রূপকথা
কাকলি ঘোষ
” সেই তুই যাবি? কোন কথা শুনবি না ?” অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকায় মালতী।
” গিয়ে দেখিই না। যদি কিছু ব্যবস্থা হয়____!” ব্যাগে নিজের জিনিস গুলো ভরতে ভরতে চোখ না তুলেই উত্তর দেয় নিখিল।
” কি ব্যবস্থা হবে শুনি ? কে আসবে তোর জন্য ? কত জনকেই তো ধরলি—- হল কিছু? হবে না। হবে না। আমাদের ঘরে এইটুকু হওয়াই অনেক।”
এক মুহুর্তের জন্য হাত থেমে গিয়েছিল। মনও বোধ হয়। তারপর আবার স্থির ভাবে নিজের কাজ করে যায় নিখিল।
কয়েক পলক ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে রান্নার জায়গায় ফিরে যায় মালতী। কড়ায় তেল দিয়ে আলুগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে আবার ফিরে তাকায়। কেমন যেন কঠিন দেখাচ্ছে ছেলের মুখ। সেদিকে চেয়ে মোচড় পড়ে বুকে।
বাপ মা হয়েও কিচ্ছু করতে পারলো না ওরা ছেলেটার জন্য। এত পড়াশুনো করার শখ! কত ভালো ‘রেজাল্’! মাধ্যমিক , উচ্চ মাধ্যমিক! সারা গ্রামের কথা বাদ দাও জেলার মধ্যে সেরা হয়েছে ছেলে! রাজ্যের মধ্যেও কি যেন ! কাগজ থেকে, টিভি থেকে কত ছবি , কত খবর! সেখানেই কি শেষ! ওই যে কি বলে না! “জয়েন্ট এন্ট্রেস” না কি! ঠিক করে তো উচ্চারণ ই হয় না ওর! ছেলে বলে তাই শুনে শুনে বলা! সেখানেও সুযোগ পেয়েছে ছেলে! কোথাকার অজ গ্রামের এক দিন মজুরের ছেলে! সেও কিনা ডাক্তারি পড়ার ডাক পায়! কিন্তু পেলে কি হবে? পড়াবে কি করে? ভর্তি করার টাকা কই? চেষ্টা তো কম করলো না এই ক ‘ দিন! রেজাল্ বেরোবার পর যারা এত ভালো ভালো কথা বলল তারা তো কেউ ই কিছুই করলো না! গেছে তো নিখিলের বাপ সবার কাছে। দোরে দোরে। পার্টির নেতাদের কাছেও। কই! কেউ একটা আশার কথা, ভরসার কথা শোনাল? উল্টে অন্য রকম বুদ্ধি দিয়েছে সব।
” এত দূর লেখাপড়া শিখেছে ছেলে! এবার কাজে কম্মে ঢুকিয়ে দাও। ”
মাথা নিচু করে বাপের সাথে ঘরে ফিরে এসেছে ছেলে। মনটা মুচড়ে উঠেছে মালতীর। না একটা মাস্টার, না ঠিকমত বই! কিছুই দিতে পারেনি ছেলেটাকে! পেট ভরে যাদের ভাত জোটে না তারা আর অন্য চিন্তা করবে কখন! তার মধ্যেও শুধু নিজের চেষ্টায় পরীক্ষায় এমন রেজাল্! অথচ টাকার অভাবে ভর্তি হওয়াই বন্ধ হতে চলেছে। সাহায্যের জন্য ছেলে নিজেও কম চেষ্টা করেছে? এখন কি সব হয়েছে না! মোবাইলে! বন্ধুদের ধরে প’ড়ে সেখানেও চেষ্টা করেছে। কই! কিছুই তো হল না।
অথচ ছেলে বুঝেও বুঝতে চায় না। এই যে জোর করে যাচ্ছে কলকাতায়। আজই ভর্তি হবার শেষ দিন। কি লাভ হবে গিয়ে! কে ভর্তি করবে তোকে! টাকা কোথায় পাবি! কিন্তু কিছুতেই শুনবে না। উল্টে বাপকে সুদ্ধু টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক দিনের রোজ মাটি হবে মিছিমিছি। অনেক বলেছে মালতী। কি যে জেদ ছেলের! সেই ঘাড় গুজে দাঁড়িয়ে থাকবে!
হবে না রে হবে না। শুনলি না? সেদিন উঠোনে দাঁড়িয়ে তোর সামনেই তো বলে গেল বলাই বাবু,
“ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে কি লাভ রে? বরং একটা কাজ টাজ জুটিয়ে নে এবার” মুখ নিচু করে মাটিতে পা ঘষেছে ছেলে! জবাব দেয় নি। জানে, দেখেই বুঝেছে মালতী ও ছেলে কারুর কথা শুনবে না! যাক । নিজেই গিয়ে দেখে আসুক।
বুঝবে তখন!
বুঝছিল নিখিল সত্যি। এতবড় কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে একবার মনে হচ্ছিল পালায়। এখানে কি কোন আশা আছে? শুধু ওর রেজাল্ট দেখে ভর্তি কেউ নেবে ওকে? টাকা চাই। টাকা। তবু এসেছে। আসলে আসতে বলেছে ওকে। রথীন, তপন , সুদেশ । ওর ই স্কুলের বন্ধু ওরা। সোশ্যাল নেট ওয়ার্ক এ ওরা নাকি ওর কথা ছড়িয়ে দিয়েছে। রথীন বলছে হতেও পারে। এরকম নাকি হয়! কেউ কেউ আছে এমন ও যারা লোকের জন্য কিছু করে।
” তুই চল তো। হয়ত দেখলি কেউ এসে তোর ভর্তির টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।” _
আর ওকে বলতে দেয় নি নিখিল। হেসে ফেলে নিজেই শেষ করেছে কথাটা,
” হ্যাঁ। সেই রূপকথার মত। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মত। তাই না? ওসব গল্পেই হয় রে। বাস্তবে না।”
ওর হাসিতে কি কান্না মেশানো ছিল ! তা না হলে অমন ছলছলিয়ে উঠবে কেন ওদের চোখ গুলো। জানে কিচ্ছু হবে না। তবু ওদের কথা ফেলতে পারেনি নিখিল। এসেছে।
” তুই এখানে দাঁড়া। আমি ভেতর টা দেখে আসি। একটা অ্যানাউন্সমেন্ট করাব। ”
এক ছুটে ভেতরে চলে যায় রথীন আর সুদেশ।
” আজ শেষ দিন না রে ভর্তি হবার? ” চারদিক চেয়ে প্রশ্ন করে তপন
” হুম।”
” এত ভীড়! কত জন বাকি রে এখনও! তুই একাই না!”
” তাই তো দেখছি” , সংক্ষেপে উত্তর দেয় নিখিল। কথা বলতে ইচ্ছে করে না ওর। শুধু চেয়ে থাকতে মন চায় স্বপ্নের এই বাড়ীর দিকে।
মেডিকেল কলেজ! ওর ছেলেবেলার স্বপ্ন! ওর তারুণ্যের অঙ্গীকার! ওর ভবিষ্যত জীবনের আশ্রয়! মিলবে কি ! হবে কি পূর্ণ এই আকাঙ্ক্ষা! রথীন যা বলল সত্যি কি হবে তেমন কিছু ওর জীবনে! রূপকথার মত! ভোরের দেখা স্বপ্নের মত! আসবে কি কেউ সত্যি ওর আশা পূরণ করতে! নাকি ছেলেবেলা থেকে পরীক্ষার খাতায় শেষ দিন পর্যন্ত লিখে আসা ডাক্তার হবার স্বপ্ন আজ এক্ষুনি এই মুহুর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে! কিন্তু তার পর! কি করবে নিখিল! স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে কি করে মানুষ! বাঁচে কি করে! না। না। তা হতে দিতে পারে না নিখিল। বাকি জীবন টা স্বপ্ন ছাড়া বাঁচবে কি নিয়ে ও! তার চেয়ে চলে যাবে ও। রথীন শুকনো মুখে ফিরে আসার আগেই পালিয়ে যাবে এখান থেকে ! এক্ষুনি!
দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় নিখিল। এখন ফিরলে বাবা কাজে যেতে পারবে। পুরো রোজ টা মাটি হবে না। ওকেও যেতে হবে বলাই বাবুর কাছে। কি কাজ আছে বলেছিলেন সেদিন____ যদি হয়!!
মুখ ফিরিয়ে বাবার দিকে চেয়ে কি বলতে যায় নিখিল। পরক্ষনেই চোখে পড়ে উন্মাদের মত ছুটে আসছে রথীন। হাসছে, কাঁদছে পাগলের মত!
” কি! বলেছিলাম না! হবে। হবেই! ওরে পৃথিবীটা এখনও খারাপ হয়ে যায় নি! ওরে মানুষ এখনও আছে। ভাবতে পারিস ! তোকে ভর্তি করার জন্য তোর আগে থেকে লোক এসে বসে আছে! শুধু অ্যানাউন্সমেন্ট করার অপেক্ষা! বলেছিলাম না সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু জানানো!! চল ! হাঁ করে দেখছিস কি! ভর্তি হবি। ডাক্তার হবি। তারপর আবার কিন্তু এই গ্রামে ফিরে আসিস ভাই। আমাদের ভুলিস না। ”
চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল নিখিল। ঝাপসা হয়ে আসছিল ওর চারপাশ। তার ই মধ্যে স্পষ্ট দেখছিল নিখিল। অনুভব করছিল তাদের অস্তিত্ব।
রূপকথারা আজও আছে। আজ ও আসে। আসে নিঃশব্দে। ঘুরে বেড়ায় এই ইট কাঠ কংক্রিটের শহরে। নীরবে। গোপনে।
—oooXXooo—