আত্মা হইতে পরমাত্মা
সলিল চক্রবর্ত্তী
” আজ একজন মহামানবের পূর্ব জন্মের গল্প বলবো। কে সেই মহামানব হতে পারেন, তা পাঠকগণ অনুমান করবেন।”–
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে জঙ্গলাকীর্ণ কোন এক গ্রামের বনান্তে এক কাঠুরে এবং তার স্ত্রী বসবাস করত। কাঠুরে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে দিত, আর তার স্ত্রী কাঠ গুলোকে শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে প্রস্তুত করে বিত্তবানদের বাড়ীতে যোগান দিত। এই ভাবেই তাদের দিন গুজরান হতো। সুখেই ছিল তারা, কিন্তু তাদের মনে কোনো শান্তি ছিল না। কারণ ঊনিশ বিশের দাম্পত্য জীবনে ভাঙা ঘর আলো করে একটা সন্তান এলো না। কাঠুরে দম্পতি সব সময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো একটি সন্তানের জন্য। কিন্তু ঈশ্বর তাদের দিকে মুখ তুলে তাকাননি। একদিন কাঠুরে দম্পতি খবর পেলো জঙ্গলে এক সাধু বাবা থাকেন, তাঁর আশীর্বাদে অনেক মানুষের অপ্রত্যাশিত ইচ্ছাও পূরণ হয়েছে। খবর পাওয়া মাত্রই কাল বিলম্ব না করে তারা গিয়ে পড়লো সাধু বাবার চরণতলে।
তিঁনি কাঠুরে দম্পতির সমস্ত প্রার্থনা শুনে, ললাট নিরীক্ষণ করে বললেন-” দেখো মা, তোমাদের ললাটে পুত্র সন্তান আছে, কিন্তু এই বয়সে তাহাকে পৃথিবীতে আনয়ন করা কি ঠিক হইবে?” সাধু বাবার মুখে ‘কপালে পুত্র সন্তান আছে’ এই টুকুই শুনে কাঠুরে দম্পতি আনন্দে উৎচ্ছাসে কেঁদে কেটে সাধু বাবার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সাধু বাবা তাদের শান্ত করে বললেন-” দেখো মা, তোমাদের সন্তান পাওয়ার আকাঙ্খা প্রবল। কিন্তু প্রবল আকাঙ্খীত সন্তানের কারণে পিতা মাতাকে যে অনেক কষ্ট পাইতে হয়।” সাধু বাবার এই অর্থবহ ভারী কথাটা আনন্দ উৎচ্ছাসে কাঠুরে দম্পতির কর্ণগোচর হলো না। যেন তেন প্রকারেন সন্তান হওয়ার আশীর্বাদ তাদের চাই ই চাই।
এক সময় এক সুন্দর মহেন্দ্রক্ষণে কাঠুরের স্ত্রীর কোল আলো করে একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান জন্ম নিল। কাঠুরে পরিবারে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। শিশুটি নাম রাখলো বোধিরাজ। পরম আদর যত্নে বোধিরাজ ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকলো। বোধিরাজের বয়স যখন এক বছর পূর্ণ হলো, তখন তার মা বাবা বুঝতে পারলো, তার নিম্নাঙ্গের কোনো সমস্যা হচ্ছে। কারণ সে হামাগুড়ি দিতে শেখেনি, বোসতে শেখেনি, হাটতে শিখছে না। এই ভাবে আরো একটি বছর পার করে দিলো। বোধিরাজ ছোট ছোট অনেক কথা বলা শিখে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভালো করে বোসতেই শিখছে না, হাঁটা তো অনেক পরের কথা। প্রতিবেশীদের সাথে আলোচনা করে বোধিরাজকে নিয়ে কাঠুরে দম্পতি বদ্যির কাছে গেল। বদ্যি মহাশয় ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিছু জড়িবুটি দিয়ে বললেন যে এটি একটি জটিল রোগ। শরীরের উপরের অংশের বৃদ্ধি বয়সের সাথে সাথে হবে। কিন্তু নিচের অংশের বৃদ্ধি তুলনা মূলক ভাবে অনেক কম হবে। ফলে বোধিরাজ কোনোদিনই হাঁটা চলা করতে পারবে না। এমন কি দাঁড়াতেও পারবে না।
বদ্যির ভবিষ্যদ্বাণী শুনে কাঠুরে দম্পতি দুঃখে একেবারে ভেঙে পড়ে। কিন্তু তাদেরই তো সন্তান, অপত্য স্নেহ তো থাকবেই। ফলে সেই স্নেহ ছায়ায় বোধিরাজ ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকলো। বোধিরাজের যখন বছর দশেক বয়স,তখন কাঠুরে দম্পতি দেখলো তার বুদ্ধি, চিন্তা ভাবনা আচরণ সবই একটি কুড়ি বাইশ বছরের যুবকের মতো। অথচ সে কোনো চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন করতে যায় না। কোনো পন্ডিত মানুষের সান্নিধ্যে আসেনি। ওই বয়সের সাধারণ পাঁচটা শিশুর মতো নয়, কেমন যেন অস্বাভাবিকতা বোধিরাজের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যাইহোক কাঠুরে দম্পতি তাদের পর্ণ কুটিরের দাওয়াতে একটা কেদারায় বোধিরাজকে বসিয়ে কিছু শুকনো খাবার ও জল দিয়ে নিজেদের কাজে চলে যায়। সন্ধ্যার আগে ফিরে না আসা অবদি বোধিরাজ একই ভাবে সেখানে অবস্থান করে। খিদে পেলে শুকনো খাবার খায়। ঘুম পেলে কেদারাতে ঘুমিয়ে পড়ে। যেন প্রকৃতির জীব প্রকৃতির ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে। বোধিরাজকে দীর্ঘ সময় কেদারাতে বসেই থাকতে হয়। কাঠুরে দম্পতির খুব দুশ্চিন্তা হয়, জঙ্গলের নিকট কুটির, জীব জন্তুর ভয়ও তো থাকে।
কিন্তু অবাক কান্ড , কুটির সংলগ্ন বিচরণ করা ছোট ছোট পশু পাখির সাথে বোধিরাজর একটা প্রাকৃতিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। পক্ষীকুল তার চার পাশে ঘুরে বেড়ায়, বোধিরাজ শুকনো খাবার ছড়িয়ে দেয় ,পাখিরা খুঁটে খুঁটে খায়। নেউল, মেছো বিড়াল, শিয়াল, কুকুর ইত্যাদি ছোট খাটো জীব জন্তু গুলো তার চারপাশে ঘোরাঘুরি করে। বোধিরাজের সাথে তাদের একটা আত্মিক যোগ সূত্র তৈরি হয়ে যায়। পশু পাখির সাথে নিজ নিজ ভাষায় ভাব বিনিময় চলে। এভাবেই চলছিল, একদিন ঘটলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা যা দেখে ওই গ্রামের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেল।
কেদারাতে বসে বোধিরাজ এক ঝাঁক বিভিন্ন ধরনের পাখিকে চাল ভাজা খাওয়াচ্ছে। এরই মধ্যে কোথা থেকে একটা কোলা ব্যাঙ থপ থপ করতে করতে বোধিরাজের কেদারার পিছন দিকে চলে গেল। বোধিরাজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাখি গুলো খওয়া ছেড়ে হুটপাটি করে উড়ে পালালো। এরই মধ্যে সরসরিয়ে দাওয়ায় উঠে এলো একটা গোখরো সাপ। সাপটি কেদারার চার দিকে ঘুরতে থাকলো। সাপটি যে ব্যাঙটিকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে তা বুঝতে বোধিরাজের আর বাকি থাকল না। পাখি গুলো সহজাত ক্ষমতার দ্বারা সর্পের উপস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছিল। একটু দূরে গিয়ে পাখি গুলো খুব ডাকাডাকি করতে লাগলো। প্রতিবেশীরা বুঝতে পারলো পাখির এমন ডাকাডাকির অর্থ। নিশ্চই সেইস্থানে তারা কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। কয়েক জন প্রতিবেশী ছুটে এলো বোধিরাজদের পর্ণ কুটিরে। ঠিক সেই মুহূর্তে কাঠুরেও কাঠ কেটে বাড়ি ফিরে এলো। তারা তো বোধিরাজকে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। সাপটি কেদারার পায়া দিয়ে উঠে বোধিরাজের পেশিহীন সরু লিকলিকে পা দুটির ভিতরে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কাঠুরে কুঠার উঁচিয়ে সাপটিকে মারতে উদ্যত হলো। বোধিরাজ ইশারা করে বাবাকে থামতে বললো। এরই মধ্যে ব্যাঙটা একটা কোন থেকে দাওয়ার মাঝখানে চলে এলো। এবং সাপ সেটা দেখতে পেয়ে কেদারা থেকে নেমে ব্যাঙ টাকে ধরল, তারপর জংগলে চলে গেল। সাপ চলে যেতেই সকলে ছুটে এলো। বোধিরাজ সবাইকে বললো-” সাপ হিংস্র প্রাণী নয়, নিরীহ প্রাণী। সে আমাকে ছোবল মারতে আসেনি, ব্যাঙটাকে ধরতে এসেছিল। যখন ব্যাঙ টাকে ধরে ফেললো কোনো দিকে না তাকিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। ওকে আঘাত করলে ও হয়তো আমাকে ছোবল মারত।
এই ঘটনা যখন ঘটলো বোধিরাজ তখন অজাত শ্মশ্রু কিশোর। কাঠুরে দম্পতিরও বয়স হচ্ছে। একটা দুঃচিন্তা তাদের মন প্রাণকে দিনে দিনে বিদ্ধস্ত করে তুলল। তাদের অবর্তমানে বোধিরাজকে কে দেখবে ? কি হবে তার দুর্বিসহ জীবনের পরিণতি। যে বাবা মা শয়নে স্বপনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো একটি সন্তানের আশায়, আজ তারাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে-ঈশ্বর যেন তাদের মৃত্যুর আগে এই ধরাধাম থেকে তাদের প্রাণাধিক সন্তানকে তুলে নেন। স্বামী স্ত্রীতে যখনই ঈশ্বরের কাছে এমন মিনতি করেন,তখন তাদের বুক চাপা কষ্ট অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসে। মা বাবার এই বুক চাপা কষ্ট শয্যাসায়ী বোধিরাজ অনুধাবন করতে পারে। এবং সেও ঈশ্বরের কাছে তার মৃত্যু কামনা করে। এই ভাবে আরো বেশ কয়েক বছর কেটে গেল।
বোধিরাজের বয়স যখন একুশ বছর, তখন একদিন রাত্রে খাওয়ার পর বোধিরাজের মা তাকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ বোধিরাজ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল-” মা আমি তোমাদের খুব কষ্ট দেই না?” মা ছেলেকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো -” না বাবা, তুমি কেন কষ্ট দেবে? আমাদের মতিভ্রমে তোমার আজ এত কষ্ট।” বোধিরাজ অশ্রুসিক্ত নয়নে আবেগাপ্লুত হয়ে বলল -” মাগো, আমার উপস্থিতি যে তোমাদের শরীর মনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে।” কাঠুরে বোধিরাজের মুখে এমন কথা শুনে কেঁদে ফেলে জড়িয়ে ধরে বলে-” সন্তানের মুখ থেকে পিতামাতাকে এমন কথা শোনাও যে মহা পাপ বাবা!” বোধিরাজের গায়ের কাঁথা ঠিক করে দিতে দিতে তার মা বললো-” তোমার আজ কি হলো বাবা? এসব কথা কেন বলছো? অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।”
বোধিরাজ ঘুমিয়ে পড়লো, ভোর রাতের দিকে তার শরীরে একটা ঝাকুনি মেরে শরীরটা স্থির হয়ে গেল। বোধিরাজ দেখলো মা, বাবা, সে নিজে শুয়ে আছে। আবার সে নিজে যেন ঘরের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই ভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হল। সে এই স্বপ্নময় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের শরীরটাকে নাড়াবার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। মা বাবার কাছে গেল, ওদের ডাকার চেষ্টা করলো অনেক। কিন্তু তাও পারলো না। ওর বাবা মা অকাতরে ঘুমোচ্ছে, বোধিরাজ যে এত ডাকাডাকি করছে তা ওর মা বাবার কর্ণ গোচর হচ্ছে না। এরই মধ্যে সে কুটিরের বাইরে পাখির করুন কলরব শুনতে পেল। সে বাইরে চলে এলো, একটু অবাকও হলো। পাখি গুলো অমন করে ডাকছে কেন! কুটিরের চার দিকে বেজি, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি ছোট প্রাণী গুলো যেন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাঘুরি করছে। বোধিরাজ ওদের সাথে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু পশু পাখি তা বুঝলো না। এরই মধ্যে সে কুটিরের ভিতর থেকে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ পেলো। ঘরে ঢুকে দেখে মা, বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে। বোধিরাজ মা বাবার কাছে জানতে চাইলো তারা ওকে জড়িয়ে ধরে অমন করে কাঁদছে কেন! পারলো না। আস্তে আস্তে প্রতিবেশীরা ভিড় করলো। বোধিরাজ সব দেখছে, কিন্তু নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে পারছে না। এমন কি নিজের শরীরেও প্রবেশ করতে পারছে না। তার বিকলাঙ্গ ঘুমন্ত শরীরটা সকলে মিলে দাওয়াতে এনে রাখলো। চোখে দিলো তুলসী পাতা, গলায় ফুলের মালা। চন্দন নিয়ে সাজাতে এলো, চির দুঃখিনী মাতা। বোধিরাজ স্বপ্ন দেখার মতো সব কিছুই দেখে যাচ্ছে। শুধু স্বপ্নটা আর ভাঙছে না। সে যে মারা গেছে, তার আত্মা বায়ু মন্ডলে সূক্ষদেহে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ছেড়ে আসা স্থূল শরীরটা দাহ করার প্রস্তুতি চলছে। পিতা মাতার জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট অনুভব করছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। সকলে মিলে তার স্হূল শরীরটাকে নিয়ে শ্মশানে এলো। তারপর কিছু পরলৌকিক কাজ করে, স্থূল শরীরটাকে কাঠের চিতায় শুইয়ে অগ্নি সংযোগ করলো। চোখের সামনে তার শরীরটা পুড়ছে,এবং তার মা বাবার করুন ক্রন্দন তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। একটা সময় দাহ কার্য সম্পন্ন করে মা,বাবা বাড়ীর উদ্দেশে পা বাড়ালো। বোধিরাজ চিৎকার করে ডাকলো, কিন্তু তাঁরা পিছন ফিরে তাকালো না। বোধিরাজ বুঝলো মা, বাবা তার মায়া ত্যাগ করেছে। গ্যাস ভর্তি বেলুন যেমন আস্তে আস্তে উপর দিকে ওঠে, ঠিক তেমনি বায়বীয় শরীরে বাবা মা কে শেষ বিদায় জানিয়ে সে আস্তে আস্তে উপর দিকে উঠতে শুরু করলো।
বায়বীয় শরীরটা একটা সময় একটা বায়বীয় স্তরে গিয়ে দাঁড়ালো। যে স্তরে এমন আত্মা অসংখ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। সময়ের কোনো হিসেব নেই শুধুই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা অসহ্য কষ্ট যন্ত্রনা সহ্য করে চলেছে। স্বপ্নে যেমন আমাদের কেউ প্রহার করে বা আমরা আগুনে দগ্ধ হই তখন যেমন আমাদের কষ্ট অনুভহত হয় ঠিক তেমনই। বোধিরাজের বায়বীয় শরীর, অন্য যন্ত্রনা ভোগী বায়োবীয় শরীরের যন্ত্রনা উপলব্ধি করতে পারছে। এরই মধ্যে একটি আত্মার বায়োবীয় শরীরটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে ওঠা শুরু করলো। কে যেন বোধিরাজকে বলল ওই আত্মার নরক যন্ত্রনা সমাপ্ত হলো। চললো সে বিধাতা পুরুষের দ্বারে। মহাকালের দ্বারে এসে সময়ের কোনো হিসাব নেই। আদি অনন্ত কাল যেন একটা ছোট্ট দৃষ্টিপটে আবদ্ধ। বোধিরাজের আত্মা শুধুই বর্তমানে বিরাজ করছে। মহাকালের মহা পরিসরে প্রবেশ করায় সে অতীত ভুলে গেছে, ভবিষ্যৎ বিধাতা পুরুষের হাতে। চোখে তার শুধুই বর্তমান। তার বায়বীয় আত্মা গ্যাস বেলুনের মতো আবার ধীরে ধীরে উর্দ্ধ মুখী হলো। কে যেন আবার বললো তার ক্ষণস্থায়ী জীবনে পুণ্যের ঝাঁপি পূর্ণ হয়ে আছে, ফলস্বরূপ তার স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটতে চলেছে। মানুষের জীবন তো পাপ পুণ্যের মিশ্রনে অতিবাহিত হয়, সেই জন্য ক্ষণকাল নরক দৃষ্ট হয়ে তার স্বর্গে আগমন ঘটছে।
বোধিরাজের বায়বীয় আত্মা একটা সময় গ্যাস বেলুনের মতো আর একটি বায়বীয় স্তরে গিয়ে স্থিতি হলো। এখানে নেই কোনো হাহাকার, দুঃখ, কষ্ট, যাতনা কেমনে হয় কেউ বুঝতে পারে না। শুধুই মনের তৃপ্ত আনন্দ আর প্রাপ্তি। এ যেন এক নৈসর্গিক পরিবেশ। স্বর্গের সুখ-স্বাচ্ছন্দে মহাকালে প্রবেশ করে, ঈশ্বর সান্নিধ্যে উপনীত হয়ে, বোধিরাজের আত্মা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে থাকলো। তার জ্ঞান বুদ্ধির ভান্ডার পরিপূর্ণ হলো। এভাবে কতদিন অতিক্রান্ত হলো বোধিরাজের বায়বীয় আত্মা সেটা বুঝতেও পারলো না। অবশেষে বিধাতা পুরুষের দুয়ারে এসে উপস্থিত হলো। এমতাবস্তায় বোধিরাজের ইয়োলোকের ক্ষণ জন্মের সমস্ত স্মৃতি পুনরায় জাজল্ল্যমান হলো। ভালো কর্ম ফলের জন্য বিধাতা পুরুষ তাকে কিছু নিজ সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দিলেন। এসবই বোধিরাজের আত্মা স্বপ্নের মতো চাক্কুষ করছে। বিধাতা পুরুষ তার ক্ষণজন্মের পুণ্য ফলের পুরস্কার দিতে চাইলেন। তিনি বোধিরাজকে বললেন-” আমি তোমাকে নব জন্মের দ্বারা পুনরায় ইয়োলকে প্রত্যর্পণ করিব। কহ, তুমি কিরূপ জীবন প্রত্যাশা করো – শান্তিময় না সুখময়?” বোধিরাজের আত্মা একটু ভেবে উত্তর দিলো-” আমি শান্তিপূর্ণ জীবনই কামনা করবো।”
বিধিতা পুরুষ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো -কিসের নিমিত্তে তুমি সুখময় জীবন প্রত্যাশা করো না?
বোধিরাজের আত্মা দৃঢ় ভাবে উত্তর দেয় -সুখ ক্ষণস্থায়ী, মানব জীবনে তা অতিথির ন্যায় স্বল্প সময়ের জন্য বিরাজ করে। ঠিক সেই সময়ে সুখের অনুসারী হয় (কাম, ক্রোধ,লোভ,মোহ,মদ ও মাৎসর্য ) ষড়রিপু। যারা মনুষ্য জীবনকে মনুসত্ত্য হীনতায় ভরিয়ে তোলে। জীবন জীবনের পথে চলে না, সে শুধুই নিজের জন্য ভাবে। তড়িৎ গতিতে জীবনে প্রবেশ করে, জীবনকে উলটপালট করে ভস্মে পরিণত করে বিদায় লয়। কিন্তু শান্তি, আমৃত্যু মানুষের সাথে থাকে। শান্তি থাকলেই সুখকে অনুভব করা যায়, কিন্তু সুখ থাকলে শান্তিকে অনুভব করা যায় না।
বিধাতা পুরুষ মৃদু হেঁসে বললেন “- তোমার ব্যাখ্যায় আমি প্রীত হইলাম। শান্তি স্বর্গের অগ্রদূত আর সুখ নরকের। এবার কহ, মনুষ্য জীবনে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র চতুর বর্ণের কোন বর্ণে তুমি জন্মগ্রহণ করিতে ইচ্ছুক?” বোধিরাজের আত্মা এবারও একটু ভেবে বললো -“শুদ্রের বংশে।” বিধাতা পুরুষ ভীষণ অবাক হয়ে বোধিরাজের আত্মাকে প্রশ্ন করলেন-” তুমি কি ভাবিয়া কোহিতেছ? যেখানে তোমার পুণ্য কর্মের ফলে তুমি বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বংশে জন্মাইতে পারো! তাহা না চাহিয়া তুমি শুদ্র বংশে জন্মগ্রহণ করিতে চাহিতেছ!” বোধিরাজের আত্মা এই প্রশ্নের উত্তরে বলিল-” ইয়োলকে শুদ্রদের বড়ো করুন অবস্থা, সমাজের নিকৃষ্ট প্রকৃতির কাজ তাদের করতে হয়। যে কাজ তারা না করলে উচ্চ শ্ৰেণীর উচ্চ জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। আর সেই কাজ করায় তারা সমাজে অস্পৃশ্য। উচ্চ শ্রেণী তাদের স্পর্শও করে না। এমনকি ঈশ্বরের নামগান ও তারা করতে পারে না। তাঁর চরণতলে পৌঁছনো তো দুরস্ত।
আছে।” বিধাতা পুরুষের কথা শুনে বোধিরাজের আত্মা বললো-” একটি গাছ থেকে ফুল তুলে, মালা গেঁথে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করার সময় দেখা হয়না কোন ফুলটি বড়ো, কোনটি গন্ধ বেশি বা কোনটি বেশি রঙিন। সব ফুল একই সুতায় গেঁথে ঈশ্বরের চরণে নিবেদন করা হয়। আমি চাই সমস্ত মনুষ্য কুলকে মালার ন্যায় গাঁথিয়া ঈশ্বরের আঙিনায় নিয়ে যেতে।” বিধাতা পুরুষ বলিলেন-” তবুও আমি তোমাকে শুদ্র কুলে পাঠাইতে পারি না। তুমি ক্ষত্রিয় কুলে এক রাজ মাতার গর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইবে। তবে রাজ সুখ তোমার অভীষ্টের কাছে পরাজয় স্বীকার করিবে। লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, অবহেলিত পিছিয়ে পড়া মনুষ্য কুল তোমাকে পথ প্রদর্শক মানিয়া অনুসরণ করিবে। তুমিই তাদের পথ দেখাইবে।”বোধিরাজের আত্মা নব নব জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করে ইয়োলোকের লক্ষে এগিয়ে আসতে থাকলো। এদিকে পৃথিবীতে তখন কোনো এক গর্ভধারিনী রাজমাতা শিশু ভূমিষ্ঠের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকলো।