— কাশতে কাশতে সত্তরউর্দ্ধ বৃদ্ধ পরেশ পাল ফটিককে ঠাকুর গড়ার কাজ করতে করতে ছোট ছোট হুকুম করে। ফটিকও খুশি মনে সেই হুকুম তামিল করে।
রথের দিন থেকে মা দুর্গার মূর্তি তৈরির কাঠামো বাঁধার কাজ শুরু হয়। অগাস্ট মাস থেকে ফটিককে আর এলাকায় দেখা যায় না। খেলার সময় ফটিককে পেতে হলে যেতে হবে বদরতলা হসপিটালের উল্টো দিকে পোটো পাড়ায়, পরেশ পালের স্টুডিওতে। স্টুডিওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা উদাস হয়ে মূর্তি তৈরি দেখে। বাঁশের বাখারী বাঁধা থেকে মূর্তিতে রংয়ের প্রলেপ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ ফটিকের মুখস্ত। ফটিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মূর্তি গুলোর দিকে। চার ফুট হাইটের ফটিক,আর পাঁচ ফুট হাইটের পরেশ কাকা যেন গালিভারের দেশে লিলিপুট। পরেশ পালের স্টুডিওতে বসিরহাটের বড়ো বড়ো পুজো কমিটির মূর্তি তৈরি হয়। কার্তিক,গণেশ,লক্ষ্মী,সরস্বতী,এবং সিংহের পিঠে মা দুর্গার মুখ কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে গেলে ফটিকের ঘাড় ব্যাথা হয়, তবুও পূর্ণ অবয়ব মনুষ্যরূপী ঈশ্বর সৃষ্টি, ফটিক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। পরেশ কাকা ছয় সাত ফুটের এক একটা মূর্তি তৈরি করছে, যেন তিঁনি ঈশ্বরের ঈশ্বর।
নদীতে লোক পারাপার করে মহম্মদ আর তার ছেলে আনসার। সেই কাজের ফাঁকে বাপ বেটাতে ইছামতী নদীর পলি মাটি তুলে যোগান দেয় পরেশ পালের স্টুডিওতে। আনসার ফটিকদের গ্রামের ছেলে, ওরই হাত ধরে ফটিকের এই মূর্তি তৈরি দেখতে আসা। আনসার প্রতিদিনই খানিকটা করে মাটি আনে। আনসারের সাথে পরেশ পালের খুব দোস্তি। আনসারও পরেশ পালের অনেক ফাই ফরমাস বিনি পয়সায় খেটে দেয়। এই ফাই ফরমাস খাটতে গিয়ে একদিন হলো এক বিপত্তি— পরেশ পালের ছেলের ধুম জ্বর, এদিকে বাঁশের কাঠামোয় বিচুলির বাঁধন প্রস্তুত। আজ বিচুলির উপর তুষের মিশ্রনে মাটির প্রলেপ দেয়ার কথা। কিন্তু তুষ মাটির মণ্ড তৈরি হয়নি, এখন উপায়? আনসার বললো-” কাকা, আব্বা আজ নৌকো বের করবে না, আমারও কাজ নেই, আমি মাটি চটকে দেব?” পরেশ পালেরও অসহায় অবস্তা, একটু ইতস্তত করে বললো-” তাই দে”। বছর কুড়ির আনসারের গায়েও অসুরের মতো শক্তি। খানিকটা করে তুষ আর মাটি রাস্তার উপর ফেলে , খড়ের তৈরি ভোতা অসুরের দিকে তাকিয়ে বলল-” দেখি বাপ অসুর কার গায়ে জোর বেশি”। মাংসসল কালো দুটো পা দিয়ে মাটি চটকাতে চটকাতে ছড়া কাটতে থাকলো– আয় রে অসুর দেখে যা- কার বেশি জোর মেপে যা, লোড়বি যখন দুগ্গা মায়ের সঙ্গে- বুঝবি তখন কত শক্তি অঙ্গে। পোটো পাড়ায় থাকে খগেন ঘোষ, তার নজরে পড়ে গেলো ব্যাপারটা, মুসলমানের ছেলে আনসার দুর্গা প্রতিমা তৈরির মাটি পা দিয়ে চটকাচ্ছে। ছিদ্রানেসি মনোভাবাপন্ন খগেন ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে এলাকার কয়কে জন মাতব্বরকে নিয়ে পরেশ পালের স্টুডিওতে হাজির হলো। আনসার কিছু বোঝার আগেই খগেন ওর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে চটকানো মাটির তাল থেকে সরিয়ে দিল। তার পর চিৎকার চেঁচামেচি করে আরো লোক জড়ো করতে লাগলো। বৃদ্ধ পরেশ পাল কোলাহল শুনে স্টুডিওর বাইরে বেরিয়ে এসে সব কিছু দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না, মুরুব্বিদের আসার হেতু কি। তিঁনি মাথা নিচু করে,হাত জোড় করে ছেলের অসুখের কথা বলে ক্ষমা চাইলেন। খগেন তো মানতেই চায় না, যেন ধর্মীয় বিধি নিষেধের অগ্রদূত সে নিজেই। বৃদ্ধ পরেশ পাল মুরুব্বিদের বললেন “আমি বুড়ো মানুষ বুঝতে পারিনি, ও তো মাটি এনে দেয় তাই– ঠিক আছে আপনারা বলুন এখন কি করণীয়। যা বলবেন আমি মাথা পেতে মেনে নেব”। এলাকাতে পরেশ পালের নির্লোভ, নিরীহ, গোবেচারা বলে একটা সুনাম আছে। সেই সুনামের উপর নির্ভর করে মাতব্বররা আলোচনা পূর্বক সিদ্ধান্ত নিলো- ওই মাটি প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে না। এবং আর কখনো তিনি যেন এমন কাজ না করেন। কারণ মাটি আনা আর পা দিয়ে মাটি চটকানো এক কাজ নয়। ছোট্ট ফটিক হা করে সব কিছু দেখছিল, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি ব্যাপারটা কি ঘটলো। লোকজন ফাঁকা হলে পরেশ কাকা বললো-“আনসার মাটিটা ফেলে দিয়ে হাত পা ধুয়ে নে”। ফটিক গুটি গুটি পায়ে আনসারের পাশে এসে দাড়ালো। আনসারের চোখের কোনায় চিক চিক করছে জলকনা। হটাৎ বৃষ্টি নামলো, ঝমঝমিয়ে মুসল ধারে।আনসার একটা খুঁটি ধরে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকলো বৃষ্টির মধ্যে। ফটিক এক ছুটে স্টুডিওর ভিতরে ঢুকে অনসারকে ডাকলো, আনসার কোনো উত্তর দিলো না নড়লোও না। পরেশ কাকা বললো-” ওরে ডাকিস নে, মা দুগ্গার চোখের জলে ওর মুসলমান কালিমাটা ধুয়ে যাক”।
আজ বেশ রৌদ্র করোজ্জ্বল দিন। আনসারের মনের মেঘ কেটে নতুন ভাবে সূর্য উঠেছে। ফটিককে ডেকে আনসার বললো,আজ যেন সে মসজিদে আসে, রহমত চাচা নামাজের পর সবাইকে জিলাপি দেবে। ফটিক আনন্দের সাথে যাওয়ার সম্মতি জানালো, কারণ রহমত চাচা গ্রামের উচ্চবিত্ত গণ্যমান্য ধার্মিক মানুষ। প্রতি শুক্রবার নামাজের পর মসজিদের সকলকে একটা করে বড় বড় খাস্তা গরম বাতাস নিজে হাতে দেন। উনি একটু মুচকি হেসে ফটিককে দুটি করে বাতাসা দেন। সবাইকে একটা করে,ফটিকের বেলাতে কেন দুটো, ফটিক তার রহস্য সমাধান করেনি, সে দুটি পায় তাতেই খুব খুশি। মাসে একদিন জিলাপি দেন তাও আবার দুটো , যাবে তো বটেই। পাড়ার কেষ্ট অধিকারী ফটিকের মসজিদে গিয়ে বাতাসা খাওয়ার ঘটনাটা ফটিকের বাবার কাছে নালিশ করে। কিন্তু ফটিকের বাবা এই ব্যাপারে ফটিককে কখনো কিছু বলেননি। কেষ্ট অধিকারী ফটিককে একদিন রাস্তায় ধরলো। ফটিক তখন বড় বড় গরম বাতাস খেতে খেতে মসজিদ থেকে বাড়ির দিকে আসছে। ফটিককে মৃদু ভৎসনা করে বলে-” তুই যে বাতাসা খাচ্ছিস, জানিস ওটা মুসলমানের দেওয়া!” ফটিক একটু অবাক হয়ে বলল-“কেন রহমত চাচা যে হারু ময়রার দোকান থেকে জিলিপি বাতাস কেন, আমি নিজে দেকিচি”। এই বলে ফটিক দে ছুট।
পরেশ পালের স্টুডিওতে চার সন্তান নিয়ে মা দুর্গা অর্ধ প্রস্তুত। পরেশ কাকা মালসাতে মাটি গুলে ব্রাশ দিয়ে গোলা মাটি নাদুস নুদুস সাত ফুটি গণেশের গায়ে বুলাচ্ছে, যাতে মূর্তির গায়ে চিড় খাওয়া দাগ গুলো মিলিয়ে যায়। ফটিক স্টুডিওর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পরেশ কাকার হাতের নিপুণ শিল্প কর্ম দেখছে। ঠিক সেই সময় পরেশ কাকার ছেলে একটা ডাব এনে বাবাকে খেতে দিলো। পরেশ কাকা গণেশের পায়ের কাছে বসে ডাব খাচ্ছিল। কিছুটা খেয়েই মুখ থেকে ডাব সরিয়ে নিয়ে গণেশের দিকে তাকিয়ে বলল-” আমি কিছু খেলেই তোর খেতে ইচ্ছে করে? নে খা তবে”। এই বলে আধ খাওয়া ডাবটা গণেশের পায়ের কাছে রাখলো। ফটিক তো অবাক, পাগল নাকি মাটির গণেশ ডাব খাবে, তাও আবার চেয়ে! ফটিক ওখানে আর দাঁড়ালো না ,বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। বন্ধু বান্ধবদের ঘটনাটা বলতে তারা তো বিশ্বাস করলোই না উল্টে ফটিককে পাগল বললো। শুধু আনসার ভাই শুনে চুপ করে ছিলো। ফটিকের নিজে চোখে দেখা অথচ কেউ বিশ্বাস করলো না। ও একটু মন মরা হয়েই বাড়ি চলে এলো।
ফটিকের বাবা পেপার পড়ছেন, আর মা পাশে বসে সবজি কাটছেন। ফটিক মায়ের পাশে এসে চুপ করে বসে থাকলো। কিছু একটা ঘটেছে বুঝে মা বললো-” কি রে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলি যে বড়!” ফটিক মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে-” মা ,তুমি যে ঠাকুরকে জল মিষ্টি দাও , সেটা তো কিছুক্ষন পর আমরা খেয়ে নেই। কই ঠাকুর তো খায় না!” মা হঠাৎ ফটিকের মুখে এমন একটা প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে বলল-” ঠাকুর খাননা ঠিকই, তবে ঠাকুর ওই খাবারে দৃষ্টি দেন,তখন সেটা প্রসাদ হয়ে যায়। কিন্তু–” ফটিক মাকে কথা বলতে না দিয়ে আবার প্রশ্ন করে-” মা ঠাকুর তোমার কাছে কখনো খেতে চেয়েছে?” মা আরো অবাক হয়ে বললেন-” তা হলে তো আমার জীবন ধন্য হয়ে যেত, কিন্তু তোর কি হলো বলতো? ফটিকেট বাবা ফটিকের বয়স ছাড়া প্রশ্ন গুলো খেয়াল করছিলেন। এবার পরেশ কাকার স্টুডিওতে দেখা ঘটনাটা ফটিক সব বললো। ফটিকের বাবা পেপার থেকে মাথা তুলে বললেন– “ব্রম্মের সহিত ব্রহ্মঞ্জানীর তাদাত্ম্য সন্বন্ধ”। ফটিক বোকার মতো একবার বাবার, একবার মায়ের মুখের দিকে চায়। মা ফটিকের বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন-” আমিই কিছু বুঝলাম না, তো ফটিক”! একটু হেসে ফটিকের বাবা ঘটনাটার ব্যাখ্যা করলেন– “পরেশ পালের কাজ বলতে ওই মূর্তি তৈরি। খাওয়া ঘুম বাদে বাকি সময়টা প্রাণহীন ওই মূর্তি গুলোর সাথে থাকতে থাকতে, তার আর মূর্তি গুলোকে প্রাণহীন মনে হয়না। যেন একটা নিবিড় অবিচ্ছেদ্য আত্মিক সম্পর্কের বন্ধনে একাত্ম হয়ে গেছে। যে শক্তি গুনে ঠাকুর শ্ৰী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব পাথরের বিগ্রহের সাথে আপন মনে কথা বলতেন। বিজ্ঞান কিন্তু এটাকে নস্যাৎ না করে, তাদের ভাষায় এটা কে বলছে টেলিপ্যাথি। হিন্দু শাস্ত্র বলছে ব্রহ্মাণ্ডে যিনি এই ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন, তিনি তো ব্রহ্মার সাথে বাক্যালাপ করতেই পারেন। যেটা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে উন্মাদের সমতুল্য। আরো সহজ করে ভাবা যায়- সদ্যজাত শিশু তো শুধুই ঘুমায় আর ঘুম ভাঙলে কাঁদে , কিছু বলতেও পারেনা, বোঝাতেও পারেনা। প্রায় জড় বস্তুর ন্যায়। মা কিন্তু বোঝে সে কি বলতে চাইছে। এটা আত্মিক সম্পর্ক ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এখানে মূর্তি গুলোর মধ্যে আত্মা নেই ঠিকই, তবে পরেশ পালের সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। সে যখন গণেশের সামনে বসে ডাব খাচ্ছিল, তখন তার কর্তব্য, বিবেক একই সাথে জাগ্রত হয়ে উঠলো। এবং গানেশকে ডাবের ভাগ দিলো। যেটা সাধারণ দৃষ্টিতে হাস্যকর হয়ে উঠলো”।
পুজোর আর মাস দেড়েক বাকি। বসিরহাট গোয়াল পোতার লাহা বাড়ি থেকে একচালার ঠাকুরের অর্ডার এলো। এতো অল্প সময়ে পরেশ পাল তো অর্ডার নিতে রাজি হয়না। তারাও অনেক অনুনয় বিনয় করে বললো, যিনি ঠাকুর দালানে রেখে ঠাকুর তৈরি করেন, তিনি হঠাৎ সন্ন্যাস রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। এখন পরেশ পাল অর্ডার না নিলে পুজোটাই বন্ধ হয়ে যাবে। পরেশ পালও ভেবে দেখলো,একশো বছরের বনেদি পুজোটা ঠাকুরের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। অসুবিধা হবে জেনে বুঝেও রাজি হয়ে গেল।
ফটিক আর আনসার অসম বয়সী হলেও বন্ধুত্ব অটুট। দুজনে গল্প করতে করতে পরেশ পালের স্টুডিওর দিকে আসছে- আনসার-“তোদের উৎসব গুলোতে বেশ আনন্দ হয়,নতুন জামাকাপড় পরে মণ্ডপে মণ্ডপে গিয়ে ঠাকুর দেখা, খাওয়া দাওয়া। আমাদের শুধু এর বাড়ি যাও ওর বাড়ি যাও, তোদের মতো আনন্দ নেই”। ফটিক-” কিন্তু বাবা বলে হিন্দুরা মূর্তি নিয়ে আরাধনা করে, আর মুসলিমরা শূন্যে তাকিয়ে আরাধনা করে, ভক্তি দুটোতেই এক”। আনসার-” ঠিকই , তবে সব মিলিয়ে তোদের উৎসবে আনন্দ বেশি”। ফটিক আনসারের কথার উত্তর না দিয়ে বললো-” ওই দেখো আনসার ভাই , পরেশ কাকা ঠাকুর গড়ছে না, দরজার পাশে বসে আছে!” আনসার-” তাইতো, চলতো দেখি কি ব্যাপার!”
সকাল থেকে মেঘলা আকাশ, সূর্যের তো দেখা নেই-ই বরং মাঝে মাঝে এমন কালো হয়ে আসছে যে, মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা। পরেশ পালের স্টুডিওতে আলোর ব্যাবস্থা না থাকায়,কাজের খুব অসুবিধা হতে থাকলো। ফলে পরেশ পাল দোরগোড়ায় বসে মায়ের উদ্দেশে গুন গুন করে গান ধরলো– মর্তে আসিস তুই মা যখন কত আনন্দ করে, এখানে তখন তোর সন্তানেরা যুদ্ধ করেই মরে। ভিন্ন জনে ভিন্ন রূপে বিরাজিত মা তুই, বোঝে না এরা এটাই সত্য প্রভেদ নেই কিছুই।
আনসার,ফটিককে দেখে পরেশ পাল গান থামায়। কাজ না করে বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে, পরেশ পাল কারণটা বলে। আরো বলে লাহা বাড়ির দুর্গা প্রতিমা অর্ডারের কথাটা। চিন্তিত মুখে বলে এত অল্প সময়ে কাজ তুলব কি করে ভাবছি। মনের অনাবিল উৎচ্ছাসে আনসার বললো -” জানো কাকা তোমার ওই এক চলার ঠাকুর আমিই তৈরি করে দিতে পারি। চক্ষু দান, শাড়ি পড়ানো এগুলো মনে হয় ঠিকঠাক পারবো না। কিন্তু উপায় নেই , খগেন ঘোষেদের আবার সহ্য হবেনা”। পরেশ পাল কি যেন একটা ভাবলো , তারপর লড়াকু সুরে আনসারকে বলল-” পারবি, তুই পারবি”? পরেশ পালের চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। আনসার যুদ্ধের সেনাপতির মতো বললো-” পারবো, কিন্তু—” ফটিকের দিকে আনসার করুন ভাবে তাকালো। ফটিক ভাব বুঝে দুম করে বলে ফেললো-” মা কালীর দিব্যি আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না”। পরেশ পাল আনসারের কাঁধে দুবার বাহবার চাপর মেরে বলে-” তুই পারবি, আমি জানি, তুই যে আমার একালব্য। ওই কোনের ঘরে বসে তুই মূর্তি গড়া শুরু কর। ওদিকটায় কেউ যায় না”।
আজ পঞ্চমী, মা দুর্গা সেজেগুজে চার সন্তানকে নিয়ে মণ্ডপে গিয়ে উঠছেন। পোটো পাড়া যেন কৈলাস পর্বত হয়ে উঠেছে। মা হাতিতে আসবেন না ঘোড়া,দোলায়, নৌকায় আসবেন,সেটা না হয় পাঁজিতে থাক। পরেশ পালের স্টুডিও থেকে সাত আটটি দুর্গা পরিবার ভ্যান ও ডালাখোলা লরিকে বাহন করে মণ্ডপে মণ্ডপে পৌঁছাতে থাকলো। ফটিক এক কোনে দাঁড়িয়ে চুপ করে ভাবছে, লাহা বাড়ির লোকজন কখন আসবে! কাকা আবার আনসার ভাইকে স্টুডিওতে আসতে বারণ করেছে। ফটিককে দেখেও না দেখার ভান করছে। মনে হয় ভয় পাচ্ছে। লাহা বাড়ির প্রতিমা আনসার তৈরী করেছে, এটা যদি কোনো ভাবে পাঁচ কান হয়ে যায়। এর মধ্যে হৈ হৈ করতে করতে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে লাহা বাড়ির লোকজন চলে এলো। লাহা বাড়ির ঠাকুর যখন ঘোড়ার গাড়িতে তোলা হচ্ছে তখন ফটিক দেখতে পেল, আনসার বাস রাস্তার উল্টো দিকে একটা বন্ধ দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আনসার কে দেখতে পেয়েই ফটিক ছুটে চলে যায় তার কাছে। আনসার ভাবতেই পারছে না যে প্রতিমাটির সিংহ ভাগই ওর তৈরি। মা দুর্গা ওর হাতে ভর না করলে, এমন প্রতিমা তৈরি সম্ভব হতো না। আনন্দে উৎচ্ছাসে আনসারের মনটা টগবগ করে উঠলো। আবার সঙ্গে সঙ্গে মনের হালটাকে শক্ত করে ধরে নিজেকে সংযত করে নিলো।
সপ্তমীর দিন দুপুরের মধ্যে সেরার সন্মান ঘোষণা হয়ে গেল। সেরা প্যান্ডেল, সেরা পরিবেশ, সেরা আলোক সজ্জা,এবং সেরা প্রতিমা। বিশেষ পুরস্কার সেরার সেরা প্রতিমা। এখানে প্রতিমা তৈরির নিপুণ শিল্প কর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এবার লাহা বাড়ীর এক চলার দুর্গা প্রতিমা সেরার সেরা সন্মান পেলো। লাহা বাড়ী উৎসবের উপর উৎসব লেগে গেলো। বাজি কম্পিটিশন, নরনারায়ণ সেবা, বিশেষ অতিথি আপ্যায়ন, বস্ত্র দান আরো কত কি।
খবরটা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত বসিরহাট অঞ্চলে। ফটিক বাবার কাছে খবরটা শুনেই ছুটলো আনসারদের বাড়িতে। আনসার খবরটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। আবার নিজেকে সংযত করে, ফটিককে সাবধান করলো যেন প্রকৃত শিল্পীর নাম পাঁচকান না হয়। ফটিক যে খুব সাবধানী তা বোঝাতে আস্তে আস্তে আনসারকে বলল-” মা কালীর দিব্যি, আমি মাকেও বলিনি”। ” ঠিক আছে চল, পরেশ কাকার ওখানে যাই”। এই বলে ফটিককে নিয়ে আনসার পরেশ পালের স্টুডিওর দিকে পা বাড়ালো।
প্রতি বছর পরেশ পালের ঠাকুর প্রথম পুরস্কার পায়, এটা তার মন সওয়া হয়ে গেছে। নুতন করে কিছু মনে হয় না। কিন্তু এবারের সেরার সেরা সম্মানটা তার কাছে বড় বেদনা দায়ক হয়ে উঠলো। কারণ প্রকৃত প্রাপক থাকবে জন চক্ষুর অন্তরালে। প্রকৃত ঘটনাটা সে না পারছে হজম করতে, না পারছে উগরে দিতে। আনসার ও ফটিক স্টুডিওতে ঢুকতেই পরেশ পাল আনসার কে জড়িয়ে ধরলো। আনসার আনন্দে কেঁদে ফেললো। আবেগঘন কণ্ঠে বললো-” কাকা, আমার তৈরি ঠাকুর পুরস্কার পাবে এ আমি কল্পনাও করতে পারিনি”। আবেগে পরেশ পালেরও গলা ভারী হয়ে গেল, বললেন-” আনসার তোর উপরে মা ভর করেছেন। না হলে কাঁচা হাতে এমন সৃষ্টি হলো কিভাবে! মা তোর সৃষ্টি দিয়ে মর্ত বাসীকে বুঝিয়ে দিলেন–“মা সবার, যে মাকে মন দিয়ে ডাকে মা তার। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবেতেই তিনি অধিষ্ঠান করেন।” ফটিক হঠাৎ ছুটে গেটের দিকে চলে গেল। একটু এদিক ওদিক চেয়ে ফিরে এসে বললো তার মনে হলো, কে যেন একটা উঁকি মারছিল। পরেশ পাল, আনসারও সতর্ক হয়ে গেল। এরই মধ্যে স্টুডিওর সামনে একটা রিক্সা এসে দাড়ালো। রিক্সা থেকে একটা ফুলের স্তবক হাতে নেমে স্টুডিওর দিকে আসছেন স্বয়ং বিজয় লাহা। উনি যখন স্টুডিওর ভিতরে আসছিলেন তখন কয়কেজন কৌতহলী মানুষও তার সাথে ঢুকলো, যার মধ্যে গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল খগেন ঘোষও আছে। লাহা বাবু ফুলের স্তবকটি পরেশ পালের হাতে দিয়ে বললেন-” আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লাহা বাড়ীর তরফ থেকে। নবমীর দিন সন্ধ্যায় আপনি আমাদের মণ্ডপে আসবেন। স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে উত্তরীয়, শাল, এবং কিছু অর্থ দিয়ে সম্বর্ধনা দেবেন”।
নবমীর সন্ধি পূজা চলছে। জন সমাগমে গমগম করছে লাহা বাড়ির ঠাকুর দালান। পাশে মঞ্চ তৈরি, সেখানে এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা বসে আছেন। মঞ্চের এক দিকে গরীব বৃদ্ধ বৃদ্ধারা ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে বস্ত্র পাবার আশায়। গোটা দশেক ঢাকের আওয়াজে মুখরিত চারদিক।পরেশ পাল হাটু বার করে ধুতি আর একটা ফতুয়া পরে, পান চিবুতে চিবুতে গুটি গুটি পায়ে ঠাকুর দালানে গিয়ে উঠলেন। মাকে একটা প্রণাম করে মনে মনে বললেন-” আমাকে ক্ষমা কর মা, আনসারের যোগ্য সম্মান থেকে আমি ওকে বঞ্চিত করলাম”। এর পর এদিক ওদিক তাকিয়ে বিজয় লাহাকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগলেন। ভিড়ের ভিতর থেকে এক ভদ্র লোক এগিয়ে এসে পরেশ পালকে ডেকে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন। পরেশ পাল বসেই আছেন। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন কিন্তু লাহা বাবুকে দেখতে পাচ্ছেন না। এক সময় উনি লাহা বাবুকে দেখতে পেলেন, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লাহা বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। লাহা বাবু না দেখতে পাওয়ার ভান করে সরে গেলেন। পরেশ পাল ঘটনাটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলেন না। যে মানুষটা একদিন আগে তার স্টুডিওতে গিয়ে ফুলের স্তবক দিয়ে নিমন্ত্রণ করে এলেন, একদিন পরে তিনি তাকে চিনতেই পারছেন না! বৃদ্ধ মনে মনে অশনিসংকেতের আভাস পেলেন। মনের অস্বস্তিটা যেন শরীর ধরে নিলো। তাঁর ওখানে একদম বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আবার ভদ্রতা বলে একটা ব্যাপার আছে। ভিড়ের ভিতর থেকে সেই ভদ্রলোক আবার এগিয়ে এলেন। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট। পরেশ পাল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোককে বললেন-” আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, আমি বাড়ী চলে যাই”। পরেশ পালের মুখে সেচ্ছায় বাড়ী ফিরে যাওয়ার কথা শুনে, মেঘ না চাইতে জল পাওয়ার মতো খুশি হয়ে তিনি বললেন-” ঠিক আছে, সাবধানে যাবেন”। মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে দিয়ে বললেন-” একটা ভ্যান ডেকে দেব”? লজ্জায় অপমানে পরেশ পালের শরীরটা তখন থর থর করে কাঁপছে। মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন-” তার আর দরকার হবে না, আমি ঠিক চলে যাবো”।
পরেশ পাল প্রথমে খেয়া ঘাটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর পার্শবর্তী উদ্যানে ঢুকে একটা বেঞ্চে চোখ বন্ধ করে মিনিট পনেরো বসে থাকলেন। ইছামতী নদীর ফুরফুরে বাতাসে শরীরটা একটু হালকা হলো। মনটা হলো না। পরেশ পাল বেঞ্চ থেকে উঠে নদীর কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। জলের দিকে তাকিয়ে বললেন-” মা, কাল এখানে তোর বিসর্জন হবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সন্তানকে ক্ষমা করিস মা। আজ তোর মণ্ডপ থেকে পাওয়া প্রসাদ আমি বিসর্জন দিলাম”। হাতের বড়ো মিষ্টির প্যাকেটটা জলে ভাসিয়ে দিয়ে পরেশ পাল উপরে উঠে এলেন।
আজ শুক্র বার, দশমী, বাঙালির মনে বিষাদের রেশ। মা কৈলাসে ফিরে যাবে। তার মধ্যে প্রতিটা হিন্দুদের ঘরে ঘরে আজ নারকেল নাড়ু,নিমকি,গজা তৈরির ধুম পরে যায়। ফটিকদের বাড়ীতে যেন ভিয়েন বসে যায়। এই দিন পেটুক ফটিক সারাদিন বাড়িতেই থাকে। সন্ধ্যার পর বড়দের সাথে বসিরহাট উদ্যানে যায়। ওখান থেকে ইছামতী নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেখে।
সেরার সেরা প্রতিমা যে একজন মুসলিম তৈরি করেছে, এই খবরটা সংক্রামক রোগের মত ছাড়িয়ে পড়লো। কিছু মানুষ মৃদু সমালোচনা করা শুরু করলেন। কেউ বলছে পরেশ পালকে সাবধান করা সত্ত্বেও তার এই কাজ করা উচিত হয়নি। ফটিকের বাবার বক্তব্য, ছেলেটির নিপুণ শিল্পকর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে জাতিভেদকে গুরুত্ব দেওয়া চরম নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। খবরটা বাপ বেটা মহম্মদ ও আনসারের কানেও পৌঁছলো। দিনটা শুক্র বার হওয়ায় মসজিদে ইমাম ছিলেন। মহম্মদ অনসারকে নিয়ে ছুটল তার কাছে। ইমাম প্রথমে ধমক দিলেন কারণ ইসলাম ধর্ম এমন কাজকে মন্যতা দেয় না। অনেক বিবেচনা করে পরামর্শ দিলেন কয়েক দিন অন্যত্র ঘুরে আসতে।
একাদশীর ভোর, একটা কুস্বপ্নে পরেশ পালের ঘুম ভেঙে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিছানাতেই শুয়ে থাকলেন। এরই মধ্যে স্টুডিওর পার্শবর্তী কয়কে জন হন্তদন্ত হয়ে এসে জানালো, গতকাল রাতের অন্ধকারে করা যেন এসে পরেশ পালের স্টুডিও ভেঙেচুরে লন্ড ভন্ড করে দিয়েছে। বাড়ীর অন্য সকলে রুদ্ধশ্বাসে স্টুডিওর দিকে ছুটলো। পরেশ পাল নির্লিপ্ত, যেন তাঁর অন্তর আত্মা আগেই তাকে জানান দিয়ে ছিল,-‘ শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও”।
গাত্রোত্থান করে ফটিকের আজ প্রাতঃকর্ম সারা হয়নি। খবরটা শুনেই রুদ্ধশ্বাসে ছুটলো স্টুডিওর দিকে। দোচালা স্টুডিও ভেঙে চুরমার। অর্ধ নির্মিত লক্ষ্মী, কালীর ভাঙা ভাঙা মূর্তি গুলো এমন ভাবে পড়ে আছে যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সদ্য সমাপন হয়েছে। এ কোন সুরাসুরে যুদ্ধ নয়। এ সধর্মের যুদ্ধ। স্টুডিওতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভাঙা মূর্তি গুলো দেখে ফটিক চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলো না। সে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
ফটিক জানালার গরাদ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফটিকের মা ফটিকের মনের ব্যাথাটা অনুভব করেন, এবং ওর মনটাকে অন্য দিকে ঘোরাতে কাছে গিয়ে বলেন-” কি রে বেলা তো অনেক হলো, টিফিন করবি না? ফটিক মার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করলো-” মা, বাবা তো বলে মা দুর্গা বিশ্ব জননী, সার্বজনীন। এটা কি মিথ্যা মা? মা দুর্গা শুধুই কি আমাদের?” ফটিকের মা ফটিককে বুকে টেনে নিয়ে বলেন-” না বাবা, মায়ের কোনো জাত হয় না। মা শুধু মা-ই হয়। তোমার বাবা মিথ্যে বলেন নি। কিন্তু ওরা যে তা মানতে চায় না।”