শিউলি
সলিল চক্রবর্ত্তী
‘ও রসূল ভাই ভালো গুড় হবে’?
“হবে, সাড়ে ছয় টাকা কেজি পড়বে বলো”।
রসুল মোল্লা মূলত ইঁট ভাঁটার শ্রমিক, কিন্তু পরিচিতি শিউলি বলে। নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে যায় খেজুর গাছ ঝুড়ে গাছের মাথা পরিষ্কার করা। হাতে দুই আড়াইশো গাছ তো আছেই। রসূল ও তার ভাই কামাল ইঁট ভাঁটার কাজ ছেড়ে খেজুর গাছ পরিচর্যায় নিযুক্ত হয়ে যায়। চলে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। কাজটি দেখতে অনেক সোজা, আদতে এটি অনেক কষ্টের কাজ। যেমন আমরা যখন ডাব কিনি তখন ডাব ওয়ালা দা দিয়ে খুব সহজে “ক্যাচ ক্যাচ” করে ডাবের মুখ ছাড়িয়ে দেয়, এই সহজে ডাবের মুখ ছাড়াবার জন্য দা টাকে দুই ঘন্টা ধরে শান দিতে হয় , আমরা সেই খবর রাখি না। ঠিক তেমনি শীতকালে আমরা রস ও পাটালি পয়সার বিনিময়ে তৃপ্তি করে খাই। এই গুড় রস কত কঠিন পরিশ্রমের পর আমাদের কাছে আসে আমরা তার খোঁজ রাখি না। এই কাজ জন্মলগ্ন থেকেই ম্যানুয়ালি হয়, কোনো মেশিনে তৈরী হয় না। এই কাজকে নিয়ে শিউলি সমাজে একটা প্রবাদ আছে -“নানা গাছ কাটে, নানী পানি পানা দেখে”। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাস ধরে চলে হাড় ভাঙা খাটুনি, তবে গরিব মানুষ অতিরিক্ত দুটো পয়সার মুখ দেখে। বছর পনেরো আগে খেজুর গাছ ঝুড়তে গিয়ে রসুলের বাম চোখে খেজুর পাতার কাঁটার খোঁচা লাগে। গ্রামের মানুষ তো ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি। ফলে চোখটি কানা হয়ে যায়। বর্তমানে রসুলকে সামনে রসুল ভাই বললেও পিছনে কানা শিউলি বলেই ডাকে। এই ডাক নিয়ে একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল – রসুল গাছে উঠেছে রস পাড়তে, সেদিন রসের পরিমান কম হওয়ায় রসুলের মেজাজটা বিগড়ে ছিল। এরই মধ্যে গাছ তলায় এক কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক এসে রসুলকে চেঁচিয়ে বললো -“কানা শিউলি এক ভাঁড় রস দিবি”? এই কথা শুনে রসুলের মেজাজ গেল আরো বিগড়ে, সে গাছ থেকে চিৎকার করে বললো – “যে কথা কয়েছাও তাতে রস কেন গুড় দেবানি”। লোকটি নিজের ভুল বুঝে কাল বিলম্ব না করে স্থান ত্যাগ করলো।
বসিরহাটের সন্নিকটে ধলচিতের মোল্লা পাড়া গ্রাম। চার পাঁচশো পরিবারের বাস। আশি শতাংশ পরিবারই মুসলিম। বাকি হিন্দু, এক ঘর কেবল ব্রাহ্মণ। ফলে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ পরিবারকে ঠাকুর বাড়ি বলেই সম্মধন করে। ওই পরিবারে ছোট দুই ভাই ফটিক আর দেবু। যদিও ওই নামে তাদের কেউ ডাকে না। গ্রামের লোক বড়ো ঠাকুর আর ছোট ঠাকুর বলেই ডাকে। গ্রামের মানুষজন ভালো কিন্তু শিক্ষা কালচারের খুব অভাব। অল্প বয়েস থেকে সব রুজি রোজগারে বেরিয়ে পড়ে, কেউ ইঁট ভাটায়, কেউ চাষের কাজে, কেউবা গরুর গাড়ি, ভ্যান চালাতে । নব্বই শতাংশ পরিবারই গরীব। ফটিক ওরফে বড় ঠাকুরদের পরিবার শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত পরিবার। সবই ঠিক আছে, তবে ফটিককে নিয়ে ঠাকুর পরিবার খুব সমস্যায় আছে। বছর আটেক এর ওইটুকু ছেলে, স্কুলে যাবেনা,পড়াশুনা করবে না, সারাদিন লোকের আগানে বাগানে টো টো করে ঘুরে বেড়াবে। এর গাছের আম ওর গাছের জাম,কারো গাছের খেজুর পেড়ে খাবে। ছাড়া গরুর মতো সারাদিন চরে বেড়াবে সন্ধ্যে হলে গোয়ালে ফেরার মতো ঘরে ফিরবে। বকে, মেরেধরে কোনো কিছুতেই কোনো ফল হয় না। সম্ভবত জন্মস্থানের প্রভাব ওর ভিতর প্রকট হয়ে উঠেছে।
রসুল মোল্লা কাঠের পাটাতন ফেলে তাতে সাদা বলি দিয়ে গাছ ঝোড়া বড়ো বড়ো দা গুলো ধার দিচ্ছে। ফটিক একপা দুইপা করে আস্তে আস্তে তার পাশে এসে দাড়ালো। রসুল মোল্লা মেজাজি মানুষ, কথা কম বলে। তা বললে তো আর ফটিকের চলবে না, ভাব জমাতে হবেই, নইলে খেজুরের কচি মুচি খাবে কি করে। সুতরাং ফটিক খেজুরে আলাপ শুরু করল। “কাকা তোমার দা গুলো না যাত্রা পালার তরোয়ালের মতো, শত্রুর গলায় বসবে আর কচ করে গলাটা মাটিতে পড়ে যাবে”। রসুল কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করে চলেছে। ফটিক ভাব ভালো না দেখেও আবার বললো – “কাকা, বড়ো পুকুরের বাগানে যে খেজুর গাছগুলো আছে, যেমন তার ঝাঁকড়া পাতা আবার বেশির ভাগ পাতার গোড়ায় মুচি থাকে, তাই না”? রসুল মোল্লা ফটিকের উদ্দেশ্যটা বুঝে ফেলে। তাছাড়া সে ফটিকের চরিত্র জানে। সে রেগে গিয়ে বলে – “দার কোপ শত্তুরের গলায় বসাতি হবে না, তোর পায়ে বসাবানে। তুই না ভদ্দর লোকের ছেলে! ইসকুলে যাবি নেখাপড়া করবি তা না আমাদের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছিস মুচি খাবি বলে। বড়ো লোকের ছেলে এত খাস তাতেও হয় না। তোর বাপ সামনের শনিবার কলকাতা থেকে ফিরুক সব বলে দেব”। ফটিক দেখলো কাকার মেজাজ বিরাট গরম, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পাশে কল তলায় খোদে কাকী একটা তলা কালো হাড়ি মাজছিলো। খোদে কাকী ফটিকে ডেকে বললো -“বড় ঠাকুর কাকার মেজাজ ভালো নেই, তুই এখন বাড়ি যা। ঘন্টা খানিক পরে আসিস, তখন আমি খেজুর পাতা আনতে যাবো বড়ো পুকুরের বাগানে। আমার সাথে গিয়ে মুচি খাস”। ফটিকের কথাটা খুব মনে ধরলো, তারপর এক দৌড়ে অন্যত্র চলে গেল।
রসুল মোল্লা দায়ে শান দিয়ে উঠে লুঙ্গিটাকে ভালো করে কাছা দিয়ে পরে তার উপর আরো ভালো করে গামছা জড়াল যাতে লুঙ্গি না খুলে যায়। আলগা শরীরে পিঠে বাঁশের তৈরী টুঙ্গিটা ঝোলাল, তার মধ্যে ভরলো ব্লেডের মতো ধারী আর বর্শার ফলার মতো মাথা ছুঁচল দা তিন খানি। বেরোনোর সময় খোদে বিবিকে বললো -“ঘন্টা খানেক পরে বড়ো পুকুরের বাগানে আসিস পাতা সরাতে হবে”। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে রসুল মোল্লা বাগান মুখো রওনা হলো। বাগানে ঢুকে প্রথমে একটা ফুট কুড়ির খেজুর গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো, তারপর আল্লাতালাকে স্মরণ করে এই মরসুমের প্রথম গাছটিতে উঠলো।
ফটিক ওরফে বড়ো ঠাকুরের আর তর সয়না। ঘড়ি তো নেই, এক মিনিটকে এক ঘন্টা হয়ে গেছে বলে মনে হতে লাগলো। মন পড়ে আছে বড়ো পুকুরের খেজুর বাগানে। কাহাতক আর এদিকে ওদিক ঘুরতে ভালো লাগে। ওদিকে যদি অন্য কেউ এসে মুচি নিয়ে চলে যায়। যেই মাত্র অন্যের মুচি নেয়ার কথা মাথায় এলো, অমনি খোদে কাকীর সাবধান বাণী মন থেকে উড়ে গেল। ফটিক ছুটলো বড়ো পুকুরের বাগানে। দূর থেকে আধা চুল কাটার মতো আধ ঝোড়া খেজুর গাছ দেখে তার তলায় গিয়ে হাজির হলো। গাছ তলায় গিয়ে ফটিক চমকে উঠলো। রসুল কাকা গাছ তলায় পড়ে থাকা কাঁটা ওয়ালা তাজা খেজুর পাতা গুলোর উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বর্শার ফলার মতো একটা দা তার পাঁজরের নীচে এক পাশে পিঠের দিক থেকে ঢুকে বুকের দিকে থেকে বেরিয়ে গেছে। চাপা পড়া খেজুর পাতার ফাঁক দিয়ে রক্ত টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে। চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে। ফটিক পাথরের মত দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড দেখলো। সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারলো না। ওইটুকু বাচ্চার পক্ষে একা কিছুই করা সম্ভব নয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে দৌড় লাগলো রসুল কাকার বাড়ির দিকে।
খোদে বিবি বাগানে যাবে বলে সবে মাত্র দরজায় শিকল লাগাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ফটিক ছুটতে ছুটতে এসে খোদে বিবির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকলো। খোদে বিবি ফটিককে অমন করে হাপাতে দেখে অবাক হয়ে বলল – “তুই ওরাম করতিছিস কেনো বড়ঠাকুর”? ফটিক ততক্ষনে একটু দম নিয়ে বললো -“কাকা***” । “কি কাকা, তোরে বকেছে”?
মাথা নাড়িয়ে ফটিক বললো-“না”।
-“তবে হাপাচ্ছিস কেন”?
ফটিক আরো কয়কে বার দম নিয়ে বলে-“রক্ত***”।
খোদে বিবি বাকিটা অনুমান করে, চিৎকার করে কেঁদে বলে উঠে, -“কেডা কোথায় আছ, শিখগিরি এস গোলামের বাপ গাছ থেকে পড়ে গেছে”। বলতে বলতে বড়ো পুকুরের বাগানের দিকে দৌড়ায়। খোদে বিবির চিৎকারে আশপাশের পুরুষ মানুষ যারা তখন বাড়িতে ছিল, সবাই ছুটলো খেজুর তলার দিকে।
খেজুর পাতার কাঁটার উপর থেকে যতটা সম্ভব সন্তর্পনে রসুল মোল্লাকে তুলে আনা হলো। জাকিরের তিন চাকার ভ্যান এনে তার উপর গোটা চারেক চটের বস্তা পেতে, রসুলকে আস্তে করে শুইয়ে দেয়া হলো। করিম ভাই সাবধানে পেটে ঢোকা দা টাকে বার করলো। এবার রসুল মোল্লাকে নিয়ে কয়কে জনে মিলে চললো বদরতলা হাসপাতালে। কিন্তু এত ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের পেসেন্টের জন্য বদর তলা হসপিটাল উপযুক্ত নয়। ওখানে একটু প্রাথমিক চিকিৎসা করে সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ট্রান্সফার করে দিলো। তার আগে বসিরহাট থানায় হসপিটালের তরফ থেকে এফ আই আর করা হলো। পুলিশ এলো কেস হিস্ট্রি নিলো তারপর এম্বুলেন্স ছুটলো কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশ্যে। সপ্তা খানিক ধরে চললো পুলিশ ইনভেস্টিগেশন। এদিকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চলেছে যমে মানুষে জীবন নিয়ে টানাটানি। অবশেষে মাস দুই মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অপরাজেয় রসুল মোল্লা বাড়ি ফিরলো।
এদিকে গ্রামে তখন একজনই হিরো, ফটিক ওরফে বড়ো ঠাকুর। সেদিন যদি ফটিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে অতি তৎপরতার সাথে একসিডেন্টের খবরটা না দিত, তাহলে হয়তো রসুল মোল্লা আজ এই দিনটা দেখতে পেত না। রসুলও তা বিলক্ষণ বুঝেছে। ফটিকের বাবা একটা হরলিক্স নিয়ে রসুলকে দেখতে গেলে, রসুল বলে -” দাদা, বড়ো ঠাকুরকে একটু পাঠিয়ে দেবেনখন, যার জন্নী আজ বেঁচে আছি, তারে দেখার জন্নী মনটা বড্ড আকুপাকু করতেছে”। এদিকে ফটিকের মনটাও ব্যাকুল হয়ে আছে রসুল কাকাকে দেখার জন্য। যতই তাকে বকাবকি করুক না কেন, গাছ ঝোড়ার সময় খেজুরের মুচি পেলে বলে – ‘ও ঠাকুর এইনে একটা মুচি”।
খোদে বিবি জীবনে এই প্রথম হরলিক্স গুলছে, ভাবখানা যেন সে রসুল মোল্লার দিদিমণি। হরলিক্স গুলতে গুলতে রসুলকে শাসনের সুরে বললো – “দেখো গোলামের বাপ, বড় ঠাকুরের বাপ বলে গেছে হললিক্সটা নিয়ম করে খেতি হবে, তালি গায় জোর পাবা”। রসুল মোল্লা বউয়ের কথার উত্তর দিতে যাচ্ছিল, এরই মধ্যে দরজার সামনে ফটিক এসে দাড়ালো। রসুল মোল্লা ফটিককে দেখেই মনে একটা প্রসস্তি এনে বললো – “আয় বাপ আয় তোরে একটু ছুঁয়ে ধন্যি হই, তুই আমার সাত জম্মের বাপ”। কথা গুলো বলতে বলতে রসুল মোল্লা ফটিককে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। আবেগপ্রবন হয়ে যে এই ভাবে কাঁদতে পারে ওই বদরাগি মানুষটা তা তার স্ত্রী খোদে বিবি কোনো দিন ভাবতেই পারেনি।
শিশু মনে, অপোক্ত চিন্তাশক্তি দিয়ে একটা কথাই ফটিকের মনে উথাল পাথাল করতে থাকলো — কি কারণে রাগি রসুল কাকা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।