অভিসার শেষে
কিশোর বিশ্বাস
হাইওয়ে দিয়ে তীব্র গতির গাড়িটা যেন উড়ছে। পাশে চলা গাড়িগুলোকে মূহুর্তে পিছনে ফেলে দিচ্ছে,দু,পাশের কুঁড়ে ঘর,গাছ পালা, জল আনতে যাওয়া গাঁয়ের বধূ ছনাত্ ছনাত্ মিলিয়ে যাচ্ছে, কৃষকেরা বাইকের তীব্র গতি দেখে ক্ষেতের কাজ বন্ধ করে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকছে। শুধু কি তাই? উড়ছে পুস্পিতার সোনালি চুল,উড়ছে পুস্পিতার নীল রং এর শাড়ি। এই শাড়ি নাকি তার খুব পয়া তাই আজকের শুভদিনে সে এই শাড়িই পরেছে। কিন্তু জ্যোতির মন ছুটছে তার থেকে ও তীব্র গতিতে।সে আজ তার প্রেমিকাকে একটা তিন রুমের ফ্লাট উপহার দেবে। এতদিন তারা ভাড়া বাড়িতেই কাজ চালিয়েছে, সেখানে বার বার ভয় এসে আনন্দের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। আজ আর ভয় নেই।
ফ্লাটটা শহরের কাছে কিন্তু শহরে নয়,শহরের প্রান্তে,একান্ত নির্জনে।সেখানে বেশীর ভাগ ফ্লাট কিনেছে শহরের বাবুরা সপ্তাহান্তে অবকাশ যাপনের জন্য। তার চারিদিকে বেশির ভাগ ফ্লাটেই লোকজন বিশেষ নেই। আছে নির্জন আকাশ, গাছপালা, ফুল ফল,একটা সুইমিংপুল কিন্তু সেখানে কবে শেষ জল পাল্টানো হয়েছে কেউ মনে করতে পারে না,জলে শেওলা জমেছে। আছে বাচ্চাদের একটা পার্ক,সেখানে বাচ্চাদের হরেক রকমের খেলনা কিন্তু তাতেও ধুলো জমেছে। আছে এক দারোয়ান সে বসে বসে ঝিমোয় কিন্তু বাইক বা গাড়ি আসলে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকে হাত পাতে,দু,শো একশো যে যা দেয় পকেটে পুরে আবার ঝিমোয়।যেন সে কিছুই দেখে না,সে কিছুই জানে না,সে কিছুই বোঝে না।
পুস্পিতাকে নিয়ে ঝড়ের বেগে উপরে উঠে গেল জ্যোতি।অতঃপর জামার বুক পকেট থেকে এক গোছা চাবি বের করে পুস্পিতাকে বলল তোমার ফ্লাটের দরজা তুমিই খোল।জ্যোতির মনে পড়ছে প্রথম দিনের কথা হাবড়া বিগ বাজারে ও একটা প্যান্ট কিনবে বলে ঘুরছে,হঠাৎ ডান দিকে চোখ ঘুরতেই দেখে এক প্রজাপতি উড়ছে বিভিন্ন রং এর সেলোয়ার-কামিজের মধ্যে। তার গায়ের রং কাঁচা হলুদের মত,স্লিম ফিগার, হাত কাটা জরির কাজ করা নীল রং এর ব্লাউজে, নীল রং এর সিফন শাড়িতে তাকে দেখে মনে হচ্ছে অতীতের রাধা হাজার হাজার বছর পেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।জ্যোতি যেন নিজের অজান্তেই ওর কাছে চলে গেল।একস্ কিউজ মি।ভদ্রমহিলা বললেন বলুন? আপনি কি তন্দ্রা? নাতো, কেন? না,তন্দ্রা নামে আমার এক বান্ধবী ছিল….। তো?আপনাকে অনেকটা তার মত দেখতে। অনেক বছর তার সংগে দেখা সাক্ষাত্ নেই, ভাবলাম তন্দ্রা।তাই? হাঁ।তো, আপনি আমাকে বান্ধবী ভাবতে পারেন। জ্যোতি এবার জিজ্ঞাসা করল আপনি কি দেখছিলেন? এই সেলোয়ার-কামিজটা। আপনার পছন্দ? পছন্দ তো কিন্তু…. কিন্তু কি? দাম অনেক, এত টাকা তো নিয়ে বের হইনি। কত দাম?চার হাজার সাতশো চল্লিশ। নিয়ে নিন।নিয়ে নিন মানে? টাকাটা আমিই পেমেন্ট করব।আপনার কাছ থেকে আমি টাকা নেব কেন? পরে যখন দেখা হবে দিয়ে দেবেন। না,আমি বাকিতে কাজ করি না।মানে? মানে টাকাটা আপনাকে আজই নিতে হবে। কি করে? আমার সংগে আমার বাড়ি গিয়ে। বন্ধু, যখন ভেবেছেন না নিলে হয় না?না নিলে আমি টাকা নেব না।অগত্যা জ্যোতি বিল পেমেন্ট করে তার বাইকে পুস্পিতাকে নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা দিল।এত কথার পর জ্যোতির মনে পড়ল ওনার নামটাই জানা হয়নি। জিজ্ঞাসা করল আপনার নামটা?আমার নাম পুস্পিতা মৈত্র।আপনার? আমি জ্যোতি প্রকাশ মল্লিক। বেশ ছিম ছাম,পাথর বসানো ফুলের বাগানে সাজানো দোতলা বাড়ি।পুস্পিতা তার স্বামীকে বলল ও আমার বন্ধু, নাম জ্যোতি। ভদ্রলোক বেশ অমায়িক হাত তুলে নমস্কার করে বললেন আমার নাম অমিয় মৈত্র।জ্যোতি প্রতি নমস্কার করলে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন তা আপনার….।জ্যোতি কথা কেড়ে নিয়ে বলল আমি MBBS ডাক্তার।অমিয় বাবু বললেন খুব ভালো একজন ডাক্তার বন্ধু থাকলে খুব উপকারে লাগে। তা আপনি কি করেন?আমার ভাই ছোট খাট প্রোমোটিং এর ব্যবসা। এখন তো প্রোমোটিংয়ের দারুন বাজার। তা একটু আছে বটে। তারপরই ভদ্রলোক পুস্পিতাকে বললো, পুস্পিতা আমাকে একটু বেরতে হবে। সাইডিংয়ে কাজ চলছে, ফিরতে রাত হবে কিন্তু ডাক্তার বাবুকে না খাইয়ে যেতে দিও না।অতঃপর জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বললেন ভাই জানেন তো আমাদের লেবার নিয়ে কাজ, না গেলেই ফাঁকি। জ্যোতি বলল ঠিক আছে। কিছু সময় পর পাশের ঘর থেকে পুস্পিতার মেয়ে এসে হাজির মা আমি একটু অপর্ণাদের বাড়িতে যাবো। ওখানেই আমরা চার বন্ধু মিলে পড়াশুনা খাওয়া দাওয়া করব।বাবা বাড়ি এলে আমাকে নিয়ে আসতে বলো।জ্যোতি জিজ্ঞাসা করলো মা তোমার নাম কি?সে বললো অঙ্কিতা।কোন ক্লাসে পড়? টুয়েলভে।জ্যোতিকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সে বেরিয়ে গেল।পিছন থেকে পুস্পিতা বললো মা সাবধানে যাস।অঙ্কিতা কোনো কথা না বলে, ফিরে ও না তাকিয়ে সোজা চলে গেল।এরপর কি আর সেলোয়ার-কামিজের দাম চাওয়া যায়? নাকি নেওয়া যায়? পুস্পিতা ও আর টাকার কথা তুললো না।সে আজ তিন বছর আগের কথা।তারপর দু,এক দিন পর পরই পুস্পিতা ফোন করে ও চলে যায়। ফাঁকা বাড়ি, দুপুরে স্নান খাওয়া বিশ্রাম সবই ওখানে হয়।ডাক্তার বাবুর সকালের চেম্বার সাতটা থেকে এগারোটা ছিলো, এখন সাতটা থেকে নয়টা হয়েছে। রুগী পত্তর ও বিশেষ হয় না।তার অন্যমনস্কতা আসছে তাই ওষুধে ও বিশেষ কাজ হয় না
এমন কি ছেলে বৌয়ের সংগেও ব্যবহারে রুক্ষতা আসছে। ছেলে মাধ্যমিক দেবে, বাবার এই ব্যবহারে সে পড়াশুনা শিকেয় তুলে মার কাছে এসে কাঁদে,মা ও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এই ভাবে দু,টো অসহায় প্রাণীর দিন কাটে,তন্দ্রা বিহীন রাত কাটে। ইত্যবসারে ডাক্টার বাবুর লক্ষ লক্ষ টাকা কানের দুল,গলার হার হীরের আংটি হয়ে পুস্পিতার লকারে জমা হতে থাকলো। জ্যোতির রাস্তার পাশে দশ কাঠা যায়গা ছিল, ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে কাজে বলে কিনেছিল।সে সেটা এক কোটি টাকায় বিক্রি করে ফ্ল্যাট কিনে,সোনা দানা কিনে প্রায় শেষ করে এনেছে। তবু পুস্পিতা বলে লোকেরা কত কিছু দেয়,তুমি আর আমাকে কি দিলে? জ্যোতি ও ভাবে তাই তো ও এত কিছু দেয়, আমি কেন সব উজাড় করে দিতে পারি না।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল পুস্পিতা চারিদিকে ফুল দিয়ে, বেলুন দিয়ে, আলো দিয়ে, সুগন্ধ দিয়ে সাজানো। মাঝে একটা সেগুন কাঠের বক্স খাট, দামী দামী বিছানা বালিশ, একটা গোদরেজের আলমারি, একটা ডাইনিং টেবিল চারটে চেয়ার। টেবিলের উপর দলিল। পুস্পিতা ঘরে ঢুকেই দলিলটা তুলে দেখে নিল ফ্লাটটা সত্যি তার নামে কেনা হয়েছে কিনা তারপর তার ব্যাগের মধ্যে রেখে চেন টেনে দিল।অতঃপর দু,টি নদীর ধারা আনন্দ সমুদ্রে মিশে গেল।
এই ভাবে আরো দু, বছর চলে গেল। ডাক্তারের কোটি টাকা ফুরিয়ে গেল,হাতের আংটি, গলার চেন চলে গেল। বৌ ছেলে ছাড়া বিক্রি করার মত আর কিছু নেই। প্রাকটিস ও প্রায় বন্ধ। পুস্পিতার ব্যবহারে পরিবর্তন আসছে। ফোন করলে বলে আমার দরকারী কাজ আছে আমি আজ সময় দিতে পারব না।এদিকে জ্যোতি না থাকতে পেরে পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়।তাই একদিন জ্যোতি বাধ্য হয়েই ওর বাড়ি এসে হাজির হলো। ও বাড়ি নেই। মেয়ে বললো কোথায় গেছে জানি না।জ্যোতি বাইক চালিয়ে দিল তার ফ্ল্যাটের দিকে। দারোয়ান বললো ম্যাডাম তো তার ফ্ল্যাটেই আছেন। সংগে কেউ আছে? ম্যাডাম তো একা আসেন না।প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে নিয়েই আসেন।জ্যোতি আর দাঁড়াতে পারল না। দারোয়ানের হাতে দু,শো টাকা গুঁজে দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে গেল। পুস্পিতার ফ্লাটের জানালা দিয়ে সে যে দৃশ্য দেখলো তার হার্ট সেটা সহ্য করতে পারল না।সে টলতে টলতে দারোয়ানের কাছে এসে পড়ে গেল। অতঃপর দারোয়ানের সাহায্যে সে তার বৌকে ফোন করলো।। জ্যোতির বৌ ছেলে ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো। ডাক্তার বাবু দেখে শুনে বললেন, এ্যাটাক অবস্থায় পড়ে গেছেন, ডান সাইটটা এ্যাফেকটেড হয়েছে। তবে বেশ কিছু দিন নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ালে আর সেবা যত্ন করলে আশা করি সেরে উঠবেন। জ্যোতির স্ত্রী বললো তার কোন ত্রুটি হবে না।
–~০০০XX০০০~–