ভোরবেলা
মৌসুমী ঘোষাল চৌধুরী
অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে হওয়ার পরে, ” নদী “, চুপচাপ সংসারের গতিধারায় জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলে। তাকে ঘিরে অনেক গুলো মানুষের জীবন ও প্রবাহিত। সারা রাত ঘুমোতো না। ঝিমিয়ে উঠে পড়ত। ভোরবেলা অনেক রান্না করতে হবে। একটা ফ্রীজ ও নেই। বাজারের থলিটা নিয়ে বেরিয়ে পরে। তার মা কিনে পাঠায়, চাকি বেলুন, শিল নোড়া। বাটা মশলার স্বাদ ই আলাদা। ছেলেবেলার দিনগুলোতে ও দুপুরে ঘুমোতো না। কোথায় আ্যকোরিয়ামে মাছেদের খেতে দেওয়া, খরগোসের জন্য ঘাষ তুলে আনা, বিড়াল ছানাদের জন্য দুধ চুরি করা। কখনো কখনো কাকার কাছে আবদার করা, ” তোমার গাছের একটা গোলাপ দেবে? ” দিয়ে দিত। শৈশবে বিকেল বেলা, কেউ একরাশ মাথা চুলে কলাবিনুনী করে দিত। পাড়ার দিদি ঘটীহাতা ফ্রক তৈরী করে আনত। ব্যাস, ছুটোছুটি। কুমীরডাঙা, খো খো। একটু কূলের আচার। গানের স্কুলের মাষ্টার মশাই দেখেই তাড়া। ” এত মিষ্টি গলাটা নষ্ঠ করছে। রেওয়াজ নেই।” হানিমুনে গিয়ে ও বৌ রান্না করবে একথা শুনে, বরের বন্ধুদের ঠাট্টা ইয়ার্কি। নদীর মা বলে উঠত, ” এত কাঁচের চুরি কিনে টিউশনির টাকা নষ্ঠ করিস কেন? ” চাল ডাল কত কিছু হয়ে যাবে সংসারের। তখন বর্ষাকাল। পা টিপে টিপে চলছে অন্তসত্বা ” নদী “, খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা নিয়ে মাকে দিয়ে আসছে। ফলের অনেক দাম। ভাত, ডাল আর পাতিলেবু। আয়রন আছে। শরীরে খুব ব্যথা। ঘরদোর পরিষ্কার রাখছে।
ভাদ্রের রোদে একটু ঝিমুনি আসে। ব্যথা জুড়ায়। মায়ের হাড় থেকেই শিশুটির হাড় গড়ে উঠছে। হাঁসপাতালে কত শিশু। দেখেই নদীর মনে হয় যেন স্বর্গরাজ্য। শিশুটি একটু বড়। হাঁটি হাঁটি পা। ” নদী ” মন্টেসরি ইস্কুলে নিয়ে যায়। কি তীব্র শীত। সারারাত ঘুমোয় নি। সকাল আটটায় ইস্কুল। নদী উঠে পড়ে। ছাদের চিলেকোঠায় শিশুটিকে অনেক ভুলিয়ে খাইয়ে দেয়। তারপর জামা পরিয়ে, সোয়েটার, কানটুপি দুজনে মিলে কত গল্প করতে করতে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। মা ও শিশুটিকে দেখে ভোরবেলা সব স্কুল পড়ুয়াদের সে কি আনন্দ। স্কুলে দিয়ে অন্য শিশুদের মায়েরা ” নদীর ” সাথে গল্প করতে চায়।
নদী ফিরে আসে। একটাই চুড়িদার প্রতিদিন। দীর্ঘ, ঘন চুল কেটে ফেলে। বাড়ি ফিরে যদি কাজের দিদি আসে, আর বাসন মাজতে হয় না। শীর্ন নদীটি
কুয়ো থেকে জল তোলে। পাড়ায় একজন ঠিক করে দেয় ছাগলের দুধ। খানিকটা রান্না সেরে নদী ছুটতে ছুটতে শিশুটিকে আনতে যায়। এতটুকু বিরাম নেই, সেই যে শিশুটি জন্মালো। কখন কলা, কখন আপেল সেদ্ধ খাওয়াবে, কখন জুনিয়র হরলিক্স এসব নিয়েই ভাবে। হঠাৎ শিশুটি কথা বলছে না। দুপুরে মায়ের কোলে মাথাটা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেল হলে অনবরত কথা বলে ” নদী “, শিশুটির সাথে, কখনো পড়ায় কত কিছু। পাড়ায় বলে ওঠে, মা কি পরিশ্রম করে। পাড়ার অন্য বাচ্চারা ছুটে আসে, ” বোনু বোনু। ” কেউ বই খাতা নিয়ে পড়তে আসে নদীর কাছে। দুটো খুচরো পয়সা জমা হলে মেয়ের জন্য নতুন জামা, মায়ের জন্য সোয়েটার। এই ভাবে বহুদিন ঘুমোয় নি ” নদী “। শুধু হাঁসপাতাল আর ঘর শিশুটিকে নিয়ে। মায়ের যত্নে বেড়ে ওঠে চারাগাছ। স্বামী দূরে চাকরি করতে যায়। দুটো টাকা বেশি রোজগার হবে। ভাড়ায় একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। স্বপ্নের মত। শিশুটি অসুস্থ। কিন্ত মায়ের পরিচর্যা দেখে সবাই মুগ্ধ। নদীর মুখে রা টি নেই। তখন সূর্যাস্ত। নদীর দু চোখে জল। আর একটা চোরা কান্না, ভিতর থেকে। নদী এত সংগ্রামের মধ্যে তার পোষা কুকুরটির দায়িত্ব আর নিতে পারছে না। একটা আশ্রমে বেশ কিছু টাকা দিয়ে রেখে আসে। আর কুকুরটি ও নদীর নাভিচেরা কান্না। বারবার যায়, তার ” সানসাইন ” কে ফেরত নিয়ে আসে। খুব কাঁদে নদী। একদিন আশ্রম থেকে খবর আসে কুকুরটি হার্ট ফেল করে মারা গেছে। নদীর আকাশ ভেঙে পরা আকূল কান্না। সেই থেকে ব্যাগে কিছু বিস্কুট রেখে দেয়। নদী পশুপ্রমী বলে ঠিক ছুটে ছুটে আসে কুকুর, বিড়াল। রান্নাঘরে, ছাদে জল ভাত রেখে দেয় কাকপক্ষী দের জন্য। গাছেদের নিয়মিত জল দেয়। এত কষ্টে হাঁফাতে হাঁফাতে
বুকে পাথর নিয়েই নদী দেওয়ের সম্বন্ধ দেখে। অনেক খুঁজে খুঁজে ভালো মেয়ের সাথে দেওরের বিয়ে দেয়। বিয়ের তত্ব কিনতে গিয়ে প্রখর রোদে একটা এসি ট্যাক্সিতে ওঠে। দক্ষিন কোলকাতা থেকে উত্তর কোলকাতা। মনে হচ্ছিল, কত যুগ পরে অনেক খানি ঘুরে এল। শিশুটি মায়ের হাতের রান্না পেলে আনন্দে আত্মহারা। সেদিন ওরা বৃষ্টিতে ভিজছিল। শিশুটি কৈশোরের ছোঁয়ায়। মায়ের বুকে ঝড়। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নদীর চোখ বুজে আসে। তখন অনেক গভীর রাত, প্রায় ভোর হয়ে আসে।
—০০XX০০—