আত্মজন
✍ শ্যামাপ্রসাদ সরকার
আজ পয়লা বৈশাখ। একটু পরেই হাল খাতার জন্য জনে জনে লোকের মিছিল শুরু হবে।
সরু গলির পাশে উপচে পড়া ডাস্টবিনের পাশে একমাথা উকুন আর ছিন্ন পোশাকে তার মা ! মা টা পাগলী ! মাঝে মাঝে উদোম হয়ে ঘোরে। ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খায়। কিন্তু সেই যে ওর আসল মা সেটা ও জানে । কেউ বলে দেয়নি, তবু জানে। যেমন বাপ বলে কাউকে সে চেনে না। ছোটবেলাটাও তার মনে নেই। এখানে কতদিন আছে তাও জানে না। চোখ বুজলে মা’ ছাড়া কিছুর স্মৃতি মনে নেই। মাথার উপর শহরের ধোঁয়াভরা আকাশ আর পাশে মা, সম্পূর্ণ উলঙ্গ। সারাগায়ে আবর্জনা মাখা। তার মধ্যে থেকে কোথা থেকে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার পুতুল কুড়িয়ে পেয়েছে সে।শুকনো ঝুলে যাওয়া বুকে পুতুলটাকে ঠেসে ধরে। একটু পর আক্রোশে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। সে দেখতে পেয়ে পরক্ষণেই একটা শতচ্ছিন্ন কাপড় জোগাড় করে আনে আর তার মা’র গা টা ঢেকে দেয়। সেটা গায়ে জড়িয়ে এই বৈশাখের নরম ভোরের আলোর মত তার পাগলী মা হেসে ওঠে !
গলির সামনে বড় রাস্তার ওপারে ফ্ল্যাটবাড়ির পার্কিং লটে যত গাড়ী আছে সবগুলো সে মোছে টাকার বিনিময়ে। ওখানে সবাই ওকে ছোটু বলে ডাকে। মোটামুটি দিনে দুশো টাকা কামাই হয়ে যায়। ফ্ল্যাটবাড়ির লোকগুলো ছোটু বলে না ডাকলে ও জানতেই পারত না ওর কোন নাম আছে ! পাগলী কোনও দিন নাম ধরে ডাকেনি ওকে। খাবার এনে মুখের সামনে ধরলে খানিক দেখে, শোঁকে , তারপর খেয়ে নেয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এখান থেকে পালিয়ে গেলে বেশ হয় ! আসলে পাগলী আর ওর কোমরের নীচে একটা একই রকম জরুলের জন্মদাগ আছে। ওই দাগটার জন্যই পাগলীকে ও মা বলে। ছেড়ে চলে যেতে পারেনা শেষ পর্যন্ত। গুলতির টিপটা খারাপ নয় ওর। দুটো কাকের একটা উড়ে গেল। অন্যটা মুখ থুবড়ে ডাল থেকে পড়ে গেল। কি অদ্ভূত ! দুনিয়ার যত কাক যেন জড়ো হয়ে গোল করে চক্কর মারতে লাগলো। পুরো ব্যাপারটাই ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে হচ্ছে।
প্রায় পঞ্চাশটা কাক এখন সমস্বরে চেল্লাচ্ছে ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনের কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে।
কাকেদের ডাকটা শহরটার আধুনিক ক্যাকোফোনির সাথে বেশ সঙ্গত করে কিন্তু। আসলে শহরেরর দিনরাত্রি একটা ছিন্ন তমিশ্রার তন্তু হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। এখানে প্রেম,ঘৃণা, হতাশা,শরীর সবই সুস্থতর ধনবান নাগরিকের একচেটিয়া। সেখানে এক অর্ধউলঙ্গ উন্মাদিনীর হাসি শুধু ফুকরে ওঠে খাবারটা মুখে তোলার আগে !
সেও এতদিনে জানে প্রতিটি সম্পর্ক আসলে এক জটিলতর স্বার্থের বোঝাপড়াই। মরা কাক কে ঘিরে বাকী কাকেদের সাময়িক বিক্ষোভের মত তা সবই মুহূর্তকালেই তা মিলিয়ে যাবে একই রকম উদাসীন নির্লিপ্তিতে। শুধু রয়ে যাবে ধূসরবর্ণ চিত্রপটে একটি অপার্থিব দৃশ্যকল্প। শহর করুণ হয় মৃতের আবর্জনায়।
যে বালকটি এখন তার সদ্য কৈশোরের জাগৃতিতে সে কেবল তার জন্মদাগের স্বার্থশূন্য কারণেই এক উন্মাদিনী নারীর নগ্নতাকে ঢেকে রাখে পরম মমতায়। সেই যেন আসলে এক অলীক পক্ষীমাতা। তার নিশ্চিন্ত পক্ষপুটের আশ্রয়ে সে ঢেকে রেখেছে ক্ষমাহীন ক্লিন্ন পৃথিবীর শেষ অবশিষ্ট একমুঠো অপত্য স্নেহকে। বৈশাখ থেকে চৈত্র কালাকাল এভাবেই তাকে চিরদিন জড়িয়ে রাখে মমতায়।
–~০০০XX০০০~–