রাঁধুনি
ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়
নিমাইদীঘি গ্ৰামের নাম অনেক মানুষ শুনেছেন।কাটোয়া স্টেশন থেকে বাসে অশুততলার চারমাথা মোড়ে নেমে ওখান থেকে অটোতে নিমাইদীঘি।দেবু রেজ এখানকার মুদিখানার মালিক।অটো ওলা সুশান্ত বললে “কুড়ি টেকা দিয়ে চলে গেলে হবে না।মালসামানের ভাড়া লাগবে”।
দেবু রেজ কিপটের শিরোমণি। মূলো মূলো দাঁত বার করে বিকৃত মুখে বললে “তোর শালা দেখি বেশি খিদে। একটিন সরষের তেল আর দুটো ব্যাগে কতটুকু মাল আছে রে যে তার ভাড়া চাইছিস।”
“দেখো দেবু দা। আরো দশ টেকা ছাড়ো।ওসব ওজর অন্য জেয়গায় দেখিও।আমার কথা যা তাই।বলি তুমি মাগনায় কাকে কোন জিনিস টা দেও শুনি।”বলেই হাত পাতে সুশান্ত।
রেগে অগ্নিশর্মা দোকানি দেবু হাত কাঁপিয়ে দশটাকা দিয়ে জোরে হাঁক পাড়ে “কোথায় গেলি রে পারুল।বলি ও পারুলের মা।আসবে তো।এত মালসামানের ভার আমি একা কী করে বইব।”
সুশান্ত গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বললো “শালা উল্লু কে পাঁঠে।একটু আগে বলছিল সামান্য মাল।এই ঢ্যামনা গুলোকে ওই জন্য গাড়িতে তুলি না।”
দেবুরেজ হাঁকের পর হাঁক দিয়ে যায়।অনেক ক্ষণ পরে এক বাজখেঁয়ে গলা সাড়া দেয় “অত ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছ কেন।বলি কী হয়েছে কী।যেদিন দোকানের মাল আনতে যাও সেদিন ই তোমার লম্ফঝম্ফ ধরে না।বলি হপ্তায় তো একদিন।তারপর তো পুরো হপ্তা গদিতে বসে।”
“সত্যি!এর নাম ধর্মপত্নী।কথা বলছে দেখো।যেন কিষ্কিন্ধ্যার বানরী”বলে আবার ডাক দিল “পারুল।ও মা পারুল”।
দেবু রেজের প্রথম পক্ষের মেয়ে পারুল।ওর মা চলে গেলে দ্বিতীয় পক্ষে ওই ঢিপকপালী চিরুনদাঁতি জুটেছে।এত উঁচু দাঁত যে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাতে পারে না।
নিমাইদীঘি গাঁ চৈতন্যের পদধূলি ধন্য গাঁ।এলাকায় একথা প্রচলিত আছে গৃহত্যাগ করে কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস দীক্ষা নেবার আগে এখানের এই দীঘিতে স্নান করেছিলেন তিনি।
সেই তখন থেকে এখানে দোল পূর্ণিমা তে মেলা বসে।এই পুণ্যতীর্থে দেবুরেজের জন্ম।অথচ কপাল দেখো।সেই যে মাধবীলতা চলে গেল পারুল কে জন্ম দিতে গিয়ে, তারপর থেকেই ভালোবাসা হীন এ জীবন।এখন ও মনে পড়ে দেবুর।সেই মিষ্টি হাসি।তখন উঠতি যৌবন।জ্যোৎস্নার মতো সে আলো জীবন থেকে কেন যে চলে গেল।রেখে গেল পারুলকে। চৈতন্যপুরের কেষ্ট মুখুজ্যে বললে “বিয়ে কর দেবু।অতটুকু মেয়েকে দেখবে কে?”
কথাটা খুব সত্যি আবার খুব নির্মম।অন্ধকার নেমে এলে দাওয়ায় বসে রোজ ভাবে দেবু।ভালোবাসা।কত গভীর এই শব্দ।এ দিয়ে তো বিশ্বজয় করা যায়।জীবনে তো বারবার আসতে পারে।তবে চাঁপা কেন পারলো না নতুন করে সব এনে দিতে!
নিমাইদীঘি তে আজ সাত পুরুষ ধরে বাস করছে রেজ পরিবার।দেবু রেজের বাবা ছিল মাণিক রেজ।জমিদারি সেরেস্তার তহশীলদার ছিল বাপ।আশপাশের গ্ৰামে খাজনা আদায়ে যেত।এমন ই এক দিনে প্রচুর দাবদাহে মাধবীদের বাড়িতে ঢুকেছিল মাণিক।দেখলে ফুটফুটে এক সোনার পিতিমে যেন।বললে “ও মা।একটু জল দিবি।বড় তেষ্টা পেয়েছে”।
ছুট্টে গিয়ে রেকাবিতে ঘরের তৈরি সন্দেশ আর দুটো বাতাসা দিয়ে এক ঘটি জল দিলে মেয়ে।তারপর একটা হাতপাখা এনে বললে “একটু হাওয়া করি আপনাকে।বড়ো ঘেমে গেছেন”।
ব্যাস!আর যায় কোথায়।সেদিনের সেই ব্যবহারে কী ছিল কে জানে।মাণিক বললে “আসি গো মা কল্যাণী”।
মাধবী হেসে বললে “না গো মশাই।আমি মাধবী”।
মাণিক এর মনে জেগে র’ইল সেই কল্যাণী রূপ।বললে “তোকে আমি কল্যাণী বলেই ডাকবো”।
মাধবীর মামা বিষ্ণুচরণ।বললে “আমার মা মরা ভাগ্নি।আমার ঘাড়েই এসে পড়েছে।কী করবো।ফেলে তো দিতে পারি না।”
মাণিক বললে “এমন সোনার পিতিমে ফেলে দেবে!কী বলছো বিষ্ণুচরণ।ও মেয়েকে তুমি আমায় দাও।আমার দেবু খুব ভালো ছেলে।শুধু একটু বোকা।মা এর কল্যাণ স্পর্শে সংসার সগ্গো হয়ে যাবে।”
বিষ্ণুচরণ অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।তবে মামী আড়ালে ই ছিল।বললে “বে দেবো কী করে।আমার নিজের ই দুটো মেয়ে আছে”।
হিসেবী আর দূরদর্শী মাণিকের বুঝতে বাকি র’ইল না।বললে “পুজো মিটলে সামনের অঘ্রাণেই চারহাত এক করবো আমি।বরপণ হিসেবে লাল পাড় একটা শাড়ি তুমি দিও বিষ্ণুচরণ।তবে তোমার ধর্মপত্নী র যদি তাতেও আপত্তি থাকে তবে আমি নিজে এসে আমার পুত্রবধূকে সাজিয়ে নে যাবো।তাহলে ওই কথাই থাকলো”।
এবারের পুজোয় আনন্দের বান ডেকে গেল মাধবী লতার মনে। মামীর অনাদরে আর কিছু না পাবার বঞ্চনায় যে মন অদৃষ্ট কে মেনে নিয়েছিল সেই পাথরচাপা কপালে এ কোন নতুন আহ্বান।পুজোর চারদিন আগে মাণিক রেজ এলো বিষ্ণুচরণ এর বাড়ি।বললে “তোমরা হলে নতুন কুটুম।তাই তত্ত্ব করে গেলুম”।বলেই একটা লাল টুকটুকে শাড়ি মাধবীর গা এর উপর ছড়িয়ে দিয়ে বললে “মা কে আমার দারুণ মানাবে”।
শুধু মাধবীর জন্যই কত সাজ।প্রসাধনী।মামার মেয়েরা কাঁদতে বসলে।মামীর বিষাক্ত মন বললে “আদিখ্যেতা”।
এতকিছু পেয়েও মাধবী ভীত সন্ত্রস্ত।মাণিক বললে “কী হল রে মা।তোর পছন্দ হয় নি বুঝি”।
ডুকরে কেঁদে ওঠে মাধবী।বলে “মামা মামী তো আপনাদের কিছু দেবে না।শুধু হাত পেতে নেওয়া”।
মাণিক বলে “চুপ কর তুই।কাঁদিস নে।তুই হলি লক্ষ্মী।তোকে পেয়ে গেলে আর কী চাই!”
ভাবী শ্বশুর মশাই কে জলখাবার দিতে হবে। বিষ্ণুচরণ ময়দা আর সাদাতেল এনে দিয়েছে।মামী বললে “পুজোতে জিনিস তোর এসেছে।রান্না করে তুই খাওয়াগে”।
অপটু হাতে মাধবী লুচি করলে।সাদা ডিম বেগুন ঘোষেদের থেকে চেয়ে এনে ভেজে দিলে।আর ঘরের তৈরি সন্দেশ দিলে।
মাণিক খাচ্ছে আর ভাবছে “এ তো অমৃত”।
দেদার ঘটাপটা করে মাধবীলতার বিয়ে হয়ে গেল।কোনো আয়োজনের ত্রুটি নেই।মাণিক রেজ সকলকে পেটপুরে খাওয়ালে।ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল চারদিকে।নতুন এক জীবনে এল মাধবীলতা।কবে বাবা মা কে হারিয়ে সে। নতুন করে সব ফিরে পেল।
মাধবীকে মাণিক রেজ কল্যাণী বলেই ডাকে।কত কথা যে হয় বাপ বেটিতে তার ইয়ত্তা নেই।মাণিক বলে “তোকে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী মনে হয়।কত স্নিগ্ধতা মাগো।আমি যেন জগজ্জননী রূপ দেখি।তাই তো কল্যাণী নাম দিয়েছি তোর।মেয়ে মানেই কল্যাণী।যে সংসারে তোরা থাকিস সেটাই চকচকে হয় রে মা”।
এসব কথা যত শোনে ততই শ্বশুর মশাইকে তার দেবতা মনে হয়।মনে মনে ভাবে সে ও কল্যাণী হবে।ভালোবাসা দিয়ে সব ভরিয়ে দেবে।
দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেল।দেবু বললে “তুমি পিঠেপুলি করতে জানো মাধবী”?
মাধবী থতমত খায়।বলে “মা এর থেকে শিখে নেবো।আমি তো ভালো রান্না করতে পারি না”।
দেবুর মা মোক্ষদা বলে “তাতে কী হয়েছে বৌমা।আমি তোমাকে সব শিখিয়ে দেবো”।
শাশুড়ি র তত্ত্বাবধানে রান্নাশিক্ষার পাঠ চলে।মাধবী মনে মনে ভাবে “দারুণ তো।ভালো রান্না করে সবাইকে খাওয়ালে কত তৃপ্তি।বেশ ভালো লাগে রাঁধতে।”এদিকে মাণিক অট্টহাসি হাসে।দেবুকে দেখিয়ে বলে “ওই রাক্ষসকে তুই খাইয়ে এলাতে পারবি না”।
মাণিক রেজ খাজনা আদায় করে।আশপাশের প্রায় সব গাঁ থেকে অনেক মানুষ আসে তার কাছে।সবসময় রান্নাঘরে চলে অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি।সেদিন কানাই ঘোষ এসেছিল।মাণিকের বন্ধুও বটে।অগাধ বিষয় সম্পত্তি।বললে “বুঝলি মাণিক।মরার আগে সম্পত্তি সব বাঁটোয়ারা করে দিয়ে যাবো।নৈলে লাঠালাঠি করে মরবে ব্যাটারা।”
এই মানুষ টা এলেই শ্বশুর মশাই খুব খুশি হয়।মাধবী চায় শ্বশুর মশাই খুশি তে থাকুন।
মাধবী দেবুকে বলে “মাচা থেকে কুমড়ো ফুল গুলো এনে দাও”।
দেবু বলে “কুমড়ো ফুল।কেন?”
“এই তোমার অভ্যেস।একটা কাজ বললেই কী।কেন”?
দেবু কথা বাড়ায় না।ফুল তুলতে যায়।মাধবী বলে “ছেলে ফুল গুলো তুলবে ।মেয়ে ফুল তুললে কুমড়ো হবে না”।
দেবু হাসতে থাকে।বলে “তোমার মুন্ডু।দুজনকেই চাই।”
এরপর খিলখিল করে হেসে ওঠে মাধবী।বলে “এই তো কত বুদ্ধি।তবে বাবা বলেন তুমি নাকি বোকা!”
কুমড়ো ফুল ভালো করে বেছে আর ধুয়ে নিল মাধবী।তারপর বেসন দিয়ে চটকে কাঁচালঙ্কা দিয়ে বড়া করলো।ঘন দুধের কফি বানিয়ে চলে গেল সদর দুয়ারে।বললে “আপনাদের জন্য কুমড়ো ফুলের বড়া আর কফি করেছি।গরম গরম খেয়ে নিন”।
মাণিক বললে “উফফফ!আমার আত্মাটা এটাই চাইছিল রে।তুই সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা।আমার মা তুই”।
কানাই বললে “ভালোই আছিস বটে।কেমন লক্ষ্মীমন্ত ছেলের বৌ।আমি তো সকালে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে থাকি।ছেলের বৌ রা মুখ তাকাতাকি করে।সবাই ভাবে অন্যরা দিক।শ্বশুর আমার একার নাকি?”
মাণিক বলে “তবে তো বেশ মুশকিল।এখন তো আবার শুনছি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় ছেলে বৌ।”
কানাই বলে “আচ্ছা।ওরা কী বুড়ো হবে না”?
কথার মাঝে মাধবীলতা উপস্থিত হয়।কানাই ঘোষকে উদ্দেশ্য করে বলে “আজ এখানেই দুপুরের ভাতটা খাবেন কাকাবাবু।আমি রান্না করছি”।
বিক্ষুব্ধ কানাই হঠাৎ নরম হয়ে যায়।জিজ্ঞাসা করে “আজ কী রান্না হচ্ছে শুনি?”
মাধবী বলে “পুঁইমেচুরি মাছের মাথা দিয়ে,শুক্তো,মাছ আর টক।”
দুই বুড়োর আজ খুব আহ্লাদ।মাধবী রান্না করে।পাশের বাড়ি থেকে একটা ছোট্ট মেয়ের গান ভেসে আসে “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়”।
মাধবী গান শুনতে শুনতে রান্না করে।
খাওয়া দাওয়ার পর কানাই ঘোষ চলে গেলে বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়ালো মাধবী।তখন বিকেল হতে বেশি দেরি নেই।দেখলে গাছি পাড়ার ময়না খেঁজুর গাছের শুকনো পাতা আনছে।মাধবীকে দেখে বললে “বিজলের চরে যত খেঁজুর গাছ সবে তে হাঁড়ি বাঁধা হচ্ছে”।
মাধবী বলে “ওখানে তো অনেক খেঁজুর গাছ। সবেতেই হাঁড়ি বাঁধা হবে।সব গাছ তোমাদের বুঝি”?
ময়না বলে “কী যে বলো।তুমি কিছু জানো না।আমি তোমাকে বিজলের চরে নিয়ে যাবো বৌমণি।দেখবে।কী সুন্দর জায়গা।আর খেঁজুর গাছে কেমন করে গাছিরা রস বার করে দেখে আসবে”।
ময়নার কথায় লাফিয়ে ওঠে মাধবী।বললে “আমাকে এখন ই নিয়ে চলো।যাবো আর আসবো “।
ময়না বললে “তবে তোমাদের খামারে খেঁজুর পাতা গুলো রাখি।আগে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি তোমাকে।সাঁঝের আগে ফিরতে হবে”।
ময়নার সাথে মাধবী চলে গেল।ময়না বললে “বিজলের চরা বিশ্বেসদের সম্পত্তি।খেঁজুর গাছ লিজ দিয়েছে আমাদের।সেই মাঘ মাস পর্যন্ত রস ভালো পাওয়া যাবে।তারপর যত গরম পড়বে তত রস উধাও”।
মাধবী বলে “আমাকে এক কলসী রস দেবে তুমি।আমি পিঠা করবো”।
ময়না বলে “ঠিক আছে।কাল তোমাদের বাড়িতে ভোরবেলা দিয়ে আসব।
বিজলের জোলের দিকে চলল ময়না আর মাধবী।ময়না বললে “বৌমণি।তুমি বাড়িতে বললে না।আমাদের ঘুরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।ওরা তোমাকে না দেখে চিন্তা করবে তো”।
মাধবী বলে “ইসস।বললে আসতেই দেবে না।বলবে আমরা নিয়ে যাবো।আর বেশি দেরি করবো না।যাবো আর আসবো”।
ওদের যেতে আধ ঘন্টা লাগল।মাধবী যেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভাসছে।হাসি যেন বন্ধনহীন।বললে “ময়না ।কী সুন্দর জায়গাটা।কত বড় জোল।তোমার দাদা বলেছিল।কিন্তু নিয়ে আসে নি।আমার ভীষণ ভালো লাগছে।আবার আসবো।মাঝে মাঝেই আসবো”।
নির্জন নিস্তব্ধ চরে কাদের যেন নৌকা নোঙর করা।চরের চারিদিকে প্রায় শ”পাঁচেক খেঁজুর গাছ।মাধবী বললে “চলো দেখি।গাছিরা কেমন করে গাছ চাঁচছে দেখি”।
ছুট্টে চলে যায় মাধবী।দেখে আজিম শেখ কে।ইরফান ভাইকে।ওরা ময়নাকে বলে “তোর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই।বৌ কে এখেনে এনিচিস।এই বিজলের চরা খুব ভালো জায়গা নয়।বাড়ি নে যা তাড়াতাড়ি”।
মাধবী এসবে কান দেয় না।ডাকে “এই ময়না।এদিকে এসো।ওই দেখো কত হাঁস।এমন হাঁস তো দেখিনি।মাথা গুলো লাল লাল।আমি নেবো একটা”।
ময়না বলে “তুমি পাগল হলে বৌমণি।ওগুলো রাঙামুলী হাঁস।অন্যদেশের হাঁস।সেই রেশে দেশের।”
মাধবী কী যেন ভাবে।তারপর বলে “রেশে নয়।রাশিয়া”।
ময়না বোকাবোকা হাসে।বলে “আমরা কী ন্যাকাপড়া শিখেচি বলো”।তবে ওরা গরমে বাঁচে না।শীত ফুরোলেই পালায়”।
মাধবী ঘাড় নাড়ে।ময়নাকে জিজ্ঞেস করে “এক একটা কলসীতে কতটা রস থাকে গো ময়না?”
“সে পেরায় দশকেজি।এরাম তিনটে কলসীর রস ফুটোলে তবে দু কেজি গুড়।খুব উপকার।তুমি খাবে।গায়ে অক্ত হবে”।
মাধবী বলে “পাগলী মেয়ে একটা।অক্ত নয় রক্ত”।
দুজনেই হাসতে থাকে।ময়না বলে চলে “বাজারে তুমি খাঁটি গুড় চিনতেই পারবে না।এখন তো গাছিরা চিনি মেশায়।রঙ মেশায়।ফিটকিরি মেশায়।শহরের বাবুরা ভাবে গুড় লাল টকটকে হলে ভালো।ঘোড়ার ডিম।রামঠকা ঠকে”।
প্রকৃতি কন্যা মাধবীলতা।আকন্ঠপান করছে যেন রূপ রস গন্ধ।ভাবে এই বিশাল আকাশ টা সব দেশের মাথায় আছে।যদি সে পাখি হতে পারতো।তবে উড়ে উড়ে চলে যেত সেই রাশিয়া।কী ভালো যে হত।আর তারপর ই হাতটা পিছনে বাড়িয়ে দেয় বলে “হাতটা ধরো ময়না।এখান টা কী উঁচুনীচু।”
কিন্তু একি!কে হাত ধরেছে।এত শক্ত।উরি বাপ্রে।টানছে কেন ময়না।পিছন ফিরেই চিৎকার করে ওঠে মাধবী।”কে আপনি।আমার হাত ছাড়ুন।কী কী চাই ।আর ময়না।ময়না কোথায়”?
মাধবী র বুঝতে বাকি র’ইল না কী ভয়ঙ্করের মধ্যে সে পড়েছে।কিন্তু ময়না কোথায়।না ।এখন নিজেকে বাঁচাতে হবে।এই মদ্দটা ভুষকুমড়ো টাইপের।মুখে মদের গন্ধ।কিন্তু আর একটু দূরে চারজন জোয়ান কে দেখতে পেলো।এতক্ষণে গলায় সোনার চেনটা মদ্দের হাতে।ওটা দেখতে ব্যস্ত।এই সুযোগ।এক ঠ্যালা দিয়ে প্রানপণে দৌড়াতে লাগল।না আর পিছনে তাকানোর সময় নেই।আগে ইজ্জত।দৌড়,দৌড়,দৌড়।কিন্তু এই বিজলের জোলে যেন বড় তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে।গাছগাছালি ঘেরা।গাছ গুলো কে মনে হয় মানুষ।মরুভূমির মরীচিকা যেন।কোথায় বাড়ি ওর।কোনদিকে রাস্তা।কিছু বুঝতে পারছে না।শুধু দৌড়াচ্ছে।
মোক্ষদা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল।শীতকালের ছোট বেলা।তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে।ডাকলে “বৌমা।ও বৌমা।কোথায় গেলি মা।ঘরদোরে ঝাঁট দাও।সন্ধ্যা দিই”।
কিন্তু এত বড় বাড়িতে তার ডাক প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে।এমন তো কখনো হয় না।কোথায় গেল।দেবু দোকান খুলবে।দোকানে ধূপ দেবে।এই সময় খুচরো খদ্দের দের ভিড়।বললে “ও দেবু।বৌমা কোথায়”?
দেবু বললে “কী জানি।কোথায় গেল”?
বাড়িতে হৈচৈ লাগিয়ে দিলে মোক্ষদা।মাণিক রেজ বললে “মা তো কখনো না বলে কোথাও যায় না।এতো খুব চিন্তার বিষয় হল”।
মণিক বললে “এত চেঁচামেচি কোরো না।এখন ই পাড়া গাবিয়ে লাভ নেই।দেখি কী করতে পারি”বলেই বাইরে এল মাণিক।দেখলে খামারের এক পাশে খেঁজুর পাতা।তবে কী বিজলের জোল!ওখানে তো ফাঁসুড়ে ডাকাতেরা থাকে।হায়!সর্বনাশ”!
দেবু সাইকেল নিয়ে এগিয়ে চলল বিজলের জোল এর দিকে।ভীষণ অস্থির লাগছে আজ।কোথায় যে গেল?একবার তো বলেছিল “আমাকে বিজলের চরে নিয়ে যাবে গো”?
দোকান দোকান করে বৌকে নিয়ে যাওয়া হয় নি।কান্না পাচ্ছে যেন।
ময়না এতক্ষণ অচেতন ছিল।মদ্দটা যখন বৌমণির হাত ধরবে বলে এগোচ্ছিল তখন ময়নাকে ঝনকা দেয়।ময়না ছিটকে গিয়ে পড়ে দূরে যেখানে একটা পাথর ছিল।কপাল থেকে তখন রক্ত ঝরছে।জ্ঞান ফিরতেই চিৎকার করে উঠল “বৌমণি গো।কোথায় তুমি।”
ময়নার গলার আওয়াজ পেয়ে আজিম চাচা এগিয়ে এল।বললে “বৌমণি কোথায় গেল?”
ময়না কান্নায় ভেঙে পড়ে।বললে “তুমি বৌমণিকে বাঁচাও আজিম চাচা।ফাঁসুড়ে ডাকাতের কবলে পড়েছে”।
আজিম বললে ‘না বোধ হয়।যে নৌকোটা নোঙর করা ছিল ওটা তেমন ই আছে।ওরা তাহলে নৌকা টাতে নিয়ে চালান করে দিত বৌমণি কে।আমার মনে হয় বৌমণি পালিয়েছে।”
ময়না বললে “তবে বাড়ির দিকে যাই।যদি বাড়ি গিয়ে থাকে”
ময়না ফিরছিল।ওকে দেখেই দেবু বললে “ময়না।তোর বৌমণিকে দেখেছিস।এদিকে আসে নি”?
ময়না এবার বুঝতে পারে বৌমণি ফেরে নি।কেঁদে ভেঙে পড়ে দেবুর কাছে।দুজনেই আবার ছোটে জোলের দিকে।
এবার আজিম এবং ইরফান যোগ দিল।সারা জোল আর চারপাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজছে ওরা।সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে।মাণিক অস্থির হয়।বড় একটা সার্চ লাইট নিয়ে বনের দিকে যায়।
দেবু র শিরদাঁড়া টা যেন কে ভেঙে দিয়েছে মনে হচ্ছে।বললে “ময়না।তোর বৌমণি কোথায়?”
ময়না বলে “বৌমণি কে ভুলভুলাইয়া ধরে নি তো।বনের মাঝে পথ হারায়।গল্প করতে করতে আমরা ভিতরপানে ঢুকে গিয়েছিলাম।আর তারপর,,,,,”
মাণিক সার্চ লাইট টা জ্বাললো ।গাছগাছালি তে ভরা চারদিক।কিন্তু পাতার আড়ালে কী ওটা।হলুদের আভা।কাছে এগিয়ে গেল।দেখলে তার কল্যাণী। আনন্দে তার চোখের জল বাগ মানল না।নাড়ি দেখলে।ঠিক আছে।অচেতন।কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে চলল।
বিজলের জোলে খবর পাঠালো মাণিক।বৌ বাড়িতে চলে এসেছে কখন।ছাদের চিলেকোঠার ঘরে বাতি জ্বালাতে গিয়েছিল।তাই বাড়ির লোক বুঝতে পারেনি।ময়না হাঁফ ছাড়লে।বললে “যাক বাবা।আমরা কত কী ভাবছি।তুমি বাড়ি যাও দেবুদাদা।আমি কাল বৌমণিকে খেঁজুর রস দে আসবো।বৌমণি পিঠাপুলি করবে।বড় সরল মেয়ে গো ।তুমি ভাগ্যবান।এমন বৌ পেয়েছ।”
আজিম আর ইরফান নিশ্চিন্ত হল আর দেবু।হাউই এর মতো বাড়ির দিকে ছুট দিল সাইকেল নিয়ে।
দেবু বাড়িতে ঢুকলো।কেমন যেন নিথর নিথর গোটা বাড়ি ।বাবাকে এত ভেঙে পড়তে সে কখনো দেখেনি।রান্নাঘরে শিকল তোলা।
দেবুকে দেখেই মাণিক বললে “সোজা অশুত তলার মোড়ে যা।ওখানে গঞ্জের বাজারে শঙ্কর ডাক্তার বসে।গিয়ে ডাক দে।যা টাকা চাইবে দেবো বলবি”।
দেবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়।বলে “কী হয়েছে?কার জন্য ডাক্তার”?
মণিক গর্জে উঠলো।বললে “সারাজীবন ন্যাকা বোকা আর জড় পদার্থ হয়েই থাক।আজ তোর জন্যই আমার কল্যাণী মরতে বসেছে।ভালোবাসা র মানুষ এর মনের আর শরীরের খোঁজ নিতে হয় বাপ হয়ে সেটা কী শিখিয়ে দিতে হবে”?
দেবু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।মাণিক বসে আছে দ্বার আগলে।একবার যে বৌটাকে চোখের দেখা দেখবে সে উপায় ও নেই ।আমতা আমতা করে বলল “কার কী হয়েছে জিজ্ঞেস করবে ডাক্তার । কী বলবো তবে।”
মাণিক গর্জায়।বলে “যেমন মা তার তেমন ছা।বোকার হদ্দ”।
মোক্ষদা দেবুকে ডাকে।বলে “শোন এদিকে”।
দেবু কাছে যেতেই বলে “বৌমা কী মা হতে চলেছিল?তুই তো এখবর বলিস নি।”
দেবু হতবাক।ও তো জানেই না ।মোক্ষদার চোখে জর চিকচিক করে।বলে “তুই তাড়াতাড়ি ডাক্তার কে ডাক।যদি শেষরক্ষে হয় “।
দেবু আর দেরি করে না।চলে যায় সেই অশুততলার মোড়ে গঞ্জের বাজারে।মুরারী বলে “হন্তদন্ত হয়ে কোতায় চললে।দোকান খুলবে নি।রান্না হবে কী করে”।
দেবু বলে “আমার অশুততলার মোড়ে কাজ আছে।তুমি স্বদেশের দোকান থেকে নিয়ে নাও “।
মুরারী হাঁ করে থাকে।দেবুর দোকানে হাওলাতে জিনিস কেনে।এখন স্বদেশ তো দেবে না ।বললে “তুমি ফিরে এলেই দুকান নেবো”
শঙ্কর ডাক্তার আসে।মাধবীলতা র জ্ঞান এসেছে।মোক্ষদা যতটা সম্ভব ওকে পরিস্কার করে দিয়েছে।ডাক্তার বললে “শরীর ভালো নেই।পুরোপুরি বিছানায় থাকতে হবে এখন।আমি প্রোজেস্টেরন হরমোন ইঞ্জেকশন করে দিচ্ছি।আশা করি গর্ভস্থ শিশুটি বাঁচাতে পারবো।”
বড়িতে আবার খুশির বন্যা।বিশেষ করে মাণিক এর আনন্দ যেন ধরে না।এই শীতে ওর সাথে চলছে নিত্যনতুন খাবার।ময়না এসে খেজুরের রস দিয়ে যায় মাঝে মাঝেই।কত রকমের পিঠা পুলি তৈরি করে মাধবী।ময়না বলে “জানো বৌমণি।তোমার মুখটাতে বড়ো মায়া।সবাই কে কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে গো”।
মাধবীলতা হাসে।বলে “পাকা পাকা কথা না বলে পিঠে খাও দেখি”।
ময়না পিঠে খায়।রসবড়া,গোকুল পিঠে,সেদ্ধ পিঠে,আস্কে পিঠে।কী অপূর্ব স্বাদ।আবার বকবক করে “জানো বৌমণি।তোমার শ্বশুর মশাই বলছিল পিঠে তো সবাই করে।তবে আমার কল্যাণীর খাবারের সোয়াদ টাই আলাদা।মা আমার সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা”।
মাধবী বলে “সেদিন না বলে বিজলের জোলে না গেলেই ভালো ছিল।খুব অন্যায় হয়ে গেছে”।
ময়না বলে “ধুত্তোরি।কেন ভাবো ওসব নিয়ে।এখন পেটে তোমার ছানাপোনা।আজকে মাঠ থেকে তোমাকে কুলেখাড়া এনে দেবো।খেও।অক্ত হবে।”
মাধবীলতা খিলখিল করে হাসে।বলে “অক্ত নয়।রক্ত”।
এবারের দোলের মেলা মাধবীলতা প্রথম দেখবে।ফাগুনের মাঝামাঝি দোল।নিমাইদীঘি তে সাজো সাজো রব।প্রতিটি বাড়িতে যেন আনন্দের রোল।কুটুম আত্মীয়ে ঘর ভরে যাবে।মাণিক রেজ বললে “এবারে কাটোয়া থেকে গোষ্ঠবিহারী দাসের কীর্তন দল আসছে।খুব বড়ো গায়ক”।
মাধবীলতা খুশিতে ডগোমগো।বললে “আচ্ছা বাবা।কাটোয়া শব্দের মানে কী?”
“কন্টকদ্বীপ থেকে কাটোয়া এসেছে।ওখানের গৌরাঙ্গ বাড়িতে তোকে নিয়ে যাবো।খুব ভালো লাগবে তোর।ওখানে যে ভোগ রাঁধে সে এবারে নিমাইদীঘি র দোলের ভোগ রাঁধবে।আমি বলেছি আমার বাড়িতে থাকতে”বলেই মাণিক বলে “তুই তো রান্না করতে ভালোবাসিস।সব শিখে নিবি”।
দোলের আগের দিন বিষ্ণুচরণ সপরিবারে হাজির।মামী এখন খুব ভালোবাসে মাধবীকে।যাকে গলার কাঁটা ভাবতো আজ সে গলার মালা।
মণিক রেজের বোনেরা এসেছে।এসেছে দেবু রেজের মামা মামী।অতিথি দের আপ্যায়নে তৎপর মাধবী।সবাই আজ খুব খুশি।যেন প্রচন্ড গরমে বটবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছে ওরা।
দোলের ভোগের জোগাড় চলছে।রাঁধুনি যে সে নয়।রাধামাধব তর্ক চূড়ামণি।মাণিকের আপ্যায়ন তাঁকেও আপ্লুত করেছে।বললেন “তোমার পুত্রবধূ র তুলনা নেই।ভারী মিষ্টি মেয়ে”।
মাধবী তাঁর জন্য লুচি ,বেগুন ভাজা আর ঘুগনি এনেছে।খেতে খেতে বললেন “বাহ্।সুন্দর রান্না।তুমি তো পাকা রাঁধুনি।আসলে হৃদয়বান না হলে সঙ্গীত আর রান্না আসে না।”
মাধবী বলে “ঠাকুরমশাই।দোলে ভোগের রান্না কী হবে?”
রাধামাধব বলেন “সে তো ভোগের গানেই আছে।শাক,শুক্তো,ঘি ভাত ,বিভিন্ন ভাজা,মুগডাল, পায়েস,মিষ্টি।এইসব।”
“বাবা বলছিলেন দোলের ভোগে আলু থাকে না।কেন ঠাকুর মশাই”।
রাধামাধব মৃদু হাসলেন।বললেন “চৈতন্যজীবনী কাব্যে আলুর উল্লেখ পাবে না।আসল কারণ সে সময় বাঙালি আলু খেতে শেখেনি।জানতোই না।ওটা পর্তুগিজ দের থেকে খেতে শিখেছি আমরা।”
মাধবী রান্না করতে করতে কত কী ভাবে।সত্যি!কত কী ও জানে না।দুপুরের ঘুম এলে স্বপ্ন দেখে।এক দিব্যকান্তি যুবক এসেছেন।মাধবীলতা তাঁকে সব রান্না করে দিয়েছে।শুধু আলু দেয়নি।
মাধবী স্বপ্নে তাঁকে বলে “তুমি সন্ন্যাস নিলে কেন ঠাকুর।বিষ্ণুপ্রিয়া র চোখের জল তোমাকে কষ্ট দেয় নি?”
হঠাৎ দেবু ডাকে।”এই মাধবী।এই।কাঁদছো কেন”?
দেবুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো ফোঁপাতে থাকে মাধবী।আর বলতে থাকে “কেন এত কষ্ট মানুষের”।
দেবু কিছুই বুঝতে পারছে না।বলল “ডাক্তার এইসময় হাসিখুশি থাকতে বলেছে।কাঁদতে বলে নি।চলো।দোলের মেলা দেখতে যাই।”
মেলায় গিয়ে মাধবী যত উল্টোপাল্টা জিনিস কিনলো।লালনীল ফুল,কথা বলা পুতুল যে মা মা বলে,চুষিকাঠি।
দেবু বলে “একেবারে পাগলী।বাচ্চা হতে এখন ঢের দেরি।এখন থেকে এসব”!
মাধবী বলে চলে “পরে আর কেনা হবে না।তাই এখন কিনে রাখলাম।”
গভীর রাতে দেবু মাধবীকে আদর করে।মাধবী বলে “আমাদের একটা মেয়ে হবে।নাম দেবো পারুল।আমি সাত ভাই চম্পা আর পারুলের গল্প জানি”।
দেবু পিতৃত্বের আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠে।হাসতে হাসতে বলে “বেশ তো।তাই হবে” ।
পাশের বাড়ির মেয়েটা গান করে।কী সুন্দর ওর গলা।কাল থেকে নতুন গান তুলছে।মাধবী রান্না করতে করতে গায় “যখন জমবে ধূলা তানপুরা টার তারগুলায়/কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বার গুলায়”।
ময়না শোনে।বলে “এ গান তুমি গেয়ো না বৌমণি।হৃদয়টা ধড়ফড় করে”।
মাধবী বলে “এটা রবি ঠাকুরের গান।খুব ভালো গান”
ময়না বলে “তোমার মেয়ে হলে তুমি গান শিখিও।ওই টুসির মতো”।
মাধবী ঘাড় নাড়ে।
পুজোর আগেই বাড়িতে নতুন অতিথির আগমন ঘটবে।আকাশে বাতাসে আগমনী সুর।নিতাই বাউল ভীষণ ভালো গান গায়।নিমাইদীঘির পাশে ওর আখরা।সেদিন মাধবী বললে “গান শোনাও না নিতাই কাকা”।
নিতাই আগমনী গান শোনালে
“গিরি গনেশ আমার শুভকারী
গিরি গণেশ আমার শুভকারী
পুজে গণপতি পেলেম হৈমবতী
যাও হে গিরিরাজ আনিতে গৌরি”।
মাধবী থালা ভরে চাল আলু টাকা দিলে।নিতাই বাউল বললে “দীর্ঘায়ু হও মা”।
না।নিতাই বাউলের আশীর্বাদ ফলে নি।আগমনীতেই বেজে উঠলো বিসর্জনের সুর।পারুলকে জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল মাধবী।এয়োতি চিহ্ন নিয়ে ভাগ্যিমানি মা স্বর্গীয় রথে চড়ে বসল।আর তার পারলৌকিক কাজের দিন তার বয়স্ক সন্তান মাণিক রেজ বুকে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করতে করতে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলো।গোটা নিমাই দীঘি কেঁদে ভাসালে।
দেবু রেজ হৃদয়ে পাষাণ ভার নিয়ে বেঁচে আছে।কাল দোল পূর্ণিমা।কত কী রান্না হচ্ছে।চাঁপা রান্না করছে।সেই এক পদ।শুধু কোনো পদে স্বাদ নেই। এখানে তো হৃদয় নেই।ভালোবাসা নেই।শুধু পারুলকে দেখে দেবু।ওর মধ্যে তো মাধবীলতা আছে।দেবু বলে “তোর মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল।তোকে গান শেখাবে।।একটা গান কর না মা”!
পারুল গান ধরে।
গান শুনতে শুনতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে দেবু রেজ।পারুল অবাক চোখে বাপকে দেখতে থাকে।
–~০০০XX০০০~–