টুলুদা
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
টুলুদার ছিল চা এর দোকান। না এখন নয়। অনেক কাল আগে। ভিড় দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যেত। তাবলে ভেবে বোসো না যে টুলুদার অনেক টাকা। বেশির ভাগ খদ্দের ই ধারে চা খেত। আর চা এর দোকানে পৃথিবীর জ্ঞানী মানুষের আড্ডা থাকে।চা এর সাথে পান, বিড়ি,সিগারেট ও বেচতো। এগুলো ধারে দিতে চাইতো না।আর ছিল ছোটদের মনভোলানো সব খাবার।পাঁউরুটি,লজেন্স, কটকটি এইসব। দোকানে কেউ গেলে টুলুদা এমন হাসতো আর জয়রাধে বলতো।সাথে মাথাটাও নাড়তো।
টুলুদার জীবনীশক্তি প্রশংসনীয়।ওর বয়স এখন বাহাত্তর।এখনও কলকাতা গিয়ে ফ্ল্যাট বাড়ির কেয়ার টেকারের কাজ করে।হিসাব অনুযায়ী টুলুদা কে জ্যাঠা বা কাকা বলা উচিত।কিন্তু টুলুদা সবার দাদা।চাঁদমামার মতো ব্যাপার আর কি।
কদিন আগেও টুলুদা চলে গিয়েছিল মায়াপুরে। সংসারের জ্বালায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে। ওখানে ফুল তোলার কাজ, গোরু দেখাশোনা কিছুদিন করলে। আর ওই জয়রাধে শিখে এল।
টুলুদার যখন অল্প বয়স তখন থেকেই ও যাত্রাপাগল।গ্ৰামবাংলায় তখন যাত্রাপালা ভালোই হত। ওদের পাড়াতেই ছিল নবোদয় ক্লাব। টুলুদার একটা বাবা কি কাকা গোছের পাট হলেই আনন্দে ট ইটম্বুর।তার সঙ্গে থাকতো খাওয়া দাওয়া। চা এর দোকানে তখন চলত চা এর ফোয়ারা আর যাত্রা নিয়ে জোরে জোরে কথা। একবার জয়দেব পদ্মাবতী পালায় ওকে পদ্মার বাপ সাজতে হয়েছিল।মাত্র দু সিন পাট। তাতেই মাথা নেড়ে নেড়ে একশা।যাইহোক। পরিচালক বললে লাস্ট সিনে শিব উঠবে মঞ্চে। কে সাজবি। কোনো ডায়লগ নেই।শুধু দেখা দেওয়া।কারো মুখে সাড়া নেই। টুলুদা বললে দুটো সিন করে আমার আর পাট নেই।আমি শিব সাজবো এখন।
বললে বিশ্বেস করবে কি না জানিনা।শিব স্টেজে উঠতেই পাড়ার ছোট ছেলে মেয়েরা মানে আমরা বলে উঠলাম “ই বাবা। অয় দ্যাখ।টুলুদা। আবার উঠেছে।
ছেলেদের ওইকথায় কী ছিল কে জানে। টুলুদার বৌ রেগে মেগে টুলুদাকে বলল “মরণদশা”।
টুলুদা খুব লম্বা । অমন আমুদে মানুষ দেখা যায় না। ঘেঁটু সংক্রান্তির দিন প্রচুর ঘেঁটুফুল তুললে টুলুদা। তারপর পাড়ায় এক জ্যাঠার বাড়ি গেল। ওই জ্যাঠা ছিলেন পাঁচফুটের। আর বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা।গা এ ছিল প্রচন্ড খেমতা। ওর নাম ছিল মহেশ। বললে চলো মহেশ দা।আজ ঘেঁটু সংক্রান্তি। আমি হবো রাণী।আর তুমি সাজবে রাজা।চাল পয়সা তুলবো বাড়ি বাড়ি।তারপর পরের দিন সারা গাঁ খিচুড়ি খাবে।মহেশ একপায়ে খাড়া।বললে চল রে ভাই।
উফফ।সেদিন এমন মেয়ে সাজলে টুলুদা।বোঝাই গেল না একটা পুরুষ মানুষ।তার উপরে নাচের বাহার।রাজা বাড়ি বাড়ি যায় আর চেয়ারে বা উঁচু জায়গায় বসে।আর টুলুদা রাণী সেজে রাজাকে বেষ্টন করে নেচে যায়।সাথে কিছু ছেলে চাল পয়সা তোলে আর গান গায়
“ঘেঁটুরাজ আমাদের বেঁটে বলে/লম্বা রাণী হয়েছে”।
গোটা পাড়ায় মেয়ে বৌ দের কী হাসি।বলে টুলুদার যত কান্ড।
যাত্রাপাগল টুলুদা এক কান্ড করলে। মনে মনে ঠিক করলে অপেরার যাত্রা দেবো। টিকিট কেটে দেখবে লোকে। তা বৌ শুনে এমন ঝগড়া লাগালে।বললে “হ্যাঁ। ঘরের পয়সায় রামযাত্রা বার করছি “।
চা এর দোকান রাস্তার ওপরে।টুলুদা বসে ছিল। একদল যাত্রাপার্টি আসছে দেখতে পেল। অবাক কান্ড!ওর দোকানের সামনেই গাড়ি দাঁড় করাল। ওরা চা খাবে। টুলুর উৎসাহ দেখে কে। যেন সাত রাজার ধন এক মাণিক পেয়েছে। না না। এটা ভাবার কারণ নেই যে উপায়ের জন্য আনন্দ। যাত্রাদল ।অপেরা ।ওদের থেকে ঠিক জেনে নিল ওরা দশঘরা থেকে ফিরছে।
টুলুদা দেখলে গাড়ির ভেতরে ঝাঁ চকচকে নায়িকা। একটা গোঁফ ওলা লোককে বললে মা ঠাকরুণ একেবারে মা নক্কী। তা হ্যাঁ গা। কী নাম গো নায়িকার?
লোকটা গোঁফে তা দিয়ে বললে মিস পাপিয়া।
টুলুদা চা নিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে ডাক দিলে “মা জননী। তোমার চা। একটা অভয় দেন তো একটা কথা বলি।একটা দিন আমাদের গেরামে পালা করে যান না।”
গোঁফ ওলার সাথে কী যে চোখে চোখে ইশারা হল টুলুদা বুঝলে না। সত্যি বলতে কী টুলুদার সাদা মনে কাদা নেই।আর স্বভাব চরিত্রি যাকে বলে ধোয়া তুলসীর পাতাটি। সেই কবে টুলুদার ঠাকমা বলে গেসলো শোন রে টুলু। মেয়েদের পা এর দিকে তাকাবি। আর নাহলে মাটি বা আকাশের দিকে। সেই থেকেই টুলুদা অমনি থাকে। তবে ধর্মপত্নী হলে ব্যাপার আলাদা।
নায়িকা পাপিয়া স্টাইল দিয়ে গলা কাঁপিয়ে বললে “আপনার নাম কী”?
টুলুদা বললে “ভালো নাম মুরলী”
ঠিক আছে আপনি আমার বাসায় আসুন। কথা হবে।বুকিং হবে।
টুলুদা বললে” আচ্ছা।সামনের সপ্তাহে যাচ্ছি”।
গোঁফ ওলা বললে “বলাবলি কথা কি। আমরা হাইফাই যাত্রা ধরি। এবারে আমাদের সাড়া জাগানো পালা “মা বাবা আজ বোঝা”।
“বাহ্। দারুন নাম।” আনন্দে টুলুদার চোখদুটো পুরো মার্বেল।
গোঁফ ওলা বলল “এখানে কমসম করে করে দেবো এখন”।বলে চা সিগারেট সাঁটিয়ে দলসমেত চলে গেল।যাবার আগে পাপিয়া বলে গেল “আপনি খুব ভালো মানুষ।তবে যাত্রা দল বুকিং করে তবে সবাই কে জানাবেন মুরলীবাবু।”
গোঁফ ওলা বলে গেল” পাঁচ হাজার টাকা দিলেই বুকিং”।
টুলুদা কে বলে গেল “প্রচুর টাকা লাভ করতে পারবেন”।
টুলু ভাবলে “আজ দেব দেবীরা দেখা দিয়ে গেল”।ওদের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল “এই হল গিয়ে মানুষের বাচ্ছা”।
গ্ৰামের লোক এবার ভাববে টুলু আমাদের সামান্য ছেলে নয়।মুখে বিড়বিড় করতে লাগল “মা বাবা আজ বোঝা”।
দোকানের পুঁজি ভেঙে পাঁচহাজার টাকা নিয়ে যাত্রাদল বুকিং করে এল টুলুদা। মহেশ জ্যাঠা সঙ্গে গিয়েছিল।গোঁফ ওলা বলেছে যাত্রা শুরুর চার ঘন্টা আগে বাকী পনেরো হাজার দিতে হবে।
এদিকে ফিরে আসতেই গোটা পাড়া জেনে গেল যাত্রা হচ্ছে পাড়ায়। সাজো সাজো রব।তবে মাঝে মাঝে চুপ হয়ে যাচ্ছে টুলুদা। এখন ও পনের হাজার চাই। বাড়িতে ঢুকে আর এক কীর্তি। বৌ এর মুখের দিকে তাকাতে পাচ্ছে না। তবু আমতা আমতা করে বললে টিকিট কেমন বিক্রি হবে দেখবে।প্রচুর লাভ।আরে যে সে পালা নয়।নামটা ভাবো “মা বাবা আজ বোঝা”।
“আনন্দ সংবাদ!
আনন্দ সংবাদ!
আনন্দ সংবাদ!
আর মাত্র দুই দিন বাকী।হরিশপুর গ্ৰামের হাই ইস্কুলের মাঠে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সন্ধ্যা ছটায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এ বছরের সাড়া জাগানো সামাজিক যাত্রাপালা “মা বাবা আজ বোঝা”।
“ছোট পরিবার সুখী পরিবার
হিসাব হয়েছে সোজা।
বৌ বাচ্ছা আমি ই সব
মা বাবা আজ বোঝা”
“টিকিটের মূল্য মাত্র কুড়িটাকা।
আসর মাতাতে আসছেন দুষ্টু মিষ্টি নায়িকা মিস পাপিয়া।যাত্রাশেষে আপ ও ডাউন ট্রেন পাওয়া যাবে।”
এইভাবে জোরকদমে প্রঢার চলল আশপাশের গ্ৰামে ও দূরদূরান্তে। তাতেও বেশ কিছু টাকা গলে গেল। দোকানে কোনো মাল আনা হয় নি।বুকটায় যেন হাপর নাচছে।কিন্তু পনের হাজার জোগাড় করবে কী করে। বৌ এর কানের দুল আর হার বন্ধক রেখে লাইট,প্যান্ডেল রেডি।বৌ কে বলেছে টিকিট বিক্রি করে টাকা পেলেই ছাড়িয়ে দেবে সোনার জিনিস।কিন্তু পনের হাজারের কী ব্যবস্থা হবে। জমি বলতে দশকাটা দো ফসলী জমি।তবে ওটায় হাত দিলে ছেলে রুখে দাঁড়াবে।উফফ। হাসিটা আর ঘাড় নাড়াটা।দুটোই গেছে ওর। কী কুক্ষণে যে এসবের মধ্যে গেল।
পাড়ায় সমু বামুনকে একবার বললে হয়ত পাওয়া যাবে। ও ব্যাটা সুদখোর লোক। তা হোক। এখন তো টাকাটা দরকার। ওখানেই উপস্থিত হল। বললে
“দাও না সমু ভাই। টিকিট বিক্রি হতে যা দেরী। টাকা পেয়ে যাবে”।
টুলুদার মাথার ঘা এ কুকুর পাগল অবস্থা। সমু দেখলে বেশ বিনি পয়সায় যাত্রাও দেখা যাবে আর কিছু সুদ দুদিন এ পেয়ে যাবে। বললে “বেশ। পনের দিলাম। তুই যাত্রা র দিন রাতে সতের দিবি বুঝলি”।
টুলুদা রাজি হয়ে গেল। টাকা জোগাড় হয়ে গেছে।তবু ধুকপুকুনি থামে না।
অবশেষে হাজির সেই দিন। দারুণ প্যান্ডেল।একেবারে টিন দিয়ে ঘেরা।তিনটে গেটে তিনটে টিকিট কাউন্টার। উৎসাহ আর উদ্দীপনা।যাত্রাপার্টি টাকা পেয়ে গেছে।কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা ছটায় শুরু।
জোর কদমে অ্যানাউন্স চলছে
“ছোট পরিবার সুখী পরিবার
হিসাব হয়েছে সোজা
বৌ বাচ্ছা আমিই সব
মা বাবা আজ বোঝা”
তিনটের ট্রেনটা এখন ও আসছে না। টুলুদা স্টেশনের দিকে মুখ করে বসে আছে। ঘনঘন টয়লেট পাচ্ছে।
“জয়বাবা বুড়োশিব। জয় ধর্মরাজ। লাভের দরকার নেই বাবা। খরচাটা অন্তত তুলে দাও”।
সর্বসাকুল্যে পাঁচশো লোক নিয়ে যাত্রা শুরু হল।বাড়ির লোক আর সমু বামুনের যাত্রা মাথায় উঠেছে। কোথায় গেল টুলু।
সমু বামুনের সারারাত ঘুম হয় নি। ভোর হতেই চলল টুলুর বাড়ি। টুলুর বৌ বলল “কী জানি। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না”।
সমু বললে “এলে আমার টাকাটা দিয়ে আসতে বোলো”।
টুলুর ছেলে বৌ তো সব শুনে হাঁ করা দন্ত স।আচ্ছা কেলোর কীর্তি। রাগে ফুঁসছে সব।
সমু বামুন চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে।পাকারাস্তার উপরে কাঁথাজড়ানো কী ওটা। “ওরে বাপরে। ভোরবেলা এ কী ফ্যাসাদে পরলাম।শেষে ভূতের খপ্পরে”।
চিৎকার চেঁচামেচি কাজে লাগল। সবাই মিলে সা হস করে এসে দেখে ভূত নয়।টুলুদা। কাঁদছে আর বলছে
“আমার উপর দিয়ে লরি চলে যাক”।
সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে। ছেলে বললে জমি বিক্রি করে দেনা শোধ হবে এখন। শুধু টুলুদার বৌ কী বুঝলে কী জানি।বললে “মরণদশা”।
–~০০০Xসমাপ্তX০০০~–