দাদাগিরি আনলিমিটেড
সুমান কুন্ডু
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী রেডিওতে যখন বাজে তখন ছেলেবেলা থেকে কোনদিনই ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে শোনা হয়ে ওঠে নি। কিন্তু বাবা প্রত্যেক বছর নিয়ম করে ওই রাত থাকতে রেডিওটা চালিয়ে দেন। আধোঘুমে কানে যা আসে তাই সকালবেলা উঠে মনে মনে আওড়ে নিতাম। আসলে মহালয়ার থেকেই শুরু হয়ে যায় আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা। শৈশবে পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলের ফেস্টুন টাঙানো থেকে একটা উৎসবের শুভ সূচনা হয়ে যেত। পরে ধীরে ধীরে প্যান্ডেলের বাঁশ পড়া থেকে মহালয়া এবং একটু একটু করে তৃতীয়া, চতুর্থী থেকে শুরু হয়ে যেত আনন্দ। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে চূড়ান্ত মাত্রা পেয়ে দশমীতে ঢলে পড়তো পশ্চিমাকাশে সূর্য ডোবার মত। ছোট থেকে যৌথ পরিবারে যাঁরা মানুষ হয়েছেন এবং পুজোর আনন্দটা চেটেপুটে যাঁরা উপভোগ করেছেন তাঁরা ভাল বুঝবেন যে দুর্গোৎসব বাঙালির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যাপ ফোটানোর আওয়াজ কেউ পাচ্ছেন? আমাদের শৈশবে মহালয়ার অন্তত দিন সাতেক আগে থাকতে স্পট ক্যাপ অথবা রোল ক্যাপ ছোট ছোট টিনের বন্দুকে ভরে শুরু হয়ে যেত মাস্তানি। পরবর্তীকালে লোহার একনলা পিস্তল আসে ক্যাপ ভরে তা ফোটানোর জন্য। সেই বন্দুক যার কাছে থাকতো তার রোয়াব দেখলে পাড়ার খুদে-পুঁচেরা সিঁটকে থাকতো। এখনকার বাচ্চাগুলো কেমন মেকানাইজড হয়ে গেছে। আর হবে নাই বা কেন ড্রোন কালচার যখন তার ঘরে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিস পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে দেখছে তখন যন্ত্রচালিত রোবট হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? মনে পড়ে পুজোর দিন যত এগিয়ে আসতো তত আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্ল্যানিং বাড়তো কিভাবে ত্রিকোনপার্ক বা মিলন সমিতির প্যান্ডেলে গিয়ে ওপাড়ার ছেলেগুলোর ওপরে হামলা করব। ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত সকালে নিয়ম করে নতুন জামা জুতো পরে প্যান্টের পকেটে বন্দুকটা গুঁজে নিয়ে পাড়ার বন্ধুরা মিলে চলতো বেপাড়ায় গিয়ে হামলাবাজি। এখনকার বাচ্চাদের কাছে যা হয়ত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। একবার তখন কোন ক্লাসেই বা পড়ি, ক্লাস ফাইভ কি সিক্স, বন্ধুরা মিলে এরকমই এক সপ্তমীর দিন অ্যাটাক করলাম আরো ছেলেবেলার এক বন্ধুকে। খেলনা ওই ক্যাপঠাসা বন্দুক নিয়ে ওই অবলা ছেলেটার ওপর চলল মিনিট পাঁচেকের আমাদের ভাষায় ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। ছেলেটির ঠাম্মা তখন জীবিত। তিনি আমাকে অতগুলো ছেলের মাঝখানে লোকেট করে ফেললেন। আর যাই কোথায়? আমার দাদুর দোকানে এসে রীতিমতো নালিশ এবং হুমকি দিয়ে গেলেন যে নাতির যদি শাস্তির ব্যবস্থা না করেন তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব। সে যাত্রায় কাকুদের এবং দাদুর অতিরিক্ত ভালোবাসায় পার পেয়ে যাই তবে ওই ঘটনাটা আমার ছেলেবেলার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও রয়ে গেছে। এছাড়াও কোন বান্ধবী যদি সামনে এসে পড়তো তাহলে হিরোগিরি দ্বিগুণ হয়ে যেত। তখন ক্যাপের আওয়াজ আর ফটাস-ফটাস থাকতো না। হয়ে যেত ফট-ফট-ফট। যেন সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে র্যাপিড ফায়ারিং চলছে।এই যে ক্যাপ ফোটানো মহালয়ার আগ দিয়ে শুরু হত চলতো নভেম্বর মাসে জগদ্ধাত্রী পুজো পর্যন্ত। ফটাস ফটাস ক্যাপের আওয়াজে বাড়িতে কান পাতা দায়। তখন ছিল আমাদের যৌথ পরিবার অতএব কারও না কারও আসকারা পেতামই। এখন যেমন বাচ্চারা পান থেকে চুন খসালে, ‘বাবোন, এটা তোমার কাছ থেকে আশা করা যায় না’ গোছের সতর্কতা বাচ্চাদের নিত্যপ্রাপ্তি তা আমাদের সময় ছিল না।
যাইহোক, পারলে আপনাদের বাড়ির কচি কাঁচাগুলোকে দু একটা ক্যাপ ফোটানোর বন্দুক কিনে দিন যাতে ওরাও শৈশবটাকে উপভোগ করতে পারে এবং আমাদের মত জীবন মাধ্যাহ্নের ব্যাক্তিদেরও একটু ক্যাপের আওয়াজে সেইসব ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ে।
–~০০০XX০০০~–