশ্য করে বলল-” আমায় ক্ষমা করে দে পুষ্প, এ আমার পাপের ফল। তোকে আমি কত কিছু থেকে বঞ্চিত করেছি, অথচ তোর জন্যই আমি আজ প্রাণ ফিরে পেলাম। যেটা ঈশ্বর আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।” পরেশ মহান্তি কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো বলায় পুষ্পরও খারাপ লাগছিল। সে বলল-” বাবু, ওসব কথা থাক, ডাক্তার বাবু আপনাকে বেশি কথা বলতে বারণ করেছে। গিন্নীমা আমি বাড়ি যাই বাচ্চা দুটো আমার মুখ চেয়ে বসে আছে।” পরেশ মহান্তির মনে পড়ল যে আজ পুষ্পকে আট রোজ মজুরি দেয়ার কথা, যা দিয়ে সে ছেলেমেয়ের জামা কাপড় কিনবে। পরেশ মহান্তি স্ত্রীর কাছে জানতে চাইল সে টাকাপয়সা এনেছে কিনা। তার স্ত্রী জানাল দশহাজার টাকা নিয়ে এসেছে। পরেশ মহান্তি সম্পূর্ণ টাকাটা পুষ্পকে দিয়ে দিতে বলল। টাকাটা হাতে নিয়ে রীতিমতো অবাক বিস্ময়ে পুষ্পর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,-” এত টাকা আমি—।” কৃপণ পরেশ মহান্তি বিনয়ের সুরে ছলছল চোখে বললেন-” তুই ওটা রাখ মা, তোকে আর শোধ করতে হবেনা। এখন বাচ্চা গুলোর কাছে যা, পরে তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।” পুষ্প পরেশ মহান্তিকে হাত জোড়ে প্রণাম করে বেরিয়ে যায়।
নবমী হচ্ছে দুর্গোৎসবের সব থেকে প্রতীক্ষিত দিন। গৃহস্থের রন্ধনশালা আজ গুরুপাক রান্নায় সুশোভিত। বেলা বাড়তেই চার দিকের পরিবেশটা যেন অনুষ্ঠান বাড়ির মতো হয়ে উঠছে।চম্পা ভাইকে মায়ের কথা মতো নজরেই রেখেছে। পুজোর দিনে ছোট দুটো শিশুর কতক্ষনই বা ঘরে থাকতে ভাল লাগে। দিপু বলল-” চল দিদি, প্যান্ডেলে যাই।”পুজোর দুই দিন যে জামাপ্যান্ট পরেছে, আজও সেটাই পরে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় দিপুর মতো শিশুদের নুতন জামাপ্যান্ট পরতে দেখে দিপু বলল-” এবার আমাদের নতুন জামাপ্যান্ট হবে নারে দিদি!!” ছোট্ট দিদি কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে কথা ঘোরানোর জন্য বলল-” ভাই এবার প্যান্ডেলটা দেখছিস ঠিক মোবাইল টাওয়ারের মতো লম্বা।” ওরা দুজন এক গৃহস্থের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে দিপুর নাকে মাংসর গন্ধ আসায় সে চম্পার মুখ পানে চেয়ে বলল-” এটা মাংসের গন্ধ বেরুচ্ছে নারে দিদি!!” চম্পার চোখ ফেটে জল চলে এলো। ভাইকে অন্যমনস্ক করতে বলল-” জানিস ভাই, মা আজ ধোনে পাতা দিয়ে ভোলা মাছটা যা রান্না করেছে না, ঠিক এমনি গন্ধ বেরুচ্ছিল, যেন মাংস ফেল। মণ্ডপে কিছুক্ষন বসে বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেব।”
দুর্গা মন্ডপ জনহীন। অঞ্জলী পর্ব শেষ, পুরোহিত ঠাকুর আর কর্মকর্তাদের কয়েকজন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। সমস্ত বাড়িতে আজ দ্বিপ্রহরিক আহার পর্ব চলছে। ছোট্ট দিপু মণ্ডপের এই পরিস্থিতি দেখে দিদিকে বলল-” সবাই বাড়িতে মাংস ভাত খেতে গেছে না রে দিদি?” সমানুভূতি সম্পন্ন দিদি ভাইয়ের কষ্টটা অনুভব করে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারল না। মন্ডপ থেকে একটা গাঁধা ফুল নিয়ে করজোড়ে মাকে বলল-“মা গো, তুমি কি কিছুই দেখতে পাছ না? আমার কিছুই দরকার নেই, ভাইকে একটা জামাপ্যান্ট, আর আজকের দিনের জন্য একটু মাংস ভাতের ব্যাবস্থা করে দাও মা।” হটাৎ পিছন থেকে ডাক শোনে-” চল দিপু বাড়ি চল।” স্বর্গের দশভূজা মায়ের থেকে মুখ ঘোরাতেই চম্পা দেখল মর্ত্যের দ্বিভুজা হাসিমুখে তাদের ডাকছে,এই প্রাণখোলা হাসি চম্পা বহুদিন মায়ের মুখে দেখেনি। এক হাতে তার নুতন জামাকাপড় জুতোর বাক্স, অন্য হাতে মাংস সবজি মিষ্টির প্যাকেট।
##########