ক্ষুধা ও অন্ন
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
রিহার্সাল শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়াল বিজন। ওদের কয়েকজনকে পুলিশের খোঁচড় গুলো চোখে চোখে রাখছে। ওরা অবশ্য এ সবে পাত্তা দেয়না। দিনকাল সুবিধার ঠেকছে না। যুদ্ধের জন্য জিনিষপত্র বেবাক কালোবাজারে বিকোচ্ছে। জোতদারদের গোলায় ধান অথচ গরীব মানুষ একটু ফ্যানের জন্য কেঁদে কেঁদে মরছে। অথচ চোখ তুলে বাইরে তাকালে শস্যশ্যামলা প্রকৃতি হাত উজাড় করে ফসল ফলাচ্ছে। আর সেই সব ফসল গভর্ণমেন্ট জোর করে কিনে নিচ্ছে আমেরিকান টমী দের জন্য। কিছু কিছু এলাকা আবার দাঙ্গার উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এইতো কালীঘাট আর দমদমে কত মানুষের লাশ ভেসে এল। মোটের ওপর একটা বারুদের স্তুপের ওপর বসে আছে ওরা।
………………
আজকের রিহার্সালটা শুরু থেকেই ঠিক জমছে না। শোভা বলে একটি নতুন অভিনেত্রী ‘রাধিকা’র চরিত্রটি করছে। কিন্তু আজ যেন ওরও তালে সমে ঠিক জমছে না। এরই মধ্যে বেশ কজন বন্ধু জুটেছে বিজনের। তারাই ওর বল ভরসা। শম্ভু অবশ্য নিজে একাই অনেকটা ভরসা দিতে পারে। এছাড়াও গঙ্গাপদও যথেষ্ট ভাল অভিনয় করেই। তবে তৃপ্তির অভিনয়টা এদের মধ্যে সবচেয়ে আসল। এই পুরো নাটকটায় একমাত্র বিনোদিনী রূপী তৃপ্তিরই মুখস্থ। দলের কারো কোথাও আটকে গেলে সেই অভিনয় করে দেখিয়ে দেয়। সবাই একটা অন্যধারার নাটকের অপেক্ষায়।
……………
দাশু এরমধ্যে ভাঁড়ে করে লাল চা এগিয়ে দেয় সবাইকে। চিনি ছাড়াই খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। কালো বাজারে উঠতি বড়লোক ছাড়া চিনি খাওয়ার বিলাসিতা মানায় না। বিজনরা এমনিতেই অনেকদিনই চিনি খাচ্ছে না। কারো আবার চা এ একটু গুড় অন্তত চাই। বিজন চেষ্টা করে সবাইকে মনের মতন চা টুকু অন্তত করে খাওয়াতে। কিন্তু কালোবাজারে সবটাই দূর্মূল্য এখন।
………….
১৯৪৩ সাল, বাংলায় ১৩৫০ যে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে বিশেষ করে শহর কলকাতায়, মহামন্বন্তরের করাল ছায়া চারদিক অন্ধকার করে দিয়েছে। বিজনরা হাত গুটিয়ে আর ঘরে বসে থাকতে পারছিল না। জমাটি সাহিত্যিক আড্ডা ও রিহার্সাল ছেড়ে ওরা এখন সবাই রাস্তায় নেমে পড়েছে চরম বিপর্যয় ও বীভৎস মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে। বিজনরা সবাই বিশ্বাস করে জনতার প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার কথা , আর তার সাথে কি করে সম্মিলিত অভিনয়-ধারার প্রবর্তন করা যায় এবং কি করে বাস্তবের একটা অংশের অখণ্ডরূপ মঞ্চের উপর তুলে ধরা যায়।
ওদের সবার এই চেষ্টা একটা প্রচণ্ড আলোড়ন বলা যেতেই পারে। বাংলার একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠবৎ শিহরিত করে তুলল।
…………..
একদিন ফেরবার পথে বিজনের কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প করছে। কি আশ্চর্য! অনাহারের মধ্যেও ওরা ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে এখন কী হচ্ছে। এই সূত্রটি ধরে টুকরো টুকরো সংলাপ বুনে বুনে একটা আস্ত নাটকই তৈরী হয়ে গেল।এইভাবেই যেন শোষিত সর্বহারাদের নিজের সংলাপ উঠে এল কোনও আরোপিত দৃশ্যকল্প ছাড়াই।
…………….
ডি. এন. মিত্র স্কোয়ারের পাশ দিয়ে রোজ আপিস যায় বিজন। রোজই দেখে গ্রামের বুভুক্ষু মানুষের সংসারযাত্রা, নারী-পুরুষ-শিশুর সংসার। এক একদিন এক একটা মৃতদেহ নোংরা কাপড়ে ঢাকা। মৃতদেহগুলো যেন জীবিত মানুষের চেয়ে অনেক ছোট দেখায়। ওদের বয়স্ক কি শিশু, আলাদা করা যায় না…. ফিরতি পথে রোজ ভাবনা চলে । এইসব নিয়ে কিছু লিখবার তাগাদা আসে মনে। জগুবাবুর বাজারেরও অবস্থা তথৈবচ।
………….
মোতিয়া বলে একটা পাগলী রোজ অর্ধউলঙ্গ দেহে আবর্জনা মেখে পড়ে থাকে।সামনের ওড়িয়া চা ওলা একটা ভাঁড় চা আর লেড়ো বিস্কুট নামিয়ে রাখে তার সামনে নিয়ম করে। বিজন সেটাও রোজ তাকিয়ে দেখেন। পাগলীটার পেটটাতে আস্তে আস্তে স্ফীত হচ্ছে গর্ভধারণের চিহ্নে। ওফ্ কি ভয়ংকর তার এলোমেলো চুলে ঢাকা মুখটা। চোখদুটোয় যেন মূর্তিমান ক্ষুধা হিংস্রতার ঢাকনা পড়িয়ে রাখা। সেও বিজনকে দেখে। আহা রে ,কেউ যদি দুটো খেতে দিত।থু থু করে থুতু ছিটায় সে। তার পরণের কাপড়টি শতচ্ছিন্ন আর তা লুটোচ্ছে গা থেকে খুলে। এরমধ্যেই
হঠাৎ সাইরেন বেজে ওঠে। মুহূর্তে শহরটা ব্ল্যাক আউটের অন্ধকার মেখে ভুতুড়ে হয়ে যায়।
………..
নবান্ন নাটকটা সবাইকে সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ দেখিয়েছে। সর্ববঞ্চিতদের কথা বিজনরা জোর গলায় বলতে পেরেছেন। সবার অভিনয়ই প্রশংসিত। স্বয়ং শিশিরবাবু শ্রীরঙ্গম সাতদিনের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন বিজনদের। নিজেও রোজ আসেন। যে কথা তিনি বলতে পারেননি তাই যেন এই যুবকযুবতীদের কন্ঠে আর দেহভঙ্গিমায় মূর্ত। শিশিরবাবুর বড় ক্ষোভ ওই সিনেমার ওপর। অথচ তাঁর থিয়েটারে সস্তার বিনোদন নেই বলে দর্শক কম হয়। অবশ্য একজনও না এলে তিনি খালি চেয়ারগুলোর সামনেই অভিনয় করতেই পারেন তবু প্রযোজনার খরচটাতো আছেই। গণনাট্যের ছেলে মেয়েরা এর মধ্যেও থিয়েটারের জন্য নিবেদিত বলে তাঁর আলাদা গর্ব হয়।
………..
এরই মধ্যে বিজন একদিন দেখলেন মোতিয়া মরে পড়ে আছে নর্দমার ধারে। মুদ্দোফরাসরা কেউ এসে তখনো দেহটা তোলেনি। মনে হয় অজান্তেই প্রসব হয়ে গেছিল । দু একটা কুকুর জড়ো হয়ে তার নাড়ীধরে টানছে গোপনাঙ্গের ছিন্ন অবশেষ থেকে। আর কালচে নীল রঙের জমাট অন্ধকারের মতো মরা বাচ্চাটার একটা পা মনের সুখে চিবোচ্ছে আর একটি স্ফীতোদরা পূর্ণগর্ভা কুকুরী। তার সাথে গরগর শব্দ করে তারা নিজেদের এলাকার দখল রাখছে। বিজন চুপ করে সেই দৃশ্যটি দেখেন।কি মর্মান্তিক!কি নিষ্ঠুর দৃশ্য।
নাহ্ বিজনরা হেরে গেছেন আজ।
এই দৃশ্যকে জীবন্ত লেখার মত কলমের জোর নেই তাঁর। সংলাপের আদিম ভাষাটিও তাঁদের আজও অজানা।
পার্কের বেঞ্চিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন বিজন। সমস্ত পৃথিবী অর্থহীন মনে হয় ওঁর। টলতে টলতে বাড়ির উদ্দেশ্য চলেন তিনি। আজকের অন্ধকার বিকৃত সেই পথটিও যেন অনন্ত ঠিকানার।
তবুও তাঁর কানে কানে ভাবীকাল হঠাৎ যেন বলে ওঠে,
” অস্তিত্বের বড় কাছে, হে প্রিয় তোমার আক্রমণ!
বঙ্গরঙ্গভূমি রক্তে ভেসে গেছে সেদিন, একদা—
তুমি তরবারি নিয়ে নেমেছিলে সন্ধ্যায় প্রভাতে।
ঐ দীপ্তি, ঐ ক্ষোভ, ঐ মারাত্মক বিবেচনা নিয়ে,
প্রিয় সশরীর নবান্নের বিষন্ন প্রাঙ্গণে
নেমে এসেছিলে, সেই দৃশ্য এক কিশোর দেখেছে,
তারপর থেকে দীর্ঘপথ ছিলো পর্যটনময়
পথ ছিল, মত ছিল, ফুল ও পাথর ছিল কত।
মায়ের মমতা দিয়ে সবকিছু জড়িয়েছো বুকে
তুমি দীর্ঘতম বৃক্ষ, নাকি তুমি মাধবীর লতা-
বাংলার সন্ন্যাসে, গৃহে প্রাণময় জ্যোৎস্নায় জড়ানো? নীলকণ্ঠ তুমি,
তুমি অভিমন্যু ব্যূহের ভিতরে
দিগ্বিজয়ী, ঢুকে গেছো,
কিছুতেই বেরুতে পারছো না-
এই ভালো, কাজ নেই,
জীবনে ও নাট্যে দুঃখ আছে….”
…………..
বিজন টলতে টলতে কোনওমতে বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়ে। অধৈর্য সে বলে ওঠে নাটকের সংলাপ। শম্ভুর কথাটাই সত্যি মনে হয় বিজনের। শম্ভু বলে ও মানেও, ” ‘নবান্ন’ নাটকের আগে ওদের ট্রাজেডিই ডোমেসটিক ট্রাজেডি, ‘নবান্ন’-এ এল এপিক নাটকের ব্যাপ্তি। “
বিজনের মাথায় কেবল একটা ঝড় ওঠে। পালাবদলের সময় এটা নিজেও জানেন। মৃত মানুষগুলো ফিসফিসিয়ে ওঠে সব সময়।
সে এখন মুক্তি খোঁজে নাটকে। সে নাটক কি আদৌ লেখা হবে?? নবান্নের পরে চাই চিন্তার সিনেমায় মুক্তি। নাটকের মত সিনেমারও সমাজ বদলে দায় থাকাটাই উচিত। বিজন ভাবতে ভাবতে তৈরী হয় অসম প্রতিবাদে। এটাই তো দরকার এখন। লড়াই তো আর থামছে না। সবাইকে একসাথে লড়তেই হবে আজ।
–~০০০XX০০০~–