অগ্নিপথ রেখা ধরে…
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
এখন প্রায় রাত দশটা বেজে গেছে। সূতীব্র হূইসেল বাজিয়ে ‘ ক্রান্তিসূর্য স্পেশাল এক্সপ্রেস’ নামের এই ট্রেনটা এই খানিক আগেও বোধহয় মালিহাবাদের কাছে কোন একটা অখ্যাত স্টেশনে সিগন্যাল না পেয়ে একঘন্টা প্রায় দাঁড়িয়েছিল। এই কিছুক্ষণ হল লাইনে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে ট্রেনটা অবশেষে লখনৌ এর দিকে ছুটতে শুরু করেছে।
এখন এই অগ্রহায়ণের শেষদিকটায় এসে বেশ ভালোমতোই আসন্ন পৌষের হিমেল আভাসটাকে টের পাওয়া যাচ্ছে। আর সেটাই যেন থেকে থেকেই কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। ফলে শেষমেশ রাত দেড়টার পরে যখন ট্রেনটা গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছবে সেটা যে তখন আরও বেশী করে মালুম হতে চলেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
………
টিফিন বাক্সে রাখা চারটে শুকনো রুটি আর একটু আলুভাজা খেয়ে মুখ ধুয়ে আসতেই যেন একঝলক ঠান্ডাহাওয়া এসে এখন নগেনের হাড়গুলোকে ভেতর অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নতুন জয়েনিং এর পর সবেমাত্র পনেরদিন হল সারা হিন্দিবলয় চষে বেড়াতে হচ্ছে নইলে মধ্যভারতের অখ্যাত শহরতলীর ব্রাঞ্চে জয়েন করে এই আগের দুটো মাসও গা’এ ফুঁ দিয়ে দিব্যি সময় কেটে যাচ্ছিল।
এর আগে সালকিয়াতে থাকতে কয়েকটা বছর সে যেমনই হোক তবুও মিলের চাকরীটা তখনো ছিল বলে তাও কায়ক্লেশে হলেও খরচখর্চা সব চলে যাচ্ছিল। মাস চারেক আগে ওই কারখানাটা লকআউট হতে নগেন ভীষণ আতান্তরে পড়েছিল। ওর সংসারে লোক বলতে বলতে বিধবা মা আর নগেন নিজে। বাবা তো সেই ক্লাস টেনে পড়ার সময় হার্টের রোগে হঠাৎ করে চলে গেল। তখন ওই জুটমিলে কন্ট্রাকচুয়াল লেবারের চাকরিটা না পেলে হয়তো না খেতে পেয়েই মরতে হত। ওদের ঠিকাদার কুন্ডু মশাই তাঁর ভাগ্নেকে বলে কয়ে এই চাকরীটা পাইয়ে দিয়েছেন।
অবশ্য রিপ্রেজেন্টেটিভ এর এই কাজটা একেবারে অন্যরকমের। দিল্লীর হেড-অফিস থেকে বেছে দেওয়া কিছু ফিল্ড এলাকা গুলোতে এখন জোনাল টীমের তরফ থেকে ঘুরে ঘুরে ডিস্ট্রিবিউটারশীপ নেওয়ার জন্য আগ্রহী বিজনেসম্যানদের ধরে খুঁজে আনতে হচ্ছে। এদিকে আবার সামনের জানুয়ারিতে ওদের কোম্পানী একটা আয়ুর্বেদিক ফরমূলাতে দাঁতের মাজন তৈরী করে দেশের এফ. এম.সি.জি.বাজারে একটা নতুন চমক আনতে চলেছে। এ সব হাঙ্গামাই সেইসব কাজের জন্য।
………
ঝুপ্ করে কামরার বাল্বটা নিভে যেতেই ও এতক্ষণে টের পেল ওর সাথে একজন মাঝবয়েসী গুঁফো লোক ছাড়া এই S3 কামরাটায় আর কেউ নেই। আর পুরো ট্রেনটাই যেন ভূতে পাওয়ার মত এই বেবাক অন্ধকারে অবাক করা শূন্যতা নিয়ে আরো বেশী করে খাঁ খাঁ করছে।
ইতিমধ্যে গুঁফো লোকটা উঠে নগেনের দিকে মৃদু হাসি হেসে এগিয়ে আসছে।
এখন যদিও কোত্থেকে মিটমিট করে একটু আলো ভেতরে এসে পড়েছে তাও যেন ভিতরকার অন্ধকারটা সেইভাবে কাটেনি। লোকটা ওকে দেখে জিজ্ঞাসা করল যে ও কি
” বংগালী”? আর যদি সে তাই হয় তাহলে কোনওভাবে ‘মন্মথ আর মুরারী’দের কোনও খোঁজ সে জানে কি?
কি আশ্চর্য এইলোকগুলো সব আবার কারা? তাছাড়া বাঙালী হলেও বা নগেন যে এদের চিনবে তারই বা কি মানে?
তবে নগেনের যদিও এই লোকটার মুখ চোখ দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে ; তাও ঠিক কোথায় দেখেছে সেটা অবশ্য কোনওমতেই মনে করতে পারছে না।
…………
লোকটা এবার ওর এক হাত দূরত্বে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে উদ্দেশ্য করে এবারে
দেহাতী হিন্দিতে বিড়বিড় করে আপনমনে বলে উঠল,
” বুঝলেন বাবুজী! আজাদী আর যাই হোক বাপুজী’র দেখানো পথে শুধু কখনোই আসবে না! ইংরেজ কুত্তাকে ডর্ পাওয়ানোটা এখন জরুরী! আফশোস এই যে হর্ রোজ তাজা তাজা জীবন এজন্য শুধু আমাদের বলি দিতে হচ্ছে … আমাদের হিন্দুস্তান রিপাবলিক্যান এসোসিয়েশন একদিন আজাদীর রোশনাই ঠিক আনবেই….তবে এটাও সত্যি যে এর জন্য মরতেও আমরা সবাই রাজি আছি…..”
নগেন অবাক হয়ে কপালে ছ-সাতটা ভাঁজ ফেলে কথাগুলো শুনতে শুনতে ভাবলো,
পাগল না কি লোকটা?যাহ্ বাব্বা..লোকটা এসব কি বলছে! ওর কথা গুলোরই বা কি অর্থ? আর আজাদী মানে……?
লোকটা কি জানেনা আজ প্রায় পঁয়ষট্টী বছর হয়ে গেছে দেশ এখন তো স্বাধীন!
……
কাকোরী আসতে আর বেশী দেরী নেই। ট্রেনের হুইসেল এখন রাত্রের নিস্তব্ধতা ভেদ করে চারিদিক খানখান্ করে দিচ্ছে।লোকটা ওকে এবার হাত দেখিয়ে মাথা নীচু করে বার্থে উঠে যেতে বলে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
” আওয়াজ নেহী করনেকা! আপলোগোকা কুছ নেহী হোগা। বিসমিল অউর আসফাক আভ্ভি ইধার আ যায়গা। উনলোগ গার্ড কো ঘায়েল করকে পাঁচ হাজার রুপেয়া ডাকাইতি কর্ লিয়া। ইসসে হামলোগ কুছ্ নয়া মাউজার পিস্তল খরিদ্ করকে…..”
কথাটা শেষ হলোনা এর মধ্যে শোনা গেল কান ফাটানো গুলির শব্দ আর সম্মিলিত বিভিন্ন লোকজনের চীৎকার। মনে হচ্ছে কেউ যেন এমার্জেন্সী চেন টেনে মনে হয় কেউ এই ট্রেনটাকেও আচমকা থামিয়ে দিল!
এখন তারমধ্যে কয়েকটা হাত বোমাও ফাটার শব্দে চারপাশটায় দমবন্ধ হয়ে অনেক অনেক ধোঁয়া আর বারুদের জমাট গন্ধটা সরাসরি নাকে আসছে।
এইসব ঝামেলার মধ্যে প্রাণ নিয়ে নগেন শেষমেশ বাড়ি ফিরতে পারবে তো!
………..
এতক্ষণে সবটা একটুএকটু বোঝা যাচ্ছে যেন ! ওই গোঁফওয়ালা লোকটা তাহলে একটা ডাকাত দলের লোক ! হিন্দীবলয়ে যে সব ডাকাতদের গল্প শোনা যায় সেসব তাহলে একেবারে মিথ্যে নয়।
এবার বোঝা যাচ্ছে যে ওরাই তাহলে কায়দা করে ট্রেনটাকে থামিয়ে যাত্রীদের থেকে টাকা পয়সা লুঠ করতে চায়! কিন্তু এর সাথে লোকটার মুখের ওইসব ‘ আজাদী..টাজাদী ‘ শব্দগুলোর মধ্যেই বা আবার কিসের সম্পর্ক?
………….
কিন্তু এখন কাউকে দেখা যাচ্ছেনাতো!
গোলমালের শব্দটাও যেন দুম্ করে কি করে যে ভ্যানিশ করলোই শুধু নয় সেই লোকটাও যেন কামরার মধ্যেই কোথায় যেন হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল।
তারপর পরক্ষণেই কোত্থেকে একটা অজানিত আচ্ছন্নের ভাব এসে নগেনের দুটো চোখে যেন কতদিনের জমানো ক্লান্তি আর ঘুমঘোর এনে দিল!
………
একটু পরে ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন থামতেই ও অবাক হল। এখন ঠিক রাত দেড়টা বাজছে।
এত ঝামেলা সত্ত্বেও ঠিক টাইমে চারবাগ স্টেশনে গাড়িটা কি করেই বা দাঁড়িয়ে আছে।
সত্যিই ও যেন কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা তো।
ঠিক করল স্টেশন যখন যা হোক এসে গেছে…তাহলে তো এবার নামতেই হচ্ছে!
………..
তাড়াতাড়ি নেমে নগেন দেখল জনাদুয়েক দেহাতী লোকজন ছাড়া আর কেউ এখানে নামলনা। নিঝুম রাতে স্টেশনটা একরকম ঝুপসি আলোমেখে যেন কয়েকযুগ আগের চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে।
এত রাতে হোটেল -টোটেল নিশ্চয়ই পাওয়াও যাবেনা। নগেন ঠিক করল একটা আপাতত ওয়েটিং রুম গোছের কিছু একটা আস্তানার খোঁজ করাটাই এখনকার মত জরুরী। ও ভুল করে লখনৌর চারটে স্টেশনের মধ্যে সব থেকে জনবিরল স্টেশনটাতেই এখন নেমে গেছে।
এখানে এসে যে বিস্ময়ের এখনো বাকি ছিল সেটা আর কে জানত?
এখানে আধা অন্ধকার একটা জেনারেল ওয়েটিংরুম পাওয়া গেল বলে আজ রাতের মত নিশ্চিন্ত হয়ে নগেন যেই গায়ের চাদরখানা বিছিয়ে এবারে শুতে যাবে ও দেখল ওয়েটিংরুমের দেওয়ালে কার একটা ফটো যেন জ্বলজ্বল করছে।
………….
আরে! এ তো ট্রেনে দেখা ওই গুঁফো লোকটার ছবি ? কি আশ্চর্য! সেটা আবার কেউ এসে ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে রেখে গেছে। ।
এখন ওই ছবিটা মৃদু হাওয়ায় একটু একটু করে দুলছে বলে ওর তলায় রাখা একটা টিমটিমে প্রদীপের আলোটাও থেকে থেকে কাঁপছে।
এই মায়ান্ধকারেও ছবিটার নীচে যে কয়েকটা অক্ষর ভাল করেই পড়া যাচ্ছে সেগুলো হল,
“শহীদ চন্দ্রশেখর আজাদ…
কাকোরী ট্রেন হামলা……
৯ আগস্ট, ১৯২৫সন……
জয়হিন্দ!”
–~০০০XX০০০~–
Kakori conspiracy case —– এক রাশ মুগ্ধতা !!!!!