তৃপ্তি সরদার এক মা
-: কিশোর বিশ্বাস :-
অরুণাচলের এ গ্রামটির নাম যে রঙিলা রেখেছিল তার দূরদৃষ্টি ছিল, এ গ্রামে টিয়া, শালিক, ময়না, কোকিল আরো কত যে পাখি সারা দিন কিচির মিচির করে বেড়ায় তার সীমা পরিসীমা নেই, রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় ময়ূর ময়ূরী নৃত্যরত, বর্ষাকালে তো কথাই নেই, তাদের আশ্রয় দিতে আছে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, শাল, মহুয়া গড়ানের মত বৃক্ষরাজি ও, আছে জুঁই, চামেলী, শিউলি, বেল, আছে অজস্র অজস্র পাহাড়ি ফুল, তাদের বুকে অগণিত রং বেরং এর প্রজাপতির পাখায় যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন স্বর্গ হার মানে, স্বর্গ হার মানে যখন কচি ধানের ডগায় শিশিরের উপর প্রভাত সূর্যের আলো পড়ে, স্বর্গ হার মানে যখন বৃষ্টিস্নাত বৃক্ষপাতায় বিদায়ী সূর্যের রং লাগে, পর্যটকেরা বলেন ছবির মত গ্রাম, ছবি কি এত সুন্দর হতে পারে? শিল্পির কত রঙ আছে? প্রকৃতির অনন্ত রঙ, অফুরান্ত বর্ন, এ সুন্দর কি বলে বর্ণনা করা যায়? মানুষের শব্দের ভান্ডার সীমিত, একে শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়, এ এক হৃদয়ের চরম পরম অনুভূতি -সেখানে মন নির্বিকার প্রাণ হতবাক, গ্রামটা পাহাড় আর বনের সঙ্গমে, এখানে মানুষ অনধিকার প্রবেশ করেছে, তবে মানুষগুলো ও সহজ সরল, প্রকৃতির মত পবিত্র, এখানে সোনালী ফসলে ভরে যায় মাঠ, কিন্তু ফসল মহাজনের, এরা শুধুই শ্রমিক, তবু এরা ভালোবাসে মাটিকে, এরা যে মাটির সন্তান, সেই গ্রামের শেষ প্রান্তে বাস করে তৃপ্তি সরদার, তার বর সোরেন সরদার, ক্ষেত থেকে হাতি তাড়াতে গিয়ে হাতির শুঁড়ে এমন আছাড় খেয়েছে প্রাণে বেঁচে আছে বটে কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে পারেনি, ছেলে নবীন সর্দার গ্রামের স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, সেই নবীনের জ্বর, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হলে মা ভয়ে আঁতকে উঠল, কিন্তু হাসপাতাল তো ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, তাও আবার বারো কিলোমিটার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তবু সন্তান বলে কথা, তৃপ্তি দেবী ছেলেকে সাইকেলে নিয়ে ছুটল, হ্যাঁ, সত্যি করোনা হয়েছিল, ছেলের চিকিৎসা হল, তাকে ও কোয়ারেন্টাইনে রেখে কুড়ি দিন পর বিকাল চারটা নাগাদ ছেড়ে দিল, জঙ্গলের কাছে আসতে আসতে রাত ঘনিয়ে এল, জঙ্গল শেষ হয় হয় এমন সময় মা দেখতে পেল দু,টো চোখ জ্বলছে, সে জানে এ রাস্তায় কখনো সখনো চিতা বেরয়, আর নিস্তার নেই, মুহূর্তে স্থির করে ছেলেকে বলল, আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে শোন, আমি ওটাকে মারতে যাচ্ছি, তু্ই সেই ফাঁকে প্রাণ পন সাইকেল চালিয়ে চলে যাবি, অতঃপর তৃপ্তি দেবী নেমে একটা মোটা শুকনো গাছের ডাল নিয়ে এগিয়ে গেল, ছেলে সাইকেল চালিয়ে দিল, গ্রামের লোকজন যতক্ষনে ঢাল, সড়কি, মশাল নিয়ে সেখানে হাজির হল, ততক্ষনে সেখানে তৃপ্তি দেবীর কয়েক টুকরো হাড় আর এক তাল মাংস ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
–~০০০XX০০০~–