চিমড়ে গুন্ডা
কাকলি ঘোষ
সালটা ছিয়াশি সাতাশি হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মফস্বল থেকে কলকাতার কলেজে এসে ভর্তি হয়েছি। থাকি শিয়ালদার কাছে একটা মেসে। লম্বাটে ধরনের দোতলা বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে সামান্য ভেতরে। গোটা বাড়িটাই মেস। দোতলার কোনের দিকে একটা ঘরে চার জনের বাস। প্রথম প্রথম এই বড় শহরের ছেলেদের ব্যাপারে স্বাভাবিক কারণেই একটা গোপন ভীতি কাজ করত। আস্তে আস্তে কেটে গেছে সেটা। এখানেই আলাপ রজত মিত্তিরের সাথে। তালতলার প্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার প্রশান্ত মিত্তির এর ছেলে। বড় বনেদি বংশ। দিলখোলা, হাসি খুশি, কিছুটা রোমান্টিক স্বভাবের রজতের সাথে অচিরেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। কলেজ ছুটির পর প্রায়ই জোর করে ধরে নিয়ে যেত ওর বাড়িতে। কাকিমা অর্থাৎ রজতের মা ছিলেন খুব মিষ্টি অথচ ব্যাক্তিত্বময়ী মহিলা। খুব সহজেই হেসে আপন করে নিয়েছিলেন। আমি তখন কলেজের ফুটবল টিমে খেলি। দুরন্ত স্বাস্থ্য। দুর্দান্ত ক্ষিদে। সত্যি কথা বলতে কি মেসের খাবারে পেট ভরত না। একবার রজতের বাড়ি গিয়ে পড়তে পারলে কাকিমা চোব্য চোষ্য খাওয়াতেন। আর সেই টানেই রজতের তালতলার বাড়িতে ঘন ঘনই যাতায়াত ছিল আমার। সে যা হোক।
একদিন হঠাৎ কী কারণে কলেজ ছুটি। বই খাতা সামনে খুলে আসন্ন ফুটবল ম্যাচের কথা ভাবছি হঠাৎ রজত মেসের নিচে এসে হাজির।
” নেমে আয় দরকার আছে। ”
নেমে এলাম। দেখলাম। উস্কো খুস্কো চুল, লাল চোখ, ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস। কি বৃত্তান্ত! না রজত প্রেমে পড়েছে। আর প্রেমে তো পড়াই ! তাই না ? ওঠার জায়গা কই? পরে অবশ্য জানলাম শুধু প্রেমের জন্যই ওর এই উতলা হওয়া নয়___ সঙ্গে আরও কিছু রয়েছে। একটু একটু করে যা শুনলাম তা হল বিবেকানন্দ রোডের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে ও। সুন্দরী টি বেথুন কলেজে পড়েন। চোখে চোখে চাওয়া, ইশারা, হাসি, ইত্যাদির প্রতিদান পেয়ে রজতের ধারণা হয়েছে তিনি ও ইচ্ছুক।
তা বেশ তো! সমস্যা কি! দু পক্ষই রাজি থাকলে প্রেমে অসুবিধে কি?
কিন্তু অসুবিধে অন্য জায়গায়। সেটা রজত খোলসা করলো পরে। বিবেকানন্দ রোডের যেখানে ওই সুন্দরী বাস করেন সেই গলির ভেতরে রকে বসে আড্ডা মারে কিছু ছেলের দল। কবে নাকি তারা রজত কে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে এবং সম্ভাব্য ব্যাপারটা আন্দাজ করে উত্তম মধ্যম লাগিয়ে দিয়েছে।
সন্দেহ হল! এরকম তো হবার কথা নয়। দুজনেই যখন রাজি তখন___ তার মানেই___ ‘ ডাল মে কুছ কালা হ্যায়” ।
রজত কে আরো একটু চেপে ধরতেই জানা গেলো ওই রকে বসিয়েদের একজনও ওই রূপসীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। বুঝলাম__কন্যে টি সব্যসাচীর মত দু হাতে দুজনকে সামলাচ্ছেন। ইংল্যান্ড হলে ডুয়েল অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু দেশটা ভারতবর্ষ , জায়গাটা কলকাতা আর রজত ওর বাপকে যমের মত ভয় করে। অথচ অপমানটাও মেনে নিতে পারছেনা। বোঝালাম অনেক।
“দ্যাখ ও মেয়ে খেলুড়ে। তুই পেরে উঠবি না। ”
কিন্তু ওই যে কথায় আছে , ” চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। ”
রজত অবরুদ্ধ স্বরে বলল ,” ও কি করবে? সামান্য একটা মেয়ে। ওই রাস্কেল টা ওকে ভয় দেখাচ্ছে। ”
বুঝলাম। ওকে আর এখন ফেরানো যাবে না। অগত্যা। সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললাম,
” তো কি করতে চাস? ”
উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠল রজতের চোখ জোড়া!
” ঠিক করে ফেলেছি। গুন্ডা ফিট করে ফেলেছি। অসম্ভব দক্ষ। চিমড়ে গুন্ডা।”
ধোঁয়া ছাড়ার বদলে ভক্ করে গিলে ফেললাম একগাদা। চিমড়ে গুন্ডা! সে আবার কে! নাম শুনেই অশ্রদ্ধা জাগল! কিন্তু রজত তখন বেপরোয়া। বললে ও শুনবে না।
তাই মনের ভাব মনে রেখে ওর সাথে ট্যাক্সি চেপে বসলাম। মানিকতলার মোড় বেঁকতেই চিমড়ে বাবুর দর্শন পেলাম।
লুঙ্গি পরা, নাইলনের শার্ট( তখন প্রচলিত ছিল),বুকের বোতাম খোলা। ভেতরে গেঞ্জি নেই। পাঁজরের প্রায় প্রতিটি হাড় গোনা যাচ্ছে। রজত জানালা দিয়ে মুখ বাড়াতেই হাতের সিগারেট টা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ট্যাক্সিতে উঠে সামনের দরজা সজোরে বন্ধ করল। কিছুটা এগিয়ে একটা কানা গলির মুখে বড় রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করালো রজত। ট্যাক্সির ভেতরে বসেই আঙ্গুল দিয়ে ছেলে গুলোকে দেখিয়ে দিল। তারা দিব্যি রকে বসে সিগারেট টানতে টানতে আড্ডা মারছে। পোড় খাওয়া চেহারা। একজন কে বিশেষ করে নজরে পড়ল। কপালের একপাশে কাটা দাগ, রুক্ষ চোয়াড়ে মুখ, শরীরের প্রতি টা পেশী সবল। দেখে শুনে মনে হল ইনিই দলের নেতা।
ছেলেগুলোকে দেখেই চিমড়ে এক লাফে ট্যাক্সি থেকে নেমে টারজান গর্জন করে ওদের দিকে এগিয়ে গেলো।
” কে __ কে বে হারামির বাচ্চা___ হারামী! শালা আমার ক্লায়েন্টের গায়ে হাত তুলেছিস? আজ তোদের বা___ ”
মুখের ভাষা লেখার অযোগ্য। যাদের উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলা হল ___ সেই ছেলে গুলো প্রথমে কিছু টা হকচকিয়ে গেল। স্পষ্টই বোঝা গেলো হঠাৎ এ ধরনের অতর্কিত আক্রমণ আশা করে নি। ওদিকে চিমড়ে থেমে নেই। গলার শির ফুলিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তি করে চলেছে। আমি নির্বাক। মনে মনে দুর্গা নাম জপছি। যদি কেলো কিছু হয় রজতের বাবা ব্যারিস্টার। ও বেঁচে যাবে। আমার হেডমাস্টার বাবা একটি হাড় ও আস্ত রাখবেন না। কিন্তু তখন পালাবার পথ নেই। বসে দেখা ছাড়া।
হঠাৎ রজত আমার হাত চেপে ধরল। ছেলেগুলো এবার উঠেছে। মুখের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দল বেঁধে এগিয়ে এসে চিমড়েকে ঘিরে ধরেছে।
পরের ঘটনা বলাই বাহুল্য ! মার ! মার ! বেধড়ক মারে চিমড়ে চতুর্দিকে ছিটকে পড়তে লাগল। আর প্রত্যেকবার পড়ার সময় কারুর বুক পকেট, কারুর হাত ঘড়ি নিয়ে ধরাশায়ী হল।
হাল দেখে ট্যাক্সি ওয়ালাকে বললাম, ” ভাগো।”
গল্পের শেষ কিন্তু এখানে নয়।
বিফল মনোরথ হয়ে সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থায় রজত ওদের বাড়ি নিয়ে গেল। কোনরকমে ওর বাবার মক্বেল বসার ঘরে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলাম। রজত ভেতরে খবর দিল। একটু পরেই কাকিমা ক্ষীরের মালপো পাঠিয়ে দিলেন। এতক্ষণের পরে খেয়াল পড়ল সকালের জলখাবারের পর আর কিছু পেটেই পড়ে নি। দ্রুত বেগে হাত চালালাম। রজত কিছুক্ষণ মন মরা হয়ে বসেছিল বটে তবে কতক্ষণ ই বা! ক্ষীরের মালপো বেশিক্ষণ উদাস থাকতে দিল না। আড় চোখে দেখলাম ব্যার্থ প্রেম ভুলে দিব্যি সাঁটাচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে সবে আয়েশ করে সিগারেট টা ধরিয়েছি পঞ্চু এসে হাজির। পঞ্চু রজত দের পুরনো চাকর।
” কি রে?”
” একজন দেখা করতে চাইছেন।”
আমার তখন চোখ বুজে আসছে। এত ধকল আর তার ওপর এত গুলো মালপো! আর শরীর পারে! রজত বলল, ” আর পারছি না উঠতে। এখানেই ডাক। ”
পঞ্চু চলে গেলো আর মিনিট খানেকের মধ্যেই যাকে নিয়ে ঢুকলো ___দেখে তড়াক করে সোজা হয়ে বসলাম।
চিমড়ে!!!
” তুমি!! ” রজতের গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। আমার অবস্থাও তথৈবচ!
ঠোঁটের কোণে রক্তের দাগ , জামার একটা হাতা ছিঁড়ে ঝুলছে, বুকে, কপালে, গালে, অজস্র কালসিটে!
” ক্ কি ব্যাপার!”
” কিছু না স্যার। ভয় পাবেন না। ” চিমড়ের মুখে অমায়িক হাসি, ” আসলে কি জানেন? দশ বছর ধরে আখড়া তে মার খাওয়া প্র্যাকটিস করেছি। এসব আমার জলভাত। ”
সামনে রজতের বাবার সেক্রেটারিয়েট টেবিলে এর ওপর এক এক করে কিছু ঘড়ি, লন্ড্রির বিল, ইত্যাদি সাজিয়ে দিল । আর তারপর একপেশে হাসি হেসে বলল,
” আমার ভিজিট আর দিতে হবে না স্যার। বাকি যা আছে তাতেই হয়ে যাবে। ”
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলাম।
–~০০০XX০০০~–