ভাড়াটে মা
নভশ্রী সান্যাল
বিয়ের আগেই বেশ কিছুকাল থেকে মাসের ওই কটা দিন খুব সমস্যায় ফেলতো পৃথাকে।
নিউইয়র্কের মতো জায়গায় থেকেও পৃথা কেন যে এভাবে অবহেলা করেছে বিষয়টাকে কোনো ডঃ কনসাল্ট না করে, এটাই আশ্চর্য।
আসলে আদতে মনে প্রাণে বাঙালী সাধারণ মেয়ের মতোই যাচ্ছি,যাবো করতে করতে ওই সময়টা পেরিয়ে গেলেই আবার ওখানকার অতিব্যস্ত জীবনে মিশে গিয়ে হারিয়ে যেতো ডঃ কনসাল্টেশনের ভাবনা।
বিয়ের সময় পৃথা-অরণি দুজনেই এসেছিলো খুব অল্প সময় নিয়ে।
তাই এবার একটু বেশি সময়ের ছুটির ব্যবস্থা করেই দুটিতে প্রচুর প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে কলকাতায় এসেছে কখনো দুই পরিবারের সবাইকে নিয়ে, কখনো বন্ধু-বান্ধব নিয়ে, কখনো একান্তে দুজনে কোথাও …শুধু আনন্দ,খুশী,মজার হুল্লোড়ে মেতে থাকার জন্য।
কিন্তু ওই যে….কথাতেই আছে, “MAN PROPOSES, GOD DISPOSES.”
একদিন হঠাৎই প্রচণ্ড পেটে যন্ত্রণা শুরু হয় পৃথার। পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছোয় যে ওকে হসপিটালাইজ্ড করতে হয়।
ইউ.এস.জি. তে দেখা যায়
ইউট্রাসে কিছু সিস্ট ও বিপজ্জনক অবস্থায় একটি বেশ বড় টিউমার। ইমিডিয়েট অপারেশন প্রয়োজন।
অপারেশনে ডঃ-দের বহু চেষ্টা স্বত্বেও ইউট্রাস রাখা গেলো না পৃথার। অরণির কনসেন্ট চাইলে ও নির্দ্বিধায় সম্মতিসাক্ষর দিয়ে দেয়। পৃথার জীবনের মূল্য অরণির কাছে সর্বাধিক।
শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও মানসিকভাবে উত্তরোত্তর বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকে প্রাণবন্ত হাসিখুশী মেয়েটা। আর কোনোদিন ও conceive করতে পারবে না, এই ভাবনাটা ওকে ভেতরে ভেতরে দগ্ধাতে থাকে অহর্নিশ।
সন্তানধারণে ব্যর্থ পৃথা নিজেকে অপরাধী করে ক্রমশ ডিপ্রেশনে।
ওর মন ভালো করতে অ্যাডপ্টেশনের কথাও বলেছিলো অরণি। কিন্তু, পৃথা রাজি হয়নি।
মা-বাবা বলে ডাকলেও তার মধ্যে তো
পৃথা-অরণির জিন থাকবে না, তার শিরায় শিরায় বইবে না ওদের রক্ত…!!
পৃথার সবসময় মনে হবে বাচ্চাটার মা ও নয়,অন্য কেউ। মায়া-মমত্ববোধ জন্মালেও,সন্তানস্নেহ-ভালোবাসা কখনোই দিতে পারবে না মন থেকে বাচ্চাটাকে।
সেটা তো বাচ্চাটার সাথেও প্রতারণা। পৃথা তা কখনোই পারবে না।
বহুভাবে বুঝিয়েও ব্যর্থ,ক্লান্ত অরণি যখন পৃথাকে নিয়ে দিশেহারা, তখন ওর বন্ধু নিলয় ওকে আই ভি এফ স্যারোগেসির কথা বলে।
ওদের বুকে জেগে ওঠে ক্ষীণ আশার আলো।
তাই তো, এদিকটা তো ভেবে দেখেনি ওরা!
এমন নয় যে অজানা বিষয়, তবু মনে হয়নি।
শুরু হয় ডাক্তারের কাছে যাতায়াত।
দুজনেরই নানানরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আসে স্যারোগেট মাদারের পর্ব।
বিভিন্ন সূত্রে নিলয়ের সাহায্যেই কয়েকজন স্যারোগেট মাদারের খোঁজ পেলেও সমস্ত দায়িত্বগ্রহণ এবং অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়েও কেউই বিদেশে যেতে রাজি নয়।
যদিও নিজের শরীরে পৃথা সন্তানকে লালন করতে পারবে না, তবুও ওর আর অরণির অংশ থেকেই তো জন্ম হবে তার।
এও কি কম ?!
অজান্তেই পৃথা খুব গোপনে ছোট্ট এক জীবনের স্বপ্নে মশগুল হতে শুরু করেছিলো।
কিন্তু,…. আবার নিরাশার মেঘ ভিড়তে শুরু করে দুটি কাঙাল বুকেই।
এদিকে ওদের ভিসা ফুরিয়ে আসছে দুজনেরই ছুটির সাথে।
যখন সব আশা নিঃশেষ, তখনই ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ একজনের সন্ধান মেলে, যিনি পুরো ব্যাপারটাতে সম্মত।
ভদ্রমহিলাকে ডঃ নিলাদ্রীর ক্লিনিকে আসতে বলা হয়,ওরাও যাচ্ছে।
ফোনে কথা হলেও সাক্ষাত পরিচয়টাও প্রয়োজন। যেখানে উনি যাচ্ছেন ওদের সাথে।
ক্লিনিকে অপেক্ষারতা অনেকের মাঝে আপাদমস্তক বোরখা আর হেজাবে ঢাকা শুধুমাত্র দৃশ্যমান দুটি কাজলকালো চোখ মুহূর্তে কেমন দুলিয়ে দিলো অরণিকে।
বারংবার অবাধ্য দৃষ্টি এক অমোঘ আকর্ষণে মিলিত হচ্ছিলো ওই চোখে।
আশ্চর্য!! যতবার অরণি তাকিয়েছে,ততবারই দেখেছে চোখদুটিও ওকেই দেখছে…চোখে চোখ পড়াতে চকিতে সরিয়ে নিচ্ছে দৃষ্টি।
তবে কি সেই …..!!!
অনেকগুলো দিন জীর্ণ পাতার মতো ঝরে গেলেও ওই ভ্রমর চোখের দৃষ্টি কীকরে ভুলবে সে?!
ভেতরে সুনামির আলোড়ন নিয়ে নিশ্চুপ বসে ভেতরে ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলো অরণি।
মেহেরুন্নিসা কেমন একদৃষ্টে দেখছিলো পৃথাকেও। কী যেন খুঁজছিলো ওর মুখে।
সবরকম ফর্মালিটিস,কথা-বার্তা শেষে চেম্বারের বাইরে এসে মেহেরুন্নিসা জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কি পাঠভবনের 84এর ব্যাচ?”
অবাক পৃথা সম্মতি জানালে বলে,
“আপনি মানে তুই পৃথা তো?!”
“হ্যাঁ” বলতেই জড়িয়ে ধরে বিস্ময়বিহ্বল পৃথাকে।
তারপর, হাসিকান্না মিশিয়ে বলে, “এই তোর বন্ধুত্ব!! চিনতেই পারলি না আমায!!”
মুখের ঢাকনা,হেজাব সরিয়ে নিয়ে বলে, দেখতো এবার চিনতে পারছিস কিনা?
খানিকক্ষণ তাকিয়ে পৃথা চেঁচিয়ে ওঠে, “শবনম, তুই… !!!কোথায় হারিয়েছিলি রে? তোর ঠিকানা খুঁজেছি কত…পাইনি।”
পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে হারিয়ে পাওয়া এককালের দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু।
পাশে দাঁড়ানো অরণির অস্তিত্ব ওরা ভুলে গেছে বেমালুম।
অরণির বুকেও থমকেছে সময়।
ওই চোখ এতকাল পরেও ওর চিনতে ভুল হয়নি। ওতেই যে হারিয়েছিলো নিজেকে।
কত ফেরারী স্মৃতি ভিড়ছে মনে।
বহু কষ্টে সময়ের পলল মৃত্তিকায় ঢেকে যাদের আড়াল চেয়েছিলো মন।
কেন যে শবনম হঠাৎ নিজেকে অরণির থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলো সেদিন ….!!
নিয়তির বিচিত্র খেয়ালে সেই শবনমই আজ ওদের সন্তানধারনের জন্য স্যারোগেট মাদার হতে ওর সামনে!!
আবার পৃথা-শবনম বন্ধু ছিলো!!
অরণির ভেতর এই বিচিত্র যোগ-বিয়োগের অনুভবে তোলপাড়।
শবনম ভাবতেও পারেনি অরণি-পৃথার সাথে এভাবে দেখা হবে, তদুপরি ওর অরণি ওরই প্রিয় বন্ধু পৃথার স্বামী।
আল্লাহ্ রসুলের কী অদ্ভুত বিচার…
যে অরণিকে ভালোবেসে ও পরিবারত্যাগ করতে চেয়েছিলো, সেই অরণির থেকেই নিজেকে চিরদিনের মতো সরিয়ে নিয়েছিলো আব্বা-চাচাজানের ভয়ে।
নইলে ওরা অরণিকে জানে মেরে দিতো।
এতকাল পর আল্লাহ্ ওকেই পাঠালো অরণি-পৃথার সন্তানধারণের জন্য!!!
ও-ও তো পারতো আজ অরণির সন্তানের সত্যিকারের মা হতে, স্যারোগেট মাদার হওয়ার পরিবর্তে!
আল্লা তালাহ্-র যেমন মর্জি।
ও জানে, কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ওর জন্য অরণি।
নিজের যন্ত্রণা নিয়ে ও ভাবে না।
যন্ত্রনাও অভ্যাস হয়ে যায় একসময়।
তাছাড়া, যেভাবেই হোক অরণির সন্তানধারণের সাথে ওর জন্য কিছু করার সুযোগটুকু তো পেলো ও। হারিয়ে পাওয়া বন্ধু পৃথার জন্যও …
আল্লা মেহেরবান।
অরণির চাপা আশঙ্কা ছিলো, শবনম এই স্যারোগেসিতে রাজী হবে না শেষপর্যন্ত।
সব দুঃশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে শবনম ওদের সাথে উড়লো আকাশে।
নতুন জায়গায় সুখ-বিলাসের প্রাচুর্য থাকলেও শবনমের ভালো লাগেনা।
অরণির সাথে পূর্ব-পরিচয় পৃথার অজানা।
অরণির দৃষ্টি-মনোযোগ ওর মনের একতারে সূক্ষ কাঁপন জাগালেও দুজন দুজনকে এড়িয়েই চলে।
এমনভাবেই বহতা সময় একদিন এনে দিলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ।
শবনম জন্ম দিলো ফুটফুটে এক শিশুকন্যার।
পৃথা যখন বাচ্চাটাকে শবনমের থেকে কোলে নিয়ে হাসছে, আদর করছে মশগুল হয়ে, অরণি শবনমের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ও ভাসছে নোনাজলে।
অরণিকে দেখেই মুখ ঘোরালো।
এবার ফেরার পালা শবনমের।
বন্ধুকে ছাড়তে নারাজ পৃথা আজ যেন বেশীই আগ্রহী শবনমের ফেরাতে।
আপনমনে হাসে শবনম।
বোঝে পৃথার ভয়ের কারণ, পাছে সন্তানের উপর শবনমের টান বাড়ে…
একদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে শবনমের অনুপস্থিতিতে পৃথা ওকে ডাকতে গিয়ে শূন্য ঘরে দেখে টেবিলে শবনমকে দেওয়া চেক ও
একটি কাগজ চাপা ….
পৃথাকে লেখা শবনমের ছোট্ট লেখা…
পৃথা রে,
সামনে থেকে বিদায় নিতে হয়তো দুর্বল হয়ে পড়তাম।
তাই এমনভাবেই চলে গেলাম।
কিছু মনে করিস না।
যেতে তো হতোই আমাকে, তাই না?
এই চেকটা তোদের মেয়ের জন্য আমার উপহার-আশীর্বাদ।
খুব খুব আনন্দে আর শান্তিতে ভালো থাকিস সবাই মিলে।
—- শবনম
পায়ে পায়ে বেরিয়ে নীলাকাশে ভেজা দৃষ্টি ছড়ালো অরণি।
আজ জীবনের একমাত্র অপূর্ণতাকেও পূর্ণতা দিয়ে গেলো শবনম। তা সত্বেও বুকের অতলে ভুলে থাকা সেই চিনচিনে ব্যথাটা কেন নিভৃত কষ্টটুকু জিইয়ে রাখে এমন করে ….!!
কেন….??!!
জীবন সত্যিই বড় আশ্চর্য।
এখানে যোগ-বিয়োগের হিসেব বোঝা বড্ড কঠিন।
জানা অংকও কখন যেন ভীষণরকম অজানা সংকেতে না মেলা উত্তর উপহার দিয়ে যায়
যোগের সাথে বিয়োগ যেখানে অনিবার্যভাবে জড়িয়েই থাকে ওতোপ্রোত…
—ooXXoo—