কথকতার আড়ালে
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
……………………………………
ভূমিকা/ মহানট গিরীশ চন্দ্র ঘোষ ১৯১২ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ঠিক একই বছরে অভিনয় থেকে চিরবিরতি নিয়েছেন মহাঅভিনেত্রী নটী বিনোদিনী। খ্যাতি আর তার মোহ এঁদের গুরু-শিষ্যা এই দুজনকেই অঢেল দিয়েছেন সেই পরম কারুণিক। এমনকি গলায় পড়িয়েছেন জগৎচন্দ্রহারের দৈব আশীর্বাদের ঐশী মালাটিও।
তবু এই দুই মানুষ একে অপরের থেকে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিলেন জীবনের শেষভাগে এসে ।
কেন যে এই সিদ্ধান্ত নিলেন ওঁরা এ বিষয়ে ইতিহাস নীরব।
……………….
আচ্ছা তবে সত্যি কেমন হত? যদি এই গুরু-শিষ্যার মধ্যে শেষবার একটু মনের কথা’অকপটে বলবার সুযোগ হত?
তাহলেও কেবলই কি গরল মন্থন হত? সবকিছুর শেষে এসে একবারও সহজগম্যতার ফল্গুস্রোত ওঁদের মধ্যে একটুও বইতো না?
কোন কথাটা বলতে গিয়েও হয়তো আর বলে যেতে পারেনি পরস্পরকে এই দুই যুগন্ধর?
না হয় কল্পনায় আখরযাপনই হোক তবে!
………………..
গিরীশ: সময় যে দেকচি এসে এবার কড়া নাড়ছে। নাহ্ ! নাহ! ঠিক যেন কড়া নাড়া নয়! এ যেন তাঁরই ডাক…আহ্ আহ্বান ! অনন্তলোক থেকে তিনিই আবার হাসি মুকে ডাকছেন যেন! হে মৃত্যু তুমি কি এতটাই পরম আর দয়াবান? আমায় তাঁর কাছে নিয়ে যেতে চাইছ?
প্রমোদিনী: আহা! আর অমন করে ছটফট্ করবেন না যেগো! কষ্ট হবে যে আপনার! একটু শান্ত হন দিকি! একোন দানী’কে একবার ডেকে আনব কি ? তার আগে মিছরি আর বাতাসা দিয়ে এট্টু জল খান দিকি! এ..এই যে রেকাবি আর গেলাসটা এগিয়ে দিচ্চি..এই যে…..
গিরীশ: তুমি তো জানো প্রমোদ! গিরীশ ঘোষ কখনো মরতে ভয় পায় না! সবার শেষে খালি ওঁর পাদপদ্মটি স্মরণে আসলেই..জানি তো সব জ্বালা জুড়োয়! এসব নরেন থাকলে ঠিক তোমাদের এসব বুঝিয়ে দিতো ! সেও তো কবেই….
খালি এখন মা’জননীকে একবার বড় দেখতে ইচ্ছে করছে! হ্যাঁ গো! কালী’ভায়া সেই বিদেশ গেচিল ! ওখান থেকে এখনো ফেরেনি না গো?
ইদিকে রাখাল, শশী, মাস্টারমশাই…সব গুরুভায়েরা ওঁকে যেন এক্ষুণি আমার ভীষণ অসুখ করেছে এই.. খপরটা আবার না দেন!
আহ্…আহ্….মাথায় বড্ড ব্যথা কচ্ছে!
গলাটা পর্যন্ত শুকিয়ে আসচে! উফফ্! সেও যদি…হ্যাঁ সেও যদি আসত…জানি সে আর আমার কাচে মুখ দেকাতে আসবেনা। তাও…!
প্রমোদিনী: আপনার দলের অমৃতবাবু সবাইকে আপনার অসুখ করেচে সে সব খপর ইতিমধ্যেই দিয়েচেন ! তাই তো সবাই দিনরাত্তির আপনার কতা ভেবে ভেবে অস্থির! কিন্তু আপনি যেন তবে আর কার কার কতা বলছেন?
গিরীশ: নাহ্ কিচু না! প্রলাপ বকচি বোধহয়। ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দাও গে! আমি ঘুমুব ! একটু একটু তন্দ্রাঘোর যেন আসচে।
…………….
(নেপথ্যে স্বপ্নচারণের মতো)
বিনি: মাআআআস্টআআআর মশাআআই! এই যে এএএএ! দেকুউউউন তো আআআআমিইইইইইইই ! এই তো দেকুন একবারটি….. আমিইইই এসেছিইইইই!
“নম: শম্ভবায় চ ময়োভাবায় চ
নয়: শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ
নম শিবায় চ শিবতরায় চ”…মনে আচে আপনার? আপনি দক্ষযজ্ঞ ‘পালা মহড়ার সময় রোজ এসে মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে আরোও কি সব যেন বলে উঠতেন! সে সব কিচুই আআআআমিইইইইই ভুলিইইইইইনিইই….!
গিরীশ: ওহ্ বিনি! এ কিরে তুই এলি নাকি র্যে! তাহলে তোর গলাটা এত দূর থেকে আজানের মত শোনাচ্চে কেন? আমি কি কালা হয়ে যাচ্চি না তুই হঠাৎ চোঙা মুকে কতা কইছিস্ ! আয় ! আয়! বোস্! কদ্দিন দেকিনি তোকে রে! যদিও তোর ওপর খুব রাগ হচ্চে কিন্তু ! আবার যে এসিছিস্ তাই দেকে আনন্দও হচ্চে!
বিনি: কেন! মাস্টারমশাই! আমার ওপর আপনি শুদুশুদু একোনো রেগে আচেন? ছি!ছি! আমি কি আপনার অভিমানের যোগ্য? বলুন তো দেকি? আপনাকেই আজীবন গুরু মেনেচি তা কি আপনিও চাইলে কখনো ভুলতে পার্বেন?
গিরীশ: হ্যাঁ রে! তুই আজকাল থ্যেটারে আসা ছেড়ে দিয়েচিস্ শুনচিলুম? আমি না হয় অসুখ বেড়েচে বলে কদিন আর ও পাড়ায় যাইনেকো ! একোন যদিও আর ওসব ভালই লাগেনা কো আর! তাও উনি “লোকশিক্ষে” বলতেন কিনা, তাই পুরোটা বন্ধ করিনি ! কিন্তু তুই?
শুনলুম এমনকি তিনকড়ি’কেও খুব হিংসে কচ্চিস নাকি? তুই কি জানিস না? ও ভাল অভিনয় জানলেও তুই তো আসলে তুইই? তাই না রে?
অমৃতও সেদিন দুঃখু করে বলছিল যে ওর সাথে দ্যাকা না করে তুই দরজা থেকে গুরুতূল্য লোকটাকেও নাকি ফিরিয়ে দিয়েচিস্? এত বড় দেমাক হয়েচে তোর?একোন এর জবাব দে দিকি?
বিনি: তিনু’কে হিমসে করব আমি? ভাল বলেচেন! আপনি গুরু আমার। আপনার কর্মফলেই তেনার শ্রীচরণ একজন সামান্যা বাজারের মেয়েমানুষ হয়েও যে ছুঁতে পেরিচি!
আর সেই আমি! হিমসে কর্বো তিনু’কে! তাছাড়া আপনি একোন অসুস্থ ! আপনাকে তাই আর এসব কতা আজ আর বলতে চাইনি।
আসলে আমি-ই “এক্টো”করা ছেড়ে দিচ্চি যে। আমায় আর কোনো দিন আর “এস্টেজে” দেকতে পাবেনেনা নাকো! আমি আর ওমুখো হবোই না। আসলে অনেকদিন তো এসব নকলনবিশি করে খেলুম! তাই আর নয়! এই
অধমকে মার্জ্জনা করবেন গুরুদেব!
গিরীশ: অ্যাঁ! কি বললি! তোর এত বড় সাহস? তুই অভিনয় ছেড়ে দিয়ে আবার ভাগাড়ে গিয়ে নামবি? আর সেটা একেনে বসে বসে এতোক্ষণ সমানে চোপা করে বলচিস? আর তুই নিশ্চই ভুলে গেচিস্ তাই না? যে কোন স্বর্গলোকের দেবতাটি একদিন তোর অ্যাক্টিং দেকে ” আসল নকল সব এক” বলেছিলেন?
ছিঃ ছিঃ! শেষে তুই-ওও ! যা বিদেয় হ এখুনি! বলচি শুনে রাখ্! ক’দিন পরে আমি মরলেও তুইও যেন একবারো দেকতে আসবিনি আমায়! এ আমি বলে দিলুম হ্যাঁ !
বিনি- আপনি যকোন বলতেন “পুরষ্কার তিরস্কার /কলঙ্ক কন্ঠের হার” ! তখন একটা দিনও হয়নি যে শুনে আমি কাঁদিনিকো।
আপনারা সব থিয়েটার বানালেন, আমায় বেবুশ্যে মাগী’র মত গুর্মুখ রায়ের সাথে কত শত রাত্তিরে শোয়ালেন, তবেই তো স্টার থিয়েটার হল, এ্যক্টিং করে কত নাম হল !
তবুও একদিনও আপনারা সাহস করে বলতে পারলেন নেকো ” যে “বিনি” র রক্ত বিক্কিরি-ই করেই এখেনে সব টাকা উঠেচে! তার বদলে সব বললেন যে ভদ্দরলোকেরা তোর নামে থিয়েটার হলে আর একেনে আসবেন না! অমৃতবাবু পর্যন্ত আমার মন ভোলাতে বল্লেন,
“আরে বাবা ! ভাবছিস্ কেন? তুই তো আসলে স্টার আমাদের !” আর আপনিও সেদিন গেলাস গেলাস মদ গিলে চুর হয়ে বললেন,
” শোন রে বিনি! আমরা আজকে থিয়েটারের কল্যাণে মহাকালের কাচে তোকে বলি দিলুম রে!”
আমি তো সেদিন ঠিকই বুঝেচিলাম ” দেহপট সনে নট সকলি হারায়” কেন এই কতাটা প্লে’তে বলা হয়েচে! এটা যেন সেদিন থেকে আমাকে বলা আপনার আসল গুরুবাক্য হয়ে গেল তো!
তাই তো আ-আ -মি-ইইই (ফুঁপিয়ে উঠে)
…….
একদিন “চৈতন্যলীলা” চলচে। তিনি এসে তাও ওই প্লে দেখলেন। তিনি দেবতা, তবুও আমাদেরকে বাজারের মেয়েমানুষ বলে ঘেন্না করলেন নাকো! সবার সামনে এসে বললেন ” তোদের চৈতন্য হোক! ” – এই বলে নিজে যেমন কাঁদলেন তেমনি আমাদেরকেও কাঁদালেন।
…….
তারপর একদিন কানে এল যে ওঁর খুব অসুখ করেছে। ওঁর শিয়রে সেই কাশীপুরে থাকতে একদিন সায়েব সেজে গিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেম। তবু আমায় ঠিক চিনতে পেরে বললেন ” যাবার বেলায় চৈতন্যকে না চিনলে কি হবে রে?”
….আর যে তখন চুপ থাকতে পারিনি গিরীশ বাবু! মনে হচ্চিল চোখের জলে রাজপথের সব শুকনো ধূলোটা সেদিনকে ধুইয়ে দিতে পারলাম কেন! কেন!
তবে তারপরে একটা কাজ কল্লুম! থ্যেটারের নকল রাজকাহিনীকে ওই দিন থেকেই জীবন থেকে বিদেয় দিলুম আস্তে আস্তে। ঠাকুরবাড়ির জ্যোতি-বাবুমশায় তবুও তো মাঝেসাঝে আসতেন ঘরে। গল্প হত! সোহাগ হত! সুখ-দুঃকের কতা কইতাম ওনার সাথে…
কিন্তু তাও তো বুজতে পাচ্চিলাম সব সঞ্চয় যে ফোরাচ্চে এবার।
তাই তো ওসব ছেড়ে একোন থেকে দূরেই আচি। ওনার কথাতে জানি যে আমরা সব
” অবিদ্যের সংসারে” আবর্জনা হয়ে জন্মিচি ! তাই বলে কেউ কি সংসারে নিস্তার দেবে আর?
একোন দেখচি আপনিও ” তিনকড়ি” কে নিয়ে আর সবাই যা বলে তাই বলচেন!
নাহ্ উঠি তবে! রোগশয্যায় আজ বাংলা থিয়েটারের গ্যারিককে এসে দেকে গেলুম !
আপনি ভালো হয়ে উঠুন খালি! ব্যস্ আর কিচুই চাইবো নাকো!
এজন্মে তো আর হল না! পরের বারও যদি এখেনে আসি তবে যেন আপনার যোগ্য শিষ্যা হয়ে উঠতে পারি! আজ চলি তবে! প্রণাম নেবেন মাস্টারমশাই, আমার!
…….
গিরীশ: যাহ্ চলে যা তবে! যে কালকূট তোর বুকে জ্বলচে তার ভাগ আমায় দিয়ে ভালোই করেচিস্। হ্যাঁ ! এটাই সত্যি যে আমরাই সেদিনকে তোকে স্টারের নামে গুর্মুখের কাচে বিক্কিরি করিচি! তাই তো ওখেনে তোর নাম টাম যা হয়েছিল তার সবটাই গুরুপদে প্রণামীর মত ফিরিয়ে দিয়ে একোন একেবারে ঠিক-ই করেচিস্।
তবে এটাও শুনে রাখ! যেদিন আমরা দুজনেই আর থাকবোনা সেদিনও স্টার থিয়েটার থাকবে। আর তার অলিন্দে ” হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায়” গানটাও ঠিক একইভাবে থাকবে। যে পরমহংস তোকে আশীর্বাদ করেছেন তাঁর আলোতেই যতবার জন্মাবি ততবারই ইহজীবন ধুয়ে যাবে পরম করুণাঘনের ঐশী আলোয়।
আমি তো জানি তুই কাউকেই হিংসে করিস নি! তুই আসলে একজন জাত শিল্পী। ওই যে কতায় বলে না,
” Revoloution devours his own children” তুই হলি তার সার্থক প্রয়োগ।
যা সামনে থেকে চলে যা বিনি! যা এবার!
স্বয়ং রামকৃষ্ণ যাকে দয়া করেছেন তার আর এসব জাগতিক ভাবনা মানায় কি?
যা তুই এখন থেকে এসব থেকে মুক্ত!
তবে যাবার আগে এদিকে একবার দেখে যা, দ্যাক এবারে আমার ঘুমঘোরটা যেন হঠাৎ করে আরও দু’ চোকের পাতা ভারী করে বেশ জাঁকিয়েই আসছে।
আজ জানি রে ! আমাদের এসব কতা কেউ শুনতেও পাবেনা। আর তাছাড়া তোকে এখেনে আসতেও কি কেউ দেকেছে? আজ থেকে শুদু আমি না হয় এসব খালি জানলাম।
যা চলে যা এবারে!
আর জানিস্ বিনি! জীবন_মরণে কোনওটাতেই শ্বাসবায়ু’টিকে আসতে বা বেরোতে কেউ কখনোই দেকে না রে।
যা তাহলে আজ! আবার দেখবি হয়তো আমাদের দেখা হবে কোনওদিন! হ্যাঁ অন্য কোতাও! অন্যকোনখানে!
…… যা তুই ! আয় এবার!…..
–~০০০X(সমাপ্ত)X০০০~–
গ্রন্থঋণ –
গিরিশচন্দ্র ঘোষ – অবিনাশ গঙ্গোপাধ্যায়
প্রথম আলো (১) – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
গিরিশচন্দ্রের শ্রীরামকৃষ্ণ – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
আমার কথা- শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী