সেদিন নিশীথে
কাকলি ঘোষ
প্রথম পর্ব
ঘরে ঢুকতেই গা টা কেমন শিরশির করে উঠল তপনের। এত ঠান্ডা কেন রে বাবা!এসি রুম তো নেয় নি ও। তাহলে ! রুম সার্ভিসের ছেলেটিরও ব্যাবহার খুব অদ্ভুত। ও ভেতরে ঢুকেছে কি ঢোকেনি হাত বাড়িয়ে কোনক্রমে আলোটা জ্বেলে দিয়েই পালালো। তাও বেড সাইড লাইট। এ আবার কি ! টিউব জ্বলে না ?
সব সুইচ গুলো পট পট করে টিপে দেখল ও। নাহ। কাল কমপ্লেন করতে হবে তো। আজ নয় এক্ষুনি শুয়ে পড়বে। খাবার পাট ও বাইরে থেকে চুকিয়েই এসেছে। কিন্তু জলটল তো লাগবে। কে জানে দেওয়া আছে কিনা। না থাকলে পাবার আশা আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না ! যা সার্ভিসিং এর বহর দেখছে ! রাতে কি বোর্ডার আসে না এই হোটেলে ? ওই প্রথম নাকি ! ওরও কপাল খারাপ। নইলে এত রাতে এই আতান্তরে পড়তে হয় ? সকাল বেলাও জানত না যে এই বিকেলের ট্রেনে বেরোতে হবে । অফিসে যেতেই হাতে টিকিট ধরিয়ে দিল সৌমেন দা।
“ আজ বিকেলের ট্রেনেই চলে যা। দারুন স্টোরি। ভালো করে কভার করতে পারলে হিল্লে হয়ে যাবে একটা। “
ইচ্ছে না থাকলেও ‘ না ‘ বলার কোন রাস্তা ছিল না তপনের কাছে। সবে ঢুকেছে এই পত্রিকায়। এখনও চেয়ার টলমলে। তার ওপর সৌমেনদা। ওকে ধরে করেই চাকরি টা জোগাড় করেছে । এখন তাকে চটানো আর নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারা একই কথা। আর সত্যি বলতে কি চাকরি বজায় রাখতে গেলে এসব ভাবলে তো আর চলবে না। বিশেষ করে কাগজের অফিসের চাকরি। না আছে সময়ের হিসেব না আছে খাটনির বাপ মা। যখন তখন যেখানে সেখানে দৌড় করায়। কোন কোন সময় তো আগু পিছু কিছু জানাই থাকে না। শুধু চলে যাও। রাস্তায় খবর আসে। কি করতে হবে, কতটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও তাই। ট্রেনে বসেই নির্দেশ পেয়েছে এখানকার এক এম. এল এর ছেলের গোপন কীর্তি কলাপ। সেটারই খবর জোগাড় করতে হবে ওকে।
জামশেদপুর জায়গাটা ওর একেবারেই অচেনা। আসে নি আগে কোনদিন। তার ওপর আবার পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। পাঁচটা কুড়ির ইস্পাত সঠিক সময়েই হয়ত পৌঁছত কিন্তু রাস্তায় হঠাৎ রেললাইনের ওপর পাবলিক অ্যাজিটেশান। সে সব সামলে লাইন চালু হতেও বেশ কিছুটা সময় লাগল। পৌঁছেই যদি হোটেলটা দেখে নিত তাহলে হয়ত এরকম হোত না। কিন্তু ওর স্বভাব কাজের আগে জায়গাটা আর লোকজন বুঝে নেওয়া। আর সেটার জন্য সব থেকে ভালো জায়গা চায়ের দোকান ছাড়া আর কি হতে পারে ?খবর পেয়েওছে কিছু। স্টোরি করতে অসুবিধে হবে না তেমন। আর এসবের জন্যই দেরী হল। রাতের আস্তানা খুঁজতে গিয়ে তাই আর বেশি ঘোরাঘুরি না করে সামনে যেটা পেয়েছে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এ যেন কেমন ধারা বাবা ! কাউন্টারের লোকটা তো প্রথমে ভাগিয়েই দিচ্ছিল। বলে ঘর নেই। শেষে অনেক জোরাজুরিতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাবিটা দিল। ঘরটা তো বেশ ভালোই। বড় বড় জানালা। ধপধপে বিছানা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খাট ছাড়াও সোফা সেন্টার টেবিল দিয়ে একপাশ টা সাজানো। তাহলে বলছিল কেন ঘর নেই ? রাতে ঝামেলা নেবেনা বলে ? কিন্তু এমন কি বেশি রাত হয়েছে ?
যাক গে অত ভেবে লাভ নেই। ঘর ভালো। বিছানা ভালো। এবার শুয়ে পড়া যাক। কিন্তু জল ___
“ এই যে স্যার জল। “
চমকে তাকায় তপন। কে ?
“ আমি এই রুমের সার্ভিস বয় স্যার। “
অল্প আলোতে ছেলেটিকে দেখে আশ্বস্ত হয় তপন। হোটেলের উর্দি পরা বছর কুড়ির শ্যামলা ছেলে একটা।
“ ওহ ! আচ্ছা। রাখো। “
“ আর কিছু লাগবে স্যার।“
“ না।। “
“ বাথরুমে তোয়ালে সাবান রাখা আছে স্যার। “
“ আচ্ছা। ঠিক আছে। “
“ কিছু লাগলে বলবেন স্যার। “
অবাকই হল তপন। ঘরে ঢোকার সময় অন্যজন তো বাইরে থেকেই পালালো। আর এই ছেলেটির একদম পাক্কা সার্ভিস ।
“ তোমাকে দেখলাম না তো ঢোকার সময়? অন্য একজন চাবি খুলে দিল।_সে তো পড়ি কি মরি করে পালালো । কিছু বলার ই সুযোগ পেলাম না। ”
“ ওর কথা বলবেন না স্যার। রাত হয়ে গেছে তো। ও ঐরকমই করে। আমি ছিলাম স্যার। দেখেছি আপনাকে আসতে। ও ছিল বলে আর আমি তখন আসিনি। “
“ ও। আচ্ছা। এ ঘরের আলো কি হল ? একটাও জ্বলছে না যে __. এখন না হয় শুয়ে পড়ব কিন্তু পরে দরকার হলে __”
“ আসলে স্যার টিউব টা খারাপ হয়ে গেছে। দুঃখিত স্যার। “
ছেলেটার আদব কায়দা বড় সুন্দর। ভালো লাগছিল তপনের।
“ হুম। সকালে আমার বেড টি লাগবে কেমন ? পাওয়া যাবে তো ?”
“ হ্যাঁ স্যার। এই যে ফোন। টু জিরো টু নাম্বারে ডায়াল করবেন। অর্ডার করলেই পেয়ে যাবেন। “
“ ওকে “
“ গুড নাইট স্যার। “
মাথা নেড়ে রাত পোশাক বার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তপন। না তাকিয়েও বুঝল ছেলেটা ঘরে নেই আর। দরজা বন্ধ করে বাথরুম ঘুরে জল খেয়ে সটান বিছানায় গড়িয়ে পড়ল ও। সারাদিন ব্যাপক ঘোরাঘুরি গেছে। ঘুম দরকার। কাল সকালেই আবার দৌড়তে হবে। ভীষণ স্পর্শকাতর বিষয়। কিভাবে এগোবে তার কিছুটা হিন্ট সৌমেনদা দিয়েছে। কিন্তু কাজটা তো করতে হবে নিজেকেই। উফফ এত ঠান্ডা লাগছে কেন রে বাবা ? যেন কেউ দু তিনটে এসি চালিয়ে রেখেছে। জামশেদপুর তো গরমের জায়গা ! সন্ধেবেলা ও ব্যাপক গরম ছিল। কুল কুল করে ঘেমেছে চায়ের দোকানে বসে। সেখানে ঘরের ভেতরে এরকম ঠান্ডা ! অস্বাভাবিক নয় ? জানালা গুলো বন্ধ করে দেবে ? নাকি ফ্যান অফ করবে ? ঠান্ডাটা যেন কেমন হাড় হুম করা! উফফ ! একটা কম্বল পেলে ভালো হোত। চাইবে নাকি রিসেপশনে ফোন করে ? পাগল ভাববে না তো ?
“ শীত করছে স্যার ?”
ভয়ানক চমকে ওঠে তপন।
“ ক্ কে ?”
“ আমি স্যার। ভয় পাবেন না। সার্ভিস বয় স্যার “
সার্ভিস বয় ! এখন ! এখানে ! বিছানা থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা! নিমেষে তপনের চোখ দরজার দিক থেকে ঘুরে আসে । দরজা তো বন্ধ। তাহলে ? তবে কি তখন ছেলেটা ঘর থেকে যায় নি ? ঘাপটি মেরে বসেছিল ? কেন ? কি মতলব ? চুরি ডাকাতি ? চকিতে ভেবে নেয় তপন ব্যাগে টাকা পয়সা খুব বেশি কিছু নেই। কিন্তু ক্যামেরা ? লাখ টাকার ওপর দাম ! তবে কি ?
“ এই তু _তুমি ঘরে কেন ? ঢুকলে কি করে ? কি চাই ? “
(পরবর্তী অংশ… আগামী সপ্তাহে…)
অসাধারণ !! পরের পর্বের জন্য উৎসুক রইলাম