কোন মরু প্রান্তে
কিশোর বিশ্বাস
জগাই তো মুন্নিকে কিছুই দিতে পারেনি,তবু ওর মুখে হাসি লেগে থাকত।বলত তুমি যা দিয়েছ তা আর ক,জন দিতে পারে। জগাই জিজ্ঞাসা করত আমি তোমাকে কি এমন দিয়েছি যা কেউ দিতে পারে না? কেন,বুক ভরা ভালোবাসা।জগাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মরু চাঁদের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠত,তুমি মোর প্রিয়া হবে এসো রানি দেব খোপায় তারার ফুল, কর্নে দোলাব তৃতীয়া তিথীর চৈতী চাঁদের দুল,।মুন্নী কেঁদে দিত।জগাই হাত দিয়ে পরম যত্নে ওর চোখের জল মুছে দিত আর বলত, কেন কাঁদ?মুন্নী বলত এ কান্না দুঃখের নয় গো, এ কান্না সুখের, এ কান্না আনন্দের,এত ভালোবাসা ক,জন পায়।
ওরা বেদে বেদেনী, ওদের ঘর বাঁধতে নেই, কোথাও বেশি দিন থাকতে নেই কিন্তু জগাই মুন্নীকে ঘর বাঁধতে হল,জীবন ভর সেই ঘরে থাকতে ও হল,
মুন্নী ছিল ওদের সর্দারের একমাত্র মেয়ে।সর্দারের ইচ্ছা ।ওর প্রধান সাকরেদ কাল্লু তার মেয়েকে বিয়ে করুক।কাল্লুর ও তাইই ইচ্ছা কিন্তু কাল্লু বড় নিষ্ঠুর আর জগাই বড় দয়ালু তাই মুন্নীর পছন্দ জগাইকে একবার ওরা পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে কাল্লুর হাতে, কাল্লু ওর পেটে চাকু মারে,তিন মাস ভুগে মরতে মরতে বেঁচে যায় জগাই
কিন্তু কেউ কাউকে ভুলতে পারে না।তাই বছর খানিক পরেই ওরা আবার পালায়।এবার রাজস্থানের মরুভূমির পশ্চিমে জন মানবহীন প্রান্তে ওরা ডেরা বাঁধে। লোকালয়ের কাছে যেতে ওদের সাহস হয় না,সংবাদ পেয়েছে কাল্লুর সাথে এবার সর্দার ও চাকু তুলে নিয়েছে।একবার দেখা পেলে ওদের ধড় মুন্ডু থেকে আলাদা করে দেবে। মুন্নী ভাবে আমি মরি মরি কিন্তু জগাই এর যেন কিছু না হয়,আর জগাই ভাবে আমি মরি মরি কিন্তু মুন্নীর যেন কিছু না হয়।
চারিদিকে বালির পাহাড়, দু,একটা ক্যাকটাস, দু,একটা খেজুর গাছ তারই তলায় ওদের পর্ণ কুটির। গরমে তীব্র গরম আর শীতে তীব্র শীত। কখনো কখনো বালির ঝড়ে ঢেকে যায় ওদের পর্ণ কুটির।ওরা দু,জনে মিলে বালি সরিয়ে কুটির উদ্ধার করে। দিগন্ত বিস্তৃত বালিরাশি কখনো সখনো দু,একটা উটে করে দু, চারজন লোক চলে যায়, ওদের বুক কেঁপে উঠে।সর্দার আর কাল্লু নয় তো?একজন আর একজনকে বুকে চেপে ধরে। এই ভাবে চল্লিশ বছর চলে গেছে।
হঠাৎই একদিন মরুপ্রান্তে জ্বালানি কুড়াতে যেয়ে আর ফিরে এলো না মুন্নী। যে মুন্নী জীবনের রিস্ক নিয়ে দলকে ছেড়ে, দলের সম্পত্তি ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে জগাই এর সংগে এক বস্ত্রে পালিয়ে এসেছিল।এত বছর ধরে পর্ণ কুটিরে ভালোবাসার তাজমহল গড়ে তুলেছিল,যে একবেলা তার জগাইকে চোখের আড়াল করত না।আজ সে তার ভালোবাসার পর্ণ কুটির ছেড়ে, তার প্রেমের শান্তির নীড় ছেড়ে,তার বুকের মানিককে ছেড়ে, তার সুখ দুঃখের সংসার ছেড়ে কোথায় চলে গেল? তাই জগাই আজও তাকে খুঁজে ফেরে মরুভূমির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে আর চিত্কার করে ডাকে মুন্নী, মুন্নী,মুন্নী বলে। সে ডাকে চমকে উঠে পাখি, থমকে যায় উট,মরুর বালি হাহাকার করে উঠে। তার আলখেল্লা জীর্ন হয়েছে,তার বসন খুলে পড়েছে,তার মুখ দাড়িতে ঢেকে গেছে,তার চুলে পিঠ ঢেকে গেছে,চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছে তবু তার মুন্নী, মুন্নী,মুন্নী বলে চিত্কার থামেনি।
পাঠক যদি কখনো রাজস্থানে যাও মরুভূমির বালির বুকে কান পেত আজ ও শুনতে পাবে সেই হতভাগ্য প্রেমিক হাহাকার করে যাচ্ছে মুন্নী, মুন্নী,মুন্নী বলে।
–~০০০XX০০০~–