আমার পুজো
জয়িতা হালদার ঘোষ
আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা মাত্র তারা চোখে পড়লো। তারপর আরো একটা , তারপর আরো একটা।এইভাবে হাজার হাজার তারাভরা আকাশটা যেন আপন হয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমি শ্রীমতী আনন্দী রায়।কার্শিয়াং এর একটা হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে সারা পৃথিবী থেকে নিজেকে আলাদা করে তারাদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমার অতি প্রিয় স্বামী শ্রী শান্তনীল রায়, সিনিয়র একজিকিউটিভ অফিসার একমনে হোটেলের ঘরে সামনে ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন অফিসের দায়িত্ব পালনে।
অনেক জোর জবরদস্তি করে আজ আমাকে কার্শিয়াং এ আনা হয়েছে, পরিবেশ বদলের জন্য। যদিও অফিসের ট্যুরে, কিন্তু এত সুন্দর পাহাড়ী এলাকায় আমার ভালো লাগবে বলেই আনা হয়েছে আমাকে। হোটেলের বাগানে রকমারী ফুলের মেলা।মেঘ ভেসে আসে ক্ষণে ক্ষণে জানলায়, কখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি কখনো সোনালী রোদে ধুয়ে যায় সবটুকু অন্ধকার। কিন্তু আমার মনের অন্ধকার কিছুতেই দূর করতে পারছে কেউই।
গত কয়েক মাস ধরে ভীষণ কষ্ট আমার। ডঃ সেনশর্মা আমাকে এবার শেষ চেক আপ এর পর জানিয়ে দিয়েছেন , আমার আর কোনদিন মা হওয়া সম্ভব নয়।এ খবরটা আমার জীবনের সবটুকু আনন্দ শুষে নিয়েছে। আমার খুব প্রিয় মানুষ আমার স্বামী সে কখনো বাবা ডাক শুনতে পারবে না ,শুধু আমার জন্য! এটা কিছুতেই মানতে পারছি না। আমি খুব ছোট্ট থেকে পাশের বাড়ীর বাচ্চা নিয়ে এসে তাদের সারাদিন রেখে আদর যত্ন এতটাই সুন্দর করে করতে পারতাম,ওরা সবাই নিশ্চিন্তে আমার দায়িত্বে ওদের বাচ্চাদের আমার কাছে দিয়ে যেতো।অথচ সেই আমি নিজে কোনদিন মা ডাক শুনতে পাবো না? আমার জন্য আমার স্বামী যে কি না গত পাঁচ বছরে এত যত্নে আদরে রেখেছে,তাকে আমি বঞ্চিত করবো পিতৃত্ব থেকে!
আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। কলকাতায় এখন পুজোর আনন্দ।সবাই মেতে উঠেছে কেনাকাটা,ঘর সাজানোয়। আমিও গতবছর এই সময় বারান্দায় একটা দোলনা লাগালাম, কতগুলো ফুলের গাছ আনলাম,কত সুন্দর সুন্দর পর্দা আর ছোট ছোট বাচ্চাদের ছবি দিয়ে ঘর সাজিয়েছিলাম। তখন ভীষণ আশা ছিল আমি মা হবো। হঠাৎই কালীপুজোর শেষরাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর সব ট্রিটমেন্ট এর পর হার্টে সার্জারি হলোও।সব কিছু যখন ঠিক হয়ে গেছে তখন ডঃ বললেন,এত দুর্বল হৃদয়ে মা হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো।হয়তো ডেলিভারীর সময় মা ও সন্তান দুজনেই মারা যাবে।শান্তনীল এরপর একবারও চায় না সন্তান।সে শুধু আনন্দীকেই চায়।
কিন্তু আমি পারছি না এতটা কষ্টকর জীবন যাপন। দু’চোখে জল বন্যার মতো বেয়ে চলেছে। হঠাৎ একটা তীব্র শিশুকান্নার আওয়াজ নিচের দিক থেকে শুনতে পেয়ে দেখি,পাহাড়ী পথের বাঁকে ছোট ছোট ঘর গুলো থেকে আসছে আওয়াজটা। আমি খানিকক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা ছোট্ট বাচ্চা প্রচন্ড কাঁদছে কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই।বেশ খানিকক্ষণ পর একজন বুড়ো লোক এসে বাচ্চাটাকে একটা বাটি করে কি যেন চামচ করে খাওয়াতে লাগলো।বাচ্চাটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। আমিও রাত বাড়তে থাকায় ঘরের দিকে গেলাম।শান্ত কাজে ব্যস্ত থাকায় আমি কিছু বললাম না আর।
সারারাত কানে ঐ শিশুর কান্না আমাকে অস্থির করে রাখলো। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আমি বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। হোটেলের একটি ছেলেকে বললাম, ওদিকে কাদের ঘর জানো?
সে বললো,ও আগে এখানে একজন রাধুনী ছিল তার ঘর। আমি বললাম, এখন কোথায় সে? ছেলেটি বললো,ও তো মিঁয়াবিবি দু’জনেই এখানে কাজ করত, একদিন রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার বার্ষ্ট করে দুজনেই মরে গেছে। আমি বললাম,একটা বাচ্চা দেখলাম কাল।ও বললো, হ্যাঁ ওদের বাচ্চা । এখন কেউ নেই, এখানকার বুড়ো মালী ওকে দেখাশোনা করে। ততক্ষণে আমার বুকে মাদল বাজতে শুরু করেছে, প্রায় দৌড়ে গিয়ে ঘরে নীলকে ডাকলাম।
সব ঘটনা একনিঃশ্বাসে বলেই বললাম আমি ঐ বাচ্চাটাকে নেবো। ঝরঝর করে চোখের জল নীলের বুক ভিজিয়ে দিল। অনেক কষ্টে আমাকে বোঝালো একটু খোঁজ খবর করতে দাও।যদি সত্যিই সেটা সম্ভব হয়,তাই হবে।
আমি চুপ করে বসে রইলাম ঘরে।ও তৈরী হয়ে অফিসের কাজে বেরিয়ে গেল। আমার অজান্তেই কখন যেন পায়ে পায়ে ঐ বাচ্চাটির ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি । ঘরের মধ্যে খিলখিল হাসির আওয়াজ,মুখটা বাড়িয়ে দেখি একটা ঝুমঝুমি দড়ি দিয়ে ঝোলানো ওর সামনে,ও ওটা দেখছে আর হাসছে ,ঘরে কেউ নেই।
বুকটা তীব্র যণ্ত্রণায় মুচড়ে উঠলো।তখনই ঘরে এসে ঢুকলো বুড়ো মালী।ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে তাকে বললাম, আমার মনের কথা।সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো,এ বেওয়ারিশ বাচ্চা দিদিসাহেবা।ওর কেউ আপন নেই। আমি তো দু’দিন পর মরেই যাবো কে ওকে দেখভাল করবে? যদি পারেন নিজের বাচ্চার মতো নিয়ে চলিয়ে যান।
আমি ওকে সারাদিন ধরে শুধু দেখেই গেলাম,কখন খায় কখন ঘুমোয় কি করে।মন খুশিতে আত্মহারা।একসময় নীল এসে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘরে ঢুকলো। আমি চোখের ইশারায় দেখালাম বাচ্চাটাকে।ও আমাকে বললো,চলো আগে হোটেলের ম্যানেজার এর সঙ্গে কথা বলি।
তারপর…….
আজ মহাষষ্ঠীর বোধন আমি কোলে একটি ফুলের মত সন্তানকে নিয়ে শান্তনীলের সঙ্গে বেলুড় মঠের দুর্গা প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে।
আমার প্রাণের ঠাকুর আজ আমার সব ইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছেন,তাই তো মৃণ্ময়ী মায়ের কাছে আমি এসেছি প্রকৃত চিণ্ময়ী মা হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করতে।
–~০০০XX০০০~–