টেলিফোন
নিলয় বরণ সোম
“হ্যালো, দমদম হ্যালো ,
আমার হাতের মধ্যে টেলিফোন,
আমার পায়ের কাছে খেলা করছে সূর্যমনি মাছেরা ,
হ্যালো, দমদম হ্যালো “
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতাটিকে উদ্ধৃত করতে ভুল হতে পারে, স্মৃতি থেকে লেখা বলে I তবে কবিতাটা যখন পড়েছিলাম , তখন মর্মার্থ বুঝি নি – এখনও, না বোঝার চান্স- ই বেশী I তবে হাতের মধ্যে টেলিফোন বলতেই , কেন যেন , সেই কালো অবয়বের , আদ্যিকালের ঘোরালো ডায়ালের ফোনের কথাই মনে পড়ে I
আমার দেখা যে সময়টার কথা বলছি , ধরুন সাত থেকে আটের
দশক -তখন সেই টেলিফোনের একটা আভিজাত্য ছিল I অফিস গুলোতে সাহেবদের চেম্বারে একটি ফোন থাকতো , আর হল ঘরের মত সেকশনে কি কলেজ ইনভার্সিটির টিচার্স রুমের এক কোনে তোয়ালে ঢাকা অবস্থায় পরে থাকত I মধ্যবিত্ত পাড়াতে এক আধটি বাড়িতে টেলিফোন থাকত , সে বাড়িটি অবশ্যই দোতলা বা তিনতলা হত, ফ্ল্যাট তখনও এত সর্বগ্রাসী রূপ নেয় নি I প্রতিবেশীদের আপদে বিপদে মধুসূদন হত সে ফোন I
সে ফোনগুলোর সঙ্গে সে আমলের বাবাদের বেশ মিল ছিলI একটু ভারিক্কী, রাশভারী ধরণের , এলেবেলেরা কাছে ঘেঁষতে সাহস পেত না বড় I ফোনালাপ করতে হলে অপারেটরের মাধ্যমে করতে হত I দূরের আভাষ থাকলে , ট্রাঙ্ক কল বুক করে, বসে থাকতে হত I যে বাড়িতে একটু স্নেহপরায়ণ বৌদি বা কাকিমারা থাকতেন, পাড়ার ছেলেমেয়েদের গোপন প্রেমালাপের জন্য ফোনের প্রশয়টুকু দিতেন I আবার একটু চশমখোর নব্য বড়লোক কেউ কেউ, ফোনের উপর, প্রতি ফোন পঞ্চাশ পয়সা এরকম লিখে রাখতেন, শুনেছি I
যাদের আত্মসম্মান একটু বেশী ছিল ,তারা নেহাত রাত বেরাত না হলে , সটান চলে যেতেন ওষুধের দোকানে, নগদ মূল্যের বিনিময়ে ফোন করতেন, সে মেয়ের শ্বশুরবাড়িই হোক, বা আপিসের বড়বাবুকে হোক I ওষুধের দোকান থেকে ফোন করার ব্যাপারটা বাংলা সিনেমাতেও এসেছে I তখনকার দিনের এয়ারহোস্টেসদের মত উঁচু করে খোঁপা বাঁধা , স্লিভলেস শোভিতা নাগরিক নায়িকা ব্যস্ত-সমস্ত নায়কের সঙ্গে ‘ নিউ মার্কেট,বিকেল চারটা ‘ গোছের চিরকুটে আলাপ ওষুধের দোকান থেকেই করত , দোকানের মালিক কি কর্মচারী ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকলে বয়েই যেত তার !
ফোনাফুনির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ক্রস কানেকশন I ক্রস কানেশনকে নিয়ে ‘ঢাকার ভানুর কমিক, বাংলা কৌতুকশিল্পের একটি অ্যাসেট বিশেষ বিশেষ , ক্যাসেটবন্দী হয়ে অনেক দিন বাড়িতে বাড়িতে বেজেছে, বাজত পুজোর প্যান্ডেলেও I তবে ক্রস কানেকশনের দৌলতে এক আধটি মিষ্টি প্রেমের সূচনাও কি হয় নি?
কলেজে পড়ার সময় এক সহপাঠীর বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানে ওদের ভাইবোন কে বাড়ির মধ্যেই প্যারালাল লাইনে কথা বলতে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম I তবে ততদিনে একচেটিয়া রাশভারী বাবাদের জায়গায় , মার্কেটে কিছু কিছু ফিচেল বাবার দেখা মিলছিল I কালো, গম্ভীরমুখো ফোনের জায়গায়, কিছু কিছু রঙ্গীন টেলিফোন সেট, ঘোরানো ডায়ালের জায়গায় বোতাম ডায়ালও বোধহয় তখনই আমদানি হতে থাকে I
ইনভার্সিটি পড়ার সময় আরেকটি জিনিস আবিষ্কার করলাম, ফেল কড়ি ,কর ফোনের ব্যবস্থা I কলেজ স্ট্র্রিট ক্যাম্পাসে কিছুদূর অন্তর এই ফোনের ব্যবস্থা ইনভার্সিটির প্রেমময় পরিবেশকে অনেকটা সাহায্য করেছিল , বলাই যায় I তারপর এলো স্যাম পিত্রোদার টেলিকম বিপ্লব I ক’বছর বাদেই পাড়ায় পাড়ায় এস টি ডি , আই এস ডি বুথ বাড়তে লাগলো, ছেলেপুলেদের বিদেশ যাত্রাও কি সে সময়ই বেড়ে ছিল ?
ফেসবুকেই, ড: সিদ্ধার্থ মুখার্জী, বিদেশের কোনো ক্যাম্পাসে, এই কয়েনিয় ফোন ব্যবস্থাকে এক গোরা ছাত্র কিভাবে ফাঁকি দিত,তার বর্ণনা দিয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গীতে I ব্যাপারটা ছিল এইরকম – তার সম্বল ,একটি দুটি কয়েনের ঠিক মাঝখানটিতে ফুটো করে , কালো সিল্কের সুতোয় ঝুলিয়ে রাখত সেগুলো I কয়েন ঝুলিয়ে ফোন করা , আর ফোনান্তে কয়েন ফেরত নেয়া, সবটাই গ্র্যাভিটি এন্টি গ্র্যাভিটির ব্যাপার ! এই ঘটনাটি পড়ে, বাঙালীর বুদ্ধি সবথেকে বেশী, এই বড়াই আর করা যায় কি?
টেলিফোনের যেমন আভিজাত্য ছিল, টেলিফোনের কানেকশন পাওয়াও খুব সহজ ছিল না I নির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করে, ইন্সপেকশন টিনস্পেকশন সামলে, ট্রাঙ্কলের মত বসে থাকতে হত I নয়ের দশক থেকে ব্যাপারটা সহজ হয়ে আসে, পাকানো তারের মুঠি আলাদা হয়ে, কর্ডলেস ফোনেরও আবির্ভাব সে সময় I অলস শীতের দুপুরে , খোলা চুলে ছাদের উপর থেকে খুচরো প্রেম বা রেসিপি বিনিময়ের জন্য কর্ডলেস ফোন মহিলা মহলে খুব জনপ্রিয় হয় I
টেলিফোন থাকা ব্যাপারটা কতখানি একটা সিরিয়াস ইকোনমিক ইভেন্ট বলে গণ্য হত , আয়কর দপ্তরের মহাফেজখানা ঘাঁটলে , তার একটু আঁচ পাওয়া যায় I নব্বই দশকের শেষ দিকে ওয়ান বাই ফোর বলে একটি প্রকল্প চালু হয় I গাড়ি, বাড়ি, টেলিফোন এই তিনটির যে কোনোটির মালিক হলে অথবা বিদেশ ভ্রমণ করলে বলে একটি ফর্মে রিটার্ন দেয়ার কথা ছিল এই প্রকল্পেI
এস টি ডি জিনিসটি বেশ মহার্ঘ্য ছিল একসময় – দিনের বেলায় এক রেট, রাত্রি আটটার পর হাফ, রাত্রি বারোটার পর আরো কম এরকম সব স্ল্যাব ছিল I সরাসরি এস টি ডি করার জায়গায় ভার্চুয়াল কলিং কার্ড কিছুদিন চালু হয়ে ছিল I যায় হোক , আমাদের দপ্তরের এক এক অতি সৎ এবং দাপুটে বলে খ্যাত এক সিনিয়র অফিসারের এক বার পোস্টিং হয়েছিল বাইরে -সেখানে তিনি একাই থাকতেন I একটি সরকরি ফোন ওনার প্রাপ্য ছিল – খরচ কোম্পানিরI কথাচ্ছলে আমাদের তিনি বলেছিলেন, আই প্র্যাক্টিস হোয়াট আই প্রীচ ! আমি রোজ বাড়িতে ফোন করি, ঠিক রাত্রি বারোটার পর ! সরকারি খরচ কতটা বাঁচে বলুন তো !ওনার ব্যয় সঙ্কোচের তাড়নায় বাড়ির লোকের ঘুমের বারোটা বাজত, সে কথা ওনাকে বোঝায় কে !
টেলিফোনের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্পর্ক বেশ চালু ছিল ইয়েলো পেজের কল্যানে I এমনিতে সাদা পাতাগুলোতে লোকেদের নাম ফোন নাম্বার থাকত , আর ব্যবসা বাণিজ্যের বিভাগ ভিত্তিক তত্ব তালাশ থাকত হলুদ পাতায় I জাস্ট ডায়াল বা সুলেখা ডট কমের বহু আগে এই ছিল বাণিজ্যিক তথ্যের ভান্ডার I
আমার এক বন্ধু একটি চাকরি পেয়েছিলো, তার কাজ ছিল বিভিন্ন ব্যবসার বিজ্ঞাপন এই মডেলের কোনো বিজনেস ডিরেক্টরির জন্য জোগাড় করা I ‘আমি তোমার বিজ্ঞাপন ছাপাবো, তুমি আমায় চেক দেবে’ – এই ব্যবস্থা I একবার এক ভি আই পি সুটকেসের ডিলার এক অভিনব প্রস্তাব নিয়ে আসেন – চেক উনি দেবেন না- সমমূল্যের সুটকেস দেবেন I বসের সঙ্গে কথা বলে সেই প্রস্তাব গ্রহণ হলো I গোল বাধ্য অন্য জায়গায় I সুটকেস গুলো নিয়ে তিন বেচুবাবু যখন এস্প্লানেডে অফিসের দিকে ঢুকছে, তাদের আটকালো এক কনস্টেবল I কাগজ পত্র দেখিয়েও নিস্তার নেই – না এগুলো তোমরা কথা থেকে নিয়ে আসছো, আসলে বিক্রি করবে, লাইসেন্স কই , এইসব আগড়ম বাগড়ম I শেষে কিছু মূল্য ধরে ফয়সালা করতে হয়েছিল তাদের I কাহিনীর পরের অংশটি আরো চমৎকার – ওদের কোম্পানির পাঞ্জাবি মালিক সুটকেসগুলো নিজের জিম্মায় রেখে দিলেন I কর্মচারিদের বিয়ে, বৌভাত এমনকি অন্নপ্রাশনেও নাকি উনি ওই সুটকেসগুলি উপহার দিতেন I
লোকের বাড়িতে টেলিফোন ডিরেক্টরির আরো নানাবিধ ব্যবহার ছিল – যেমন নড়বড়ে চেয়ার বা খাটের নিচে ঠেকনা দেয়া , ধোয়া রুমাল টান করে রাখা , প্রেমপত্র লুকিয়ে রাখা I ল্যাপটপের প্রথম যুগে , কেউ কেউ ডিরেক্টরিকে ল্যাপটপের ‘কুলিং প্যাড ‘ হিসেবে ব্যবহার করতেন I
ভি আই পি দের ফোন নম্বর গুলো বিশেষ ভাবে দেয়া হত , শুনেছি, আর সেই আদ্যি কাল থেকে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড ইত্যাদির বিশেষ বিশেষ নম্বর তো খবরের কাগজের পাতাতেই থাকতI টোল ফ্রি নাম্বার এসেছে অনেক পরে – এমনকি বুলাদিরও ওরকম একটা নাম্বার ছিল I
তবে অঞ্জন দত্ত ২৪৪১১৩৯ নাম্বার টিকে অমর করে রেখেছেন , বেলা বোস গানটিকে কেন্দ্র করে I শোনা কথা, ওই নাম্বারটি আদতে বিশ্বামিত্র নাম কোনো হিন্দি দৈনিকের ছিল I গানটি রিলিজ হবার পরে বেশ কিছুদিন সেই দপ্তরের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা – ফোনের জ্বালায় I তবে আমার কাছে বেলা বোস নামটি বেশ আনরোমান্টিক লাগে – কেমন একটা খিটখিটে দিদিমনি ভাব -এর থেকে রুবি রায় অনেক ভাল I
ক্রমে ক্রমে, ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের অস্তিত্বই বিপন্ন হল, মোবাইলের যুগে I কমলাকান্ত আজ থাকলে নিশ্চয়ই বলত, ‘হায় ল্যান্ডফোন,তোমার দিন গিয়াছে!’কালের নিয়মে একসময় রম রম করে চলা, এস টি ডি ,আই এস ডি , পি সি ও বুথ গুলোও হারিয়ে গেল – এই নিয়ে হা হুতাশ করার মানে হয় না অবশ্য!
তবে বটমলাইন এই, মানুষের বহু প্রেম -বিরহ, সুখ -অসুখ, প্রশাসন-বাণিজ্য, ঝঞ্ঝা – মহামারীর বিশ্বস্ত সঙ্গী ও সখ্যে হিসেবে অনেক বছর কাটিয়ে গেছে ল্যান্ডফোনIএই এমন একটি জলজ্যান্ত জিনিস নিয়ে শিব্রামের গল্প থাকবে না, হয় ? এই মুহূর্তে দুটি গল্পের কথা মনে পড়ছে – একটির নাম ‘ফ্ল্যাটে থাকাই মানে’ , আরেকটির নাম ‘কলকারখানার গল্প’I সেগুলোর রসাস্বাদন করতে হলে , ফেসবুক ছেড়ে, শিবরাম রচনাবলী নিয়ে বসে পড়ুন I তবে প্রথম গল্পটিতে শিব্রাম, মেয়েদের টেলিফোনে বিদায় নেয়া নিয়ে একটা মজার কথা বলেছেন , সেটা বলেই ফেলি I গল্পের চরিত্রের মতে , পুরুষেরা , ‘এবার আসি ‘ কথাটি একবার বলেই ফোনপর্ব শেষে করে, কিন্তু মেয়েরা নাকি অন্তত আশি বার কথাটি বলে তবে বিদায় নেয় !
টেলিফোন নিয়ে ফেসবুকেও একটা খবর ঘুরে ফিরে আসে – আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের প্রথম ফোন করার গল্প, তার মার্গারেট হ্যালো নামের বান্ধবীকেI কেউ কেউ বলেন, আরো অনেক ক’টি গল্পের মত – এটিও সত্য নয় -ফোনি (phoney) বা ট্র্যাশ !
হবেও হয়ত বা, আমার এই লেখাটির মত !
–~০০০XX০০০~–
ভীষণ ভীষণ ভালো লেখা।
ধন্যবাদ 💐💐