কে ওখানে ?
সলিল চক্রবর্ত্তী
“ভাই সামান্য কিছু মাল, দোতলায় একটু তুলে দিও। কিছু বকশিস দিয়ে দেব।”
দেবানজন চক্রবর্তী, ওরফে দেবু চক্রবর্তী, ভীষণ মিতব্যয়ী মানুষ। যৌথ পরিবার ভুক্ত ছিল, কিন্তু মতের অমিল হওয়ায় বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। গ্রাম কেন্দ্রিক অফিস, অফিস থেকে পাঁচ সাত কিলোমিটার ভিতরে এক মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে এই বাড়ীটির সন্ধান পেয়েছে। বিঘা খানিক জমির উপর বিশাল একটা দুই তলা বাড়ি। উপর নীচে মিলিয়ে ছোট বড়োতে গোটা দশেক ঘর আছে। চুন সুরকির বাড়ী, নিশ্চই অনেক পুরোনো হবে। তা হোক, তাতে দেবুর কিছু যায় আসে না। বাড়ীটি যে জলের দামে পেয়ে গেছে। আজকের দিনে যা ভাবাই যায়না। উপরি পাওনা হলো ব্যাবহৃত ঘর গুলো ফার্ণিশড, ফলে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র ভ্যানে করে এনেই কাজ মিটিয়ে নিয়েছে।
রেখা অর্থাৎ দেবুর স্ত্রী, সমস্ত বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখছে। দেবু কেনার আগে এসে সব কিছু ভালো করে দেখে গেছে। এখন সে কতটা লাভ করেছে তা সরজমিনে স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। চারটি ঘরে খাট, আলমারি, বড়ো ডাইনিং এ ডাইনিং টেবিল, আট খানা চেয়ার; দক্ষিণ খোলা প্রায় চল্লিশ বাই পনেরো ফুটের বিশাল বারান্দা, সেখানে একটা দামি কাঠের রকিং চেয়ার আছে। আরো অনেক কিছুই আছে, কিন্তু ইলেক্ট্রিক নেই, হ্যারিকেনই ভরসা। দুই তলায় এ্যটাচ বাথরুমের পাশে একটা ঘর আছে যাতে এক পেল্লাই তালা ঝোলানো। দেবু বলল-” এই ঘরটা নাকি প্রথম থেকেই তালা লাগানো। প্রয়োজন না পড়ায় কেউ এটাকে খোলে না।” রেখা এতক্ষন চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল, তার একেবারেই পছন্দ হয়নি। চার দিকে বাগান, কাছা কাছি কোনো মানুষ জন নেই । একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-” শুধু দামটাই দেখলে, বেবিকে নিয়ে তিনটি প্রাণী, এত বড় বাড়ী কি হবে? এত একটা ভুতুড়ে বাড়ী!” কথাটা শেষ হতে না হতেই অন্য একটা ঘর থেকে আওয়াজ এলো ট-ক্কো, ট-ক্কো, ট- ক্কো। দেবুর চোদ্দ বছরের মেয়ে বেবি চমকে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরলো। রেখাও ভয় পেয়ে গেল। টিকটিকি তো নয় তবে কোন প্রাণী সত্যের প্রমান দিলো! প্রথমে দেবুও একটু ঘাবড়ে তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-” ও কিছু না, তক্ষকের ডাক, পুরোনো বাড়ী তো কড়ি বর্গার ফাঁকে ফাঁকে তক্ষক থাকে”। স্ত্রী মেয়েকে বোঝাল বটে কিন্তু তার নিজের মনে দুটো খটকা থেকে গেল-এক, তক্ষক তো দিনে বেলায় ডাকে না, দুই, তক্ষক তিন বার নয় আট থেকে দশ বার ডাকে।
দিন চারেক পর—-
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে দেবু ভাবল রকিং চেয়ারে শরীরটা একটু এলিয়ে দেবে। কিন্তু চেয়ারে বসে দোলা খেতে গিয়ে দেখল, চেয়ারটা রক করছে না,মনে হচ্ছে কেউ যেন ধরে রেখেছে। দেবু দেখার চেষ্টা করছে কোথায় বাধা পাচ্ছে। হটাৎ দেবু শুনতে পেল ” যাঁর চেয়ার তিঁনি হয়তো বসতে দিতে চাইছেন না।” সে ভাবল, স্ত্রী বিদ্রুপ করলো। চেয়ার ছেড়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখল স্ত্রী আপন মনে বাসন মাজছে। দেবু বলল-” তুমি কি কিছু বললে?” রেখা বললো-” কই না তো!” মেয়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে।
দুই দিন পর——
রাতে শোয়ার সময় চোদ্দ বছরের বেবি বললো -” মা আমি তোমাদের কাছে ঘুমাবো।” দেবু অবাক হয়ে বলল-” সে কি বেবি তুমি তো রাত্রে একাই ঘুমাও!”
– না বাবা আমার খুব ভয় করছে?
– কিসের ভয়? (বাবা অভয় দেন)
– জানো বাবা, আমাদের মিনি এখানে এসে কেমন হয়ে গেছে।
– কেন সে কি করেছে?
– সব সময় যেন আড়ষ্ট হয়ে থাকে, আর কাউকে দেখে যেন ল্যাজ পাকিয়ে গ-র-গ-র শব্দ করতে থাকে। অথচ আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা।
রেখা বিছানা করতে করতে বিরক্ত হয়ে বলল-” দূর দূর এখানে কি মানুষ বাস করতে পারে?” রেখার মুখের কথা শেষ না হতেই ” ট-ক্কো, ট-ক্কো, ট-ক্কো করে তক্ষক ডেকে উঠলো আট বারের জায়গায় তিনবার।
তারও দুই দিন পর——-
মাঝ রাতে একটা শব্দে রেখার ঘুম ভেঙে যায়। দেবুকে জাগিয়ে তুলে ভয়ার্থ কণ্ঠে বলে-“শব্দটা কোথা থেকে আসছে বলতো?” দেবু ঘুম চোখে আওয়াজটা বোঝার চেষ্টা করল। “পুরোনো বাড়ীতো নিশাচর পাখির ডাক টাক হবে হয়তো” চোখ বন্ধ করে কথাটা বলে রেখাকে অন্য মনস্ক করার চেষ্টা করল। ‘ক্যাঁচ’ ‘ক্যাঁচ’ করে আওয়াজটা বেশ কয়কে বার হলো। ঠিক যেন পুরোনো রকিং চেয়ারে কেউ দোলা খাচ্ছে। ‘ক্যাঁচ’ ‘ক্যাঁচ’ শব্দ থেমে ‘থপ’ ‘থপ’ পায়ের শব্দ শোনা গেল। মনে হলো কেউ যেন রকিং চেয়ারে বসে ছিল সেখান থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে বাইরের দিকে চলে গেল। দেবু কিছু একটা অনুমান করল তো বটেই মুখে বলল-” নিশুতি রাত, এত বড় বাড়ী, কোথায় কি আওয়াজ হচ্ছে খেয়াল না করে ঘুমানোর চেষ্টা করো।” পায়ের আওয়াজটা আবার শোনা গেল, এবার বাইরে থেকে ভিতরে আসার শব্দ, দরজা খুলল,এবং শব্দটা বাড়তে থাকল। রেখা দেবুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।
রাতে রেখা ও দেবু কারোরই ভালো করে ঘুম হয়নি। রেখা কড়া করে দুই কাপ চা এনে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকা দেবুকে ডেকে তুললো। তারপর চা-য়ের কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে দেবুকে বললো-” চলো আমরা এখন থেকে চলে যাই। এই জায়গাটা আমার একদম ভালো লাগছে না। জানতো সন্ধ্যার পর থেকে সামনের খামারে একটি লোককে আমি ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি। দেখলাম লোকটি ধীরে ধীরে ঘোরাঘুরি করছে আবার চোখের নিমিষে কোথায় উধাও হয়ে গেল।” দেবু প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বললো-” বাজারে যেতে হবে তো?” দুঃশ্চিন্তা যে দেবুর ও বাড়ছে না তা নয়। কিন্তু চলে যাওয়ার কথা বলা যতটা সহজ, বাস্তবায়িত করা অতটা সহজ নয়।
অথএব কথা না বাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়াটাই বুদ্ধি মানের কাজ।
সকাল নয়টা–
অনেক ঘরের মধ্যে একটা ঘরে বসে বেবি দুলে দুলে উচ্চ স্বরে পড়ছে আর শুনতে পাচ্ছে রকিং চেয়ারটা তালে তালে ‘ক্যাঁচ’ ‘ক্যাঁচ’ করে আওয়াজ হচ্ছে। রেখা বেবিকে টিফিন খেতে ডাকলো। বেবি সাড়া দিয়ে বারান্দার হয়ে রান্না ঘরে আসছিল। সে দেখল বাবা রকিং চেয়ারে বসে দোলা খাচ্ছে। কিন্তু রান্না ঘরে এসে দেখে বাবা অফিসে যাবে বলে ভাত খাচ্ছে, যেটা বেবির কাছে অসম্ভব মনে হয়ায় সে বলল-” বাবা তুমি তো রকিং চেয়ারে বসে দোলা খাচ্ছিলে, খেতে এসে বোসলে কখন?” দেবু এক লাফে খাওয়া ছেড়ে উঠে বারান্দাতে গেল, এবং দেখতে পেলো রকিং চেয়ারটি মানুষ বিহীন রক করছে, যেন সদ্য কেউ চেয়ারটি ছেড়েছে।
দেবু ভুত বিশ্বাস করে না। কিন্তু যা দেখছে সবই কি চোখের ভুল! দুঃশ্চিন্তা মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। বাড়ীতে স্ত্রী ও ছোট বাচ্চাকে রেখে অফিসে যেতে হয়! ভাবলো বাড়ীটা সম্পর্কে এলাকায় ভালো করে খোঁজ খবর নেয়া উচিত ছিল।
হ্যারিকেনের আলো বলে দেবুরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে।আজ দেবুর মনটা ভালো না থাকায় একটু আগেই দেবু মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। রেখা তখনো সংসারের সব কাজ সেরে উঠতে পারেনি। চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে পেঁচা, বাদুড়ের কর্কশ রব শোনা যাচ্ছে। এই তিনটি প্রাণী ছাড়া এ তল্লাটে আর জন মনিষ্যি নেই। মনে মনে স্বামীর উপর খুব রাগ হয়। মনে মনে বলে “ওকেই ভুতে পেয়েছে, তা না হলে এই রকম ভুতুতে বাড়ীতে এসে ওঠে!” হঠাৎ রেখা শুনতে পেল-” বেবি দরজা খোল” ঠিক যেমন দেবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বেবিকে খিড়কির দরজা খুলে দিতে বলে। রেখার শরীরটা ভার হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে সে দেখল বেবি বিছানা থেকে উঠে খিড়কির দরজার দিকে যাচ্ছে। বেবি যখনই দরজার ছিটকানি খুলতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে রেখা গিয়ে বেবির হাত চেপে ধরে বলল-” ডাকটা আমিও শুনেছি”। তারপর আঙ্গুল তুলে বেবিকে দেখালো বিছানাতে বাবা অকাতরে ঘুমোচ্ছে।
পরদিন সকালে—–
বেবি তখন ঘুম থেকে ওঠেনি। দেবু সকাল সকাল সেভ করছে আর গত রাতে বেবিকে নিয়ে ঘটা ঘটনার সাতপাঁচ ভাবছে ফলে একটু অন্য মনস্ক হয়ে ছিল। এরি মধ্যে হঠাৎ রেখা পেছন থেকে এসে “মুদি খানার মাল পত্র আনতে হবে” বলে ওঠে। এবং অন্য মনস্ক থাকার জন্য দেবু চমকে ওঠে। হাতের রেজারটা নড়ে যাওয়ায় নিচের মাঝ ঠোঁটের তলায় ব্লেডে কেটে যায়। আয়নাতে দেবু দেখলো,রক্ত বেরিয়ে চিবুক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি সেভটি রেজারের বাক্স থেকে দেবু ফিটকারীটা বার করলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষতস্থানে ফিটকিরি লাগাতে গিয়ে চমকে উঠলো, মৃদু যন্ত্রনা আছে, অর্থাৎ ক্ষতস্থান আছে কিন্তু এক ফোঁটাও রক্ত নেই। রেখা স্তম্ভিত, এও কি সম্ভব! দেবু রেখাকে বোঝালো, রক্ত সাবানের ফ্যানায় মিশে গেছে। নিজেকে কিন্তু বোঝাতে পারলো না।
দেবু বসে মুদিখানার লিস্টটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। রেখা এক কাপ চা দেবুর সামনে রেখে বললো-” লিস্টের সব মুদি মশলাই আনতে হবে।” দেবু কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললো-” ওরে বাবা! এ যে ভীষণ গরম।” তারপর
কাপ রেখে বললো-” তাইতো মুদি খানার লিস্টটা দেখছি, কতবড়ো ব্যাগ নেব।” এরই মধ্যে বেবি ঘুমোতে ঘুমোতে ” মা” বলে চিৎকার করে উঠলো। দেবু রেখা ছুটে বেবির ঘরে গেল। বেবি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল-” আমি স্বপ্ন দেখলাম মেনি একটা মানুষের সাথে লড়াই করছে।” কথাটা শেষ হতে না হতেই মেনি ঘরে ঢুকলো মুখে তার রক্ত লেগে। রেখা দেবুকে দেখাতেই দেবু ঘটনাটা হালকা করতে বললো-” মনে হয় ইঁদুর খেয়েছে।” কিন্তু দেবু জানে মিনি কাঁচা মাংস খায় না। দেবু চা খেতে চলে এলো। রেখা কিছু বলবে বলে দেবুর পিছু পিছু এলো। এসে দেখলো কাপে চা নেই , নেই তো নেই একেবারে তলানি পর্যন্ত নেই। রেখা বললো -” তুমি কি- গো, অতো গরম চা তুমি কি ঢকঢক করে খেয়েছো?” দেবু ফ্যাকাশে হেসে মনে করার চেষ্টা করতে থাকলো, কখন সে চা খেয়েছে।
ব্যাগ হাতে নিয়ে দেবু চলেছে শান্তি ঘোষের মুদির খানায়। কিন্তু মনে তার শান্তি নেই। কি যে সব ঘটে চলেছে যার মাথা মুন্ডু দেবু কিছুই বুঝতে পারছেনা। “সস্তার তিন অবস্থা” প্রবাদটা তার কাছে খুব প্রাকটিক্যাল মনে হলো। বছর তিরিশ বয়সের শান্তি ঘোষের গ্রাম্য একটা মুদির দোকান, অনেকটা চায়ের দোকানের মতো। দোকানের সামনে প্রশস্ত জায়গা, দুটো মাঝারি সাইজের বেঞ্চ পাতা আছে। দোকানের অল্প বিস্তর ভীড় সরিয়ে দেবু দোকানদারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শান্তি ঘোষ নুতন খদ্দের আর হাতে লম্বা লিস্ট দেখে এক গাল হেঁসে বললো-” দিন ,লিস্টটা দিন (দেবুর হাত থেকে লিস্টটা নিয়ে) আর ওই বেঞ্চে গিয়ে বসুন, আমি মাল রেডি করে আপনাকে ডেকে নেব খোন।” দেবু একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল। শান্তি ঘোষ দোকানের ভিতর থেকে উচ্চ স্বরে বললো-” দাদা বিড়ি খাবেন?” দেবুকে বলছে বুঝে দেবু বললো-” না না ধন্যবাদ, আমার কোনো নেশা নেই। আপনি মাল গুলো রেডি করুন।”
মুদি খানার দোকান থেকে দেবুর বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে। দেড়শো ফুটের মতো লম্বা জমিটার একদম পশ্চিম কিনারায় একটা বেদী করা কবর আছে। কবরের পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ দোকানের দিকে চলে এসেছে। দেবু এটা জানে, কিন্তু জলের দামে বাড়ী সহ অনেক জায়গা তো,তাই হাফ কাঠার মতো জমিতে কবরটাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। এখানে কোনো গোরস্থান নেই,সব মুসলিমরা মৃত্যুর পর নিজের জমিতে কবর দেয়। দেবু বেঞ্চে বসে চুপ চাপ বাড়ীতে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা গুলো ভাবছিল, এরই মধ্যে সে দেখল কবরের পাশের পায়ে চলা পথ ধরে এক বৃদ্ধ লাঠি ভর করে দোকানের দিকে আসছে। বৃদ্ধ কাছাকাছি আসতে দেবুর মনে হলো বেশ খানদানী মুসলমান হবে। পরনে দামি লুঙ্গি, জড়ির কাজ করা দামি ফতুয়া, মাথায় বাদশাহী সাদা টুপি, হাতে বেতের লাঠি যার হ্যান্ডেলটি হরিণের সিং দিয়ে তৈরী। একে বারেই কাছাকাছি এসে পড়ায় দেবু একটু অন্য দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো।
– বাবু, আমি কি এখানে একটু বসতে পারি? (বৃদ্ধ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো)
– হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চই বসুন না। (দেবু একটু সরে বসলো)
– (বসতে বসতে) বাবুর এ গ্রামে মনে হয় নতুন আসা হয়েছে?
– হ্যাঁ, ওই বাড়ীতে এসে উঠেছি। (নিজের বাড়ীটা দেখিয়ে )
– বাড়ীটা কি কিনেছেন,না ভাড়া —–?
– না না, কিনেই এসেছি।
– তা বেশ করেছেন, কিন্তু কেনার আগে এলাকায় বাড়ীটার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিলেন কি?
দেবুর একটু খটকা লাগলো, সত্যিই তো সে কোনো খোঁজ খবরই নেয়নি। ভাবলো বৃদ্ধ মানুষ বাড়ী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানবে হয়তো। সেই জন্য একটু আমতা আমতা করে বললো-” না মানে হঠাৎ ই—-“
– বুঝেছি, সস্তায় পেয়েছেন আর সাতপাঁচ না ভেবে কিনে নিয়েছেন।
– হ্যাঁ, সেই রকমই–
– একবার ভাবলেন না, আজকের দিনে বাড়ী সহ এতটা জমি কেন এত সস্তায় হলো! এই বাড়ী আগেও কয়েক জন কিনেছে, কিন্তু বসবাস করতে পারেনি।
দেবু একরাশ কিউরিসিটি নিয়ে প্রশ্ন করলো -” কেন?”
গোঁফহীন ছুঁচল দাড়ি বেষ্ঠিত মুসলিম মিঞা সাহেব মুচকি হেঁসে বললেন-” কেন আপনি কিছু বুঝতে পারেন নি? নাকি আমার কাছ থেকে আবার জানতে চাইছেন?” দেবু মিঞা সাহেবের মুখের দিকে অসহায় ভাবে চেয়ে থেকে।
মিঞা সাহেব মাথা নিচু করে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন।তারপর শুরু করলেন পুরোনো বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস—–
“ওই বাড়ীটা তৈরী তরফদি মোড়ল নামে এক ব্যক্তির। উনি ছিলেন তখনকার সময়ে জমিদার। তাছাড়াও এই এলাকার বিচার ব্যবস্থার ভার তাঁর উপর ছিল। সেই জন্য এতদ অঞ্চলে তিঁনি মোড়ল নামেই খ্যাত ছিলেন। ভীষণ সৌখিন মানুষ ছিলেন। ওই বাড়ীতে গিয়ে সেটা নিশ্চই আপনি বুঝতে পারছেন। ঊনিশ পাঁচ ছয় সালে যখন মানুষ মাঠে ঘাটে প্রাতঃকর্ম সারত, সেই সময় তিঁনি দুই তলায় শোয়ার ঘর লাগোয়া পায়খানা, স্নানের ঘর তৈরী করেছিলেন। নিশ্চই দেখেছেন, বড়ো বারান্দায় একটা দামি কাঠের দোলা খাওয়া চেয়ার আছে। ওই চেয়ারে বসে তিঁনি দোলা খেতেন। ওনার কঠোর নির্দেশ ছিল,ওই চেয়ারে তিঁনি ছাড়া অন্য কেউ বসতে পারতো না। বাড়ীতে ছুতোর মিস্ত্রী ডেকে ঘরের মানানসই আসবাবপত্র তৈরী করিয়েছিলেন।ওই বাড়ী ছিল তাঁর প্রাণাধিক। তরফদি মোড়লের চারটি জোয়ান ছেলে ছিল, তারা কখনো আব্বার কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সব ঠিকঠাকই চলছিল, গোল বাঁধল ভারত ভাগ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে হিন্দুরা এপারে আসতে থাকলো, আর এখানকার মুসলমানরা জমি বাড়ী জলের দামে বিক্রি করে চলে যেতে থাকলো ওপারে। সেই সময় তরফদি মোড়লের চার ছেলে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার মনস্থ করলো। এদিকে তরফ দি মোড়ল জন্ম ভিটে পরিত্যাগ করতে একেবারেই নারাজ। ছেলেরাও নাছোড় বান্দা, অবশেষে তরফদি মরোলকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শখের ভিটে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। পাকিস্তানে যাওয়ার আগে তিঁনি তাঁর শেষ ইচ্ছাটি কবুল করেছিলেন, যেন মৃত্যুর পর তাঁকে এই ভিটেতে কবর দেওয়া হয়। ছেলেরা তাই করেছিল, ওই সেই কবর (জমির পশ্চিম কোনে অবস্থিত কবরটি দেখিয়ে)। তবে এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োতে গুছিয়ে নেওয়া সমস্ত জিনিষ পত্র নিয়ে যেতে পারেন নি। পরে সুবিধা মতো নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। যারা এই বাড়ী কিনেছিলেন তারা সেই গোছানো মালপত্র গুলো একটা ঘরে রেখে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শুনেছি ঘরটি নাকি এখনো তালা লাগানো অবস্থায় পড়ে আছে। তরফদি মোড়ল নিজের একটা তৈল চিত্র আঁকিয়ে ছিলেন , সেটি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন বলে একটা চাদরে তৈল চিত্রটি মুড়ে একটা টিনের বাক্সে ভরে নিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেটাও নিয়ে যাওয়া হয়নি, বাক্স বন্দী হয়ে ওই ঘরেই পড়ে আছে। এই ভিটের উপর অত্যধিক মোহের বশবর্তী হয়ে তরফদি মোড়লের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। তিঁনি চাননা কেউ এই বাড়ী ভোগ দখল করুক।”
শান্তি ঘোষ দোকানের ভিতর থেকে উচ্চ স্বরে বললো–
দাদা, আপনার মাল রেডি।
“হ্যাঁ, যাচ্ছি” বলে মিঞা সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দোকানের খড়ের চালায় গিয়ে ঢুকলো। শান্তি ঘোষ মালপত্র বুঝিয়ে দিতে দিতে দেবুকে প্রশ্ন করলো–
” দাদা, মনে হচ্ছে আপনি খুব টেনশনে আছেন?” দেবু এক রাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো-” তা আছি ভাই, এই বাড়ীতে এসে উঠা অবদি একের পর এক যা সব ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে আমি পাগল হয়ে যাবো। তারপর এই মিঞা সাহেবর কাছে এখন যা শুনলাম তাতে আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।” শান্তি ঘোষ রীতি মতো অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো-” এখন, এখন কোন মিঞা সাহেবের সাথে কথা বললেন?” ” আরে এইতো বেঞ্চে বসে, গায়ে ফতুয়া মাথায় সাদা টুপি পরা বৃদ্ধ ভদ্র লোকের সাথে—–” কোথায় আপনি তো আপন মনে কথা বলে যাচ্ছিলেন!” দেবু বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখে মিঞা সাহেব নেই, দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দেবু এদিক ওদিক ভালো করে দেখল। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। শান্তি ঘোষের কথাটা শুনেই ভুত বিস্বাস না করা দেবু চক্রবর্তী শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। বাড়িতে মেয়ে, স্ত্রীর কথা মনে পড়তেই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দোকানের হিসাব মিটিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ীর দিকে চললো।
রেখা দুপুরের রান্নার কাজে ব্যস্ত, বেবি নিজের ঘরে আপন মনে পড়ছে। হন্তদন্ত হয়ে দেবু ঘরে ঢুকে হাতের ব্যাগ দুটো রেখেই তালা বন্ধ ঘরের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। রেখা দেবুর এই অপ্রত্যাশিত আচরণ দেখে নিজের কাজ ফেলে দেবুর পিছু নিলো। দেবু মরচে ধরা তালাটা ধরে একটু টানাটানি করলো, তারপর একটা শাবল গোছের লোহার রড খুঁজে নিয়ে এসে বন্ধ ঘরের ইউ আকৃতি ছিটকানির মধ্যে রডটা ঢুকিয়ে দিলো এক চাপ। সাথে সাথে মরচে ধরা ইউটি ভেঙে দরজা খুলে গেল। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর বন্ধ থাকা ঘর খুললে যেমন হয়। মাকড়শার জালে সমস্ত ঘর ভর্তি, জিনিস পত্র যা আছে মোটা ধুলোর আস্তরণ পড়ে তা বোঝার উপায় নেই। দেবু কোনো কথা বলছে না, ধুলো ঝেড়ে কিছু যেন খুঁজছে। হঠাৎ রেখার মনে হলো কেউ যেন ওর পিছনে দাড়ির আছে। মেয়ে ভেবে ফিরে তাকাতেই কাউকে দেখতে পেলো না। ভয়ে রেখার শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল, কে দাঁড়িয়ে ছিল? তবে কি——! হঠাৎ ট-ক্কো, ট-ক্কো, ট-ক্কো তক্ষকের ডাক। রেখা ছুটলো মেয়ের ঘরে। মেয়ের ঘরে ঢুকতেই বেবি ভয়ার্ত চোখে বললো-” মা, বাবা কি এক্ষুনি এই ঘরে এসেছিল?”
এদিকে দেবু উদভ্রান্তের মতো মাকড়শার জাল সরিয়ে,ধুলো ঝেড়ে অবশেষ খুঁজে পেল একটা টিনের বাক্স। তালা বিহীন বাক্সটা খুলতেই ভিতরে চাদরে মোড়া কিছু একটা আছে বোঝা গেল। মিঞা সাহেবের কথা মতো চাদরের মোড়কটা খুলে দেবু চমকে উঠল। সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। শিরদাঁড়া দিয়ে গলগল ঘাম ঝরতে লাগলো। ভয়ে আতঙ্কে বধির হয়ে গেল। এতো খানিকক্ষণ আগে কথা বলে আসা মিঞা সাহেব তরফদি মোড়লের ছবি।
———//////////——–///
Ei golpo ti paath kore voice record koriye dekhun… Valo lagbe sunte
অবশ্যই, ধন্যবাদ 💐