রাস্তা পারাপার
নিলয় বরণ সোম
কলেজ জীবনে একটা রসিকতা খুব চালু ছিল –
“ Why did the tiger cross the road ?”
এর উত্তরে বলতে হত , ”He saw one zebra crossing “.
এর অব্যবহিত পরের প্রশ্ন ,”Why did the other tiger cross the road ?”
এর উত্তর, “ He saw another zebra crossing “
এর পরে নিলয় বরণীয় একটা সংযোজন মার্কেটে বেরিয়েছিল – “ Why did the next tiger did not cross the road ?”
এর জবাব কেউ পারত না , আমাকে বলতে বললে উত্তর হত, “ He did not feel like !”
এটা শুনে জনগণ খুব বোর হত , মনে আছে।
বাঘ আর জেব্রাকে রাস্তা পার হতে না দেখলেও , বিড়াল কখনো রাস্তা পার হলে ড্রাইভারদের অস্বস্তি আমরা সকলেই দেখেছি। কাটান দেওয়ার জন্য ওরা গাড়ির কাচে আঁক কেটে একটা মন্ত্র পড়েন কিন্তু এই কুসংস্কারের মুলে কি আছে , জানা নেই।
তবে যেকোন জঙ্গুলে জায়গায় ঘুরতে গেলে কখনো সখনো রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বুনো জন্তুদের মুখোমুখি হতে হয় , এমনকি কেউ কেউ হাতির পালের মুখেও পড়েছেন।
একটা দুটো গল্প আমারও আছে , বলেই ফেলি।
২০০১ সাল। আমি তখন আফ্রিকার দক্ষিণপ্রান্তে বতসোয়ানার হ্যাবরণীতে কর্মরত। অফিস থেকে ট্যুরে যাব , আমি , আমার বস নূর মহাম্মদ ইসমাইল ও অ্যানি সিবান্দা। প্রসঙ্গত , ইসমাইল সাহেবের দেশ শ্রীলংকা আর সিবান্দা ছিল জিম্বাবোয়ের। আমাদের গন্তব্য স্থল ফ্রানসিটাউন বলে আরেকটি শহর, ৪০০ কিলোমিটার মত দূর , রাজধানী হ্যাবরণী থেকে । আমি হিসেব করে নিয়েছিলাম ,বিকেলে বেরোলেও সন্ধ্যা নাগাদ ওখানে পৌঁছে যাব , অফিসের কাজকর্ম তো পরের দিনই হবে। ইসমাইল সাহেব কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ওদেশে আছেন , উনি বারবার আমাদের তাড়া লাগলেন, না , দুপুর দুপুর বেরোতে হবে , কারণ সন্ধ্যা নেমে গেলে রাস্তায় বুনো জন্তু বেরোলে অন্ধকারে অসুবিধে হতে পারে !অবশ্যই বুনো জন্তু বলতে সিংহ বা হাতি নয় , কিন্তু বুনো গাই , গাধা বা বাইসন বেরোন বিচিত্র নয়!
অনুরূপ অভিজ্ঞতা আরেকবার দু তিনটি পরিবার মিলে হ্যাবরণী থেকে তুলি ব্লক যাওয়ার সময়। প্রত্যেকটি ট্যুরে একজন দলপতি থাকে, সেবার নীলিমেশ I ও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল , একটানা গাড়ি চালাতে অনেকসময় অসুবিধা হয় , নিলয় তুমি কতটা স্পিড তুলতে পারো ? তাহলে মাঝে সাঝে তোমাকে স্টিয়ারিং দেব।
আমি বেশ উৎসাহ ভরে বললাম , আশি অব্দি তো তুলতেই পারি ! নীলিমেশের জবাব ছিল ক্লাসিক , ” না নিলয়, দরকার নেই , কোনো বুনো মোষ যদি রাস্তা পেরোয় , তুমি স্টিয়ারিং এ থাকলে ভাববে আরেকটা মোষ আসছে হয়ত , সরতে চাইবে না , আর ধাক্কা লাগলে কী হবে বুঝতেই পারছ!”
ওর কথার সারমর্ম মালুম হল বেরোনোর পর,-স্টিয়ারিংয়ে নীলিমেশ – নিঝুম হাইওয়ে ধরে ১৫০ কিমি বেগে গাড়ি চলছে , একটি দুটি গাড়ি সামনে থাকলে খেলনার গাড়ির মত সেগুলো পিছিয়ে পড়ছে। ওর পাশে বসে ছিল আরেক বন্ধুর স্ত্রী মণিদীপা , খুবই শান্ত ও নিরীহ ধরনের মেয়ে । নীলিমেশ ওকে বলে দিয়েছিল ,দূর থেকে কোন জন্তু দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে যেন তাকে বলে দেওয়া হয় , যাতে স্পিড কমানো যায় !
ঘন্টাখানেক বাদে আদেশ পালন করার মত পরিস্থিতির উদ্ভব হল , মণিদীপার ভীরু , সাবধানী কণ্ঠে কাটা কাটা উচ্চারিত হল , ” নীলিমেশ -দা -গাধা !”
এবার বেচারী মণিদীপা ধমক খেল চালকের কাছে , “তোমাকে অত গুছিয়ে কথা বলতে হবে না , ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মত গাধা শুয়োর বনবিড়াল কিছু একটা বললেই হল ; যতক্ষণে তুমি ‘ নীলিমেশ –দা’ বলছ, ততক্ষনে আমরা জন্তুটার ঘাড়ে এসে পড়ব যে !
এই অবধি পড়ে যদি কেউ ভাবেন , এই লেখার শিরোনাম হওয়া উচিত ‘মানব জীবনে জীবজন্তুর রাস্তা পারাপারের ভূমিকা ‘ তাহলে ভুল করেছেন- ওটা স্টার্টার ছিল , এবার মেন্ কোর্স !
আসলে ছোটবেলায় যতই শেখানো হোক , রাস্তা পার হওয়ার সময় প্রথমে ডাইনে , তারপর বাঁয়ে এবং আবার ডানদিকে তাকাতে হয় , বড় শহরে পেল্লায় পেল্লায় চওড়া আর যানবাহনে ঠাসা রাস্তা পেরোতে আমার ভীষণ ভয়। আমার মফস্বলি কিশোরবেলার জন্যই হয়ত বা কেমন একটা দেহাতি ভাব এসে পরে শরীরি ভাষায়। মনে হয় ,একটি দুটি গাড়ি থাকলেও ,ট্রাফিক সিগন্যাল যতক্ষন না সবুজ হচ্ছে , রাজপথ পেরোতে গেলেই খবরের কাগজের সাত নম্বরে পাতার এক নম্বর কলমের কোণে জায়গা হবে আমার ! সুতরাং সাধু সাবধান !
একবার চেন্নাইতে এরকম হয়েছিল , সঙ্গে সহকর্মী ও বন্ধু দেবাশীষ ছিল। রাস্তা পারাপারে ও অকুতোভয় , আমি একটু ইতস্তত করছিলাম। উল্টোদিক থেকে ধাবমান স্কুটি চালক তরুণী আমাকে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলেন রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার জন্য , বাকি রাস্তাটুকু দেবাশীষের গালিগালাজ হজম করতে হয়েছিল। ওর মতে , তামিলনাড়ুর রাজপথে আমি নাকি বাংলার মাথা হেঁট করেছি, তাও এক মহিলাকে সাক্ষী রেখে ।
তবে সাধারণভাবে, রাস্তা পেরোবার ব্যাপারে কলকাতার লোকেরা , উত্তর বা দক্ষিণ , খুবই সাহসী ও নির্লিপ্ত। বাস কিম্বা ট্রাক , পুচকে মারুতি বা ডাকসাইটে ইনোভা যাই সামনে থাকুক ,ছোট্ট একটুকু হাত তুলে কেমন অবলীলায় রাস্তা পেরিয়ে যায় – অন্য কোন শহরে এই দৃশ্য দুর্লভ ! আসলে বাঙালীর মানসিক পরিসরে মাস ভার্সেস ক্লাসের দ্বন্দে , মাসের প্রতি যে পক্ষপাতিত্ব , এ তারই এক ক্ষুদ্র বহিঃপ্রকাশ। আমি পথচারী , আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ সুতরাং গাড়িকে চলতে হবে আমায় বুঝে ! আমি নিশ্চিত , এই পথচারীদের মধ্যে এক আধ জন পদার্থবিদ্যার শিক্ষকও থাকেন , তারা স্কুলে গিয়ে প্রথম পিরিয়ডের ছেলেদের মোমেন্টাম মানে ভর ও গতিবেগের গুনফল , সেটা সাগ্রহে বুঝিয়ে দিতে কোন অসুবিধা বোধ করেন না !
তবে আমার মত আনাড়ি আরো কেউ কেউ থাকবেন হয়ত। এক বান্ধবীর কথা জানি , রাস্তা পার হতে গেলে যার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যেত। মেট্রো থেকে নেমে মর্ত্যে উঠেই বিশাল রাজপথ , সে বৈতরণী পেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে তারপর অফিসI রাস্তা পারাপারের সময় সে মোটামুটি কারো একটা পিছু নিয়ে নিত। ক’দিন পরপর একজন নির্দিষ্ট ভদ্রলোকের সঙ্গে রাস্তা পার হওয়াতে ভদ্রলোক খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েন। রাস্তা পার হওয়ার পরেও কিছুটা যাওয়ার পর দুজনেরই অফিস , সুতরাং ভদ্রলোক ওঁর সঙ্গে কিছুটা আলাপ জমিয়ে একদিন বলেন , “ম্যাডাম জানেন , জীবনটা এক রাস্তার মত I রাস্তা পেরোতে গেলে যেমন কেউ সঙ্গে থাকলে ভাল হয় , জীবনপথেও একজন হাত ধরার সঙ্গী দরকার। সেসময়টা বান্ধবী সালমান প্রেমে মশগুল , অতটা দার্শনিকতা তার হজম হয় নি -কথার ছলে নিজে বাগদত্তা এরকম একটি ডাঁহা গুল মেরে ব্যাপারটা সাঙ্গ করে ।
বহুদিন আগে শোনা এই ঘটনাটি মনে পরে গেল আসলে এক বন্ধুর পাঠানো এক হোয়াটস্যাপ ভিডিও থেকে।
ভিডিওটিতে দেখাচ্ছে. এক তরুণ এক প্রবীণাকে হাত ধরে রাস্তা পার করতে উদ্যত। তরুণটি সুপুরুষ , ফুটপাথের উল্টোদিক থেকে আসতে থাকা এক তরুণী তাকে লক্ষ্য করে। কয়েক সেকেন্ড চারচোখের মিলন হওয়ার পর তরুণীটি পাশ কাটিয়ে চলে যায় । ছেলেটিও প্রবীণাকে প্রায় একপাক ঘুরিয়ে যুবতীর গমনপথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে –ব্যস্ত রাজপথ সহসা ড্যান্সিং ফ্লোর হয়ে ওঠার বিস্ময় প্রবীণার মুখ থেকে যেতে না যেতেই ভিডিওর পর্দায় ভেসে ওঠে – Men will be men ! এই আপ্তবাক্যটি মেনে নিলে , সঙ্গী , অমর সঙ্গী হতে চাওয়া ওই ভদ্রলোকটির আচরণ খুব অস্বাভাবিক ঠেকবে না !
পরের ঘটনাটি আরেক বন্ধুর আছে শোনা , এটিও খুশবন্ত সিংয়ের স্টাইলে বলছি এবার । ডাকাবুকো মেয়ে সরসী। কলেজে পড়ার সময় যে কোন অনুষ্ঠানে সে অগ্রণী , একবার সবার সাথে প্রফেসরদের ঘেরাও টেরাও করেছিল, ইভটিজিং এর জন্য এক উঠতি রোমিওর রোম্যান্স ছুটিয়ে দিয়েছিল বেশ। এ হেন সরসীর নয়ন সরসী জলে ভরে যেত রাস্তা পারাপারের সময়। একবার চাকরির ইন্টারভিউ দিতে সে এসেছে পুনেতে। কিসব ঝামেলার বাড়ির কেউ সঙ্গে আসে নি, তবে বাবার বন্ধুর অফিসের গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল । একটি পদ শূন্য ছিল, সবাইকে টপকে সরসী নির্বাচিত হল। ওকে বলা হল , পরদিন মেডিক্যাল টেস্ট করে নিতে , এক সপ্তাহের মধ্যে জয়েন করতে হবে।পুনে টায়ার টু সিটি হলেও প্রায় মহানগরের মতই ব্যস্ত I গেস্ট হাউসের সামনে বিরাট রাস্তা পেরিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবতেই সরসীর অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলIহাতে একটা ছোট ফাইল , রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টাও করল বার দুয়েক। তারপর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে একটি অটোকে ডেকে অনুরোধ করল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অটোওয়ালার প্রাথমিক জবাব , ওই তো রাস্তা পিয়ারী একটু ডানদিকে গেলেই হাসপাতাল -হেঁটেই যান না ! সরসী অভিনয়বিদ্যা কাজে লাগিয়ে শরীর খারাপের কথা বলতেই অটো ড্রাইভার তাকে যত্ন করে পৌঁছে দিয়েছিল !
রাজপথের এই হরেক নিয়ম কানুন , ট্রাফিক সিগন্যাল , ফুটব্রিজ ,সাবওয়ে সবকিছুর মুলে একটি ভাবনা কাজ করছে -সেটি হচ্ছে গতি। যন্ত্র সভ্যতার রাজপথও যানবাহন কেন্দ্রিক I যাকে বলে সিমলেস ট্রাফিক , সেটি চলাচলের জন্য নাগরিক প্রাণ যাতে বিপন্ন না হয় , তার জন্যই হরেক ব্যবস্থা, হরেক নিয়ম, কিছুটা ট্রাফিকের জন্য , কিছুটা নাগরিকের জন্য I এমনিতে ব্যত্যয় না হওয়া সে নিয়মের নিগড়েও ছেদ পড়ে , যখন
লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল;
ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল-
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার-
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গিপাড়ায়।
এখন রোদ্দুর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর।
স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি,
কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই;
দু’দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও
হাতের মুঠোয়। যেন তাই
টাল্মাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ।
(কলকাতার যীশু /নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
–~০০০XX০০০~–
অনবদ্য
ধন্যবাদ