দাবানল
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
এখন ঘোর নিশাকাল। আকাশও তালে সমে যেন ঈষৎ মেঘাচ্ছন্ন। একটা গুমোট হাবভাব চারপাশে। এই নিশুত রাতে কেবল জেগে গ্রামের প্রান্তে এই গির্জাঘরটি। এর আশেপাশে কিছু বাগদী, চামার আর মালো দের চালাঘর। গত পাঁচ সাত বছরে এরা পূর্বপুরুষের ধর্ম ছেড়ে কেরেস্তান হয়েছে।এখন প্রার্থনার পর এরা সকাল সন্ধে দুবেলা রুটি খেতে পায় আর একটু আধটু পড়ালেখা করতে পারে বলে রোববার রোববার করে এখানে সদলবলে আসে।
গীর্জাঘরটা পাকা নয়। বাঁশ দর্মার কাঠামোটার সবচেয়ে আগে নজর পড়ে কাঠের ক্রুশটা। একটা বেদীর ওপর ঈষৎ হেলে বসানো প্রথম থেকেই। বেদীর নীচে একদিকে সন্ধ্যামালতীর চারা আর একটা ধানীলংকার চারা বসানো। বলা চলে বৃদ্ধ ফাদার শিশির ক্রিস্টোফারের বদান্যতায় গির্জেঘর টিকে আছে।
যদিও ছোটলোকগুলোর এই অবলম্বন মোটেও ভালো চোখে দেখেনা গ্রামের মাতব্বররা। অথচ সেবাধর্মে জড়িয়ে পড়ে এই প্রান্তিক মানুষগুলোর সাথে সুখে, দুঃখে, রোগে অসুখে থাকতে পেরে খুব খুশী তাদের “বাবাসাহেব”টি।
……….
লন্ঠনটা নিয়ে পিছনের বাঁশঝাড়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছিলেন তিনি। হঠাৎ ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি নামল। উঠে পড়বার আগে একটা মেয়েমানুষের গোঙানির মত আওয়াজ কানে এল। কোনও মতে সামলে সেদিকে গিয়ে দেখলেন এক পূর্ণগর্ভ সাঁওতাল মেয়েকে।
মেয়েটি প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পরণের কাপড়চোপড় বিক্ষিপ্ত ও ছিন্নপ্রায়। মেয়েটা গোঁ গোঁ করে গোঙাচ্ছে, মুখের কষ ফেনিয়ে ঝরছে লালা। একা মেয়েটিকে উঠিয়ে নেবার সামর্থ্য তাঁর নেই। জোসেফের ঘরে দুটো টোকা মারলেন এসে। জোসেফ আর তার বউটির সাহায্যে কোনওমতে মেয়েটাকে গির্জে ঘরের সামনে একটা কাপড় পেতে শোয়ালেন। কোথাকার কে, তাকে এভাবে এখানে তুলে আনার কথাটা ভাবলেন একবার। কিন্তু মেয়েটার অবস্হা দেখে নিজেকে সামলালেন। গামলা করে একটু গরমজল নিয়ে আসল জোসেফের বউ। সঙ্গে আনল রতন বাউরীর বাঁজা বউটাকেও। সে -ই অবশ্য গত পঁচিশ বছর ধরে এই পাড়ার ধাত্রী।
বাবাসাহেব উঠে গিয়ে ক্রুশের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে বাইবেলটা খোলেন। তারপর বিড়বিড় করে প্রার্থনা করেন পরমপিতার কাছে। সজোরে বিদ্যূৎ চমকে উঠে সন্নিকটের তালগাছটায় বাজ পড়ে। সে শব্দ মিলিয়ে যেতেই এক শিশুর জন্মমুহূর্তের ক্রন্দনধ্বনি সূচিত হয়।
সাঁওতাল মেয়েটা সংজ্ঞা হারায় তারপর।
প্রবল বর্ষণসিক্ত রাতে একটি নবীন প্রাণের জন্মের রক্তে সিঞ্চিত হল ক্রুশকাষ্ঠের বেদীমূলের কর্দমাক্ত মাটি।
– ” ও বাবা সাহেব ইখোন য্যানো ইদিকে আসবেক লাই! মেয়্যেটার য্যে বিটিছ্যালা হইচে গো! দিখ্যে নিও উ বিটি বড়ো হয়ে ঠিক একদিন মা মেরী হবেক গ্যো! ইটাই তো ভগমানের ইচ্ছা বটেক!”
রতন বাউরীর বাঁজা বউটার গলায় এই খবরের আনন্দধ্বনিটাই নিশুত রাতে পাড়া কাঁপিয়ে দেয় নিমেষে।
পরদিন সকালে ঢি ঢি পড়ে গেল এ ঘটনায়। সাঁওতাল মাগীটা এ কার “বিটিছ্যালা” এমন বাদলায় বিয়োলো তাও আবার গির্জে ঘরে এমনটা লোকের মানতে মন মানতে চায় না।
মেয়েটাকে আগে কেউ দেখেনি। কোথাকার সোমত্থ মেয়ে,নষ্ট কিনা এসবেরই চর্চা চলতে লাগল পুরোদমে।
……….
সাঁওতাল মেয়েটা বোবা। তার মুখে কোনও কথা নেই। ফাদারকে দেখলে যা গোঙানির মত অস্ফুট শব্দ করে।
পরক্ষণেই ভীত হরিণীর মত বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে। উদোম বুকে মুখ লাগিয়ে বাচ্চাটা তৃপ্তিতে দুধ খায়।
সেদিন একটা আস্ত হেলে সাপকে লাঠির ঘায়ে মারে জোসেফ। সেই সময় মেয়েটার হিংস্র বেড়ালের মত চোখে ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে দেখেছিলেন বাবাসাহেব।
তিনি নির্বিকার চিত্তে আগের মত প্রার্থনা আর বাড়ী বাড়ী ঘুরে প্রভুর মহিমাকীর্তন করে বেড়ান।
সাঁওতাল মেয়েটা দিনের বেলায় গীর্জাঘরের একপাশে বাচ্চা নিয়ে শুয়ে বা বসে থাকে আর রাতে জোসেফের বাড়ীর দাওয়ায় এসে শোয়।
দুদিন পরে মাতব্বরেরা এল ফাদারের কাছে। অজ্ঞাতকূলশীল মেয়েছেলেকে এভাবে গীর্জায় তুলে আনাটা মেনে নিতে তাদের ঘোরতর আপত্তি। মাধব সাহা ওকে বাচ্চা সমেতই গঞ্জের লালপাড়ায় ছেড়ে আসতে বলে। বিজ্ঞের গলায় সে বলে – ‘বাবাসাহেব ! এবয়সে এস্যে উও কলঙ্কের কালিটো নাই বা মাখলেন কিন্তুক ! দ্যাখছেন তো বোবাকালা মেয়েছেলে কেউ কিচু করে ছেড়ে দিয়েচে কেনে! ই সবের দায়টো আপনি নেবেন কেনে ?’
শান্ত স্বরে তাদেরকে সে মুহূর্তে গীর্জাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন বলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে বাইবেল আর রোজরি মালাটা নিয়ে দরজা বন্ধ করেন বৃদ্ধ পাদ্রী। এখন মনোঃসংযোগ চাই। আর চাই ভক্তিনম্র প্রার্থনার নিবেদনটুকুই।
……….
মালোপাড়ায় বাচ্চাটার জন্য দুধ জোগাড় করতে গেছিলেন বাবাসাহেব। মেয়েটার ধূম জ্বর হঠাৎ। ওষুধ দিয়েছেন সকালে। বাচ্চাটা ধূলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছিল অবহেলায়। এই প্রথম মানবশিশুটিকে কোলে তোলেন। গীর্জাঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে মাথায় জপের মালা ছুঁইয়ে প্রার্থনা করেন। অচেতন মা এর পাশে আবার শুইয়ে দিয়ে দুধের সন্ধানে বেরোন।
ফিরতি পথে দেখতে পান আকাশ জুড়ে গীর্জার দিক থেকে সিঁদূরে মেঘের ধূমায়িত কুন্ডলী ধেয়ে আসে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দ্রুত পা চালান তিনি। জোসেফের লেংড়া ছেলেটা ট্যাংট্যাং করে গির্জার ঘন্টা পেটাতে থাকে। সর্বগ্রাসী বৈশ্বানরের লেলিহান শিখা তখন ক্ষুধার্ত জিহ্বা মেলে গ্রাস করে নিচ্ছে গির্জাঘর, ক্রুশকাষ্ঠ আর দুটি অচেতন ও অর্ধচেতন মানবসন্তানকে।
ছাইএর স্তুপের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন বাবাসাহেব। দুহাজার বছর আগেকার মানবজাতির ব্যাধির প্রকোপ নতুন করে তাঁকে ব্যথা দেয়।
অবসন্ন হাতটা জোসেফের ল্যাংড়া ছেলেটার কাঁধে রাখেন তিনি।
তারপর, ক্রমশঃ নিভে আসা ছাইএর ঢিমে আঁচের ওপর ছড়ছড় করে ভাঁড়ে করে আনা দুধটুকু ঢেলে দেন। ওটা আর কাজে লাগলো কই?
এতদিন পরে তাঁর আর বুঝতে আর বাকি নেই যে মন নিয়ে ক্রুশবিদ্ধ সেই পরমপিতার কাছে ক্ষমাভিক্ষা করার আজন্মকালের অভ্যাসটাও জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা। ওসবেও আজ যেন এতদিনে সত্যিই এবারে একটা ছেদ পড়ল !
–~০০০XX০০০~–
…………
কৃতজ্ঞতা স্বীকার –
…………
# শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক শ্রী কমল কুমার মজুমদার ও তাঁর লেখা ছোটগল্প “মতিলাল পাদরী ” যা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত।
# আততায়ীদের নিষ্ঠুরতায় অকালমৃত রেভারেন্ড গ্রাহাম স্টেইন্স ও তাঁর পরিবারবর্গ।