অন্তর্দাহ
মঞ্জুলিকা রায়
লিফটটা উপর থেকে নামছে, নীচে নামার জন্য থার্ড ফ্লোরে অপেক্ষা করছিল মঞ্জরি।
এটি একটি বিখ্যাত সোনার দোকান, এক এক ফ্লোরে এক একরকম গয়না রাখে এরা। আসার সময় যেসব সুবেশা নারী এবং পুরুষ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল যাবার সময় তাঁদের দেখা পাওয়া যায় না। হয়তো একদম বাইরে বেরনোর সময় গেটম্যান তাঁর মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে একটা নীরব নমস্কার জানায়, একদিক থেকে ভালোই, পেশাদারি আদবকায়দা খানিকক্ষণের জন্যই ভালো লাগে, বেশি মনযোগ অধিকাংশ মানুষকেই অস্বস্তিতে ফেলে।
থার্ড ফ্লোরে লিফটটা থেমেছে , মঞ্জরি লিফটে ঢুকে দেখে ভিতরে মাত্র একজন মহিলাই রয়েছেন, যাঁর চোখ নিজের মোবাইলেই আটকানো। মহিলা অসম্ভব রূপসী, শুধু রূপবতীই নন, মহিলা বেশ সাজতেও জানেন। একটু অগোছালো সাজ ওনার রূপকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পরনে একটা গোল্ডেন পাড় দেওয়া সাদা কেরালা তাঁতের শাড়ি। সোনা গায়ে যেটুকু আছে সেটুকুতেও বাহুল্য না থাকায় প্রথম দর্শনে লোকে সাজপোশাক নয়, ওনাকেই দেখবে। মহিলার মুখখানা কেমন চেনাচেনা লাগে মঞ্জরির, সে এবার সচেতন হয়ে চোখ সরিয়ে নেয় আর ভাবে সব সুন্দরীকেই প্রতিমার মতো দেখতে লাগে বলেই হয়তো তাঁদের মুখ পরিচিত বলে মনে হয়।
লিফটটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছাতেই মহিলা মোবাইল থেকে চোখ সরান, চোখাচোখি হতেই মহিলা সামান্য অবাক সুরে বলেন ” মঞ্জরি না? কতো দিন বাদে দেখা হলো তোর সাথে। ” মঞ্জরি এবার মহিলার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, আরে! এ তো তাঁদের স্কুলের দীপশিখা! মেয়েটা ভীষণ সুন্দর তো ছিলোই, তার উপর যেটা যোগ হয়ে ওকে আরও অপরূপা বানিয়েছে সেটাকেই বোধহয় গ্ল্যামার বলে।
— দীপা না? কতদিন পরে দেখা হলো বলতো?
দীপশিখা এগিয়ে এসে মঞ্জরির হাত ধরে।
– কলকাতায় কবে এসেছিস? স্কুলের কারোর সাথেই যোগাযোগ নেই তবু শুনেছিলাম যেন তুই কলকাতার বাইরে থাকিস।
– হ্যাঁ, আজকাল পুণেতে থাকি। তুই কি কলকাতাতেই আছিস?
– হ্যাঁ, আমার বাড়ি এই কাছেই, লেকের পাশে । চল, আমার বাড়িতে চল প্লিজ , আজ আমরা আড্ডা মারবো ।
— না রে, আজ যাবো না। দেরি হলে মা চিন্তা করবে।
— মাসিমাকে একটা ফোন করে দে আর বল রাতের খাবারটা তুই আমার সাথেই খাবি।
মঞ্জরি ডিনারের আমন্ত্রণে রাজি হয় না কিন্তু মাকে ফোন করে দীপশিখার বাড়ি যাবার কথা বলে।
দীপশিখা ফোন করে নিজের ড্রাইভারকে ডাকে, দীপশিখার বাড়িটা দেখে মঞ্জরি বোঝে দীপশিখারা বেশ পয়সাওয়ালা মানুষ। রবীন্দ্র সরোবরের উল্টো দিকে সাত তলায় লেকের মুখোমুখি ফ্লাট। দীপা জানালো, ফ্লাটটা নাকি অফিস থেকে পাওয়া।
দুই বন্ধু চা খেতে খেতে বসে পুরনো দিনের গল্প করছিল। দীপশিখা বলে ” তুই তো খুব ভালো ছিলিস পড়াশোনায়, মাধ্যমিকের পরে অন্য স্কুলে চলে গেলি। তারপর আর কখনো দেখা হয় নি আমাদের । এখন কোথায় থাকিস, কি করিস?
— টুয়েলভের পরে আমি বি টেক করেছি, অনিন্দ্য আমার ক্লাসমেট ছিল, বিয়ের সময় আমরা একই অফিসে ছিলাম । এখন দুটো আলাদা কোম্পানিতে রয়েছি, সানি মানে আমার ছেলে এবার টুয়েলভে উঠেছে। ন’মাসে ছ’মাসে কলকাতায় আসি মাকে দেখতে, দু চার দিন থাকি তারপর আবার ফিরে যাই।
— সোনার দোকানে কি কিনতে
গিয়েছিলিস?
— অনি মানে আমার বরের সামনের মাসে জন্মদিন, ওর জন্য একটা রিস্টলেট কিনেছি, ঘড়ি ছাড়া কিছু পরে না,আংটিও না, দেখি এটা পরে কিনা!
— আমার বর মানে মৈত্র সাহেবও কোনো অ্যাক্সেসারিজ ইউস করেন না। উনি সাজপোশাকের দিক থেকে একটু কনজারভেটিভ, অবশ্য উনি আমাদের থেকে বয়েসেও অনেকটাই বড়।
– তোর ছেলেমেয়েরা কি পড়েছে?
— কেউ নেই, আমার কেউ নেই। না সন্তান না আত্মীয়স্বজন, না বন্ধুবান্ধব। এই এতবড় বাড়িতে আমি প্রায়ই একা একা থাকি। মিস্টার মৈত্র মাসের অর্ধেক দিন ট্যুরে থাকেন , কখনো কখনো বিদেশেও যান, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, তাই একাই থাকি।
— একা থাকতে হাঁপিয়ে উঠিস না! একটা চাকরি বাকরি বা বুটিক টুটিক করলেও তো পারিস।
—- ভালো লাগে না রে! কিছুই ভালো লাগে না। বেঁচে থাকতে হয় বলে বেঁচে আছি। মা মারা গেছেন অনেক দিন হলো। বাপের বাড়ির দিকেও কেউ নেই, শ্বশুর শাশুড়ী অবশ্য এখনো আছেন, বর্ধমানে থাকেন। অনেক বয়েস হয়েছে, বলেন যে শহরের ফ্লাটবাড়িতে নাকি ওনাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। থাকনা আজ রাতটা আমার কাছে, তোর সাথে একটু মন খুলে কথা বলি।
দীপশিখা এতো পিড়াপিড়ি শুরু করে যে শেষে মঞ্জরি রাজি হয়ে যায়। সে একাই এসেছে কলকাতায়, একটা রাত নাহয় এখানেই কাটালো। টুকটাক খাবার খেতে খেতে দীপা বললো ” আচ্ছা, তুই পাপপুণ্য, কর্মফল এইসবে বিশ্বাস রাখিস? “
— সেইভাবে ভাবি নি রে কিছু , কখনো পাপ করে নি এমন মানুষ পৃথিবীতে দুর্লভ তবে দেখতে হবে সচেতন ভাবে অন্যায়টা যেন না হয় । আর যদি অনিচ্ছায় কিছু ঘটে তবে সেটার প্রতিবিধান করাটাও মানুষেরই কর্তব্য।
— অনিচ্ছায় কখনো পাপ ঘটে না, বড়জোর অন্যায় হতে পারে।
— অতশত জানি না তবে স্বেচ্ছায় না করলেও বিরাট একটা অন্যায় আমি একসময় করেছিলাম।
— কি অন্যায়? তোর আপত্তি না থাকলে বলতে পারিস ?
— সেইসময় আমরা গুরগাঁওতে থাকি, সানি তখনও ছোটো, আমি অফিস গেলে একটা মেয়ে সানির দেখাশোনা করতো। চেষ্টা করলে বাঙালি পরিচারিকা দিল্লি আর তার পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে পাওয়া যায়। রাখি মানে ওই মেয়েটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো ছিল , উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দেখে কেউ কাজের মেয়ে বলে ভাবতে পারতো না।
সানিকে খুব ভালো দেখাশোনা করতো, ওরও একটা বছর তিনেকের ছেলে ছিল, ছেলেকে সাথে নিয়েই আসতো। সন্ধ্যা বেলা আমি অফিস থেকে ফিরলে আমাকে চা জলখাবার দিয়ে রাতের রান্না সেরে বাড়ি যেত। ও যখন কাজ করতো তখন আমি আর ওর বাচ্চাটা সোফায় বসে টিভি দেখতাম। বাচ্চাটা আমার খুব ন্যাওটা ছিল, আমিও ওদের জন্য অনেক কিছু করতাম। রাখি আবারও প্রেগন্যান্ট হলো, প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করেছিল। আমি ওকে ডেলিভারির জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলাম।
ওর তিন মাসের জন্য ছুটিতে যাওয়ার দিন দুই আগে একটা ঘটনা ঘটলো। চাকরি পাবার পরপরই আমি আর অনিন্দ্য রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছিলাম, আমাদের দুই বাড়িই আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেয় নি, পয়সা ছিল না বলে কোনো অনুষ্ঠান হয় নি, বিয়েতে অনি আমাকে শুধু একটা আংটিই দিয়েছিল। খুদে খুদে হিরে বসানো সোনার আংটি তবে খুব দামী নয়। আমি ওটা সবসময় পরে থাকতাম, কখনো আঙুল থেকে খুলি নি, স্নানের সময় খুলে স্নান করতাম যাতে চকচকে ভাবটা নষ্ট না হয়। সেদিন আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল,অফিসে বেরনোর সময় তাড়াহুড়ায় আংটি পরতে ভুলে যাই । আমি স্নান করতে যাওয়ার সময় ওটা ড্রেসিং টেবিলের উপর খুলে রাখতাম। আংটিটা সেখানে নেই , আতিপাতি করে খুঁজলাম, সেই ঘরের মেঝে পুরো নিজের হাতে ঝাঁট দিলাম, কোথাও নেই।
প্রথমে কিছু মনে হয় নি, ভাবলাম হয়তো বাথরুমেই খুলেছি , তারপর হয়তো ভুলে গেছি। অনিকেও বলতে পারি নি, রাতে ভালো ঘুম হলো না, এটা নিশ্চিত যে বাড়িতে খুলেছিলাম তাহলে জিনিসটা কি করে গায়েব হয়ে গেল! সব সন্দেহের তীরই রাখির দিকে যাচ্ছিল, ভয়ংকর রাগ হলো। এতো কিছু মেয়েটার জন্য এতদিন ধরে করেছি, ওর ছেলে আর আমার ছেলে একই খাবার খায়, প্রেগন্যান্সিতে আমি ওকে বসিয়ে রোজ দুধ ফল খাইয়েছি, পাঁচ হাজার ক্যাশ টাকা দিয়েছি আর ও আমার সাথে এমন বেইমানি করলো!
মাথা গরম অবস্থাতেই ওকে গিয়ে বললাম ” তোর যা টাকার দরকার আমি দেব কিন্তু আমার আংটিটা ফেরত দে, ওটা তোর দাদার দেওয়া প্রথম উপহার। আমার কাছে ওর মূল্য টাকা দিয়ে হয় না। “
কিরকম হকচকিয়ে গেল, আমার মনে হলো ধরা পড়ে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে। আমতা আমতা করে কিছু বলেছিল কিন্তু আমি কঠিন হয়ে বললাম ” শোন, কাউকে এমনকি তোর দাদাকে পর্যন্ত জানাবো না, আমার জিনিসটা ফেরত দিয়ে দে। “
তখন কাঁদতে আরম্ভ করলো, কাঁদতে কাঁদতে বললো ” তুমি আমাকে এইরকম বলতে পারলে! “
রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল, ওর দিকে তাকাতেও ঘেন্না লাগছিল বলে সামনে থেকে সরে গেলাম। পরের দিন ওর মাকে নিয়ে এলো, বুড়িটা কাঠ বাঙাল, কি বলছিল তা আমার মাথায় ঢুকছিল না, আমি কড়া ভাবে বললাম ” ভালো চাও তো আমার জিনিস ফেরত দাও। আমি যদি থানায় যাই তাহলে তোমাদের কি অবস্থা হবে সেটা ভেবেছ! “
রাখি কিছু বলছিল না, আমার সদর দরজাটা ধরে তেরছা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। খানিক কেঁদে কেটে চলে গেল, যতই ভয় দেখাই তাই বলে একটা আঙটির জন্য আমি তো আর পুলিশের কাছে যেতে পারি না। অন্য কাজের মেয়ে রাখলাম , এটি স্থানীয় মেয়ে মানে হিন্দি স্পিকিং। এক রবিবার মেয়েটাকে দিয়ে বক্স খাটের নীচটা পরিষ্কার করাচ্ছিলাম তখন আংটিটা বের হলো। আমি যেন হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, নিজের কাছে নিজেই মুখ দেখাতে পারছিলাম না, শেষে ভাবলাম রাখির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।
রাখির খোঁজ করাতে যা জানলাম তাতে আমি পুরো ডিপ্রেশনে চলে গেছিলাম। ওর মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল আমি ওকে বিনা দোষে যে মানসিক অশান্তি দিয়েছি তার ফলেই হয়তো এটা ঘটেছে, তার মানে আমি প্রকারান্তরে একটা খুন করেছি। এতো শকড হয়েছিলাম যে অফিসে না গিয়ে সারাদিন শুয়ে শুয়ে কান্নাকাটি করতাম, মনে হতো রাখি শেষ দিন যেমন দরজাটা ধরে কাঁদছিল, ঠিক সেইরকম তেরছাভাবে দরজা ধরে কাঁদছে। অনির কাছ থেকে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না , আমাকে খুব বকাবকি করলো,তারপর সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গেল। কাউন্সিলিং শুরু হবার পর ধীরেধীরে অফিস যেতে লাগলাম কিন্তু অফিসে কাজ করতে পারি না, টার্গেট পূরণ হয় না, একদিন শরীর খারাপ লাগায় অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরছি দেখি রাখি রাস্তা দিয়ে ওর ছেলের হাত ধরে যাচ্ছে। বাচ্চাটা তো আমায় দেখেই মায়ের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে এসেছে ‘ আন্টি আন্টি ‘ করে। রাখি ওর ছেলেকে ডাকলো ” চলে আয় বলছি, অমানুষদের সাথে কথা বললে মেরে হাড় ভেঙে দেব। “
আমি সোজা ওর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম ” আমার অন্যায় হয়ে গেছে। তুই আমার আর আমার ছেলের জন্য পাঁচ বছর ধরে যা করেছিস তার দাম অনেক। তুই সংসার না সামলালে আমায় হয়তো চাকরিটা ছাড়তে হতো। যা হয়েছে ভুলে যা আর আমায় মাপ করে দে। “
ও তো কিছুতেই মানবে না, আমিও ছাড়ার পাত্রী নই, ওর সাথে ওর বাড়ি অব্দি গেলাম, শেষে আমার চোখে জল দেখে ও নরম হলো। আমি ওর হাসপাতালের কাগজপত্র চেক করে বুঝলাম ওর একটা অদ্ভুত ধরনের সমস্যা আছে যার জন্যই মিস ক্যারেজটা হয়েছে। ধরে প্রাণ এলো, যাক বাবা! আমার জন্য হয় নি বুঝে অনেকটা গ্লানি মুক্ত হলাম। ওকে বোঝালাম, বললাম যে ওর চিকিৎসা প্রয়োজন, সেই ভার আমি নিতে চাই। ধীরেধীরে ও বাস্তব পরিস্থিতিটা বুঝতে পারলো আর স্বাভাবিক হতে লাগলো। আমার ডাক্তারের কাছে ওকে বারেবারে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। ওর ছেলের পড়াশোনার খরচ আমি তুলবো সেই আশ্বাসও দিয়েছিলাম। ওর এরপর একটা মেয়ে হয়েছে, আমরা গুরগাঁও ছেড়ে চলে এসেছি দশ বছর আগে কিন্তু এখনো ওর ছেলের পড়াশোনার খরচ আমি তুলছি। আংটিটা পেয়েছি সেই কথা স্বীকার করতে অবশ্য পারি নি কিন্তু ও সেটা বুঝেছে। তাই আমি বিশ্বাস করি, চেষ্টা করলে সব অন্যায়েরই কিছু না কিছু প্রায়শ্চিত্ত আছেই ।
দীপা বলে – তোর কাজটা অন্যায় ছিল এবং রাখি অভাবী ছিল বলে সে তোর দেওয়া টাকাটা নিয়েছে, সেটাকে তুই প্রায়শ্চিত্ত বলে ভাবতে পারিস কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকার হলেও পাপের কোনো প্রায়শ্চিত্ত হয় না। সারাজীবন নরকযন্ত্রণা সইলেও পাপের কোনো প্রায়শ্চিত্ত হয় না।
– তুই এমন কোন পাপ করেছিস যে তার প্রায়শ্চিত্ত হয় না?
– প্ল্যান করে কারোর বেঁচে থাকার একমাত্র সাধন কেড়ে নিয়ে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়াটা হলো পাপ, ভাঙা গলায় দীপা বলতে থাকে ” মেঘে ঢাকা তারা সিনেমাটা দেখেছিস? নীতার বোন আর মা মিলে নীতার প্রেমিককে কেড়ে নিয়েছিল মনে আছে?
— নীতার প্রেমিক কিছু ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না ! সে না চাইলে ওরা কি করতে পারতো?
— ঠিক কিন্তু নীতার প্রেমিক বাইরের লোক, তার সাথে কি রক্তের সম্পর্কীয়দের এক করে দেখা যায়?
—- তুই কি বলতে চাইছিস, বুঝতে পারছি না। এখানে সিনেমার কথা আসছে কেন?
— ওই নীতার বোন যেটা করেছিল সেটাই হলো পাপ। আমিও একই কাজ করেছি।
মঞ্জরি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, দীপা বলে চলে ” আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা কখনো ভালো ছিল না। বাবা হঠাৎ মারা গেলেন, দিদির তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ার, পড়াশোনা ছেড়ে কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরিতে জয়েন করেছিল ও। আমি ওর থেকে অনেকটাই ছোট, আমাকে ও বোন নয় নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতো। নিজেকে বঞ্চিত করে আমার আর মায়ের প্রয়োজনীয় সবকিছুর যোগান দিতো। মিস্টার মৈত্র ছিলেন আমার দিদির প্রেমিক, দিদির সাথে ইলেভেন টুয়েলভ একসাথে পড়েছিলেন উনি। তারপর দিদি চাকরিতে ঢুকলেও দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। দিদির প্রেমিক হিসাবে প্রায়ই উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন।
প্রথম সমস্যা শুরু হলো যখন উনি ক্লাস ওয়ান ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরি পেলেন। দিদিরা বিয়ে করবে ঠিক করেছিল, আমার তখন আঠারো বছর বয়েস, পড়াশোনায় ভালো না হলেও পাকামিতে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম । মা বললেন ” তোর দিদি যদি বিয়ে করে চলে যায় তবে আমাদের কে দেখবে? তোর দিদি বাবার চাকরিটা পেয়েছে, ও তো বিয়ে না হলেও না খেয়ে মরবে না কিন্তু তুই যতই সুন্দরী হোস না কেন বিনা পয়সায় পার হতে পারবি না। ও চলে গেলে তোকে গলায় নিয়ে আমায় ডুবে মরতে হবে! “
প্রথম প্রথম মা এগিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর আমিই আসরে নামলাম। নানা ছলাকলায় দিদির অগোচরে ওর প্রেমিককে আমি ছিনিয়ে নিলাম। দিদির বয়েস হয়ে গিয়েছিল, তার উপর পরিশ্রম আর অযত্নে শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আমার দিদি কখনোই তেমন সুন্দরী ছিল না।
দিদি যখন জানতে পারলো তখন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিয়ে দিয়েছিল, বউভাতের পরের দিন থেকে দিদিকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সরকারি চাকরি ছেড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেছে তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না। দিদি চলে যাবার পরেই মায়ের চৈতন্য হয়, পাপের জ্বালায় তারপর মা-ও বেশিদিন বাঁচেন নি, আমিই শুধু বেঁচে আছি পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে।
আর কেউ না দিক, ঈশ্বর শাস্তি দিয়েছেন, আমার বা মৈত্র সাহেবের কোনো ত্রুটি না থাকলেও আমাদের সন্তান এলো না। ডাক্তার বললেন ওর স্পার্ম আর আমার ওভামের মধ্যে অ্যালার্জিক সম্পর্ক। তিন তিনবার আই ভি এফের চেষ্টা করেছি কিন্তু সাকসেস আসে নি। কাউকে অ্যাডপ্ট করতেও ভয় পাই হয়তো তাহলে হয়তো সেও আর থাকবে না। কেউ নেই, কোনো আনন্দ নেই, কারুর সাথে কথা বলি না, মিশতেও ভয় লাগে যে যদি সে দিদির কথা জেনে ফেলে !
মিস্টার মৈত্রর কোনো সমস্যা নেই, ও ভুলে গেছে কিন্তু কুড়ি বছর ধরে এই জ্বালাটা আমি সয়ে চলেছি। দিদিকে খুঁজে বের করার জন্য প্রফেশনাল হেল্পও নিয়েছিলাম কিন্তু কিচ্ছু জানতে পারি নি।
একজন রাতারাতি কর্পুরের মতো উবে গেছে, তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও আর কখনো টাচ করা হয় নি মানে সে আর বেঁচে নেই। আমার মতো প্রতারকের দিদি হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে শেষ হয়ে যাওয়াটাই ওর কাছে শ্রেয়তর হলো । “দীপশিখা বিছানায় উপুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।
মঞ্জরি কাঠ হয়ে দীপার কান্না দেখতে দেখতে ভাবছিল পাপ পূণ্য, স্বর্গ নরক অন্য কিছু নয়, অন্যায় করার পর যে অন্তর্দাহ হয় সেটাই নরক ভোগ !
ভিতরে ভিতরে মঞ্জরির কেমন করুণা মিশ্রিত বিতৃষ্ণা বোধ হতে থাকে , বেচারি দীপা! , নিজের দিদিকে বঞ্চিত করে ও আরাম ও বৈভবের জীবন চেয়েছিল কিন্তু ভাবতেও পারে নি যে ভাগ্য এতটা কঠিন, এতো বীভৎস হবে! বৈভব হয়তো পেয়েছে কিন্তু সুখ চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে।
–~০০০XX০০০~–