আমি অনুশ্রেয়া ঘোষ, আমি বছর বত্রিশের একজন আনম্যারেড মহিলা। এস বি আই এর একটি আঞ্চলিক শাখার বি এম পদে কর্মরত।
আমরা প্রতিটা মানুষ ভাবি ‘আমিই ঠিক’, সত্যিই কি তাই? কখনো কখনো হয়তো ঠিক হয়, কিন্তু সব সময় হয় কি! যাইহোক, আজ আমি আমার জীবনের বহমান একটা ঘটনা আপনাদের কাছে শেয়ার করতে চাই—-
আমার মা একা, জ্ঞান হওয়া থেকে দেখেছি আমি মামার বাড়িতে মানুষ। দাদু, দিদা, মা,আমি চার জনের সংসার। বাবার সাথে মায়ের যখন ডিভোর্স হয়, তখন মা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি একদিন বাবাকে দেখিছি, তবে ভালো করে নয়,কারণ মুখের দিকে আমি ভালো করে তাকাইনি। মায়ের কাছে বাবার আচরণ সম্মন্ধে যা যা শুনেছি তাতে তাঁর সাথে আমার ভাল ভাবে কথা বলার প্রবৃত্তি ছিল না।
আমার দাদু অনাদি নাথ সেন, প্রফেসর ছিলেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের উপর উনি লেখালেখি করতেন। ফলে এক প্রকাশনা সংস্থায় ওনার যাওয়া আসা ছিল। এবং সেই সূত্রেই বাবার সাথে দাদুর পরিচয়। বাবা ছিলেন সেই প্রকাশনা সংস্থার প্রুফ রিডার। দাদু বাবার শিক্ষা দীক্ষা ভদ্রস্থ চেহারা, সর্বোপরি কুলীন কায়েস্থ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। উদ্যোগী ব্রাইট ফিউচার আছে বুঝে তাঁর একমাত্র কন্যা অর্থাৎ আমার মাকে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ অর্থাৎ আমার বাবার হাতে সমর্পণ করেন। দিদার একটু আপত্তি ছিল, আরও সাত পাঁচ না ভেবে দুম করে বিয়ে দেওয়াটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। শুনেছি বিয়ের পর বছর খানিক মা দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে ছিলেন। কারণ দাদু, বাবা ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে যেটা ভেবেছিলেন সেটা জাস্ট উইন্ডো ড্রেসিং ছিল। মা মাস খানিকের মধ্যে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। মায়ের কাছে দিনের আলোর মতো সবকিছু পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। মায়ের মতো মেয়েকে বিয়ে করতে একটা পুরুষ মানুষের যে রোজগারের প্রয়োজন ছিল, বাবার তা ছিল না। মায়ের সুখ এবং শখ মেটাবের কোনোরকম ইচ্ছা বাবার মধ্যে ছিল না। সংসারে কোন কাজের লোক ছিলনা। মাকেই একা হাতে সংসারের সমস্ত কাজ করতে হতো। মনের দুটো কথাও বলার ফুরসৎ মা পেতেন না। প্রথম দিকে মা এসে দিদাকে বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগে গুলো জানতেন। দিদা, তাঁরতো সন্তান,শুনে ভালো লাগত না, তিঁনি আবার দাদুর কাছে মায়ের অভিযোগ গুলো জানতেন। দাদু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তিনি নাকি মাকে বোঝাতেন এই বলে—“বিয়ে হয় দুটি মানুষের মধ্যে, যারা একদম স্বতন্ত্র। দুটি স্বতন্ত্র মনের মধ্যে তাদের আচার আচরণ এবং মানসিকতার বিরাট ব্যাবধান থাকে, যেমন এক গ্লাস স্ফটিক জল এবং এক গ্লাস লাল জল, এমদম ভিন্ন গোত্রের দুটি তরল। এখন যদি দুটি তরলকে একটি বড় কাঁচের গ্লাসে ঢালা হয় তো দেখা যাবে একটা সময় পর স্ফটিক জল ও লাল জল মিশে গোলাপি রঙের হয়ে গেছে। একটা ভিন্ন তরলে পরিণত হয়ে গেছে,ওটাই তরলের নুতন অস্তিত্ব। অর্থাৎ সময় দিতে হবে। ধীরে ধীরে দুজনে দুজনকে বুঝবে চিনবে, দোষ গুন গুলো বিশ্লেষণ করবে, তারপর উভয়েই মানিয়ে গুছিয়ে একটা মিলিত মনের জন্ম হবে। ‘ দাদুর উধাহরণ দিয়ে উপদেশ মূলক কথাবাত্রা মা দিদার একদম পছন্দ হতো না। তাঁরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটাই বুঝতেন। বাবা ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। তিঁনি সসম্মানে বাঁচতে চাইতেন,করুনার পাত্র হয়ে নয়। ফলে মন মানুষীকতায় বাবা মা অবস্থান করতেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে। এমনি মান অভিমান , পছন্দ অপছন্দ নিয়েই সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে মায়ের এক বড় চাকুরে মেসো বাবার জন্য মোটা মাইনের সরকারি চাকরির খোঁজ এনে দিলেন। অস্বচ্ছল সংসারে মা একটু আসার আলো দেখে ছিলেন। কিন্তু বাবা বেঁকে বসে ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল পছন্দের যে কাজ তিনি করছেন, কিছু বেশি উপার্জনের জন্য সেটাকে ছাড়তে পারবেন না। ফলে মায়ের সাথে সংঘাত চরম পর্যায়ে পৌঁছাল। মা তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। চলে এলেন পিত্রালয়ে। দাদু মাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন মা বুঝবার চেষ্টাও করেননি। তার আর একটা কারণ ছিল দিদার মায়ের প্রতি সমর্থন। দাদু নাকি নিরাশ হয়ে বলে ছিলেন ” কী ভুল করছ তা একদিন বুঝবে, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সেইদিনটা আমার যেন দেখতে না হয়।”
আমার জন্ম হয় মামার বাড়িতেই। শুনেছি ষষ্ঠী পূজা, অন্নপ্রাশন দু- দুটো জন্মদিন বেশ ঘটা করে হয়েছিল। আমার অল্প মনে পড়ে তৃতীয় বছরের জন্মদিনের কথা। একদিন একটা বার্থডে পাটিতে গিয়ে বন্ধুর মা বাবাকে একত্রিত হয়ে আনন্দ করতে দেখে মা কে প্রশ্ন করেছিলাম আমার বাবার বিষয়ে। আমি তখন বছর সাতেকের মেয়ে। মা বলেছিলেন তিনিই আমার মা, আবার তিনিই আমার বাবা। অর্থাৎ সিঙ্গল মাদার। দিদার কাছে শুনেছি মায়ের সাথে বাবার মিউচুয়াল ডিভোর্স হলেও দাদুর সাথে বাবার যোগাযোগ ছিল। দাদুর সাথে বাবার দেখা হলেই বাবা নাকি দাদুর চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করতেন। দাদু বাবাকে পুনরায় বিবাহ করার পরামর্শ দিতেন। বাবা শুনে একটু হতাশাগ্রস্ত হয়ে মৃদু হাসতেন, মুখে কিছু বলতেন না। দিদা বলতেন ওটা বাবার করুণা আদায়ের কৌশল। মা আমাকে টিউশন পড়াতে নিয়ে যেতেন বাড়ী থেকে বেশ কিছুটা দূরে, পড়া শেষ করে আমাকে নিয়ে ফাইনালি একটু রাত করে বাড়ী ফিরতেন। মা খুব সেজেগুজে যেতেন, যেন অনুষ্ঠান বাড়ীতে যাচ্ছেন। একজন আঙ্কেলের সাথে মা মাঝে মধ্যে দেখা করতেন। আঙ্কেল মিষ্টি হেঁসে আমার হাতে একটা ক্যাডবেরি চকলেট দিতেন। একদিন মা কথা প্রসঙ্গে বলেন-” তোর বাবাকে যা কিপটিমে করতে দেখেছি তাতে তোকে এত ক্যাডবেরি কিনে দিত বলে আমার মনে হয় না।”
একদিন রাত্রে মা রাত করে বাড়ীতে ফেরার পর দাদু দিদা আর মা তিনজনে খুব ঝগড়া করে ছিলেন। আমি আমার বয়স অনুযায়ী যে টুকু বুঝে ছিলাম– ঝগড়ার কারণ ছিল ওই আঙ্কেল। মা দিদা এক দিকে আর দাদু একদিকে। দাদুর একটা কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে, তিঁনি দিদাকে রেগেগিয়ে বলেছিলেন -” তুমি মা নও, সর্বনাশী।” এই ঘটনার কিছুদিন পর দাদু হৃদরোগে আক্রন্ত হয়ে মারা যান। দাদুর মৃত্যুতে বড় একটা ক্ষতি হয়েছিল সেটা হলো তাঁর রাষ্ট্র বিজ্ঞানের উপর লেখাগুলো অসমাপ্ত হয়ে ছিল। কিছুদিন পর প্রকাশক বাড়িতে এসে দিদার কাছ থেকে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলেন। এত গেল একদিক ,অন্য দিকে দাদুর মৃত্যুর পর দিদা হলেন হেড অফ দা ফ্যামিলি। মা হয়ে গেলেন মুক্ত বিহঙ্গ। আমার জ্ঞান হওয়া থেকে বাবার সম্পর্কে কোন ভালো মন্তব্য মা বা দিদার মুখে কখনোই শুনিনি। বরং বিরুদ্ধ চারণ করতে শুনেছি। যখন নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হলাম মা গর্ব এবং ব্যাঙ্গের মিশ্রনে বলেছিলেন–” তোমার বাবার কাছে থাকলে সরকারি’ ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে’ স্থান হতো।” আবার যখন আমি ক্লাসে স্ট্যান্ড করতাম তখন বলতেন-” বাবার কাছে থাকলে কখনোই স্ট্যান্ড করতে পারতে না। কারণ টিউশন পড়াত তো পাড়ার সস্তা ছেলে ছোকরা ধরে ।” এই ধরনের ব্যঙ্গক্তি শুনতে শুনতে আমি বড় হচ্ছিলম। বাবার সাথে মেয়ের সম্পর্কটা ঠিক কেমন আমি বুঝতে পারিনি। দাদু মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পরে মা অঙ্কেলকে বিয়ে করেন। আমি তখন বছর বার তেরোর কিশোরী। মায়ের কাছে না দেখা বাবার নিন্দা শুনতে শুনতে বাবা মানেই একটা খারাপ মানুষ এমনই একটা ধারণা আমার মধ্যে জন্মে গিয়েছিল। ফলে আঙ্কেলকে বাবা ভাবতে আমার কেমন জানি একটু অসুবিধা হতো। মাও দাম্পত্য জীবনে এতটাই নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন যে আমার দিকে আগের মত নজর ছিলনা। আমি একটা ব্যাপারে নিষ্কৃতি পেয়েছিলাম, মা আমার জন্মদাতা পিতাকে নিয়ে আর কোনো নেগেটিভ আলোচনা করতেন না। দিদার কাছে শুনে ছিলাম আঙ্কেল রেলে চাকরি করেন। বড় অফিসার, মোটা টাকা মাইনা পান। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ওনাকে ওয়ার্কিং টুরে যেতে হয়। মাঝে মধ্যে মাকে নিয়ে যান, আমি দিদার কাছে থাকতাম। আমার ওদের সাথে যাওয়ার ইচ্ছাও হতনা, কারণ ওই বয়সেই আমি বুঝতে পেরে ছিলাম আঙ্কল আমাকে বিয়ের আগে যে নজরে দেখতেন এখন তা দেখেন না। ওনার আমার দিকে তাকানো, কথা বলা সবই কেমন যেন আর্টিফিসিয়াল। যাইহোক মা খুব ভালো আছে ভেবে আমারও খুব ভাল লাগত। আমার কোনো অসুবিধা হয়নি কারণ ততদিনে আমি আমার বই গুলোকে বেস্ট ফ্রেন্ড করে নিয়েছি।
মায়ের এই কাঙ্খিত সুখ মনে হয় ঈশ্বর সুনজরে দেখেননি। তাই অচিরেই বিধাতার অলঙ্ঘ নির্দেশ এসে মায়ের জীবনটাকে আবার লন্ড ভন্ড করে দিল। আসলে মা নিজেই আঙ্কেলের ছদ্মবেশটা ধরতে পারেননি। যখন ধরতে পারলেন , তখন বহু পথ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, ফিরে আসার আর উপায় নেই। কারণ সমাজে বসবাস করে সমাজ বহির্ভূত কাজ করা যুক্তিযুক্ত নয়। মা যেদিন জানতে পারলেন আঙ্কেল রেলে সার্ভিস করেন না, মাকে মিথ্যা কথা বলেছেন , সেই দিন অনেক রাত অবদি মা আর আঙ্কেলের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি চলেছিল। কেন জানিনা, দিদা সেইদিন সব শুনেও ঝগড়ার মধ্যে ঢোকেন নি। আমাকে নিয়ে পাশের ঘরে চুপ করে শুয়ে ছিলেন। কারণ, মনে হয় হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট হয়ে স্বভুল গুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠছিল। আতঙ্কে আমার ঘুম আসছিল না। অনেক রাতে মা আমার পাশে এসে শুয়ে খুব কাঁদছিলেন, আমার মনে হচ্ছিল মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দি, পাশে পেলাম তো বহুদিন পর কিন্তু সাহস হলনা। দিদা কিছু একটা বলতে গিয়ে ছিলেন, শেষ করার আগেই মা করাল মূর্তি ধারণ করে দিদার দিকে তাকিয়ে বললেন-” একদম কথা বলবে না, আমার জীবনটা তুমিই শেষ করে দিয়েছো।”
মান সম্মানের দায় এড়াতে আঙ্কেল আমাদের বাড়িতেই থাকেন, কিন্তু মায়ের সাথে এক ঘরে নয়। মা প্রয়োজন ছাড়া আঙ্কেলের সাথে কথা বলেন না। কারণ তত দিনে মা জেনে গেছেন আঙ্কেলের নিজস্ব কোন বাসস্থান নেই , ছোট বেলায় বাবা মা মারা যাওয়ায় মামার বাড়িতে মানুষ। আগে একটা বিয়ে ছিল তার কেস চলছে, মাঝে মধ্যে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। আগে মাঝে মধ্যে মদ পান করতেন, এখন মদ্যপ হয়েছেন। ডায়াবেটিকস রোগী হয়েও মদ ছাড়তে পারছেন না। মা এখন আমার হায়ার স্টাডি নিয়েই বেশি উৎসাহ দেখান। এই ভাবেই বেশ কয়েক বছর কাটল। আঙ্কেল ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মা সুস্থ্য করার জন্য অনেক টাকা পয়সা খরচ করলেন কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। লিভার কিডনি দুটোই যে সম্পূর্ণ ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল।
প্রথমে আঙ্কেল, তারপর বছর খানিক পর দিদাও চলে গেলেন। মা-ও কেমন জানি জবুথুবু হয়ে গেছেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। এখন ওনার একটাই চিন্তা আমাকে পাত্রস্থ করা। আমি সদ্য এস বি আই তে চাকরি পেয়েছি। আমি বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় মা আমার উপর ক্ষুব্ধ। আমি জ্ঞান হওয়া থেকে বাবা নামক পুরুষ মানুষটির নিন্দা মন্দ শুনে বড় হয়েছি। বড় হয়ে মায়ের দ্বিতীয় সঙ্গী আঙ্কেলকে দেখেছি, একটা মিথ্যাবাদী , ঠগ, প্রবঞ্চক প্রতারক পুরুষ রূপে। ফলে এই পুরুষ জাতিতার উপর আমার চরম অনীহা জন্মে গেছে। বয়ঃসন্ধিক্ষনে এসেও আমি পুরুষ মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারিনি। বান্ধবীরা যখন আমার চোখের সামনে তাদের বয়সের ধর্ম পালন করতে ব্যাস্ত, আমি তখন ঘর পোড়া গরুর মত রাঙা মেঘ দেখে ডরাতাম।
আমার প্রথম পোস্টিং হলো বিরাটির একটি ব্রাঞ্চে, যেখানে দাদু আমার মা কে বিয়ে দিয়ে ছিলেন। আমি এই প্রথম বিরাটিতে পা রাখলাম। সব জেনেও আমার স্থান সম্পর্কিত কোন আগ্রহ নেই। কোন কলিগের সাথে আমার অতীত নিয়ে কখনো কোন আলোচনা ও করিনি। একদিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে, দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ আমি আমার চেম্বারে বসে কাজ করছি, ব্যাঙ্ক ফাঁকাই ছিল। ঠিক সেই সময় বছর সত্তরের একজন ভদ্রলোক আমার অনুমতি নিয়ে আমার চেম্বারে ঢুকলেন। শ্যামবর্ণ, ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত শীর্ণকায় দীর্ঘ মানুষটার মুখের দিকে তাকাতেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অজানা শিহরণ খেলে গেল। মৃদু হাঁসি মাখা করুন মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম -” বলুন ব্যাঙ্কের তরফ থেকে আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? —–না মা আমি ব্যাঙ্কের কোন কাজে আসিনি, আমি এসেছি তোমার কাছে। আমার মন যা ভেবে আঁতকে উঠেছিল সেটাই ঘটতে যাচ্ছে না তো! মনটা দৃঢ় করে বললাম–” কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না।” — না মা, চেনার কথাও নয়। তুমি তো আমাকে কখনো দেখনি। হয়তো আমার কথা শুনেছ। আমার নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, তোমার জন্মদাতা পিতা।” কথাটা বলে ভদ্রলোক আমার দিকে অসহায় ভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছেন, দুচোখের কোনায় চিক চিক করছে অশ্রু বিন্দু। আমি যে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমার মনের ভিতর সাইক্লোন বয়ে যেতে থাকলো। আমি কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছি না। চোখ বন্ধ করে ভাবছি আমি এখন কি করব!!! এই মানুষটার জন্য আমার মায়ের জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। অন্য পাঁচটি সন্তান যেমন তাদের বাবার স্নেহ মমতায় বড় হয়, আমি তার কিছুই পাইনি। শুধু, শুধুমাত্র এই মানুষটার জন্যে। জ্ঞান হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত বাবার শূন্যস্থান পূরণে আমার এবং মায়ের যত রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তার দায়ভার শুধুই এই মানুষটির। এক লহমায় এই কথা গুলো মাথায় এসে যাওয়ায় ভদ্রলোককে একদম সহ্য হচ্ছিল না। মুদিত চোখ খুলতেই দেখি তিঁনি ওই একই করুন বদনে আমার দিকে চেয়ে আছেন। হয়ত আমার মুখ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায়। চোখ খুলতেই বললেন-” তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে মা?” আমি ততক্ষনে একটু ধাতস্থ হয়েছি, বললাম—
— ” না, ঠিক আছি। আপনাকে একটা কথা বলি, আমি বাবা বলে কাউকে জানিনা, আর জানতেও চাইনা। আমি জানি আমার জন্মের আগেই তিঁনি মারা গেছেন। দোহাই আপনাকে অধিকারের অজুহাতে আর এখানে আসবেন না। আপনি এখন যেতে পারেন।” নিরাশ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে ছল ছল চোখে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন-” ঠিক আছে মা, তুমি কষ্ট পেয়ো না, আমি আর কখনও তোমার সম্মুখে আসব না।” কাঁচের ডোর পুশ করতেই আমার কেন জানি মনে হল, উনি অর্থ সাহায্য প্রার্থী হয়ে আসেননি তো! ওনাকে ডাকতেই যেন এক বুক আসা নিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমি বললাম-” আমি কি আপনাকে কিছু অর্থ সাহায্য করতে পারি?” —- না মা, তার প্রয়োজন নেই, আমি সেই জন্য আসিনি, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। উনি চলে গেলেন, কিন্তু কেন জানিনা আমার মন থেকে উনি গেলেন না। মনটা আত্মগ্লানিতে ভোরে উঠলো, মনে হতে থাকল,আমি কি ঠিক করলাম? ওনার বক্তব্যটা আমার শোনা কি উচিত ছিল না! ওনার অসহায় মুখটা কথা এবং নিজের আচরণের কথা ভেবে মনটা অপরাধ প্রবণতায় খচখচ করতে থাকলো।
অফিস থেকে বাড়ী ফিরে দেখি মা বিছানাতে শুয়ে শুয়ে শরৎ চন্দ্রের উপন্যাস পড়ছেন। সাধারণত এই সময়ে মা টেলিভিশনে বাংলা সিরিয়াল দেখতে ব্যাস্ত থাকেন। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে মায়ের পাশে বসে বললাম -” মা আজ বাবা ব্যাঙ্কে এসেছিলেন।” বিনা ভূমিকায় আমার মুখ থেকে কথাটা শুনেই মা চমকে উঠলেন। হাত থেকে বইটি বিছানার উপর পড়ে গেল। বয়স হয়েছে তো, এখন আর আগের মতো রাগ, তেজ, জেদ নেই। নিচু স্বরে বললেন -” আমি এমনি একটা আশঙ্কা করেছিলাম।” আমি যে বাবার সাথে মিসবিহেভ করেছি সেটা কোড টু কোড মাকে বললাম। ভাবলাম বাবার উপর মায়ের যা ক্ষোভ তাতে মেয়ে উপযুক্ত উত্তর দিতে পেরেছে বলে খুব খুশি হবেন। কিন্তু না, আমার ভুল ভাঙিয়ে মা শান্ত নম্র ভাবে বললেন-” তুমি অতটা নির্মম না হলেও পারতে, তিঁনি কিন্তু তোমার জন্মদাতা পিতা।” এই যে বাবা নামক মানুষটার উপর আমার এত অনীহা, তার সিংহ ভাগ জুড়ে রয়েছে মায়ের বাবা সম্পর্কে নেতিবাচক কথাবাত্রা। আজ যেই মুহূর্তে মা বাবা সম্পর্কে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করলেন, আমারও কেন জানি নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। যে যে কথা বা ভাবনা থেকে বাবার থেকে দূরত্ব তৈরী করে ছিলাম, এখন সেগুলো আর মাথায় আসছে না। মনে হচ্ছে বাবার সাথে দূরত্ব তৈরী হওয়ার দায় কি শুধুই বাবার ছিল!!
এই ঘটনার মাস খানিক পরে একদিন বৃদ্ধ প্রকাশক মহাশয় আমাদের বাড়ীতে এলেন। তিঁনি জানালেন দাদুর অসমাপ্ত লেখা গুলো রবীন্দ্রনাথ ঘোষ অর্থাৎ আমার বাবা জীবনের অনেকটা সময় ব্যায় করে সম্পূর্ণ করেছেন। প্রকাশক মহাশয়ের ইচ্ছা বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে যেন আমরা উপস্থিত থাকি। তাঁর আর একটি প্রস্তাব হলো, যেহেতু বইটি দাদু ও বাবা মিলিত ভাবে সম্পূর্ণ করেছেন, সেই জন্য বইটি আমার হাতে প্রকাশ হোক। মা আমার অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে নিমন্ত্র গ্রহণ করলেন। এবং নিজেও উপস্থিত থাকবেন বলে কথা দিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আমি আর মা বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হলাম। অনেক মানুষের মধ্যে খুঁজতে থাকলাম বাবাকে, কিন্তু কোথাও তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। পাশ থেকে মা আমার কানের কাছে মুখ এনে আস্তে আস্তে বললেন- ” তাহলে তোমার বাবা কি আসেননি!!” আমি একটু অবাক হলাম বইকি। মা-ও তাহলে ভিড়ের মধ্যে বাবাকে খুঁজছেন। মনে মনে ভীষণ তৃপ্ত হলাম এই ভেবে যে , এ এক তীর্থ ক্ষেত্রের মহেন্দ্রক্ষণ, যেখানে দুটি মনের পুনর্মিলন ঘটবে। এবং সেই মুহূর্তটা চাক্ষুষ করব আমি স্বয়ং। সময় ধর্মের কাঁটা নাড়িয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় কে ভুল আর কে ঠিক। আঙ্কেল মার জীবনে না আসলে মা হয়তো বাবাকে চিনতে পারতো না। অর্থ মানুষকে সুখ দেয়, শান্তি দেয় না। আর হঠকারিতা সুখ ও দেয় না, শান্তিও দেয় না, দেয় শুধু হতাশা। যেটা মা সারা জীবন পেয়ে এসেছে। মনের মানদণ্ড দিয়ে মন গুলোকে মা মেপে বুঝতে পেরেছেন কোন মনের মান কত। সাত পাঁচ ভাবছি আর ভিড়ের মধ্যে বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। এরই মধ্যে প্রকাশক মহাশয় এলেন আমাদের সুবিধা অসুবিধা খোঁজ খবর নিতে। আমি তাঁকে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বললেন বাবার সাথে তাঁর তিনদিন আগেও কথা হয়েছে, আমি, মা যে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে আসছি সেটাও তিঁনি বাবাকে জানিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় নাকি আজ সকালে বাবা ওনাকে ফোন করে জানিয়েছেন তাঁর শরীরটা খুব খারাপ, সেই জন্য তিঁনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না। প্রকাশক মশাই আরো বলেন,বাবা নাকি হার্টের প্রবলেমে দীর্ঘ দিন ভুগছেন। মায়ের মুখ দেখে বুঝলাম মা কথাটা শুনে খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। কারণ সমাধানের তরীটা তীরে ভিড়ানোর আগেই সলিল সমাধি হলো। এর জন্য দায়ী আমি। ব্যাঙ্কে যখন আমি তাঁকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছিলাম। তখন তিঁনি বলেছিলেন, আমি যেন কষ্ট না পাই, তিঁনি আর কখনোই আমার সম্মুখে আসবেন না। তাই হয়ত আজ তাঁর এই কঠিন সিদ্ধান্ত।
বেশ কিছুদিন পর এক ছুটির দিনে আমি আর মা ঘরে বসে গল্প গুজব করে সময় কাটাচ্ছি। প্রসঙ্গত বলি, বর্তমানে মা বাবার প্রতি এতটাই সদয় যে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বাবার উপস্থিত না থাকার দায় মা বাবার কাঁধে না চাপিয়ে নিজের কাঁধে নিয়েছেন। এবং তিনি এটাও মেনে নিয়েছেন যে তিঁনি যদি প্রথম থেকে আরও কিছুটা মেন্টালি এডজাস্টমেন্ট করতেন, তাহলে হয়তো তাদের জীবনে এমন সময় আসত না। আবার ব্যাঙ্কে বাবার সাথে দূর ব্যাবহারের কথাটা মনে পড়লেই নিজের প্রতি আমার ঘৃণা হয়। আমি জানি অতীতকে ফিরিয়ে এনে ভুল সংশোধন করা যায়না। কিন্তু ভুল স্বীকার করে তো প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। যেই ভাবা সেই সিদ্ধান্ত। ঠিক করলাম আমি আর মা বাবার কাছে গিয়ে আমাদের সব অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইব।
যাব যাব করতে করতে মাস ছয়েক কেটে গেল। মা আমি কিছুতেই সময় করে উঠতে পারছিলাম না। সেদিন অফিস থেকে ফিরে মায়ের পাশে বসে চা খাচ্ছি। মা দুই একটা সাংসারিক কথা বলে বাবার কথা তুললেন, বললেন বাবার সাথে যোগাযোগ করার ব্যাপারে আমরা দেরি করে ফেলছি। আর কাল বিলম্ব না করাই উচিত ভেবে ঠিক করলাম পরের রবিবার অবশ্যই যাব।
ঠিক দুইদিন পর সকালে অফিসে যাব বলে ব্যাস্ততার মধ্যে গোছগাছ করছি। বাথরুম থেকে বেরুতেই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখি, বছর বাইশ তেইশের একটি ছেলে হাতে একটা ফাইল আর একটা সাদা খাম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। কি ব্যাপার জানতে চাইলে ছেলেটি প্রথমে আমার হাতে সাদা খামটি দেয়। আমি একটু অবাক হয়ে খামটি খুলে দেখি ভাঁজ করা একটা কাগজ। কাগজের ভাঁজ খুলে দেখি একটা হাতে লেখা চিঠি। চিঠি খুলতেই——
কল্যাণীয়াসু— অনুশ্রেয়া, আমি তোমার হতভাগ্য বাবা। কোনো উপায়ান্তর না হওয়ায় এই পত্রের অবতারণা। তবে, এই পত্রখানি যখন তোমার হাতে পড়বে তখন আমি আর এই পৃথিবীতে থাকব না। এইটুকু পড়ে আমি চমকে উঠি,অর্থটা ঠিক পরিষ্কার না হওয়ায় ছেলেটির দিকে তাকাই। আমি কিছু বলবার আগেই ছেলেটি বলল-” গত কাল জেঠু মারা গেছেন। বাবার কাছে এই ফাইল আর খামে ভরা চিঠিটি রেখে বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন আপনাদের ঠিকানাতে পৌঁছে দেয়া হয়।” ছেলেটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে চিঠিটি পড়তে শুরু করলাম। “আমাকে ক্ষমা কোরো মা, তোমার মায়ের নিঃসঙ্গ জীবনের দায় শুধুমাত্র আমার । আমার অক্ষমতা তোমার জীবনকেও দুর্বিসহ করে তুলেছে। আমি আত্ম বিশ্লেষণ করে স্বভুল গুলো অনুধাবন করেছি, কিন্তু ভয় এবং লজ্জায় তোমাদের সম্মুখে যেতে পারিনি। তোমার দাদা মশাই যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আমি তোমার খোঁজ খবর পেয়েছি। তোমাকে দেখার জন্য আমার মনটা ছটফট করতো, অনেক স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু বাস্তবতার কথা ভেবে আর এগুতে পারিনি। যখন আমার কানে এল তুমি বিরাটি ব্রাঞ্চে জয়েন্ট করেছ, তখন আমার কর্তব্য, বিবেক,বুদ্ধির মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধে গেল। জয় হলো আমার অপত্তস্নেহের। তোমার মা তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, এটা শাশ্বত, কিন্তু আমার রক্তের ধরা যে তোমার শরীরেও প্রবাহিত হচ্ছে, সেটা তো আমি অস্বীকার করতে পারবনা। কারণ রক্ত যে কথা বলে। মানুষিক যুদ্ধে আমি তার কাছে পরাজিত হলাম, ছুটলাম ব্যাঙ্কে, শুধুমাত্র তোমাকে দুই চোখ ভোরে দেখতে। ওখানে যেটা ঘটেছিল তাতে আমি দুঃখ পাইনি, শুধুমাত্র হতাশ হয়েছিলাম। কারণ ওটা আমার প্রাপ্য ছিল।
তোমাকে উপদেশ দেওয়ার মতো সৎ সাহস আমার নেই, তবুও বলি, তুমি নিজে পছন্দ করে পাত্রস্থ হও। নিঃসঙ্গতা মানব জীবনের ধর্ম নয়। আমার ভুলে আমি ও তোমার মা এই জনঅরণ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ। বাবাকে দিয়ে বিচার কোরনা, পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ হয় না। স্বেচ্ছা নির্বাসনে না গিয়ে মায়ের পরামর্শ নিও। পরিশেষে বলি আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই তাই আমার ক্ষুদ্র বসত বাড়ীর দলিল এবং ব্যাঙ্কের বইটি পাঠিয়ে দিলাম। তোমাদের মঙ্গল কামনা করি। তোমার বাবা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ।
চিঠি পড়া শেষ করে অনুশ্রেয়া হাত দুটি বুকের উপর ধরে আকাশের দিকে চেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সমস্ত ঘটনাটা আমরা অনুশ্রেয়ার মুখে শুনলাম। চিঠি পড়া শেষ করে সে কেঁদে তার বাবাকে কি বললো আমরা জানিনা, তবে কাঁদার ভাষাটা অনুমেয়——– সাশ্রু লোচনে পড়িতে না পারি, চোখ মুছি বারে বারে; এ কোন পত্র দিলে তুমি মোরে, বিধিল যে অন্তরে।
Ato Bhalo lekha satti mon chuye gelo.
ধন্যবাদ..