পাগল প্রেমিক ও লাল গোলাপ
সুপ্তোত্থিতা সাথী
⚫ ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে কোনো রকমে শরীরটা টেনে হিঁচড়ে বাড়ি ফিরলো ঊর্মিশা।কারো সাথে বাক্যালাপের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার কবেই মরে গেছে! সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা লক করে দিলো ভেতর থেকে।ইদানিং বেশ কয়েক মাস ধরে ওকে যেনো একাকীত্ব পেয়ে বসে ঘরে ঢুকলেই।ব্যাপারটা প্রথম প্রথম আমল না দিলেও ঊর্মিশার এমন আচরণ নিয়ে ওর মা-উত্তরাদেবী ভীষণ উদ্বিগ্ন থাকেন।আজও তাই ঊর্মিশার দরজায় বার বার নক করেও আশানুরূপ কোনো ইঙ্গিত পেলেন না।আসলে ঊর্মিশার হঠাৎ বদলে যাওয়ার কারণটা হয়তো আঁচ করতে পারেন উর্মিলাদেবী।হাজার হলেও পেটে তো ধরেছিলেন! তাই ওনার উদ্বিগ্নতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে ঊর্মিশার আচরণও এখন ভয়াবহ দিকে বেড়ে চলেছে।এমনটা চলতে থাকলে বড়ো সড়ো অপূরণীয় ক্ষতি যে হয়ে যেতে পারে এ ব্যাপারে মা হিসেবে উনি সুনিশ্চিত।বহুবার মেয়েকে নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতেও চাইলেও ঊর্মিশা একবার বেঁকে বসলে ওকে টলানোর সাধ্য আজ আর কারো নেই।অথচ এই মেয়েই এক সময় হৈ-হৈ করে হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখতো সারা ঘর।আর আজ যেনো বাড়িতে শোকের নিস্তব্ধ কালো ছায়া বুকের ভেতরেটা নিংড়ে নিয়ে যায়। উর্মিলাদেবী তাই কিছুতেই আদুরে মেয়ের ভবিষ্যৎ এভাবে জলে ভাসিয়ে দিতে পারবেন না। কিছুতেই তা হতে দেওয়া যায় না।পরিচিতমহল থেকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের খোঁজ পেয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করে তবে উনি দম ছাড়লেন।নিজের সন্তানকে প্রতিদিন চোখের সামনে জ্যান্ত লাশ বনে যেতে দেখতে কোন্ মায়েরই আর সহ্য হয়!!
⚫ দমদম নাগেরবাজার চত্তর।এখানেই ফুলের দোকানের সামনে প্রায় দুবছর ধরে আত্মভোলা, উস্কোখুস্কো চুলের এক শিক্ষিত, মানসিকভারসাম্যহীন যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।আপাত নিরীহ ওই যুবক কাউকে কখনো বিরক্ত করেছে বলে স্থানীয় লোকেরা কখনো অভিযোগ করেনি।ওর অদ্ভুত আচরণে এখন প্রায় সবাই অভ্যস্ত।কখনো কিছু প্রশ্ন করলে ওর মুখে শুধু একগাল নিষ্পাপ হাসি লেগে থাকে,আর একটা ময়লা ডায়েরিকে যেনো যখেরধনের মতো বুকের উপর শক্ত করে চেপে ঘুরে বেড়ায়।কখনো কর গুনে আকাশের দিকে তাকায় আবার ডায়েরি খুলে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে এদিক ওদিক চলেও যায়। তবে মাঝে মাঝে ও পরমস্নেহে ফুলের দোকানে এসে লাল গোলাপের গায়ে হাত বুলিয়ে হাসে কিন্তু দোকানী তাতে মারাত্মক চটে গিয়ে হ্যাঁট-হ্যাঁট করে তাড়িয়েও দেয় ওকে।আত্মভোলা লোকের কী আর ভালো-মন্দ জ্ঞানগম্যি আছে? সব কিছু ভুলে ও আবার মাঝে মাঝে ওই একই কাজ করার জন্য ফুলের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকে।কেউ কেউ বলে ও নাকি ভালো ঘরেরই ছেলে,উচ্চশিক্ষিতও,তবে ঠিক কি কারণে বা কবে থেকে ওর এমন আত্মবিস্মৃতি ঘটেছে তা কেউ বলতে পারেনা বা ওকে অতো আমল দেওয়ারও কেউ প্রয়োজন বোধ করেনা।
⚫ অনেক সাধ্য-সাধনার পর ঊর্মিশা রাজী হয়েছে মায়ের কথায়।বলা ভালো মায়ের কান্না দেখে রাজী হয়েছে বাধ্য হয়েই।কারণ ও এটুকু বোঝে- উত্তরাদেবী না থাকলে ও হয়তো এতোদিন এই পার্থিব জগতেই থাকতোনা।যাই হোক, ডাক্তারের যে ডেট পাওয়া গেছে সেটা দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্যের- সেসব নিয়ে ঊর্মিশার মাথাব্যথা না থাকলেও উত্তরাদেবীর কাছে ওই দিনটা কিন্তু ভীষণ স্পেশাল।কারণ ওই দিনটা ওনার মাতৃত্বের পরম আনন্দের দিন।ছোটবেলায় এই দিনটাই ঊর্মিশার কাছেও বহু প্রতীক্ষিত দিন ছিলো।আত্মীয়-বন্ধু সমাগমে বাড়ি সেদিন আনন্দনিকেতন হয়ে উঠতো।বড়ো হবার সাথে সাথে সবারই যেমনটা হয়ে থাকে, ওরও এই বিশেষ দিনটির পরিমন্ডল পাল্টে যেতে থাকে,আর গত দুবছর আগে এই বিশেষ দিনটাকে রশ্মিত,হ্যাঁ রশ্মিত-ওর জীবনের সেরা দিন হিসেবে চিহ্নিত করে রাখার মতো করে সেলিব্রেট করেছিলো।ঊর্মিশার চারিদিক সেদিন সেজে উঠেছিলো লাল গোলাপে।আর একটা ডায়েরির বুকে মুক্তাক্ষরে লেখা হয়েছিলো ‘আদুরি’ সিরিজের বেশ কয়েকটি কবিতা।ঊর্মিশার সেদিন রশ্মিতকে দেবদূত মনে হয়েছিলো।ও যেনো ঊর্মিশার জন্যই সাতরঙা রামধনু থেকে খুশির রঙ পেড়ে এনে লেপে দিয়েছিলো ওর হরিণ চোখে।সব কিছুর পরেও ওর ঘোর যেনো কাটছিলোই না সেদিন।ভেতর ঘরে নানান প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠেছিলো।চারিদিকে এতো সুন্দরীদের মেলা,তা সত্ত্বেও রশ্মিত শুধু ঊর্মিশারই ভরসার কাঁধ হতে চাইলো! কিন্তু কেন? প্রশ্নের উত্তরে সেদিন রশ্মিত হাঁটু মুড়ে নতজানু হয়ে ঊর্মিশার হাত ধরে বলেছিলো- “উইল ইউ ম্যারি মি! অ্যান্ড বি মাই লাইফ-লাইন!”
আনন্দে বিহ্বল ঊর্মিশা সেদিন নিজেকে রাজকন্যে ভাবতে একটুও কার্পণ্য করেনি।তবু এতো সুখ কী ওর কপালে সয়!! তাই বুঝি সেই মূহুর্তে অলক্ষ্যে বসে হেসেছিলো ঈশ্বর! আর তাই বুঝি……..
⚫ নাগেরবাজার মোড়,হঠাৎ করে জোরসে ব্রেক কষে থেমে গেলো ঊর্মিশাদের উবার।সামনে তখন একটা ছোট্ট জটলা।পথচারী এক ভদ্রলোকের কাছে ড্রাইভার ঘটনার কারণ জানতে চাইলো।প্রত্যক্ষদর্শী ভদ্রলোকের বয়ান অনুযায়ী–স্থানীয় এক পাগল যুবক আজ এক ফুলের দোকান থেকে হঠাৎ না বলে কয়ে এক গোছা তাজা লাল গোলাপ হাতে তুলে নেয়। বুকে শক্ত করে সাঁটিয়ে রাখা একটা ডায়েরি খুলে হাতের কর গুনে কি যেনো হিসাবও করে পাগলটি।কিন্তু তার এরূপ আকস্মিক আচরণে দোকানী রেগে গিয়ে তার সাথে বচসা জুড়ে দেয়,যা পরবর্তীতে হাতাহাতি-ধস্তাধস্তির রূপ নেয়।স্থানীয় এবং পথচারী কিছু মানুষ উন্মত্ত জনতায় পরিণত হয় এবং তাকে চোর সন্দেহে বেধড়ক পেটানোও হয়।অথচ রক্তাক্ত পাগল যুবকটি নির্বিকার চিত্তে হাতের শক্ত মুঠোয় এখনো ধরে আছে সেই গোলাপ আর প্রলাপ বকে চলেছে–“আজ আমার আদুরির জন্মদিন,জানো?ওকে দেবার মতো এই লাল গোলাপ ছাড়া আমার যে আর কিছু নেই! আমার গোলাপ তোমরা কেড়ে নিওনা,কেড়ে নিতে দেবো না আমি।”
⚫ জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা ভাবের ঘরের ঊর্মিশার যেনো একটু টনক নড়লো। বিক্ষিপ্ত ঘটনার একটা বিশেষ শব্দ ওকে অস্থির করে তুললো।পৌছোতে দেরী হওয়ার আশংকায় চিন্তিত উত্তরাদেবীও খেয়াল করেননি কখন যে পাশ থেকে দরজা খুলে ঊর্মিশা নেমে পড়েছে রাস্তায়! ও এখন উদ্ভ্রান্তের মতো ভীড়ের ঠেলে এলোপাথাড়ি ছুটে চলেছে কোনো এক অজানা আকর্ষণে।জনস্রোতে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে ঊর্মিশা।সম্বিত ফিরতেই দুরুদুরু বুকে উত্তরাদেবীও নেমে পড়েন রাস্তায়।জনস্রোতে হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুঁজে বার করতে তিনিও এখন মরিয়া।হৃদস্পন্দনে ড্রাম পেটানোর অনুভূতি মা এবং মেয়ে দুজনেরই,কিন্তু সেই ড্রামপিটুনির ত্রাস শুধু স্ব স্ব অভিব্যক্তিকেই প্রকাশ করছে।মূহুর্তেই যেনো চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে জনস্রোত ফিসফিসিয়ে উঠলো। উত্তরাদেবীও থ হয়ে নিরব দর্শকের মতো দেখে যেতে থাকলেন চলচ্চিত্রে ঘটে যাওয়া কিছু উত্তেজক দৃশ্য। জনস্রোতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে আসছে স্লোমোশনে বিজয়ীনি ঊর্মিশা। ওর ঠোঁটে এখন একফালি চাঁদ পিছলে পড়ছে আর দু’গাল বেয়ে ঝরে চলেছে আনন্দধারা।কারণ ওর এক হাতে পিষে যাওয়া কিছু রক্তাক্ত গোলাপ আর অন্য হাতে শক্ত করে ধরে রাখা আছে অসহায়, রক্তাক্ত সেই পাগল-প্রেমিকের হাত।
–~০০০XX০০০~–