এলেম নতুন দেশে
কাকলি ঘোষ
আজ সকালে নেমে এলাম অর্বুদাচল পাহাড় থেকে হ্রদ নগরী উদয়পুরে। হ্যাঁ ঠিকই বলছি। পাহাড়ের প্রকৃত নাম এটাই।ব্রিটিশরা এর নামকরণ করেছে আবু পাহাড়। তবে আপনাদের মত জানা ছিলনা আমারও। পাশের ঋষিপ্রতিম মানুষটি শিখিয়ে দিলেন আসল কথাটি।
“ এই পাহাড়ের আসল নামটি জানো তো ?”
স্বভাবসিদ্ধ মধুর স্বরে সহাস্যে প্রশ্ন করেছিলেন।
আমি তখন উদ্বেলিত। আমি তখন আত্মহারা। ভ্রমণে চলেছি প্রাণের মানুষটির সাথে। তাই দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললুম “ আবু পাহাড়। ”
এবার হাসি আরো বিস্তৃত হল। আর তা যেন উপচে উঠল অনিন্দ্য চক্ষু দুটিতে। পুলকিত চিত্তে দেখলাম সেখানে নৃত্য করছে এক অসাধারন কৌতুক।
“ ও তো ধার করা নাম। অমন নাম কি আমাদের দেশের হতে পারে ? এর প্রকৃত নাম অর্বুদাচল। কি ? এবার বল দেখি নামটি কেমন ? ”
“ অপূর্ব ! আচ্ছা গুরুদেব রাজস্থানে বেড়াতে আসা কি আপনার প্রথম ?”
“ তা প্রথমই বটে। শুনলুম তোমরা চলেছ। তুমিও ডাকলে। ভাবলুম যাই — দেখেই আসি রাজভূমি রাজস্থান কে।”
কি অপূর্ব ! রাজভূমি রাজস্থান ! বুকের ভেতরে খুশির তুফান যেন উছলে উঠছে। অবশ্য শুরু হয়েছে তা অনেক আগেই। যেদিন থেকে এই ভ্রমণে সঙ্গী হয়েছেন এই অনন্য মানুষটি। আবু পাহাড়ে গিয়ে এমন সঙ্গীর সঙ্গ করতে পারব এ যে স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।
কনকনে ঠান্ডায় লেকের ধারে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়েছিলাম। সঙ্গী সাথীরা গেছে সস্তায় উলের জিনিস কিনতে। একটু একটু করে পাহাড়ের মাথায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দিনান্তের রঙ নিঃশেষে মুছে নিচ্ছে আরক্তিম গোধূলি। একটা বাণী কেমন যেন বারংবার গুঞ্জরিয়ে উঠছে মনের মধ্যে।
“ মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দর বেশে এসেছ তোমায় করি গো নমস্কার।
মোর অন্ধকারের অন্তরে তুমি হেসেছে তোমায় করি গো নমস্কার।”
“ বাহ্ ! তোমার গলাটি তো বেশ !”
একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বরে চমকে তাকাই। মহেন্দ্র নিন্দিত কান্তি উন্নত দর্শন এক পুরুষ। পরনে গেরুয়া জোব্বা, আজানু লম্বিত বাহু, শুভ্র কেশ, শুভ্র শ্মশ্রু। আর অধরে দেব দুর্লভ হাসি। কে ! কে !
“ বড় অচেনা ঠেকছে বুঝি !’’ সহাস্যে কৌতুক করলেন তিনি।
“ গুরুদেব ! আপনি ! এখানে এই সময় ! কোথা থেকে এলেন ?”
“ আমি যে চির পথিক। বিশ্ব পথিক। তোমরাই তো নাম রেখেছ এমন। নয় কি ? জানো না আমি পথ ভোলা এক পথিক !”
স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। বুকের ভেতর অনাদি অনন্ত ঢেউয়ের উতরোল। রসের প্লাবনে কম্পিত হৃদয়। তিনি ! আমার অনন্ত আশ্রয়। আমার চিত্তের শান্তি। আমার আত্মার আনন্দ ! আমার সমস্ত হৃদয় পদ্ম জুড়ে যার অস্তিত্ব। সেই তিনি !
হাসছেন। তখনও। তেমনিভাবে।
“ আমার বাস কোথা যে জানো নাকি ? শুধাতে হয় সে কথা কি ?”
“ প্রণাম গুরুদেব।”
“ স্বস্তি।”
ওই অনিন্দ্য মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একটা সুতীব্র বাসনা তখন ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে অন্তরে। বলব ? তিনি কি পূর্ন করবেন আমার এই দুঃসাহসিক প্রার্থনা ! যদি অসন্তুষ্ট হন ! কিন্তু ওই দেবোপম অধরে যে ক্ষমাসুন্দর হাসি বিরাজ করছে তা কি কাউকে আঘাত করতে পারে ? নাহ ! কক্ষনো না। এমন দুর্লভ ক্ষণ আর কি কখনো আসবে সামনে ? এই ক্ষণ বিফলে গেলে বাকি জীবন নিস্ফল হয়ে যাবে আমার। তিনিই তো বলেছেন,
“ জীবনের পরম লগন কর না হেলা। “
সাহস সঞ্চয় করে দুরুদুরু বুকে মিনতি জানাই, “ গুরুদেব আমরা রাজস্থান ভ্রমণে বেরিয়েছি। কাল উদয়পুর যাব। আমার সঙ্গী হবার প্রার্থনা জানাই ।”
উদার মধুর হাসি খেলে যায় ওষ্ঠে।
“ বেশ। চল। যাওয়া যাক।”
কম্পিত বক্ষে ফিরে এলাম হোটেলে। জানা হল না তো কখন কিভাবে তার দেখা পাব আবার। বিনিদ্র রাত কাটিয়ে পরের দিন গাড়িতে বসে দেখি শান্তভাবে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। পাশের স্থানটিতে বসতে পেয়ে ধন্য হলাম।
উদয়পুর পৌঁছবার পথে পড়ল হলদিঘাটি। গাইড ভদ্রলোক হিন্দি ভাষায় রানা প্রতাপের বীরত্ব কাহিনী বর্ণনা করছিলেন।
সবার কান বাঁচিয়ে বললাম “ গুরুদেব আপনি কিছু বলুন।শুনি।”
করুন দুটি চোখ তুলে তাকালেন। দেখলাম টলটলে অশ্রু। বললেন, “না। কিছু না। সময় এখানে স্তব্ধ। মাথা এখানে আপনি নত হয় দেশপ্রেম , ত্যাগ আর শৌর্যের। সম্মুখে।”
বুঝলাম ইতিহাসকে বক্ষে ধারণ করেছেন যিনি তিনিই এখানে বাকরুদ্ধ। কিন্তু চলা তো শেষ হয় নি। তাই সেই মৌন মহান ত্যাগ মন্ডিত পরাক্রমকে বুকে রেখে যাত্রা শুরু হল আবার। এলাম উদয়পুর।
ভোর তখনও পূর্ণতা পায়নি। উদীয়মান সূর্যের অপূর্ব রক্তিম আভা যেন রাজটীকা পরিয়ে দিচ্ছে শৈল শহরটির মস্তকে। শুনলাম কবি গুন গুন করে গাইছেন
“ তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে কেউ তা জানে না। ”
অদূরেই ফতে সাগরের ওপর ঝিলমিল করছে সোনালী আলোর রশ্মি। সকল কলুষতা , বিচ্ছিন্নতা, নির্মমতার ঊর্ধে এক অনির্বচনীয় আলোকধারা। এক অনন্ত আনন্দের উৎস।
“ আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও । আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও।”
কতক্ষণ চেয়েছিলাম জানিনা। সম্বিত ফিরল যখন গাড়ি থামিয়ে দলের সকলেই ফতে সাগরে বোটিং এ যাচ্ছেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম সঙ্গের মানুষটির দিকে ।
“ নৌকা বিহার ? অতি চমৎকার। চল। যাওয়া যাক। ”
বসলুম পাশটিতে। শুরু হল ফতে সাগরের নীল জলে আমাদের একান্ত আপন নৌকা বিহার। বড় ইচ্ছে হচ্ছিল ওই হাতের স্পর্শ পেতে। কিছু কি বুঝলেন ?নিশ্চয়ই । নাহলে হঠাৎ কাঁধে হাত রেখে গান ধরবেন কেন “ এলেম নতুন দেশে। তলায় গেল ভগ্ন তরী কুলে এলেম ভেসে।” রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম,
“ সেকি ! এখন এই মাঝ নদীতে তরী ভগ্ন হলে উপায় কি হবে গুরুদেব ?”
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে হেসে গানেই উত্তর দিলেন,
“ নাম না জানা প্রিয়া
নাম না জানা ফুলের মালা নিয়া
হিয়ায় দেবে হিয়া। ”
মনে মনে ভাবলাম – মন্দ নয় ব্যাপারখানা। আপনার জন্য প্রিয়ারা অপেক্ষায় থাকবে ঠিকই। কিন্তু আমার মত সাধারণীর ব্যবস্থা কি হবে ?
যাই হোক গুরুদেবের কৃপায়ই হোক বা ঈশ্বরের শেষে তীরেই ভিড়ল তরী। এবার গন্তব্য ‘সহেলিও কি বাড়ি।’ রানা দ্বিতীয় সংগ্রাম সিংয়ের একমাত্র কন্যা শকুন্তলা কুমারীর জন্য তৈরি হয়েছিল এই উদ্যান বাটিকা। অপূর্ব স্থাপত্য, অসামান্য প্রযুক্তির এক অনুকরনীয় উদাহরণ এই বাগিচা।অজস্র গোলাপের বাগান। কোনটি প্রস্ফুটিত, কোনটি আবার স্ফুটনোন্মূখ। কবির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আবেশে বুজে গেছে তার চোখ। একটি আধ ফোটা গোলাপের সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছেন,
“ বল গোলাপ মোরে বল তুই ফুটিবি সখী কবে ?”
দেখলাম এ বিবশা ভাব কাটাবার উপায় দেখতে হবে। সামনেই রয়েছে অসাধারণ সব ফোয়ারা। প্রথমেই সুস্বাগতম ফোয়ারা। ভিতরে প্রবেশ করলেই এই জলধারা সিক্ত করে তপ্ত ক্লান্ত দেহকে। কানে এলো কবি গাইছেন
“ মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল মিলিয়ে থাকে মাটি পায় না তাকে। ”
এরপর বিন বাদল বরসাত ফোয়ারা। বৃষ্টি না হলেও যেন জলকেলিতে বাধা না পড়ে রাজকন্যা এবং সখীদের। এরপর রয়েছে রাসলীলা ফোয়ারা।রয়েছে কমল তলাই। পদ্মফুলে ভরা এই কৃত্রিম হ্রদ ফোয়ারা হাত তালির আওয়াজে বাড়ে কমে। আর সব শেষে শাওন ভাদো ফোয়ারা। চারদিক গাছপালায় ভরা এই জায়গার ফোয়ারার জল ওপরে উঠে এমনভাবে গাছের ওপর পড়ে যে কান পাতলে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়।
ঘুরতে ঘুরতে কবির মুখের দিকে চাইলাম। সদাপ্রসন্ন মুখে হালকা এক বিষন্নতার প্রলেপ। কি হল ? এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যন্ত্রের এমন জয়যাত্রা তা কি মুক্তধারার কবিকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না ?
“ না হে। তেমনটি নয়। ভাবছি —”
“ কি ভাবছেন গুরুদেব ? ”
“ শান্তিনিকেতনে বড় জলাভাব ছিল হে। বড় কষ্ট পেত আমার ছেলেরা, অধ্যাপকরা। আমি গরীব কবি। সে কষ্ট দূর করতে পারি নি।”
বুঝলাম। এই মরুদেশেও এমন জলের প্রাচুর্য কবিকে নিজের অক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। শিল্পীদের কৃতিত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলাম এই বাগিচা থেকে। এবার যাত্রা উদয়পুর সিটি প্যালেস। রানা উদয় সিংহ নির্মিত এই প্রাসাদ গঠন সৌকর্যে অতুলনীয়। পাহাড়কে ঘিরে নির্মিত মিউজিয়াম, অমরবিলাস, দেওয়ানি-খাস দেখে থেকে থেকেই কবি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছেন তখনকার মানুষের প্রযুক্তি বিদ্যা, সৌন্দর্য জ্ঞানের পরিচয়ে। গেয়ে উঠছেন মাঝে মাঝে,
“ বড় বিস্ময় লাগে ”
মিনিয়েচার সংগ্রহ দেখে শিশুর মত হেসে উঠছেন। সব শেষে এলাম রাজা ভূপাল সিংয়ের চিত্রকলা ও বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ শালায়। কবির খুশি যেন বাঁধনহারা।
“ ওটা এক ধরনের এসরাজ। বুঝলে ? আমার গান এসরাজ ছাড়া ভালো লাগে না জানো ?”
আমি তো চিরকালের তার্কিক। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। বললাম,
“ তাই বুঝি ! তাহলে আমরা যে এতকাল হারমোনিয়াম, তানপুরা নিয়ে গেয়ে এলুম – সেগুলো বুঝি গান নয় ?”
“ আহা তা বলছি নে।” একটা বীণার উপর হাত বোলাতে বোলাতে কবি বোঝাবার চেষ্টা করলেন , “ আসলে এসরাজে সুর খোলে ভালো। আচ্ছা ওটা কি কোন হ্রদ ? কি হ্রদ ?”
প্রাসাদের পিছনেই রয়েছে পিছোলা লেক। কবির অনুপম তর্জনী প্রসারিত হয়েছে সেদিকেই। লেকের মধ্যেই ভাসমান ধবধবে সাদা প্রাসাদ জগমন্দির প্যালেস। শোনা যায় জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র খুররম —- পরবর্তী কালে যিনি শাহজাহান নামে পরিচিত হন — পিতার রোষ থেকে বাঁচতে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
শুনে চুপ করে রইলেন কবি। তারপর মৃদু স্বরে বললেন “ আহা ! কি সুন্দর ! শুক্তি মধ্যে মুক্তা যথা। জানো তো এই শাহজাহানকে নিয়েই একটি কবিতা লিখেছিলাম —”
“ জানি । শোনাতেও পারি।
একথা জানিতে তুমি ভারত ইশ্বর শাহজাহান ।কাল স্রোতে ভেসে যায়–”
“ থাক।”
বুঝলাম না। একটা বিষাদ চিহ্ন আবার স্পষ্ট প্রকট কবির মুখে।
“ কি হয়েছে কবি ?”
“ এবার যেতে হবে বুঝলে ? বেলা যে পড়ে এলো।”
বেলা পড়ে এলো ! যেতে হবে ! বিদায় দিতে হবে প্রাণপ্রিয় কবিকে ! নিজেরই অজান্তে কখন ভরে এসেছে দু চোখ — টেরই পাইনি। তিনি বুঝলেন। নিঃশব্দে দু হাতের মুঠোয় ধরলেন হাত। তার সেই অনুপম চোখ দুটি মেলে পূর্ন দৃষ্টিতে দেখলেন আমার চোখে।
“ বিদায় নেবার সময় এবার হল
প্রসন্ন মুখ তোল , মুখ তোল।”
রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা
এমন কেন সত্যি হয় না আহা
ঠিক যেন এক গল্প হোত তবে
শুনত যারা অবাক হোত সবে
কলমে তোমার এত কি করি আছে ?
পৌঁছে যাবে এক্কেবারে রবিঠাকুরের কাছে ?
—oooXXooo—