আতসকাচের নীচে..
শিল্পী মিত্র হাতি
আজকাল কোন্ কাকভোরে ঘুম ভেঙে যায়, কোথা থেকে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো টোকা মারে, চমকে উঠি, দুহাতে কুয়াশা ঠেলে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে পৌঁছে যাই জনহীন প্রাসাদের নিরালা জলসাঘরে, জ্বলে ওঠে ঝাঁড়বাতি, টুং টাং পিয়ানোয় সুর খেলে যায়, আর সেই মায়াবী সুরের আলোয় আমি ভেসে বেড়াই, ডুব সাঁতারে তুলে আনি এক একটা অমূল্য রতন, ছুঁয়ে ফেলি হাসি কান্নার নিষিদ্ধ সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি।
আমার তখন ত্রিশটা বসন্ত পেরিয়েছে, একটি বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে আসীন, বয়সের তুলনায় একটু আগেই আমার পদোন্নতি, তাই অফিস, বন্ধু, প্রেমিক সব নিয়েই আমার ব্যস্ত জীবন, তবে উপভোগ করছি ষোলোআনা। বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা, তাই একটু বেশি আস্কারা পেয়ে থাকি। ওদের আদর স্নেহ আর নিরাপত্তার বলয়ে আমি সম্পৃক্ত। তখনও বিয়ে করছি না কেন, কবেই বা করব, এসব নিয়ে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালি মা বাবার মত আমার বাড়িতে কোন উচাটন ছিল না।
বাবা ছিলেন শিক্ষক, মা সরকারি হাসপাতালের নার্স, পরে মেট্রন হয়েছিলেন। সপ্তাহে তিন দিন নাইট ডিউটি থাকত। পরদিন দিনের বেলায় মাকে ঘুমিয়ে নিতে হত। বাবা মায়ের প্রেমজ বিয়ে, আমি আসতে আমাকে কেন্দ্র করে তাদের জীবনের সবকিছু। তবু আমাকে বড় করার জন্য তেমন কোন হেল্পিং হ্যান্ড ছিলনা। রবিবার বাবার ছুটি, মা অন্য একটা দিন ডিউটি থেকে অফ নিতেন, এভাবে দুজনে সময় ভাগাভাগি করে বড় করেছেন আমায়।
স্বাভাবিকভাবে আমি মায়ের থেকে বাবাকেই কাছে পেয়েছি বেশি। স্কুল থেকে ফেরার পর বাবা পুরো সময়টুকুই আমাকে দিতেন। এরপর আমার স্কুল জীবন শুরু হল,অক্ষরপরিচয় হল বাবার কাছেই, বাবার কোলে বসে শ্লেটে চক পেনসিল দিয়ে অ-আ লিখতাম, তবে এখন মনে হয় বাবা বেশিক্ষণ ধৈর্য্য রাখতে পারতেন না। ছোটবেলায় আমার হ্যান্ড রাইটিং তাই ভাল ছিল না। হোমওয়ার্ক থাকত, আমি নিজেই করছি, বাবা আমাকে দেখাতে দেখাতে কখন নিজের পছন্দের বইটি টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করেছেন।
‘ ও বাবা, এখানে কি হবে দেখনা’…বই থেকে চোখ সরিয়ে বললেন বটে, তারপর আবার নিজের মধ্যে ডুবে গেলেন। বেশ কবার এমন হওয়ার পর বাবা,
‘চল ফুচকা খেয়ে আসি, যাবি?’। আনন্দে আমি তখন বই খাতা ফেলে খানিক নেচে কুঁদে বাবার সাথে বেরিয়ে পড়লাম।
মা ফিরেছেন এর মধ্যে, আমরা আসতেই বিছানায় ছড়ান বই খাতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ‘ হোম ওয়ার্ক কমপ্লিট হয়েছে নাকি টঙটঙ করে ঘোরাই হচ্ছে কেবল’।
‘যা হয়েছে ওতেই হবে, ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড না হলেও চলবে আমার মেয়ের’…
‘তা তো, কোথায় লোকে বাচ্চার জন্য কত চেষ্টা করে, জামাইবাবুকে দেখ, অফিস,থেকে এসে বুবাইকে নিয়ে বসে পড়ল, এগারটা অবধি লেগে থাকল’
‘ এই শুরু হল, তুলনা করো না তো, সব সময় এক কথা… ‘
কখনও কখনও বাবা উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছেন, আমি পিঠের পর বসে বাবার বইটায় উঁকি মেরে, ‘এত মোটা বই তুমি এখন মুখস্ত করবে?’
‘ ওরে নারে, এটা হল, দাঁড়া ছোট করে বলি’, বলে বইয়ের গল্প শুরু করলেন, আমি তো গিলছি, ভারী ভাল লাগছে, এমনি সময় মায়ের প্রবেশ,
‘ কি হচ্ছে শুনি? তুমি এত যে ভ্যাজোর ভ্যাজোর করছ, ও কি বুঝছে? অঙ্কে এত কম পেয়েছে, ওটা নিয়ে তো বসতে পার, নাকি?’
আমার তীব্র প্রতিবাদ, ‘ একটু একটু ভুল করেছি, তাতেই নম্বর কমেছে, অঙ্ক আমি পারি। বাবা বলেছে, “টু ডু মিসটেক ইজ নট আ মিসটেক, টু রিপিট আ মিসটেক ইজ আ মিসটেক”, কিই, বল বাবা?’
মা তখন, ‘বোঝও ঠ্যালা, কিছু বলার উপায় নেই, বাবা বলেছে ওই, বাবা বলেছে তাই। তা ঐ মিসটেকগুলো যে ঘন ঘন হচ্ছে’।
কেজি স্কুলের গণ্ডী পেরোলাম,বাবা একদিন স্কুটির পিছনে করে এক টিউশন সেন্টারে নিয়ে গেলেন। আমিও ধীরে ধীরে ভাল ফল করেই ক্লাসে উঠতে থাকলাম। আসলে সেই কাঁথা পাল্টানোর সময় থেকে স্কুলের ধাপ পর্যন্ত বাবা এত যত্ন করে সামলে নিলেন, মা বাবার উপর সব ছেড়ে দিয়ে নির্ভার থাকতেন।
*******
মা আর বাবার স্বভাবের মধ্যে এক রকম বৈপরীত্য ছিল, মা ছিলেন ঘোরতর সংসারী, সংস্কারী, বলা যায় একটু সাবেকি রক্ষণশীল গোছের। সে তার চাল চলন, পোশাক আশাক থেকে শুরু করে জীবন বোধে পর্যন্ত। চাকরি বাকরি করলেও চিরটাকাল শাড়িই পরেছেন। সেবার রাজস্থান বেড়াতে গেলাম,
‘ও মা, তুমি একটা সালোয়ার পরো না কেন, আমার বন্ধুর মায়েরা তো পরে বেড়াতে গেলে’।
‘না রে বাবা, এই বেশ আছি। যে যেমন পোশাকে স্বচ্ছন্দ, সেটাই তার স্টাইল’। এক কথায় মা থামিয়ে দিতেন আমায়।
পুজো আচ্চা আর বার ব্রত মা চিরকাল নিয়ম নিষ্ঠার সাথে পালন করে এসেছেন। বৃহস্পতি বারের লক্ষ্মীপুজোটা মা শত অসুবিধে বাধা বিঘ্ন এলেও করবেনই। এর জন্য স্পেশাল ফুল বেলপাতা সন্দেশের প্যাকেট আসত। বাবাও ছিলেন বেশ ভুলো প্রকৃতির, একেক দিন মা অগ্নিমূর্ত্তি হলে রাত এগারটাতেও বাবাকে দোকানে যেতে হত, আসত খানিক পচা ফুলের পাপড়ি। তখন, ‘ বেলপাতা আমপল্লব কই আ্য? একটা কাজ যদি ঠিক করে করতে পার। এই আমি যেদিকে চোখ না দেব….. ‘
কথা শেষ না হতে বাবা, ‘ তুমি নিজে আনবে এবার থেকে’..
এমন তপ্ত কথা চালাচালি ভাল লাগত না আমার। একটু বড় হয়েছি আমি, বলে ফেললাম, ‘উফ্ মা তুমি থাম, এনে তো দিল এত রাতে, একদিন বেলপাতা না হলে কি হয়েছে?’
‘সংসারে আমার একটা কথাও আর বলা চলবে না, একে রামে রক্ষে নেই, মেয়ে এখন দোসর হয়েছে’, মা প্রায় কাঁদোকাঁদো,দলভারী হয়েছে বলে..
আসলে বাবার একদম ঠাকুর দেবতায় ভক্তি ছিল না। ওসব পুজো আচ্চা নিয়ম নিষ্ঠার চেয়ে পুজো বলতে বাবা বুঝতেন উৎসব, আনন্দ এবং তা সকলকে নিয়ে। বাবার থেকে এই ভাবনা পরে আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল।
নিজে স্বনির্ভর হলেও সংসারের খরচা পাতি, এটা ওটার হিসেব, সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্যকর্মে মা একরকম নিস্পৃহ ছিলেন, তেমন কারো সাথে মেলামেশাই করতেন না। বাবা একাই সবদিক সামলাতেন।
মা মামাবাড়ির সমস্যাগুলো নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। তাদের সুবিধা অসুবিধাগুলোকে এত বেশি গুরুত্ব দিতেন, সেগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন, তার ছায়া পড়ত আমাদের উপর। আর ঠিক ততটাই উদাসীন থাকতেন আমাদের এ বাড়ির প্রতি। কোথাও একটা ব্যালেন্সিং এর তীব্র সংকট ছিল, পরে সংসার করতে গিয়ে বুঝেছি, দুদিকে ভারসাম্য করাটা সুখী পারিবারিক চিত্রের অন্যতম চাবিকাঠি।
আমি তো সারাদিন মায়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম, মা হাসপাতাল থেকে এসে চান সারতেন সারা বছর, মায়ের গায়ে তখন কী সুন্দর গন্ধ, আমি চাইতাম মা কখন আমায় কোলে টেনে নেবেন, আদর করবেন, সারাদিন কি করেছি খবর নেবেন। তা নয়, মা হয় নিজের ভাই বোনেদের সংসার নিয়ে, নয় হাসপাতালের কোন সমস্যা নিয়ে, নয় বাবার কোন কাজের খুঁত নিয়ে পড়ে যেতেন। আমিও এক সময় মুখ আঁধার করে পড়ার ঘরে ঢুকে পড়লাম। মা হয়ত ভাবতেন, বাবা সবটুকুই পূরণ করবে, সামলে নেবে, কিন্তু মায়ের সব অভাব বাবারা পূরণ করতে পারেন না, এটা মা বুঝতেন না।বড় হয়ে মনে হয়েছে, বাবাও একটু রিলিফ চাইতেন, এবং সেটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত।
ভীতু স্বভাবের মা নিজের শরীর নিয়েও অল্পেতেই কাতর হয়ে পড়তেন। সামান্য কিছুতেই অকারণে টেনশন করতেন।স্বভাবে একেবারে বিপ্রতীপে বাবার অবস্থান। খুব স্পোর্টিং, সদাহাস্যময়, প্রাণবন্ত ছিলেন বাবা, কোন সমস্যাকেই সমস্যা বলে মনে করতেন না, বরং যত কঠিনই হোক পরিস্থিতি, হাসিমুখে তার মুখোমুখি হওয়া বাবার সহজাত ছিল। বয়স বাবাকে কোনদিন কাবু করতে পারেনি, শরীরের যত্ন, ব্যায়াম সব দিকেই নজর ছিল ওনার। মুখের কথাই ছিল, ‘ নিজে ভাল না থাকলে আর পাঁচজনকে ভাল রাখা যায়না’।
উনি ছিলেন চিরতরুন।শুধু আত্মীয় স্বজন নয়, পাড়া প্রতিবেশি সকলের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন এক ডাকে। যেমন তীব্র সাহিত্যপ্রীতি ছিল, তেমনি খেলাধূলা, দেশ বিদেশের সাহিত্য, সঙ্গীত, রাজনীতি সবেতেই বাবার আকণ্ঠ পিপাসা ছিল। বাবার সংগ্রহে এত বই থাকত, একটা ছোট খাট লাইব্রেরি হয়ে যাবে। বন্ধু বান্ধবের পরিমণ্ডল একটু বেশিই প্রশস্ত ছিল। বাঙালি মধ্যবিত্তের তকমা ফুৎকারে উড়িয়ে বাবা গলায় দু পাত্তর ঢালতেন অবরে সবরে, তবে সেটাও ছিল সীমিত, নেশা নয়। আসলে বাবা মানুষটা বড্ড ডিসিপ্লিন্ড ছিলেন, তাই কোন রকম নেশার খপ্পরে পড়া বাবার চরম অপছন্দ ছিল।
আরেকটা কথা ছোট থেকেই বাবার মুখে শুনে আসছি, ‘ থিঙ্ক গ্লোবালি, অ্যাক্ট লোকালি’। চিন্তায়, মননে বাবা যতটা উদার, প্রশস্ত মানের ছিলেন, মা ছিল ঠিক ততটাই সীমাবদ্ধ, শুধু হাসপাতাল আর বাড়ির গণ্ডীটুকুই ছিল মায়ের পৃথিবী।
দুজনের স্বভাবের উল্টো অবস্থান হেতু কখন যেন পারস্পরিক সম্পর্কে শৈত্য এসে পড়েছিল, আমি কিছুটা বুঝতে পারতাম বড় হতে হতে, তবু সময় বয়ে যাচ্ছিল নিজের গতিতে।
*********
বিয়ে করেছি নিজের পছন্দে, আমাদের মত উচ্চবংশের গৌরব যার মাথায় নেই। কিন্তু তার চরিত্র, মেধা, স্বভাব মাধুর্য আমায় মুগ্ধ করেছিল। একদিন অফিস ফিরে চা খেতে খেতে দুজনের সামনেই বলে ফেললাম, ‘ আমি একজনকে পছন্দ করেছি, বিয়ে করব’।
বাবা সশব্দে এমন হাসলেন, চা চলকে গেল, ‘বলিস কি, তা সে এই গ্রহের তো?’ বন্ধুর মত বাবার সাথে আমার ঠাট্টা,তামাশা লেগপুলিং চলত প্রায়ই।
‘ব্রাহ্মণ তো, কি রে? মায়ের ভারী গলা।
আমি জানতাম বাবা এসবের উর্দ্ধে, কিন্তু মা মেনে নিতে পারবেন না। তবু আমার জেদ আর যুক্তির কাছে সব নস্যাৎ হল।
আমার বিয়ের পর ওনারা আরো নিজের মধ্যে ডুবে রইলেন। দুজনেই ততদিনে রিটায়ার করেছেন, মায়ের শরীরটা আগেই ভাঙতে শুরু করেছিল, এবার আরো নানা উপসর্গ দেখা দিল।
আজ ওটা, কাল ওটা মায়ের লেগেই থাকল, সংসারের বেশির ভাগ কাজটুকুও মাইনে করা লোকেদের ওপর বর্তাল। মামাতো ভাইবোনগুলো একটাও ঠিকমত মানুষ হয়নি,ফলে দাদাদের সংসারের ফাঁকফোকড় গুলো পূরণ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন মা। আর এদিকে বাবা নিজের পছন্দের জিনিসগুলোকে বেশি করে আঁকড়ে ধরলেন, সোসাল মিডিয়াতে লেখালিখি শুরু করলেন। বছর দুয়েকের মধ্যে বাবার দুখানা বইও প্রকাশ হল।
********
এমনই এক সময় প্রায় সায়াহ্নে এসে হঠাৎ করে বাবা যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, রোজই নিয়মিত ভাবে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেন। মা বাবার সম্পর্কের মাঝে যে শীতলতা ছিল তা আরো প্রকট হল। বাবার দৈনন্দিন যাপনে একটা বড়সড় বদল এসেছে এটা মায়ের চোখে পড়েছিল বটে, কিন্তু তা নিয়ে তেমন কোন হেলদোল ছিল না, প্রথমে একটু উষ্মা প্রকাশ করলেও পরে নিরুত্তাপই ছিলেন। সম্পর্কের উষ্ণতা কমে গেলে হয়ত প্রত্যাশারও মুক্তি ঘটে। অথবা এমনও হতে পারে, বাবা নিজের মত করে কিছু একটা বুঝিয়েছিলেন মাকে, আমি জানিনা।
এ তো গেল মায়ের দিক, বাবার এত বড় বন্ধুবৃত্তের কাছে কি প্রতিরোধের দেওয়াল তুলেছিলেন জানতে চাইনি। আমি বাবার মত বরাবর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ছিলাম। তবু অঘটন ঘটল। একদিন সকালে আমার বর অফিস বেরিয়েছে, আমিও তৈরি হচ্ছি, শাশুড়ি মা ঘরে এলেন, হাবে ভাবে বুঝলাম কিছু বলতেই এসেছেন।
সময় নষ্ট না করে আমিই বললাম, ‘কিছু বলবেন? বলে ফেলুন, এখুনি বেরোব, দেরী হয়ে গেছে’।
‘মিতু, তোর বাবার সম্পর্কে আজকাল কী সব শুনছি…’
‘ কী সব বলতে!’
‘ ঐ একজন মহিলাকে নিয়ে আরকি, ওনার বাড়ি যাতায়াত, এই বয়সে এসব কেমন কথাবার্তা, ভাল লাগে না শুনতে’।
‘ভাল না লাগলে শোনেন কেন? যখন কেউ বলবে, উঠে চলে আসবেন’..কথাগুলো রাগত স্বরে বললাম, আসলে প্রচণ্ড অপমানিত হলাম, অন্তরাত্মা কেমন ব্যাথাতুর হয়ে উঠল, চোখ দুটো রাগে দুঃখে জ্বালা করতে থাকল। বেরিয়ে পড়লাম চটপট, মনস্থির করলাম আজই অফিসের পর বাবার মুখোমুখি হব, ও বাড়ি যাব।
অফিসে মন বসাতে পারছি না, দু একজন সহকর্মীর সাথে অকারণে মিসবিহেভ করে ফেললাম। কোন রকমে অফিস আওয়ার্স শেষ করে ট্যক্সি নিলাম। আমার সত্যিকারের ফ্রেন্ড ফিলোজফার আর গাইড বলতে আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ আমার বাবা, এ কথাটা চিরকালীন সত্য, আমার বরও সেটা জানে এবং সম্মানের সাথে আপোষ করে। ছোটবেলা থেকে আজ অবধি কোন কিছুই বাবার থেকে গোপন করিনি, সব সময় বাবাকে কাছে পেয়েছি। এত স্পিরিটেড একজন মানুষ এই বয়সে আহাম্মকের মত কোন বেঠিক কাজ করবেন, মানতে পারছি না। তবু মন বলে এক অদ্ভুত জিনিসের দাসত্ব করতে হয়, বড় বিচিত্র তার চলন।
গেট খুলতে চোখ পড়ল দোতলায় বাবার পড়ার ঘরে আলো জ্বলছে। অন্যদিন আগে মায়ের সাথে গল্প গুজব করে তবে বাবার কাছে যাই, আজকাল বিয়ের পর মায়ের সাথেই বেশি কথা হয় সংসারের। আজ সোজা বাবার ঘরে, চেয়ারটা সশব্দে টেনে বসতেই,
‘ কি রে, কখন এলি, চা খেয়েছিস?’
‘না, ভাল লাগছে না’
‘ কি হয়েছে তোর, অশান্ত হয়ে আছিস, কোন প্রব্লেম না কি?’
‘ হ্যা প্রব্লেম তো বটেই, ইয়ে মানে..’
‘ ইতস্তত করছিস কেন, হয়েছেটা কি বলবি তো, অফিসে কোন…’
‘ওহহহহ, অফিস টফিস কিছু না, আগে বলতো লোকে কি বলছে তোমাকে নিয়ে যাতা’৷ কথাট বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়েছি, কেন জানি বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কি প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যে, তবু সত্যিটা আমায় জানতেই হবে।
বাবা আস্তে করে চশমাটা খুললেন, টেবিলে রাখলেন, তারপর ধীর গলায়,
‘ আমি জানতাম তুই এ প্রশ্নটা করবি, ভাবছিলাম কবে করবি,
বোস তো কাছে, একটু শান্ত স্থির হয়ে বোস, বলছি’..
সেদিন কোন কিছুই গোপন করেননি বাবা। জানলাম, রিক্তা বোস নামের এক ভদ্রমহিলার সাথে বাবার আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়েছে। উনি একজন স্পোর্টস পারসন, বাস্কেট বল খেলেছেন ন্যাশনাল লেভেলে, দলকে দেশের হয়ে নেতৃত্বও দিয়েছেন কবার আন্তর্জাতিক স্তরে। বর্তমানে খেলার সূত্রেই একটা গার্লস স্কুলে পার্ট টাইম প্লে টিচার। পড়াশুনার ডিগ্রী বলার মত কিছু নয়, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত।
উনি চেতলা কলোনীতে থাকেন, বিয়ে করেননি, এক বোন ও বিধবা মাকে নিয়ে সংসার। চাকরি আর প্রাইভেটে ‘সাথী সংঘ’ ক্লাবে বাস্কেটবলের কোচিং করে সংসার চালান।
ফেসবুকে আলাপ, বাবার লেখার পাঠিকা। উনি নিজেও লেখেন ওনার খেলোয়াড় জীবনের কথা, দেশ বিদেশের নানা অভিজ্ঞতার কথা, ছাত্র ছাত্রীদের কথা। বুঝলাম, সাধারণ আটপৌরে জীবনের গল্প থেকে এসব লেখা একটু বেশি রোমাঞ্চকর, এক ধরণের পাঠকের কাছে বেশ গ্রহনযোগ্যতা, তাই হয়ত সে সব প্রাণোচ্ছল, স্বতঃস্ফূর্ত, উদ্দীপনাময় লেখাগুলো বাবাকে আকর্ষণ করেছিল, সেই সূত্রেই আলাপ এবং হৃদ্যতা।
রিক্তা দেবী মানুষটা অত্যন্ত প্রাণবন্ত, নির্ভীক, ডাকাবুকো ধরণের। বহু ওঠাপড়া, লড়াই, আর দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছেন বলেই কোন সমস্যাকে সমস্যা বলে মনে করতেন না। যে কোন কঠিন পরিস্থিতি হাসিমুখে মেনে নেওয়ার একটা সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। ভিতরে ভিতরে লড়াকু, জেদি আর জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া এই ভাবমূর্ত্তিই বাবার ভাল লেগেছিল। বন্ধ ঘরে সেদিন প্রায় ঘণ্টা খানেক কথা হয়েছিল, সব শোনার পর বাবাকে দাগী আসামী ভাবতে পারিনি। বাবা বললেন, ‘ তুই একদিন যাস ওদের বাড়ি, আলাপ করে আসিস’।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলাম, প্রতিদিন বাবা গেট অবধি আসেন, আজ এলেন না, চেয়ারে স্থবির হয়ে বসে রইলেন। হয়ত বাবার এখন একা থাকাটাই বেশি দরকার।
সিড়ি দিয়ে নামতেই মা, ‘তুই?? কখন এসেছিলি? সাড়া করিস নি, মুখটা এত শুকনো, কি হল?’
মায়ের এক ঝাঁক প্রশ্নের একটাও উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না, খুব জোরে জড়িয়ে ধরলাম। সময়টা একটু দীর্ঘায়িত হল বলে মা বুঝলেন আমার মনের অস্থিরতা, পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, এই প্রথম বুঝি মায়ের কাছে আমার মনের পীড়ন প্রকাশিত হল। যদিও মা কিছুই জানতে চাইলেন না, মায়ের তো সেই অভ্যাসটাই তৈরি হয়নি, তাই আজও পারলেন না আমার ব্যথা বুঝতে।
মায়ের থেকে মুক্ত হয়ে ‘আজ আসি মা’ বলে বেরিয়ে এলাম, মা নিজে এলেন গেট পর্যন্ত। আজ কেন জানি, মায়ের জন্যও এক প্রকার কষ্ট হচ্ছিল কোথাও।
********
ছোট থেকেই দেখে আসছি মা কারণে অকারণে বাবাকে দোষী ঠাওরাতেন, ছোট খাট ব্যাপারেও সমালোচনায় বিদ্ধ করতেন, কেবলই খুঁত ধরতেন, মায়ের প্রতিষ্ঠিত বিত্তশালী জামাইবাবুর সাথে অমূলক তুলনা হত আমার পেশায় শিক্ষক এবং ভাবাদর্শে চলা বাবাকে। মা যে বাবাকে মন্দবাসত, তা নয়, মায়ের ভালবাসাটা ধরণটাই ঐরকম ছিল। বড় হওয়ার পর থেকে আমি সামলে নিতাম দুজনকে, বাবা সমঝদার ছিল বলে চুপ করে সয়ে যেত, মা নরম স্বভাবের বলে মায়ের মত করে বোঝাতাম।
আজ বুঝতে পারলাম, বাবা বহু দিন ধরে সবাইকে সামলাতে সামলাতে মনে প্রাণে ক্লান্ত, ওনার নিজের জীবনেও একটা চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে, আমরা সবাই ভুলে গেছিলাম। এই অবেলায় পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা সময়টুকুতে রিক্তা বোসের মত একজন ডেয়ারিং মহিলার যাপন, স্পোর্টিং মনোভাব, সদাপ্রসন্ন তরতাজা দৃষ্টিভঙ্গী কোথাও যেন বাবার স্ট্রেস রিমুভ করে, বাবাকে একটু হলেও অক্সিজেন দেয়। তাছাড়া জীবনের এই শেষ অঙ্কে এসে কারো থেকে তো নতুন করে কিছু চাওয়ার নেই বাবার।
সারাটা জীবন ধরে বাবাই মানিয়ে নিয়েছেন সর্ব ক্ষেত্রে, আমাকে সুশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করাই বাবা পাখির চোখ করে রেখেছিলেন, সে স্বপ্ন সার্থকই বলা যায়। বয়সের ভারে বাবা অনেকটাই ম্রিয়মাণ, আগের মত সেই বেপরোয়া অ্যাটিটিউডও স্তিমিতপ্রায়, আজ যদি উনি নিজের মত একটু ভাল থাকতে চান সংসারের সব দায় দায়িত্ব সেরে, আমার ন্যায় অন্যায় বোধ একাকার হয়ে যায়৷
তদুপরি, বাবা তো মায়ের প্রতি, সংসারের প্রতি, সমাজের প্রতি কর্তব্য, দায় দায়িত্ব থেকে পিছপা হননি, বরং সব সময় মায়ের পাশে থাকতেন, মা অসুস্থ হলে ওষুধ পত্র থেকে ডাক্তার ভিজিট, রাত জেগে সেবাটুকুও বাবা করতেন নিরলসভাবে।
********
বাবার থেকে রিক্তা বোসের ঠিকানাটা নিলাম একদিন, আসলে আমি তো বাবারই মেয়ে, সত্যের মুখোমুখি হতে সব সময়ই আগ্রহী, বাবা হাসিমুখেই দিলেন।
আমিও অফিসশেষে একদিন চেতলা মুখী, লোকমুখে ঠিকানা শুনে যত এগোচ্ছি ততই যেন ভেতর থেকে একটা অদম্য কৌতূহল উঁকি মারছে। এত দরিদ্রপল্লী, বস্তি শব্দটা বলতে আমার সম্ভ্রমে কোথাও একটা লাগছে, এই রকম অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে আমার বাবা আসেন যে পরিবারে তারা কেমন মানুষ, আর যিনি মূল আকর্ষণ তাকে তো চাক্ষুষ করতেই হয়।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, সরু ইট পাতা রাস্তায় যদিও সব স্ট্রিট ল্যাম্পগুলো জ্বলেনি, কোথাও কুবকুব আঁধার, কোথাও বা আলো সামান্য। কয়েকজন অল্প বয়সী ছেলে গুলতানি করছিল, জিজ্ঞাসা করলাম রিক্তা বোসের বাড়িটা কোনদিকে। ছেলেগুলোর ত্বরিত সাহায্যে মনে হল ওনার একটা জনপ্রিয়তা আছে। নির্দেশমত একটা টালির চালের ঘরের কাছে এসে কলিংবেল বাজালাম, পরনে সাদা থানের এক বৃদ্ধা এসে আমার পরিচয় এবং কাকে চাই শুনে অন্তর্হিত হলেন।
একটু পর প্রায় পাঁচ আট হাইটের দীর্ঘাঙ্গী ঋজু টানটান সৌষ্ঠবের সালোয়ার কামিজ পরিহিতা এক মহিলা এলেন, কতই বা বয়স, আমার থেকে বছর দশেকের বড় হয়ত ম্যাক্সিমাম। শ্যাম বর্ণা, চাপা নাক, বয় কাট চুল, অবিন্যস্ত ছোট চুলগুলোয় কপাল ঢাকা, উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, আর ঝকঝকে দাঁতের চওড়া হাসি। গোটা শরীরি ভাষায় ও উপস্থিতিতে কেমন গুড মর্নিং ফ্রেশনেস, সপ্রতিভ গলায়, ‘তুমিই তো দীপ্তদার মেয়ে, তাই না? আমি তো তোমাকে চিনি খুব ভাল করে’।
একেবারে হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটা ছোট ঘরে, একটা প্লাসটিকের চেয়ারে বসিয়ে ‘আসছি, এক মিনিট’ বলে চলে গেল। আমি সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম যতটা চোখ যায়। সিঙ্গল বেডের বিছানায় একটা কমদামী রাজস্থানী চাদর পাতা, পাশে একটা শোকেসে অজস্র কাপ মেডেল, দেওয়ালেও বেশ কিছু অল্প বয়সের গলায় মেডেল ও নানা পুরস্কার হাতে ছবি। পাশে একটা নড়বড়ে টেবিলের ওপর খাতা বই, কলম। কিছু স্কুল কলেজ লেভেলের বই ছাড়াও আছে নানা গল্পের বই, জীবনী ইত্যাদি। এ ঘরে আসার আগে একটা বড় ঘরের মধ্যে দিয়ে এসেছিলাম, সেখানে টিভি দেখছিলেন ঐ বৃদ্ধা ও শাড়ি পরা আধপাকা চুলের পৃথুলা এক বয়স্ক মহিলা।
‘এবার জমিয়ে গল্প করা যাবে’, দুটো চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকলেন রিক্তা বোস। সামনের তক্তপোশে বসলেন, কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি,
‘কবে থেকে বসে আছি তোমার জন্য জানোতো’
ওনার সপ্রতিভতায় আমার জড়তা কাটল একটু একটু করে।
‘এই কাপ মেডেলের ছবিগুলো সবই আপনার?’
‘হ্যাঁ, তখন স্কুলে পড়ি আরকি’
‘এত বই, নানা রকমের, কে পড়ে’,
‘প্রাইভেটে গ্রাজুয়েশনটা করব, তাহলে চাকরিতে একটু আয়বৃদ্ধি হবে আরকি, সবই দীপ্তদার অনুপ্রেরণায় বলতে পার, উনিই আমাকে পড়ান, আর পড়ার বাইরের বইগুলোও ওনারই দেওয়া’।
আমার বিস্ময়ের পারদ ক্রমাগত উর্দ্ধমুখী। বাবা তাহলে এজন্যই এখানে আসেন নিয়মিত, এত সময় দেন, কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, এত ছাত্র ছাত্রী, এত পরিচিতি, তবুও কেন ইনি? আরেকটু গভীরে যেতে চাইলাম কথায় কথায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওপার বাংলা থেকে থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে আসে একটি পরিবার, রিক্তাদেবীর বছর দশেক বয়সে বাবা কিডনির অসুখে মারা যায়, ছোট বোনটি জন্মেই কঠিন অসুখে পড়েছিল,সরকারি হাসপাতালের দাক্ষিণ্যে প্রাণটুকু পেয়েছে এই পর্যন্ত, নিজের কাজটুকু দীর্ঘ সময় নিয়ে করতে পারলেও আসলে সে জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। বাবা মারা যেতে এক সময় মা লোকের বাড়ি কাজ নেয়, ছোট থেকেই খেলাধূলায় তুখোড় ছিল রিক্তা, হাইটটা ভাল থাকায় পাড়ার ক্লাবে বাস্কেটবলের অনুশীলন নিয়ে ধীরে ধীরে তার লম্বা যাত্রা, এরপর একে তাকে ধরে একটা প্রাইভেট স্কুলে পিটি টিচার আর ছোটবেলার ক্লাবে এখন কোচিং করায়। পরিবারে একমাত্র রোজগেরে উনি একাই।
‘বিয়ে করেননি কেন?’, একটু রুক্ষ হয়েই প্রশ্ন করলাম আচমকা।
খুব জোরে হেসে উঠলেন রিক্তা বোস,
‘সময়ই পেলাম না, তারপর মা বোন, এদের সাথে এমন জড়িয়ে আছি, নতুন কোন সংসার ভাবতে পারিনি’।
‘কোন পুরুষ কি রাজি হয়নি, আপনার এত সুন্দর চেহারা, এত গ্ল্যামারাস জীবন!’…একটু নির্লজ্জ হয়ে বলে ফেললাম,
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে, …
‘গ্ল্যামারাস বলছ কি বিদ্রুপ করে? মাঠের মধ্যেই জয় পরাজয়, মাতামাতি, আদিখ্যেতা, তারপর তো আমাকে ফিরতে হয় এই এঁদো গলিতে, এই দশফুট বাই দশফুটের জীর্ন ঘরে, আমার মা যতই আমার মেডেলটাকে আঁচল দিয়ে আদর সোহাগ করে মুছে শোকেসে তুলে রাখেন না কেন, আমি জানি ওতে চিঁড়ে ভেজে না, মাস গেলে যা পাই তাতেই আমাদের খাওয়া, পরা, পোশাক, আমোদ আহ্লাদ। ঐ যে দেখছ না, মায়ের কোলের পাশে বসে যে মানুষটা ওর বয়স মাত্র ত্রিশ, অথচ দেখে মনে হয় কত বয়স্ক, সবাই বলে বড় কোথাও চিকিৎসা করাতে, কোথায় পাব বলত , আমার সামান্য আয়।’
একটু থেমে আবার নিজস্ব ভঙ্গীতে,
‘কি যেন বলছিলে, পুরুষ!বিয়ে!শোন তবে, বিয়ে করার লোক এসেছে বইকি, কিন্তু তাদের প্রত্যাশা অনেক, তারা আমাকে চায়, আমার মা বোনের দায়িত্ব নয়। আমি চাইনি ওদের ছেড়ে যেতে, নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে করিনি।’
একটু থেমে আবার স্বগোতক্তির মত করে,
‘এমনি করেই কেটে যেত, যদি না তোমার বাবার সাথে আলাপ হত। দীপ্তদা একদম আলাদা মানুষ, এটা ঠিক, বয়সে আমার চেয়ে বেশ অনেকটাই বড়, তবু উনিই আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন, এই যে পরীক্ষা দেব এর জন্য সাহস টা উনিই দিয়েছেন, আমাকে প্রচুর সাহায্য করেন। শুধু বইয়ের পড়াই নয় জান, কত দেশ বিদেশের গল্প, সাহিত্য, ফিল্ম নিয়ে কথা হয়, আমি কেবল হাঁ করে গিলতে থাকি’।
আমি একটু বোকা হয়ে গেছি, আমার মুখে কোন কথা নেই, মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছি ওনার কথাগুলো।
উনি বলে চললেন, ‘তুমি যে আসবে আমি জানতাম, দীপ্তদাই বলেছিল। জানো, আমার মা দীপ্তদাকে খুব সম্মান করেন, আমি তোমার মাকেও খুব শ্রদ্ধা করি। তোমার বাবার থেকে যতটুকু শুনেছি, তুমি আমার মুখোমুখি হতে পারবে, কিন্তু তোমার মা হয়ত পারবেন না, তাই দীপ্তদা তোমাদের বাড়িতে আমাকে কখনও যেতে বলেননি’।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ছিলাম সে বাড়ি, ফেরার সময় ঐ বৃদ্ধাকে প্রণাম করতে গেলে কপালে চুমু খেয়ে বাঙাল উচ্চারণে বললেন, ‘আবার আইবা কেমন’। ঘর থেকে বেরিয়ে গলির মোড়টুকু অবধি এসেছিলেন রিক্তা বোস, বিদায় নেবার আগে আমি ওর হাতটা ছুঁয়ে এসেছিলাম, অটোয় বসে বহুদিন ধরে অস্পষ্ট কিছু ভাবনা সহজ হয়ে ধরা পড়ল, কোথাও যেন বাবার জন্য একটু হলেও গর্ব হচ্ছিল।
*******
এরপর রিক্তা বোসের সাথে আমি আর দেখা করিনি, যাইও নি ওদের বাড়ি। তবে ওর ভালভাবে পাশ করার,খবর পেয়েছি, আনন্দ প্রকাশ করে ফোনও করেছি। এরপর গঙ্গা দিয়ে কত জলই না বয়ে গেছে, আমার কোল আলো করে এসেছে সন্তান, চাকরি, পরিবার, সন্তান লালন নিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি, পলে পলে বুঝতে পারছি মা বাবার ঋণ কতখানি। বাবা পুরুষ হয়েও কেমন করে আমাকে বড় করেছেন, মায়ের কাজগুলোও করেছেন অনায়াসে, নিজে মা হবার পর আরো হৃদয়ঙ্গম করেছি।
মা আজকাল প্রায়ই অসুস্থ হয়, দিনে রাতে অনেকগুলো করে ওষুধ খেতে খেতে ক্রমশ আরো অকর্মণ্য, মেজাজটাও কেমন হারিয়ে ফেলেন অকারণে। বাবা তুলনায় সুস্থ, সামান্য সর্দি কাশি ছাড়া বাবার তেমন কোন রোগ জ্বালা ছিল না, নিজের পছন্দ মত জীবন কাটালেও কখনও বেহিসেবী বেসামাল হয়ে পড়েনি, দুজনের জন্যই আমার উৎকণ্ঠার শেষ থাকত না, তবুও কেন জানি মনে হত, বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকবেন না, বাবা পড়ে থেকে কারো থেকে সেবা নেবেন না, বাবার জন্য একটু বাড়তি ভয় হয় মনে মনে।
শেষপর্যন্ত বাবার হার্টের সমস্যা দেখা দিল, বয়েসটাও হয়েছে, এগুলো তো স্বাভাবিক। অপারেশন হল, কিন্তু পোস্ট অপারেশনের ধকল বাবার শরীর আর নিতে পারল না, ডাক্তার আমাকে বলে দিয়েছিলেন বাবার তৎকালীন শারীরিক অবস্থার কথা, আমাকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতেও বলেছিলেন। আমার নিজের পরিবার এবং মাকে নিয়ে রোজই পালা করে হাসপাতাল বাড়ি করতাম এবেলা ওবেলা। মা গিয়ে বাবার পাশে বসে থাকে চুপচাপ, কখনও চোখ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ে জল।
সেদিন দুপুর থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, মাকে নিয়ে পৌঁছেছি বিকেলে, বাবা মায়ের হাতটা ধরার জন্য বাড়াতেই মা ঝুঁকে পড়ল বাবার মুখের উপর, ‘ কিছু বলবে? কষ্ট হচ্ছে?’ তখনও ব্রেনটা ঠিকঠাক কাজ করছে, আমাদের কিছু কথা বুঝতেও পারে, মনে হল বাবা কিছু বলতে চায়। মাকে পাশে সরিয়ে আমি এগোলাম, চোখে যেন কিছুর ইশারা, মনে হল কাউকে হয়ত দেখতে চান।
বাবার মনোজগতের ভাব তরঙ্গ আমার সাথে মিলবে না, তা কি করে হয়! ফোনে খবর দিয়েছিলাম রিক্তা বোসকে, বলেছিলাম বাবার সত্যিকারের শারীরিক অবস্থার কথা। উনি যদিও নিয়মিত অপারেশনের খোঁজ খবর রাখতেন আমার থেকে, আমিও এক ধরণের প্রবোধ দিয়ে এসেছি এতদিন কিন্তু মা থাকতেন বলে উনি একদিনও হাসপাতালে আসেন নি।
আমার কথায় পরদিনই অস্থির হয়ে ছুটে এসেছিলেন হাসপাতালে, বাবার কেবিনে যেতে বললাম, ইতস্তত করছিলেন, কিন্তু আমিই জোর করে ভিতরে যেতে বললাম। মা কতটা কি বুঝেছিল, আন্দাজ করতে পেরেছিল কিনা জানিনা, তবে কোনরকম প্রশ্ন করেননি, আসলে শোকে বড়ই মুহ্যমান ছিলেন। রিক্তা বোস একাই ঢুকলেন, ফিরেও এলেন কিছুক্ষণ পর, আমার কাছে এসে বললেন, ‘তোমরা যাও, আমি এবার আসি’। শ্রান্ত, অবসন্ন এলোমেলো একজন মানুষ শ্লথ পায়ে লিফটের দিকে এগোলেন, বুকটা আমার মোচড় দিয়ে উঠল, কি পেলেন এই মহিলা সারাটা জীবন! সম্বিত ফিরে বাবার ঘরে গিয়ে দেখি, বাবা ততক্ষণ মুক্তি পেয়েছেন।
বাবার প্রয়াণের সাথে সাথে রিক্তা বোসের সাথে সম্পর্কটা আমি আর টেনে রাখিনি, উনিও করেননি ফোন, আমিও নয়। আসল সুতোটা যখন ছিঁড়ে গেছে, তখন মিছেমিছি আর কেন এগিয়ে নিয়ে যাব পুরনো রেশকে…এরপর নিঃসঙ্গ মা শেষ দিন পর্যন্ত আমার সাথেই থেকে গেছেন।
পুরনো কথার জাল বুনতে বসে সত্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধই থাকলাম। সবার মুখে শুনি, আমি নাকি বাবার সার্থক উত্তরাধিকার, বাবার প্রতিবিম্ব, স্বভাবজাত অনেক বৈশিষ্ট্যই জিনগত ভাবে আয়ত্ত করেছি। বাবা ছিলেন নির্ভীক, সত্যকে কখনও অস্বীকার করেননি। আমিও আত্মজীবনীর এই অধ্যায়টা গোপন করলাম না।
–~০০০XX০০০~–
(শারদীয় নীরজনা পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত)