জীবনপুরের পথিক
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
চলো তবে।ঘুরে আসি জীবনপুর।যেখানে থাকে জীবনপুরের পথিক।বিচিত্র তার জীবন।সকলের সাথে তার জীবনের হিসাব মেলে না।তার জীবনের ছন্দ আলাদা,লয় আলাদা।এসো তবে।জীবনপুর এর সেই পথিকের জীবনকাহিনী শোনাবো।
রাঢ় বাংলার এক সদবংশে জন্ম হয়েছিল জীবনের।বিদ্যা বিনয় সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবার।তখন স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত।টুকরো করে রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা।জীবনের বাবা ছিলেন হরিশ ন্যায়রত্ন।বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্ররা আসতো লেখাপড়া শিখতে।সংস্কৃতের এই পন্ডিতের প্রচুর নাম।জীবন ছোটো ছেলে।আরো দুই ছেলে ধনঞ্জয় আর অনন্ত।
কাকভোরে উঠেছেন ন্যায়রত্ন।স্নান করে তিলকসেবা।স্ত্রী সৌদামিনীকে বললেন “তোমার পূজার ফুল তোলা হয়েছে”?
সৌদামিনী বলল “সব জোগাড় হয়ে গেছে।গৃহদেবতা গোপীনাথ এর ভোগের পায়েস হচ্ছে”।
পরম বৈষ্ণব পন্ডিত বলল “আমার গুণধর পুত্ররা কোথায়।শাস্ত্রশিক্ষা,নীতিশিক্ষা একেবারে কিছুই নেই।দিবানিদ্রা অলসের লক্ষণ।আমার পুত্ররা কী করে এমন হল আমি ভাবি”।
সৌদামিনী র মুখ ভার।গম্ভীর হয়ে বলে “ওদের অল্প বয়স।এই কাকভোরে উঠে ওরা কী করবে।আর ওদের কী এখন পুজোতে মন দিলে হবে”?
ন্যায়রত্ন বলে “তোমার এই প্রশ্রয়ে ওরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।মা হলেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।সেখানে তুমি ওদের আরাম আয়েশ শেখাচ্ছ”।
কাঁদতে বাকি থাকে সৌদামিনীর।মনে মনে গজগজ করে “কী অচলায়তনে এসে পড়লাম রে বাবা।সংসারে এত নীতি নিয়ম।প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত হয়ে যায়”
ঠিক এই সময় দিগম্বরী আসে।বলে “ও বৌ!জীবন কোনদিকে গেল?”
সৌদামিনী বলে “চুপ করো পিসি।।কর্তা শুনলে রক্ষা থাকবে না।জানোই তো কেমন বদরাগী”।
দিগম্বরী হাসে বলে “আগাগোড়া অমনি সব।তা জীবন যে বললে ঠাগমা চা করো।আমি থালার ছোট্ট উনুনে চা করলুম।তা উড়নচন্ডী ছেলে কোথায় যে চলে গেল।”
হঠাৎ পিসি ঠাগমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো জীবন ।পিসি চিৎকার করে “কোথাকার কাপড়ে ছুঁয়ে দিলি।আবার চান করতে হবে”।
জীবন বলে “তা করবে ঠাগমা।এই আমায় ভালোবাসো।কথা বলবো না যাও”।
পিসি ঠাগমা গলে জল।বললে “আমি কি তাই বললুম।আচ্ছা।চল।দুজনে চা খাই।”
দিগম্বরী বাল্যবিধবা।বিয়ের দুমাসের মধ্যে শাঁখা নোয়া খুইয়েছেন।শ্বশুর বাড়ির লোক বললে “অপয়া বৌ।বসিয়ে দিয়ে আয় বাপের বাড়িতে।”
দশ বছরের দিগম্বরীর পরনে তুলে দেওয়া হয় সাদা থান।বাপের বাড়িতে এসেও নিষ্কৃতি নেই।কত নিয়মে বাঁধা দিগম্বরীর জীবন।চুল গুলো কদমছাঁট।একাদশী পালন।পরপুরুষের মুখ দেখা বারণ।সব মেনে নিয়েছে দিগম্বরী।পুরোনো আমলের মাটির একটা ঘর ওর বাবা ওকে দিয়ে গেছে।ওখানে ই দুটো ভাত ফুটোয়।তবে না পাওয়ার মধ্যেও ওর মাতৃত্ব জীবনের দিকে ধায় ।জীবন ও পিসি ঠাগমা বলতে অজ্ঞান।
দিগম্বরীর জীবন না পাওয়ায় ভরপুর।নিয়মের বেড়াজালে আর সবার চোখ রাঙানিতে তার যৌবন ,কামনা বাসনা সব মরে গেছে।এখন তো বয়স হয়ে গেছে।শুধু বড় আঙিনার দিকে তাকালে মনে পরে সেই কবে যেন কোন আঙিনায় উলু দিচ্ছিল কারা।আর শাঁখের আওয়াজ ।লাল শাড়ি পরা ছোট্ট একটা মেয়েকে বরণ করেছিল কেউ।পাশে একটা মানুষ ছিল।হ্যাঁ।ওর স্বামী।কত বড়ো ওর থেকে ।
চা খাওয়া হয়ে গেলে দিগম্বরী চেঁচায়।বলে “কাদের ছাগল এসে নাউ গাছটাকে মুড়ো করে দিয়ে গেছে।দ্বাদশীতে একটু শাকের জন্য হা পিত্যেশ করে মরি”।
জীবন জানে পিসি ঠাগমার এই রাগটা ক্ষনেকের।একটু পরেই ফোকলা দাঁতে হাসবে আর বলবে “জীবন।হাটের বাজার থেকে আমাকে আশ্চর্য মলম এনে দিস না ভাই”।
আর জীবন ছুটবে আদেশ পালন করতে।
আজ চা খাবার পর আবার বৌ সৌদামিনী র কাছে গেল।বললে “ও বৌ।গুরুপুন্নিমে কবে রে?”
বৌ কাজ করতে করতেই উত্তর দেয় “পরের পুন্নিমেটা।”
দিগম্বরী বলে “পরেরটাতে একটু সত্যনারাণ দেবো।জীবনকে দিয়ে আগে থেকে রম্ভা আনাতে হবে।”
সৌদামিনী রেগে যায়।”এই তো সেদিন সত্যনারাণ পুজো করলে পিসি।আবার!”
দিগম্বরী বলে “ওই জীবনের জন্য মানত করি বৌ।তোর মনে নেই।জন্মের পর থেকে কত রোগে ভুগলো ছেলেটা”।
“মনে সব আছে।ওইজন্য তো তোমাকে এত ভালোবাসে জীবন।ওর জন্মের পর বুকের দুধটুকু পায়নি।বিছানা নিয়েছিলাম আমি।তুমি তখন জীবনের মা হয়ে গেছো”।
দিগম্বরীর চোখ চিকচিক করে ওঠে।জীবনটা ওর খেলনাবাটির মতো।শুধু জীবন আছে।জীবন যখন ঠাগমা বলে জড়িয়ে ধরে তখন হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক সত্তা অনাস্বাদিত অনুভবে জারিত হয়ে যায়।মনে মনে ঠিক করে রেখেছে এই ভিটেটুকু আর দেবোত্তর জমি জীবনকে দেবে।
ন্যায়রত্ন কৃষ্ণের আরাধনা করেন বাৎসল্য রসে।গোপাল হল সন্তান।এ ভক্তি মা যশোদার ভক্তি।জীবন এসব দেখে আর হাসে।ওর মুখে হাসি লেগেই থাকে।একদিন বাবাকে বললে “আমাকেই ভগবান ভাবতে পারো।আমি তো জলজ্যান্ত গোপাল।যা দেবে সাঁটিয়ে দেবো।তোমার গোপাল তো কিছুই খায় না।এ গোপাল গবগবিয়ে খাবে”।
ন্যায়রত্ন বলে “নাস্তিক হয়ে যাচ্ছ দিনদিন।সাধনার এ এক পথ।ঈশ্বরকে সন্তান ভাবা।বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পাঁচটি রসে সাধনার কথা বলা আছে।শান্ত,দাস্য,সখ্য,বাৎসল্য আর মধুর।”
জীবন বলে “তুমি তো বলেছিলে মধুর রস শ্রেষ্ঠ।শ্রীরাধা ওই রসে কৃষ্ণকে ভালোবেসেছেন।তবে তুমি কেন বাৎসল্য বেছে নিলে”।
ন্যায়রত্ন বলে “পূর্বপুরুষ থেকে ওই পথের সাধক আমরা।সনাতন নিয়ম”।
এই কথাটাই জীবনের মাথায় ঢোকে না।সনাতন আঁকড়ে পরে থাকা।তবে কী নিয়ম ই জীবন।সেখানে পাখির কলকাকলি,সুরমূর্ছনা কিছু নেই।পিসি ঠাগমাটাও তাই।দীপ নিভে গেলে যেমন ছাই জানান দেয় আমি একদিন আলো দিয়েছিলাম ঠিক তেমন।
প্রাঙ্গণে বড় তুলসীর মন্ডপ ।সুন্দর করে বাঁধানো চাতাল।আজ সকালে সেখানে বসে পুরোহিত দর্পণ পড়ছে হরিশ।দূরে রোয়াকে বসে অধ্যয়ণ করে ধনঞ্জয় আর অনন্ত।একটু পরেই বেশ কিছু ছাত্র আসবে।ন্যায়রত্ন বলল “অনন্ত।জীবনকে দেখছি না।সে কোথায়?”
অনন্ত বলে “ও আজকাল বাবাজির আখরাতে যায় বাবা”।
“বাবাজি মানে?সেই বাউল টা”বলেই উঠে দাঁড়ায় হরিশ।
দিগম্বরী তুলসীর পাতা তুলছিল।সকালে স্নান করে ফুল তুলসী দিয়ে গৃহদেবতার পুজো করা ওর প্রতিদিনের কাজ।জীবনের প্রসঙ্গ আসতেই সে চিৎকার করে উঠলো।”তোরা আবার ওকে নিয়ে পড়লি।ও আমার আপনভোলা ছেলে ।সেই কখন ঘুম থেকে উঠে পড়ে।তোদের মতো নাকি।তোরা দুজন তো বিছানা কামড়ে পড়ে থাকিস ।উপনয়ন হয়েছে জপ আহ্নিক এর ধার ধারিস না।ও আমার নিষ্পাপ।তোরা নিজেদের চরকায় তেল দে।”
হরিশ পিসিকে সমীহ করে চলে।ভালো ও বাসে।বললে “অমন বহির্জগতের টান থাকলে বিদ্যাভ্যাস করবে কী করে?এখন তো ওর শিক্ষালাভের সময়।উড়নচন্ডী হয়ে ঘুরে বেড়ায় নদীর ধারে।যত রাখালবালকের সাথে ঘুড়ি ওড়ায়।গুলি খেলে।বাঁশি বাজায়।জীবনপুরের শেষপ্রান্তে যেখানে বাঁশঝাড় তার পাশে কৃষ্ণদাস বাবাজির আখড়া।তাদের সাথে গান করে।এমন হলে ওকে ঘরে বাঁধা দায় হবে।ব্রাহ্মণের ছেলে।নিয়ম রীতি মানতে হবে তো পিসি”।
পিসি গজগজ করে।বলে “ওইটুকু দুধে বালক ছেলে।হাসবে খেলবে না।তা নয়।তোমাদের নিগড়ে বাঁধতে পারলে বেঁচে যাও।হেসে খেলে থাকুক আমার জীবন।”
তারপর ই বলে “অনন্ত আর ধনঞ্জয় কে তুই লেখাপড়া শেখা ভালো করে।জীবন আমার জমিজিরেত দেখশোন করবে।”
হরিশ বলে “এ কেমন কথা বলছো তুমি পিসি।জীবন তোমাকে মান্য করে।তুমি ওকে বোঝাবে কোথায়।তা না করে রাগ দেখাচ্ছ।যাইহোক।আমি ঠিক করেছি সামনের ফাল্গুন মাসে ভালো দিন আছে।জীবনের উপনয়ন দিয়ে দেবো দ্বিজত্বপ্রাপ্তি ঘটলে ওর মনের অস্থিরতা কমবে।”
পিসির মুখে হাসি ফোটে এবার।আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললে “আমার জীবনের পৈতে।তবে ভিক্ষেমা আমি হবো”।
পিসির মাটির ঘরটা জীবনের প্রাণের ঘর।এখানে শুধু ভালোবাসা।নিয়ম তো ওবাড়িতে।পিসির ফোকলা দাঁতের হাসি আর হাড় বের করা শীর্ণ হাতের স্পর্শ বড় নিবিড়।যেন স্বর্গীয়।
আজ দিগম্বরীকে বড় খুশী আর উচ্ছল দেখাচ্ছে।বারবার ওবাড়িতে যাচ্ছে।সৌদামিনী কে দেখে বললে “ও বৌ।দেখতে দেখতে পৈতের দিন চলে আসবে।খোলা মোগলাবে কে ঠিক করিচিস।ওই ঘোষাল গিন্নিকে বলবি।নৈলে আর কে আছে।মঙ্গলঘট ওকে দিয়েই সাজানো হবে”।
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলার পর বলে “জানিস বৌ।খুব ছোট্টবেলা যখন মা বলত দিগম্বরী মঙ্গলঘট সাজা।এই নারীজন্ম শুধু সকলের মঙ্গল চায়।সেসব অনেক আগের কথা।আমি তো বেধবা।জীবনের শুভকাজে আমাকে ওসব তো ছুঁতে নেই।তবে আমি তো মা।তুই তো আমায় জীবনকে দিয়েছিস।চারদিনের দিন তুই আগে সূর্য দেখাবি বৌ।তারপর আমি রাজবেশ পড়িয়ে জীবনকে সব ঠাকুর থানে নিয়ে যাবো।বাজনা হবে।কত আনন্দ হবে বৌ”
এসব কথা বলতে বলতে দিগম্বরীর চোখ জলে ভরে যায়।সৌদামিনী পিসিকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।বলে “মঙ্গলঘট তুমি সাজিও পিসি।আমার জীবনের মঙ্গল হবে”।
খুব ধূমধাম করে জীবনের পৈতে হবে।ন্যায়রত্ন আয়োজনের ত্রুটি রাখে নি।আত্মীয়স্বজন আমণ্ত্রিত।ঘরে মিষ্টি তৈরি হবে।এক একটা মাছ প্রায় সাড়ে তিনকেজি।ন্যায়রত্ন বললে “জীবন ছোটছেলে।এটাই শেষ উপনয়ন।তাই সকলকেই বললাম”।
দিগম্বরী হাসে।এতদিন পর যেন ওর নিজের কিছু একটা হচ্ছে।লাঞ্ছিত আর বঞ্চিত জীবনে এটাই পরম পাওয়া।কিন্তু খাওন দাওনের দিন ঘটল এক বিরাট ব্যাপার।সব র মাথায় হাত।ন্যায়রত্ন বললে “রান্না যা হয়েছে তাতে অত লোককে খাওয়ানো দুঃসাধ্য”।
দিগম্বরী বললে “আয় বুঝে ব্যয় করবি তো।তুই অত লোক বললি কেন”?
ন্যায়রত্ন গম্ভীর হয়ে বললে “এই কাজ আমার নয়।তোমার গুণধর জীবন করেছে।যত রাখাল বালক,গরীব গুর্বো সবাই কে বলেছে আমার পৈতে।তোদের নেমন্তন্ন।তারা দল বেঁধে বেঁধে আসছে”।
চারদিন এর দিন ব্রহ্মচারী জীবন দেখলে ওর ভিক্ষার ঝোলাতে কত কী ।সোনার জিনিস দিয়েছে আত্মীয়রা।এরসাথে ঘড়ি,কাঁসার থালা কত কী।জীবন দেখলে বেশ কিছু টাকাও পড়েছে ঝোলায়।গুনে দেখলে প্রায় পাঁচহাজার।ওগুলো পকেটে নিয়ে নিল ও।
এদিকে ন্যায়রত্ন ডাকলে জীবনকে।বলল “এ কী কান্ড!এত লোক নিমন্ত্রণ করেছ।জানাও নি।কী করে খাওয়াবো?”
জীবন বললে “ওসব ভাবতে হবে না।ওদের আলাদা ব্যবস্থা”।বলেই বাইরে যেখানে রাখাল বালকেরা জড়ো হয়েছে তাদের ডেকে পিসির বাড়ির উঠোনে গর্ত করে উনুন করে ফেললে।তারপর ঝোলায় পাওয়া টাকা দিয়ে কাঠ কিনে এনে বড় কড়ায় রাখালেরা চাপিয়ে দিলে খিচুড়ি।দিগম্বরী ব্যবস্থাপনা তে হাত লাগালো।দুটো বাড়িতে চলছে খাওয়া দাওয়া।হৈ হট্টগোল।ন্যায়রত্ন ছেলের কান্ড দেখে হতবাক।আবার মনে মনে ভাবলে এমন হৃদয় কটা ছেলের হয়!
কৃষ্ণদাস বাবাজির আখড়া গ্ৰামের শেষ প্রান্তে।জীবন ওখানে চলে যায় মাঝে মাঝেই।গান করে ।জীবনকে দেখলেই বলে “এই তো আমার প্রাণের ঠাকুর।তা ঠাকুর।তুমি আমার মনের মানুষ।তোমাকে খুঁজে বেড়াই রাত্রিদিন।কখন দেখা দাও আবার কখন শূন্যে মেলাও!”
জীবন বলে “আমি বুঝতে পেরেছি।তুমি বলতে চাইছো যে ভগবানের নির্দিষ্ট আকার নেই।কিন্তু আমরা তো মূর্তি পুজো করি।কত প্রকার।”
কৃষ্ণদাস হাসতে থাকে।বলে “হ্যাঁ গো ঠাকুর।আমরা বাউল।মনের মানুষ কে ভগবান ঠাউরাই।”
জীবনের অদ্ভুত লাগে এইসব কথা।মনের মানুষ যদি আরাধ্য দেবতা হন তবে তো সব মানুষের মধ্যেই মন আছে।কত সহজ হিসেব।আবার বাবার শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন ও বেশ দৃঢ়।দুরকম মতের মধ্যে মিল খুঁজতে চায় ।কৃষ্ণদাস বুঝতে পারে এই ছেলে দোটানায় পড়েছে।হাসতে হাসতে বলে চলে “মুক্তি চাই বাপু।বাধা থাকলে চলবে নি।মানুষ, ভগমান,প্রকৃতি এই তিনের মিশেল ঘটাতে হবে।”
জীবন বলে “একটা গান গাও।শুনি”
কৃষ্ণদাসের একতারাটা জীবন এগিয়ে দেয় ।উদাস হয়ে জীবন শোনে বাবাজির দেহতত্ত্বের গান
“খাঁচার ভিতর অচীনপাখি কেমনে আসে যায়/
ধরতে পারলে মনবেড়ি/
দিতেম পাখির পায়”
ন্যায়রত্ন জীবনকে বাঁধতে পারে নি।তার আজন্মলালিত সংস্কার এর বিরুদ্ধে জীবন যেন মূর্তিমান বিদ্রোহ।ধনঞ্জয় আর অনন্ত এখন সংসারী।আর জীবন।সারাদিন সে কী যেন সব কাজ করে।কিন্তু যেদিন মাঝিপাড়ায় গিয়ে ছন্দাকে বিয়ে করে ঘরে এল সেদিন ন্যায়রত্ন জীবন কে ডেকে বললে “আজ থেকে তুমি আমার ছেলে ন’ও।এতবড় সাহস তোমার।তুমি তো জানো ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কোনো বিবাহ মেনে নেবো না।
জীবন জানতো এ বিয়ে বাবা মেনে নেবে না।তার ইচ্ছেও ছিল না বাবাকে আঘাত দেবার।এসব নিয়ে তার ভাববার অবসর ছিল না।ছন্দার সাথে ওর বিয়েটা তবু হয়ে গেল।
কথাতেই আছে।জন্ম মৃত্যু বিয়ে/তিন বিধাতা নিয়ে।মাঝিপাড়ার পাশ দিয়ে যেখানে জলঙ্গী বয়ে গেছে সেখানে মাঝে মাঝেই চলে যেত জীবন।ওখানে বন্ধুত্ব হয়েছিল সদার সাথে।ওদের ছিল জেলে নৌকো।চলত নৌকাবিহার।
গানপাগল জীবন একদিন মায়াপুর গিয়েছিল।সদা বলেছিল “যাবি না কি মায়াপুর।বৈষ্ণব ভক্তরা যাচ্ছে।”
জীবন বলেছিল “যাবো না মানে।অবশ্যই যাবো।সাহেবগঞ্জে যেখানে গঙ্গার সাথে জলঙ্গী মিশেছে সেখানটা দেখেও আসবো “
সেদিন নৌকাযাত্রায় হরিনামের বন্যা বয়েছিল।সবাই মাতোয়ারা।
জীবন দেখল কারা যেন মাটি কাটছে নদীচর থেকে।বলল “এই সদা।ওরা কারা”?
সদা বলেছিল “চারদিকে ইঁটভাটা।নদীকে এইভাবে শেষ করে ওরা”।
সদার সাথে ওদের বাড়ি গিয়েছিল জীবন।ওখানে ছন্দাকে দেখেছিল।ছন্দাই বলেছিল সদাকে “তোমার বন্ধু তাহলে নিষ্কর্মা অবতার”।
ছন্দার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সাহেবগঞ্জে।সদার আমণ্ত্রণে সাড়া না দিয়ে পারেনি জীবন।বেশ ঠিকমতো সব চলছিল।বিভিন্ন কাজে সাহায্য করছিল জীবন।হঠাৎ একটাখবর এসে সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল।বরের নৌকাডুবি হয়ে মৃত্যু হয়েছে।এমন একটা ঘটনার সামাল দিতে গিয়ে ছন্দাকে বিয়ে করে জীবন।
ন্যায়রত্ন বিচক্ষণ মানুষ।বলল “বিয়ে যখন করেছ তখন সংসার করো।তবে আমার সংসারে তোমার থাকা চলবে না।”
জীবন কথা বাড়ায় নি।সে অপেক্ষা করবে।নিশ্চিত বাবা একদিন তাদের আবার কাছে টানবে।
জীবনের সংসার পিসিঠাগমার মাটির ঘরেই শুরু হল।ঠাগমা বললে “জীবন ছেড়ে কোথায় যাবো”!
দিগম্বরীর মাটির ঘর যেন সব পেয়েছির দেশ।ছন্দা পিসি ঠাগমাকে সেবা আর যত্নে ভরিয়ে দিলে।দিগম্বরী বললে “হরিশ।তুই জাতটাই দেখলি।আসল ফেলে নকলে মজলি”।
অনন্ত আর ধনঞ্জয় পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত আর সংকীর্ণ মনা।ওদের বৌরা ন্যায়রত্নের সেবা করা তো দূর অস্ত,মুখের উপর কথা বলে।এখনো দুবেলা সৌদামিনী কে হাঁড়ি ঠেলতে হয়।ন্যায়রত্ন একদিন ছেলে বৌ দের ডেকে বলল “আমাদের বয়স হয়েছে।তোমাদের মা কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে।তাই এখন থেকে তোমরা দুই বৌ দুইবেলা ভাগাভাগি করে সংসারের কাজ করবে।”
ন্যায়রত্নের কথায় দুই বৌ রেগে আগুন।বললে “আমরা কী বাড়ির কাজের লোক যে সকলের পিন্ডি রাঁধবো।”
এখানেই শেষ নয়।অপদার্থ দুই পুত্র বললে “ওরা অনেক উঁচু বংশের মেয়ে বাবা।ওরা এসব কাজ করতে পারবে না”।
ক্ষোভে,দুঃখে আর অপমানে ন্যায়রত্ন ম্লান হয়ে গেলেন।তীব্র অভিমানে বললে “তোমরা তবে নিজেদের মতো থেকো।তোমাদের মা আর আমি আলাদা খাবো”।
দুই বৌ যেন এই প্রতীক্ষাই করছিল।আকাশের চাঁদ ওদের আপনি ধরা দিলে।
দিগম্বরী র সংসারে অভাব আছে।সকালে বাঁশি নিয়ে বসেছে জীবন।প্রাণের নিঃশ্বাস ঢেলে দিলেই বাঁশরীতে সুর ওঠে।ছন্দা বলে “ও ঠাগমা।তোমার নাতি জাত শিল্পী।সময় বেঁধে ঘড়ি ধরে কোনোকাজ ওর দ্বারা হবে না।আর আজ তো মনে হচ্ছে ডাকলে সাড়াও দেবে না।তাহলে কী রাঁধবো”?
ছন্দার মুখের কথা শেষ হয় নি।দেখলে সদা এসে হাজির।দিগম্বরী বলে “কত কী এনেছো বাপ।”
সদা কান পর্যন্ত হাসে।বলে “নাগো ঠানদি।কিছুই তেমন আনিনি।সব্জী এনেচি কিছু।আর সাহেবগঞ্জে গিয়েছিলাম ইলিশ ধরতে।কটা নিয়ে এলাম”।
ছন্দা বলল “ঠাগমা ।আমি একবার ওবাড়িতে বাবা মা এর কাছে যাবো”?
দিগম্বরী বলল “আজ থেকে ওরা আলাদা খাচ্ছে”।
জীবনের বাঁশি বাজানো থেমে গেল।বলল “কারা আলাদা খাচ্ছে”?
দিগম্বরী বলল “হরিশ আর বৌ।”
জীবন অস্থির হয়ে ওঠে।বাঁশি রেখে ওবাড়ি যেতে চাইলে ছন্দা বাধা দেয়।বলে “আমি যাচ্ছি”।
ন্যায়রত্ন অশীতিপর বৃদ্ধ।আগের মতো ছাত্র আর নেই।সংস্কৃত শাস্ত্রের সেই রমরমার যুগ আর নেই।তবু সারাদিন ধরে কয়েকটি ছাত্রকে পড়ান।ক্লান্ত হয়ে যান আজকাল।উঠানের চাতালে এক ছাত্রকে সুভাষিতাবলি পড়াচ্ছিলেন “পিতুরপধিকা মাতা গর্ভোধারণ পোষ্যনাৎ/
অত হি ত্রিষু লোকেষু নাস্তি মাতৃসম গুরু”
পড়াতে পড়াতে উদাস হচ্ছিলেন ন্যায়রত্ন।এসব তো নিজের পুত্রদের ও শিখিয়েছিলেন।কোথায়।ব্যবহারিক প্রয়োগ তো নেই।
সৌদামিনী উনানে আঁচ দেবে।কয়লা আনতে ছাঁচতলায় নেমেই শুনতে পেলে কে যেন ডাকছে “মা”।
সৌদামিনী ছন্দা কে দেখতে পেয়েছে।বলল “কী গো ছোট বৌ।আজ রান্না করো নি?”
“করবো মা।তার আগে আপনার কিছু কাজ করে দিয়ে যাই।ঠাকুর আমার হাতে খাবেন না।তবে কয়লা ভেঙে আঁচটা দিয়ে যাই।আর জলটা তুলে যাই।ঠাকুর স্নান করবেন।আপনার রুগ্ন শরীর।এত কাজ করলে যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন”।
সৌদামিনী মৃদু হাসলে।বললে “তাই দাও বৌ”।
ছন্দা উনানে আঁচ দিতে দিতে কানের কাছে মুখ এনে সৌদামিনী কে বলে “সদা দাদা ইলিশ এনেছে।আমি বেছে ধুয়ে দিয়ে যাই।আপনার ছেলের মুখে শুনেছি ঠাকুর ইলিশ খেতে ভালোবাসেন”।
আবেগে সৌদামিনী ছন্দাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
ছন্দা বলে “কাঁদবেন না মা।মা এর চোখের জলে অনর্থ ঘটে।একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে”।
দিগম্বরী মাছ খায় না।ছন্দা আজ খুব খুশি।সদা দাদা খাবে।শাশুড়ি কে ইলিশ দিয়ে এসেছে।ন্যায়রত্ন ওকে দেখেছে।কিছু বলে নি।রাগ করে নি।যেন নতুন একটা জীবনের ইঙ্গিত পাচ্ছে ছন্দা যেমনটা ও চেয়েছিল।
দিগম্বরী ফোকলা দাঁতে হাসে।বলে “জানিস বৌ।ওবাড়িতে ইলিশ রান্না হচ্ছে।হরিশ বললে জীবনের বৌটা খুব ভালো হয়েছে”।
ছন্দা হাসে।বলে “তোমার জন্য উচ্ছে দিয়ে ডাল করছি ঠাগমা।আর ডালের বড়া।”দিগম্বরীর আনন্দ যেন ধরে না।কে বলবে পঁচানব্বই বছরের বৃদ্ধা।যেন টাট্টুঘোড়া।
বর্ষা ঢুকতেই এবারে সবকিছু যেন তছনছ করে দিল।টানা পাঁচদিন বৃষ্টি হয়েই চলেছে।সদাদের গাঁ উদয়নগর এ জল ঢুকেছে।ঘরের উঠুনে জল।ন্যায়রত্ন রেডিও চালিয়ে শুনছে।হঠাৎ কী মনে হল।দিগম্বরীর ঘরের দিকে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দেয়।ছন্দা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ডাকে “আসুন বাবা”।
ন্যায়রত্ন গম্ভীর হয়ে বলে “শোনো গো মেয়ে।আজ জলঙ্গীর জল আরো বাড়বে।সরকার থেকে জল ছাড়বে নদীতে।তোমার দাদা সদাকে বলে পাঠাও সে যেন সংসার নিয়ে এখানে চলে আসে।ওখানে থাকাটা নিরাপদ মনে করছি না”।
ছন্দা বলে “একটু চা খেয়ে যান বাবা”।
হরিশ ন্যায়রত্ন থতমত খায় ।বলে “না থাক।তোমার মা এর শরীর গতিক ভালো নয় ।আমাকে ওষুধ আনতে যেতে হবে।জীবন তো বাড়িতেই নেই।এখন আমাকেই বেরোতে হবে”।
ছন্দা ছুট্টে চলে যায় ওবাড়িতে।সবকাজ করে দেয়।তারপর বলে “আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি।এই বৃষ্টিতে আপনি বেরোবেন না।ভীষণ পিছল পথঘাট”।
ন্যায়রত্নের কেমন যেন মায়া হয় মেয়েটার উপর।সত্যি খুব ভালো মেয়েটা।
জলমগ্ন উদয়নগর।ওখানে ত্রানকার্যে মত্ত জীবন।বাড়িতে কী হচ্ছে খেয়াল নেই।এদিকে কৃষ্ণদাসের মন বড় ব্যাকুল।জীবন কদিন আসেনি।বড় ভালোবাসে জীবনকে।নিজে গান শিখিয়েছে।কী ভালো গলা।এমন উদাত্ত সুরে সবাই মোহিত হয়ে যাবে।তবে পাগল ছেলে কিছুতেই কোথাও গাইবে না।
আজকাল জীবনের জন্য পাগল হয় ন্যায়রত্ন।ছন্দাকে বলে “ছেলেটাকে বাঁধতে শেখো।ও আমার আপনভোলা।কতবড় মন ওর।”
এবারের বৃষ্টিতে দিগম্বরীর রান্নাচালা টা পড়ে গেল।এখন তো বৃষ্টি না থামলে ঠিক করাও যাবে না।দিগম্বরী বললে “বৌ।থালায় পাতা উনুনে ভাতে ভাত চাপা”।
ছন্দা বলে “অতগুলো লোক খাবে।বড় হাঁড়ি চাপাতে হবে।ওই উনানে হবে না ঠাগমা”।
দিগম্বরী রাগ করে জীবনের উপর।গর্জায় “এমন ছেলে নিয়ে হয়েছে জ্বলন।”
ন্যায়রত্ন এবাড়িতে এসে সব শোনে।দিগম্বরী কে বলে “বৌকে এবাড়িতে রান্না করতে বলো পিসি”।
এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আনন্দের জোয়ার।অনন্ত আর ধনঞ্জয়ের বৌ মুখ ব্যাঁকায় আর বলে “আদিখ্যেতা”।
ছন্দা ওসবে কান দেয় না।বড় হাঁড়িতে সে আজ খিচুড়ি চাপিয়েছে।
ন্যায়রত্ন বসে থাকে ।সামনে গীতা খোলা।কাকভোরে স্নান করে পুজো সারা হয়ে গেছে।পথের দিকে মাঝেমধ্যে তাকায়।ছন্দা জানে জীবনের প্রতীক্ষায় আছে বাবা।ঠিক এই সময় কৃষ্ণদাস হাজির।বলে “পেন্নাম হ’ই গো কর্তা।তা আপনার শরীল গতিক কেমন”?
ন্যায়রত্ন অবাক হয়।বলে “তুমি এদিকে কেন।আমি তো ভাবলাম জীবন তোমার ওখানে”।
কৃষ্ণদাস বলে “অমন ছেলেকে যে সবার পেয়োজন।আপনার বহু সাধনার ফল ও।কত সুন্দর গলা।বলি ঠাকুর।তুমি গান গাও ।মহান শিল্পী তুমি।সংসারে অর্থের পেয়োজন আছে।তা বলে কী বাবাকে আর আঘাত করবো না।বাউল গান ওঁর পছন্দ নয়।”
ন্যায়রত্ন বলে “একটা গান করো শুনি”।
কৃষ্ণদাস গড় হয়ে পেন্নাম করে আবার।বলে “আমার পরম ভাগ্যি”।বলেই গান ধরে “জলঙ্গী নদী রে এএএএ
তোর বুঝি দয়ামায়া নাই
তোর বুঝি দয়ামায়া নাই।
কতবাড়ি কতজমি নিয়েছ যে তুমি
এখনও কী খুধা মেটেনি
জলঙ্গী নদী রে এএএএ
তোর বুঝি দয়ামায়া নাই”
“এমন পাগল করা সুর।বড়।উদাস করে কৃষ্ণদাস।আমার জীবন কী এমন গান গাইতে পারে।” অশ্রুসিক্ত নয়নে ন্যায়রত্ন বলে।
কৃষ্ণদাস আবেগে বিগলিত হয়ে যায়।বলে “আপনার ছেলে জীবনপুরের পথিক।জীবনের গান গায়।অনেক অনেক বড় শিল্পী।তাই তো কইছি কর্তা।আপনি ওরে গান গাইতে বলুন।ও প্রচুর নাম করবে”।
ন্যায়রত্ন বলে “মণ্ত্রের থেকেও গানের অনেক শক্তি।জীবন গান গাইবে কৃষ্ণদাস।”
কৃষ্ণদাস হাসিমুখে বিদায় নেয়।কিছু পরেই জীবন বাড়িতে আসে।ন্যায়রত্ন দেখতে থাকে জীবনকে।আজ একসাথে সবাই খাবে।খেতে বসে জীবন বলে “সামনের সপ্তাহে পলাশী পাড়াতে বাউলগান হবে।”
ন্যায়রত্ন হাসে।রেডিও টা দেখিয়ে বলে “কদিন পরে ওটাতে তোমার গান শুনবো”।গানের সুর সব মিলিয়ে দিল।
–~০০০X(সমাপ্ত)X০০০~–