অন্তরালে
কাকলি ঘোষ
অপেক্ষা করে করে শেষে সাতটার সময় চায়ের জল চাপিয়ে দিল সুমিতা। যদিও রবিবার। অফিসের তাড়া নেই। হ’লে কী হয়? বিছানায় চোখ বুজে বুজেই চা- চা শুরু করবে শোভন। বাসি মুখেই দুবার। অন্য দিন রতনের মা সাড়ে ছটা বাজার আগেই এসে পড়ে। আজ কি হল কে জানে ! দুম করে কামাই করে বসলেই তো হয়ে গেল ! রাশি জামাকাপড়, বিছানার চাদর নামিয়েছে। জলখাবারের পাট মিটলেই মেশিনে দেবে। সারা সপ্তাহের জমানো। রান্নার ঝামেলাও রবিবারেই বেশি। অন্য দিন তো যা হোক একটা সেদ্ধ,মাছের ঝোল নাকে মুখে গুঁজে দুজনের –ই ছোটা। আজ একটু আলাদা রকমফের না হলে শোভনের মুখ ভার হয়। এই একটা দিনই নিজের ইচ্ছে মত বাজার করে ও আর মুখ বুজে রান্না করে যায় সুমিতা। রতনের মা জোগাড় দিতে দিতে হিমশিম খায়। এক এক সময় বলেই ফেলে
“ খাবে তো বাপু দুটো মনিষ্যি। এই এত ছিষ্টির রান্না!”
গামলায় হিসেব করে ময়দা নিতে নিতে মাথার মধ্যে কাজগুলো গুছিয়ে নেয়। লুচি হবে। আলু কাটতে হবে। ছুটির দিনে নরম সাদা ধপধপে লুচির সঙ্গে কালোজিরে ফোড়নের কাঁচালঙ্কা চিরে দেওয়া ঝাল ঝাল আলুর তরকারি ভালবাসে শোভন। ডিম ক’টা আছে দেখে নিতে হবে। কাঁচা আনাজের একটা লিষ্ট করে ধরিয়ে দিতে হবে ওর হাতে। সারা সপ্তাহের বাজারটা রবিবারেই মজুত করে নেয় সুমিতা। নিজে অফিস ফেরত আসার সময় মাছটা প্রয়োজনমত কিনে নিয়ে আসে।
চা ভিজে গেছে। ছাঁকতে ছাঁকতেই কলিংবেলের আওয়াজ পেল। সাতটা পনেরো। যাক বাবা এসেছে। চায়ের কাপ শোভনের সামনে রেখে দরজা খোলে। হুড়মুড় করে ঢুকে এল রতনের মা।
“বাব্বা ! আজ এত দেরি কেন গো ? আমি তো ভেবেছি—–’’
কথা শেষ করার আগেই খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ে রতনের মা।
“ আর ব’লনা বৌদি। বেরিয়েছি তো কখন ! রাস্তায় যা একখানা কাণ্ড ! হি-হি-হি। ’’
ওকে হাসতে দিয়ে রান্নাঘরে ফিরে যায় সুমিতা। উৎসাহ দেখায় না বিশেষ।
“ ময়দাটা মাখো। আলুর তরকারিটা কুটে দাও।“
চায়ের কাপটা নিয়ে কিচেনের সামনের একফালি বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় আরাম করে ব’সে ওর দিকে চায় সুমিতা। কী আর বলবে ? পাড়াপ্রতিবেশীর কোন কেচ্ছা নিশ্চয়। এসব বাপারে আমোদ খুব ! আর যদি সেগুলো ভদ্রলোকের বাড়ির হয় তবে তো কথাই নেই।
“জানো বৌদি” ময়দা ঠেসতে ঠেসতে মুখ চালায় রতনের মা, “ দুলিরামের এই বউটাও গেল।’’
“গেল মানে?”
“গেল মানে পালালো। আমাদের ওই মোড়ের মাথায় একটা টাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে না ? দেখেছো তো ! ওই ওরই ডেরাইভার পরানের সাথে –”
বাকি চা টুকু আর মুখে তুলতে পারে না সুমিতা। “ যাঃ ! সে আবার কি !”
“হ্যাঁ গো। তবে আর বলচি কী ? এইতো কাজে আসার সময় আমি নিজের চোকে দেকে এলুম ওর ঘরের সামনে ভীড়। বুড়ো মদ্দ ভেউ ভেউ করে কাঁদচে বউএর শোকে ’’, বলতে বলতে আবারও হেসে গড়ায় রতনের মা।
“লোকে কী বলচে জানো ? বলচে দুলিরামের ভাগ্যে বউ সয় না।’’
চুপ করে থাকে সুমিতা। সকাল বেলায়ই মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। লোকটাকে চেনে বলেই আরো। কালোকুলো, মোটাসোটা চেহারা। তিনকুলে কেউ নেই। বাজারের ঠিক সামনেটায় বড়সড় একখানা সব্জির দোকান। বেশ জমজমাট ব্যবসা। ব্যবহারও খুব ভদ্র। বোকা বোকা মুখে হাসি লেগেই আছে। সকলে বলে লোকটা নাকি একটু হাবাগোবা ধরনের। তা আজকালকার দিনে ভালমানুষ মানেই তো তাই! শোভন অবশ্য অন্য কথা বলে। বলে “ যতটা দেখায় ততটা নয়। নইলে অমন একখানা ব্যবসা চালাতে পারে !”
তা ঠিকই। যাতায়াতের পথে দেখে তো সুমিতা। ভীড় যেন উপচে পড়ে ওর দোকানে ! টাটকা ভালো সবজি। লোকে দাঁড়িয়ে থেকেই কেনে। পরে হিসেব করে দেখেওছে অন্য দোকানের চেয়ে সস্তাই পড়ে। লোকটা কিন্তু সৎও। সেবার ! সুমিতারা তখন এ পাড়ায় প্রায় নতুন। বাজার করতে গিয়ে শোভন পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বাকিটা ফেরত না নিয়েই বাড়ি চলে এল। ওর ধরনই ওই। বাড়ি এসে পরে আর হিসাব মেলাতে পারেনা। কাকে দিলো ? মাছওয়ালা কি সব্জিওয়ালা। পরেরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দুলিরাম ডেকে টাকা ফেরত দিল। সেই থেকেই অল্প স্বল্প পরিচয়। শোভন তো ওর ওখানেই ব্যাগ আর টাকা ফেলে দিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা মারে নিশ্চিন্তে। সেই লোক ! পর পর তিনটে বিয়ে করল। একটাও টিকল না !
প্রথমবারের বিয়েটা তো এখনো স্পষ্ট মনে আছে। এইতো বছর তিনেক আগের কথা। কেমন সেজেগুজে হাসিমুখে বিয়ে করে নিয়ে এল। ও মা ! ক’দিন যেতে না যেতেই পাড়ায় ফিসফাস, কানাকানি। কী ! না দুলিরামের বউ ভেগেছে। শুনে তো চোখ কপালে ওঠার দাখিল ! বলে কী ! খবর নিয়ে এল রতনের মা। জোড়ে বাপের বাড়ি গিয়ে বউ নাকি আর ফেরে নি ! বলে পাঠিয়েছে সে দুলির ঘর করবে না। ও লোকের পাশে থাকার চেয়ে একটা ভাল্লুককে জড়িয়ে শুয়ে থাকাও ভাল।
শোভন হেসে ঠাট্টা করেছে , “ হা হা। কী ভেবেছো ? নারী স্বাধীনতা শুধু একচেটিয়া তোমাদেরই !”
খারাপ লেগেছে সুমিতার। ভালমানুষ লোকটার মুখ পুড়ল। কিছুদিন সকলের চোখের সামনেই মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াল। বছরখানেকের মধ্যেই রতনের মা খবর এনে দিল আবার বিয়ে করছে দুলিরাম। কোন দুরসম্পর্কের কাকিমা নিজে সম্বন্ধ করেছে। পাড়াগাঁর মেয়ে। শোভনের তির্য্ক মন্তব্য, “ যাক বাবা। তোমার ভাবনা ঘুচল। ’’
কদিন পর যাতায়াতের পথে বারকয়েক চোখেও পড়েছে সুমিতার। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে বরের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে বউটা। একপলক দেখেই কেমন যেন ফ্যাকাশে লেগেছিল। রোগা , শির বের করা হাত , শীর্ণ মুখ। মোটাসোটা , নাদুসনুদুস দুলিরামের কাছে একেবারে বেমানান। তা যেমনই হোক এবারটায় আর কোন গণ্ডগোল ছিল না। বছরখানেক আর কোন কথা ওঠে নি দুলিরামকে নিয়ে। বেশ ছিল। দিব্যি ছিল। মাঝে মাঝে বাসন মাজুনি বাসন্তীর কাছে শুনত সুমিতা। এবারের বউটা দুলিরামের বড় ভাল হয়েছে। বেশ যত্ন আত্তি করে বরের। সবাই যখন প্রায় একরকম নিশ্চিন্তই ছিল যে এবার অন্তত আর আগের মত কোন অঘটন ঘটবে না। ঠিক তখনই কোথাও কিছু নেই ক’দিনের জ্বরে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে দুম করে চোখ বুজল বউটা। চোখ মুছতে মুছতে বাসন্তীই নিয়ে এল খবরটা। শোভন টা তো চিরকালের ফাজিল। ফিচেল হাসি হেসে বলে কি, “ লোকটার কি কপাল মাইরি ! চান্স তো পাচ্ছে বার বার।’’
সুমিতা কপট রাগে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ,” আহা ! চটছ কেন ? জাননা ? ভাগ্যবানের বউ মরে ?”– বলেই পুট করে ঘরের ভেতর। এমন পাজী !
বেচারি লোকটা মুখ এতটুকু করে ঘুরে বেড়ায়। প্রায়ই খবর নিয়ে আসে বাসন্তী, রতনের মা। বউ মরে ইস্তক নাকি কাজেকর্মে মোটে মন নেই দুলিরামের। ব্যবসা তুলে দিয়ে নাকি রুপনারায়নপুর না কোথায় দেশে ফিরে যাবে। যাওয়া আসার পথে ক্বচিৎ কখনো চোখাচোখি হয়েছে। সুমিতার চোখেও মুখখানা বেশ শুকনোই লেগেছে। তবে ব্যবসা তুলে দেবার কোন লক্ষন দেখা যায় নি। বরং আগের চেয়ে বেশি সময় দোকানেই যেন দেখতে পায় লোকটাকে। কখনো হিসেবে মগ্ন, কখনো বা ঝাঁট পাট দিয়ে পরিষ্কার করছে চারদিক। মাঝে মাঝে—
“লুচি বেলবো বউদি?”
রতনের মার ডাকে চমক ভাঙে সুমিতার।“ দাঁড়াও দেখি— তোমার দাদা উঠল কিনা ?”
“ উঠল তো। এই মাত্তর বাথরুমে ঢুকল। আমি চায়ের কাপ আনতে গেসলুম—’’
“ও। তাহলে বেলো,” গাস জ্বেলে ওভেনে কড়া চাপায় সুমিতা।
লুচি বেলতে বেলতে আবার শুরু করে রতনের মা।
“যেদিন পোথম ওই বউকে আমি দুলিরামের পাশে দেকেচি না বউদি তকনই জানি ও মেয়েছেলে ঠিক ফুড়ুৎ করে পালাবে একদিন। ’’
চুপ করে থাকলেও রতনের মার কথাটা ঠিক উড়িয়ে দিতে পারে না সুমিতা। প্রথম দেখে ও নিজেও চমকেছিল। মাস দুয়েক আগে বোধহয়। অফিস থেকে ফিরছে। বসাক ড্রেসেসের পাশ দিয়ে আসার সময় অভ্যেসবশত তাকিয়েছে দোকানের শোকেসের দিকে। চমৎকার একখানা সালোয়ার স্যুট ডিসপ্লে করানো আছে। ঢুকবে না ঢুকবে না ভেবেও নিজের অজ্ঞাতেই পা দিয়ে ফেলেছে দোকানের ভেতর। সিলেক্টেড জিনিস রাখে এরা। অন্যান্য জায়গা থেকে কেনাকাটা করলেও এই দোকানটাও মাথায় রাখে ও। দেখছে শোকেসগুলো খুঁটিয়ে। তখনই হঠাৎ চোখ পড়েছে। কোনের দিকে কাউন্টারের সামনে দুলিরাম। বেশ সভ্যভব্য পোশাক। পাশের দিকে চোখ পড়তে চমক আরো দ্বিগুন। আঁটসাঁট চকচকে ব্লাউজ, চুমকি বসানো সিন্থেটিক শাড়ি, কপালে ঝিলমিলে টিপ, ঠোঁটে গাঢ় রঙ। একটু চোখটা উপরে তুলতেই সিঁথিতে সিঁদুর ও দেখা গেল। দুলির নতুন বউ নাকি! আবার কবে বিয়ে করল লোকটা ! এই বউ ! সামলাতে পারবে ! সামনে প’ড়ে স্স্তুপাকার সস্তা জংলা প্রিন্টের শাড়ি। শাড়ি পছন্দের পর্ব চলছে বোধহয়। নিজের কাজ সেরে চুপচাপ চলে এসে পরের দিন রতনের মাকে জিজ্ঞেস করতেই খোলসা হল ব্যাপারটা। কেউ জানতে পারেনি। কাউকে জানায়ও নি। দিন পনেরো হল কোত্থেকে বিয়ে করে এনেছে দুলিরাম। সে রঙ্গিনী- ঢঙী বউ যা একখানা ! কী তার চটক ! ঠমক-ঠামক! দুলি তো একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বউএর ছিচরনে। সবসময় বউ আগলে পড়ে থাকে।। কারুর সাথে মিশতে দেয় না। কথা পর্যন্ত বলতে দেয় না পাশের ঘরের লোকের সাথে।
“খুব সুন্দরী বুঝি ? ”, কিছু না জানার ভান করে সাদা মাটা গলায় প্রশ্ন করেছিল সুমিতা।
“জানিনে বাপু। হবে হয়ত।’’ বেশ নীরস রতনের মার কন্ঠস্বর।
রতনের মার এহেন নিস্পৃহতা কানে খট করে বেজেছে ! এমনটা তো হবার কথা নয় ! সব ব্যাপারে যার এত কৌতূহল হঠাৎ তার এমন গা ছাড়া ভাব ! দিন পনেরো আগের খবর ! অথচ রতনের মা মুখ খোলেনি তো ! পাড়ার কথা কাজের বাড়িতে না বললে যার ভাত হজম হয় না তার এহেন পরিবর্তন ! রহস্যের সমাধান করল বাসন্তী। চটে আছে রতনের মা। বেজায় চটে আছে দুলির ওপর। কারণখানাও মন্দ নয়। দুলির শেষের বউটা মরে যাবার পর থেকে নিজের মা বাপ মরা ভাইঝিটিকে নাকি দুলির কাঁধেই গছানোর তালে ছিল। তা সে গুড়ে বালি দিয়েছে দুলিরাম। শুনে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায়নি সুমিতা। শেষকালে ওই পুঁটি ! ওই একরত্তি রোগা হাড়জিরজিরে মেয়েটা ! ওই মুশকো কালো প্রায় বাপের বয়সী লোকটার সাথে–! কী করে ভেবেছে কে জানে ? আবার বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে বলে ভেতরে ভেতরে ফুটছেও বেশ !
আজ বুঝি সেই কারনেই হাসি আর কুলিয়ে উঠছে না ওর মুখে। “ আবার কী শুনলাম বৌদি জানো? ”
শোভনের জন্য পরিপাটি করে প্লেটে জলখাবার সাজাচ্ছিল সুমিতা। পিছন না ফিরেই সাড়া দিল,” কী? ”
“বউটা শুধু পালায়ইনি; গায়ের গয়না গাঁটি তো নিয়েছেই তার সঙ্গে আগের দিন ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনা দশহাজার টাকা নিয়েও চম্পট দিয়েচে “
চমকে তাকায় সুমিতা,” সে কী !”
“বলচে তো সবাই। নিতাই মিস্তিরি পাশের ঘরে থাকে। দশবার বলচে থানায় যেতে। তো সেই যে গুম মেরে বসে আছে; না নড়ে না চড়ে। উলটে থানায় যাবার কতায় এমন লাল চোখে তাকিয়েছে –’’
“ থানায় যাবে না ? ”
“ না ’’
“ কেন? ”
“ কে জানে বাপু? ”
“ অদ্ভুত তো ! ”
“ তা ছাড়া কী ? থানায় একবার খবর দিলে বউ টাকা দুই এরই হদিশ পাওয়া যেত। তো সে ওই অনামুখো গেলে তো !’’
আরও হাজার কথা বকবক করে বলে যাচ্ছিল রতনের মা। সাড়া না দিয়ে চুপচাপ থেকেছে সুমিতা। শুধু সে দিনটাই নয়। এর পরেও আরো দিন কতক মাথায় ঘুরেছে কথাটা। শোভনকে তো বলাই যায় না এসব কথা। আবার শুরু করে দেবে ফাজলামি! “তোমার কি খেয়ে ঘুমিয়ে কাজ নেই দুলিরামের বউ পালানো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো !”
মাথা ঘামানো নয়। আসলে অবাক ই লেগেছিল সুমিতার বেশি। টাকা পয়সা নিয়ে বউটা পালালো। লোকটা কিচ্ছু করল না ! সত্যি ই কী রকম যেন মানুষটা !
পরে ভেবেছে আসলে এটাই বোধহয় জীবন ! কোন বাঁধা ফরমুলায় একে চালানো যায়না। এক একটা মানুষ অন্যরকম, অদ্ভূত হয় বলেই তো জীবন এতটা বৈচিত্রময়। আর সবচেয়ে বিচিত্র বোধ করি মানুষের মন। কার যে কোথায় ,কী ভাবে, কেমন করে তা সাড়া দেয়, কখন কী ছন্দে বেজে ওঠে সে নিজেও কি তা জানতে পারে ? জানতে পারত কি সুমিতাও যদি সেদিন হঠাৎ দুলিরাম না এসে পড়ত ওর বাড়িতে ? দেখতে পেত কি একটা চেনা মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকা আর একটা অচেনা মুখকে !
বেশ কয়েক মাস পরের কথা। অফিস থেকে সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছে ও। শোভনের বন্ধু অলকেন্দুর বাড়িতে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান আছে। শোভন অফিস থেকে সরাসরি যাবে। সুমিতা বাড়ি হয়ে। আলমারী খুলে শাড়ীগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ নজর ফেলে জরীপ করছিল। কোনটা আজকের দিনের সাথে মানানসই। অলকেন্দুর বউ মীনার আবার সাংঘাতিক মেমারি ! আগের কোন অনুষ্ঠানে কে কোন শাড়ী পরে এসেছে সব মনে রাখে। তাই একটু হুঁশিয়ার হয়েই শাড়ী বাছছিলো সুমিতা । কে জানে বাবা রিপিট না হয়ে যায়। এই গুরতর সময়েই কানে এল কলিংবেলটা বাজছে। এই মরেছে ! এখন আবার কে এল ! হাতে সময় নেই একেবারেই ! ভুরুতে দুটো তিনটে ভাঁজ ফেলে দরজা খুলতেই অবাক! দুলিরাম!
“বৌদি——দাদা আছে?”
অল্প ঘাড় নাড়ে সুমিতা। না নেই।
“ও”, মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছে দেখে পিছন থেকে ডাকল সুমিতাই আবার, “ কেন? কিছু দরকার ছিল?”
প্রথমে চুপ করে থাকলেও শেষে একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল লোকটা, “ আজ আমাকে আসতে বলেছিলেন দাদা ”
আজ ! বিস্মিত হলেও অবিশ্বাস করে না সুমিতা। শোভনের ধারাই ওরকম। কাকে কি সময় দিচ্ছে তার কোন হুঁশ আছে ওর ! কিন্তু হঠাৎ দুলিরামকে ! কী ব্যাপার ! বিমূঢ় চোখে চায় সুমিতা। ওর জিজ্ঞাসু মুখ দেখে বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পারে দুলিরাম । তাই নিজেই বলে,
“ কিছু বলে যায়নি দাদা না ? ”
এবার অপ্রস্তুতের একশেষ সুমিতাই। কই ! না তো ! কিছুই বলেনি শোভন ! কিন্তু ব্যাপারটা কী ?
“ সেরকম কিছু না বৌদি। কিছু টাকা দরকার। দাদাকে বলেছিলাম —- মানে ধার হিসেবে—বড্ড আটকে গেছি—আসলে দোকানটায় একটা পাকা ছাউনি করে নেবো ভেবেছিলাম— জলঝড়ে বড্ড মাল নষ্ট হয়—-
আরো ক’জনকেও বলেছি—দাদা বলেছিল আজ আসতে। ঠিক আছে আমি না হয় পরেই আসব। আসলে হাতে ছিল কিছু—সেই ভরসাতেই নেমেছিলাম— তারপর–জানেনই তো সব-’’
অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সুমিতা। লোকটা কী ? মানুষ না কেঁচো ! টাকাগুলো নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল বউটা। আর ও এখন বেরিয়েছে টাকা ধার করতে ! কোন মানে হয়! এ ভালমানুষি না ন্যাকামি ? সহ্য হয় কারুর ?
“তাহলে আমি আসি বৌদি ? আপনি দাদাকে একটু বলে রাখবেন—’’
একটা অকারণ রাগ হঠাৎ কেমন ভর করে বসে সুমিতাকে। বলবে না বলবে না করেও দুম করে বলে ফেলে ও
“একটা কথা বলি কিছু মনে ক’র না। কী রকম মানুষ তুমি ! অতগুলো টাকা ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল তুমি টেরও পেলে না ? ’’
চমকে মুখ তুলে তাকায় দুলিরাম। সে মুখের দিকে চেয়ে নির্বাক হয়ে যায় সুমিতা। বেদনা যে কারো মুখে এমন সুগভীর ছায়া ফেলতে পারে তা আগে বুঝি জানা ছিল না। স্তব্ধ হয়ে কয়েক মিনিট নীচের দিকে চেয়ে থাকে দুলি। তারপর ধীরে ধীরে বলে,” কে বলল টের পাই নি ? পেয়েছি তো বৌদি। সব দেখেছি আমি। সবটাই—’’
“ মানে !’’, এবার বিস্মিত হবার পালা সুমিতার
“আমি ঘুমিয়ে ছিলাম না বউদি। ওর চলে যাওয়ার সময় আমি জেগেই ছিলাম। বিছানার নীচে রুমালে বাঁধা নোটগুলো ছিল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম ও টাকাগুলো বের করে নিল।’’
“তাহলে ! বাধা দিলে না ! কিছু বললে না ?”, বোধের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় সুমিতা।
“ নাহ ‘’’
“কেন ?”
“ কী বলব বৌদি? ও যেতই। আজ নয় কাল। জোর করে কি কাউকে ধরে রাখা যায় ? না রাখলে থাকে ? আমিই পারিনি ওকে রাখতে। আমার-ই দোষ। সকলে বলেছিল থানায় যেতে। আমি যাই নি। কাদা ঘাঁটতে আমার আর ইচ্ছে করেনি। থানা পুলিস করলে হয়ত ওরা ধরা পড়ে যেত কিন্তু তাতে লাভ কী কিছু হত? আবার সূযোগ পেলেই পালাতো।’’
“কিন্তু টাকাগুলো ? ওগুলো তো বাঁচাতে পারতে !”
“হ্যাঁ তা হয়তো পারতাম। কেড়ে রেখে দিতে পারতাম। পারিনি ”
“কেন ? ”, প্রায় ফিসফিস করে ওঠে সুমিতার কন্ঠস্বর।
“ জানি না বৌদি– হঠাৎ কেমন লজ্জা হল। ঘেন্না হল নিজের ওপর। মনে হল ওকে বাধা দিতে গেলে ও একাই শুধু ধরা পড়বে না, লজ্জা পাবে না। আমি নিজেও যেন নিজের দিকে তাকাতে পারব না। ক’ টা টাকাই তো নেবে। নিক। আর সত্যি বলতে কি ওরা দুজনে হয়ত কোন নতুন জায়গায় যাচ্ছে – কোথায় থাকবে—কী করবে—পরান তো ট্যাক্সির কাজটাও ছেড়ে দিয়ে গেল – টাকার দরকার তো ওদের আমার চেয়ে বেশিই। তাই না? ”
চুপ করে চেয়ে থাকে সুমিতা। চেয়ে চেয়ে দেখে। কতবারই তো দেখেছে লোকটাকে। কই ! কখনো তো মনে হয় নি এই মানুষটার ভেতরে আর কেউ আছে ! আজ হঠাৎ–হঠাৎই বড় অচেনা ঠেকছে এতদিনের চেনামুখটাকে।
–~০০০XX০০০~–