পনেরই আগস্ট
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আজ স্বাধীনতা দিবস। সকাল থেকে দেশভক্তির আবেগ জোয়ারে ভাসছে সবাই। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রভাতফেরী বেরিয়েছে। এরপর পতাকা উঠবে। নির্মলবাবু সকালের দিকটায় প্রসন্ন থাকেন। গিন্নীর নজর এড়িয়ে জানলায় এসে বসা দুটো কাঠবেড়ালীর জন্য বরাদ্দ থাকে বিস্কুট আর তার পর আসে একটা মিশকালো দাঁড়কাক যার নাম কর্ভাস। তাকে পাঁউরুটির টুকরো খাইয়ে, নিজে এককাপ দুধচিনি ছাড়া চা খেয়ে থলি নিয়ে বাজার বেরোন।
আজকেও তাই বেরোলেন। ছুটির দিন বলে শুধু নয় আজ মেয়ে জামাই ও আসছে। বহুদিন পর আজ খাবার টেবিল জমজমাট ! ‘বল বল বল সবে’ কানে আসছে, বেশ শম্বুকগতিতেই বাজারের পথে পা বাড়ালেন। আজ মনটা ভারি ভালো লাগছে ! আজকের দিনটা আলাদা। দুশো বছরের বৃটিশ শাসনের পর আজ একটা জাতি বহুযুগ পরে মাথা তুলে দাঁড়ালো। কিন্তু সত্যি কি দাঁড়িয়েছে? বরং টলমল করছে সে ধর্ম আর বিভেদের রাজনীতিতে। যাক্ গে ! আজ এসব ভাবা নয় ! বাজারে টাটকা ইলিশ আর ফুলকপি সঙ্গে দই মিষ্টি হল ফার্স্ট প্রায়োরিটি !
………
বাজার করে বেরোতে বেরোতে ন’টা বাজলো। পার্কের সামনে পতাকা তোলা হচ্ছে, সঙ্গে ‘জনগণমন’। বুকের ভেতরটা চিন্ চিন্ করে ওঠে। মনে পড়ে যায় অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কথা। আহা ! কিছু পরোয়া না করে দেদার জীবনবলিদানের সেই আকূতি আজ কোথায় ! মনে পড়ে কানাইদাদুর কথা। একজন বৃদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কাছ থেকে দেখেছিলেন। অকৃতদার, তাম্রফলক পাওয়া সেই বিপ্লবী অনাহারে একরকম অবহেলায় মারা যান।
পতাকা উত্তোলনের পর জিলিপি বিলি হচ্ছে। বাচ্চাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নিজেও দুটো চট্ করে মেরে দিলেন। সুগার দেড়শোর ওপর ! তাতে কি হল ! আজ স্বাধীনতা দিবস ! এটুকু স্বাদ বদলের স্বাধীনতা তো পেতেই পারেন আজ।
বাজার ফেরতা উদাস হয়ে পড়েন। সামনে একটা পুরনো বাগানবাড়ি পড়ে। উনিশশতকী বাবু কোলকাতার জীর্ণ অবশেষ। গেট টপকে ভেতরে গেলেন খেয়ালে। আজ যেন ভূতে পেয়েছে। বিরাট দীঘি আছে ভেতরে, লোকে আজও রানীঝিল বলে। জঙ্গলাকীর্ণ বাগানে আম কাঁঠালের বন। মানুষজন কোন অজ্ঞাতকারণে ভেতরে আসেনা। জায়গাটা নির্জন আর শান্ত। একজন বুড়ো মালী থাকে বটে পাহারায়, সে ব্যাটাও এখন হাওয়া।
………
ঝিলের ঘাটের রকে বসলেন।খুব আরাম লাগছে। ঠান্ডা মৃদুমন্দ জোলো হাওয়া দিচ্ছে। কত পাখির কলরব। নির্মলবাবু শিশুর বিস্ময়ে তাদের ওড়াউড়ি দেখতে লাগলেন। দু একটা ফিঙে, বেনেবৌ, মাছরাঙা এমনকি ক্র্যাকর ক্র্যাকর করে একটা গাঙচিলও যেন পাক খেয়ে গেল। কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছে। সত্যি পাখিরা কত স্বাধীন।কত জায়গায় ইচ্ছেমত উড়ে যেতে পারে, কোন বাধা নেই, কোন পাসপোর্ট ভিসা নেই, কেবল উড়ে বেড়ানো।
নাঃ পাখিদের স্বাধীনতা দেখলে হিংসে হয়। মানুষ যত সভ্য হচ্ছে ততই পৃথক হয়ে যাচ্ছে সমগ্রতা থেকে। মানুষ এখন কেবল যাওয়ার আনন্দে মুক্তমনা হয়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ যাওয়ার কথা ভাবতেই পারবে না আর কোনও দিন !
নিজেকে মানুষ হয়েও আজ পাখিগুলোর কাছে ভীষণ পরাজিত বলে মনে হল তাঁর। ভাঙা ফোয়ারা আর শ্বেতপাথরের ভেনিসের ভগ্নপ্রায় আবর্জনা সদৃশ মূর্তি ছাড়িয়ে যখন একরাশ মনখারাপ নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন, হাত ঘড়িতে তখন এগারটা বেজে চল্লিশ প্রায়।দেরী হবার একটা যুতসই অজুহাত ভাবতে ভাবতে বুক জ্বালা করে একটা অম্বলের ঢেকুর উঠল, সেটা অসময়ের স্বাধীনতা দিবসের জিলিপির সশ্রদ্ধ উপসর্গ হিসাবেই !
–~০০০XX০০০~–