বুলবুল আর গোলাপের গল্প
✍ নিলয় বরণ সোম
মুল গল্প ঃ অস্কার অয়াইল্ড ( The Nightingale and the Rose )
অনুবাদ ঃ নিলয় বরণ সোম
“ একটা লাল গোলাপ নিয়ে আসতে পারলে ও বলেছিল আমার সঙ্গে নাচবে, অল্পবয়সী ছাত্রটি দুঃখ করল , “ কিন্তু আমার বাগানে একটাও লাল গোলাপ নেই। ” বুড়ো অশত্থ গাছ , যাকে সবাই পবিত্র অশত্থ গাছ বলে , তার কোটরে বসে থাকা বুল্বুলির কানে কথা ক’টি গেল , গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে সে কথাগুলি শুনছিল ।
“ আমার বাগানে একটাও লাল গোলাপ নেই , ছেলেটি প্রায় কেঁদেই উঠল , “ ইস , ছোট ছোট কত কিছুর উপর সুখ নির্ভর করে !বড় বড় পণ্ডিতেরা যা লিখে গেছেন সব আমি পড়েছি,দর্শনের সব গোপন সুত্র আমার দখলে , শুধু একটা লাল গোলাপের জন্য আমার জীবন বৃথা যাবে !”
ছেলেটির চোখে জল টলটল করতে লাগল। বুলবুল মনে মনে বলল , “ এতদিনে একজন সত্যিকারের প্রেমিকের সন্ধান পেলাম । সত্যিকারের কোনও প্রেমিক্ কে এতদিন চোখে না দেখলেও তারাদের আমি ওর গল্প শুনিয়েছি , এবার আমি তাকে চাক্ষুষ করলাম । ওর চুল মেঘের মত কালো , ওর কামনার মতই লাল ওর ঠোঁট, ওর ভালবাসার তীব্রতা ওর মুখকে করেছে গজদন্তের মত হাল্কা হলুদ আর ওর দুই ভ্রুতে পড়েছে দুঃখের ছাপ।”
ছাত্রটি মৃদু স্বরে বলতে লাগল , “কাল রাজপুত্র এক বল নাচের আসরের ঘোষণা করেছেন । আমার প্রেমিকা্র আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা । আমি যদি ওর জন্য একটা লাল গোলাপ নিয়ে আসতে পারি, তাহলে ও সারা রাত আমার সঙ্গে নাচবে । লাল গোলাপ নিয়ে এলে ওকে আমি দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরব আর ও মাথা এলিয়ে দেবে আমার কাঁধে , হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে আমাকে। কিন্তু আমার বাগানে একটাও গোলাপ নেই , তাই আমি একাই বসে থাকব , আর আমার কোন পরোয়া না করে আমাকে ছাড়াই ও চলে যাবে । এদিকে যে আমার হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে !”
“ এই হল সত্যিকারের প্রেমিক , বুলবুল বলল, “ আমি গান গাইলে ওর বেদনা হয় , আমার যাতে আনন্দ, ওর তাতে দুঃখ। সত্যি , প্রেম এক অনির্বচনীয় সৃষ্টি।হীরের থেকে এ দামি , পান্নার থেকে বেশি সূক্ষ্ম । মুক্তোই বল আর ডালিমফল-ই বল , কোন কিছু দিয়ে একে কেনা যায় না ,না একে পাওয়া যায় বাজারে। দূরদেশে থেকে আসা সওদাগরদের কাছ থেকেও এটা কিনতে পাওয়া যায় না , এক পাল্লায় সোনা চাপিয়েও একে ওজন করা যায় না ।তরুণটি বলতে থাকল , “ বাজনাদাররা সব গ্যালারিতে বসে বাজনা বাজাবে ,আর আমার প্রেয়সী বীণা আর বেহালার তালে তালে নাচবে । ওর নাচ এত পেলব, পা ওর প্রায় মাটি স্পর্শ করবে না আর চকমকে পোশাক পরা রাজার সভাসদরা ওকে চারদিকে ঘিরে থাকবে । কিন্তু আমার সঙ্গে ও নাচবে না, কারন আমি ওকে ওর শখের লাল গোলাপ দিতে পারি নি ।” কথাগুলি বলে ছেলেটি ঘাসের বিছানায় শুয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল ।
“ ও কাঁদছে কেন ?” রাস্তা পার হতে হতে গিরগিটিটা লেজ নাচাতে নাচাতে বলল ।
“ সত্যি তো !”, রোদের আলোয় ঘুরে বেড়ান প্রজাপতিটি বলল ।
“কেন , কেন ”, ফিসফিস করে ডালিয়া ফুলটি তার প্রতিবেশিকে বলল ।
বুলবুল বলল , “ একটা লাল গোলাপের জন্য ও কাঁদছে ।”
“ শুধুমাত্র একটা লাল গোলাপের জন্য ? কী বোকা বোকা!” গিরগিটি তার স্বভাবসিদ্ধ উপহাসের ভঙ্গিতে হেসে উঠল ।
কিন্তু ছোট্ট বুলবুল ছেলেটার কষ্ট বুঝতে পারল , অশত্থ গাছে চুপচাপ বসে সে কেবল ভালবাসার রহস্যের কথা ভাবতে লাগল ।
হঠাৎ সে তার বাদামি পাখনা জোড়া মেলে ধরে গাছের খাঁজ থেকে ছায়ার মত বেরিয়ে এল , আর ছায়ার মতই সে বাগানের উপর উড়ে বেড়াতে লাগল
বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা সুন্দর গোলাপ গাছ আছে , গাছটিকে দেখতে পেয়ে ওর উপরে একপাক ঘুরে বলল, “আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও , আমি তোমাকে খুব মিষ্টি একটা গান শোনাব।”
গাছ মাথা নেড়ে বলল , “আমার গোলাপ তো সাদা, সমুদ্রের ফেনার থেকেও সাদা আর পর্বত চুড়ার তুষারের থেকেও শুভ্র।তবে সূর্য ঘড়ির কাছে আমার ভাইয়ের নিবাস , তার কাছে গিয়ে দেখতে পার । তুমি যা চাইছ ,ওর কাছে পেতে পার।“
তাই বুলবুল উড়ে গেল সূর্য ঘড়ির কাছে সেই গোলাপ গাছের কাছে ।
“ আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও ,অনুনয় করে ও বলল , “ আমি তোমাকে আমার সবথেকে মিষ্টি গানখানি শোনাবI”
গাছটি কিন্তু মাথা মাথা নেড়ে না বলল ।
“আমার তো হলদে গোলাপ । সে গোলাপ সোনার সিংহাসনে বসে থাকা মৎস্যকন্যার চুলের মত হলুদ , কাস্তে হাতে মালি আসার আগে ঘাসের চাদরে ফুটে থাকা সূর্যমুখীর থেকেও হলুদ ।তবে তুমি আমার ভাইয়ের কাছে চলে যাও- ছাত্রটির জানালার নিচেই ওকে খুঁজে পাবে ; তুমি যা চাইছ ওর কাছে পেতে পার।”
চোখের পলকে বুলবুল তাই ছাত্রটির জানালার নিচে গোলাপ গাছের কাছে গিয়ে হাজির হল।
“ আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও , অনুনয় করে ও বলল , “আমি তোমাকে আমার সবথেকে মিষ্টি গানখানি শোনাব।”
কিন্তু গাছটি তার মাথা নাড়ল ।
“ আমার গোলাপ লাল রঙের, ঠিক। ঘুঘুপাখির পায়ের মত লাল, সমুদ্রের গভীরে থাকা প্রবালের থেকেও লাল । কিন্ত শীতে আমার সব শিরা শুকিয়ে গেছে , শিশির আমার কলি নষ্ট করে দিয়েছে , ঝড়ে আমার ডাল ভেঙে গেছে, এ বছর তো আমার আর গোলাপ হবে না ।“
“আমার একটি মাত্র গোলাপ চাই, বুলবুল কেঁদে বলল , “ কোন ভাবেই কি এটা পাওয়া যায় না ?”
“ একটা মাত্র উপায় আছে , কিন্তু সেটা এত ভয়ংকর যে আমি তোমাকে বলতে পারব না ।“
“ আমাকে বল সেটা – আমি কিছুতে ভয় পাই না।“
“ তুমি যদি সত্যি লাল গোলাপ চাও , তাহলে জ্যোৎস্না রাতের বাজনা থেকে এটা সৃষ্টি করতে হবে আর তোমার বুকের রক্ত দিয়ে একে রাঙিয়ে দিতে হবে।তুমি যদি তোমার বুক একটা কাঁটার সঙ্গে ঘেঁষে সারা রাত গাইতে পার আর কাঁটাটা যদি তোমার হৃদপিণ্ড চিরে দেয় , তবে তোমার শরীরের রক্ত আমার শিরায় ঢুকে আমার রক্ত হয়ে যাবে ।“
বুলবুল এবার কাতরে উঠল ,” জীবন সবার কাছেই খুব মুল্যবান, একটা লাল গোলাপের জন্য মৃত্যু বরণ করা মুখের কথা নয় । আমার যে সবুজ গাছে বসে থাকতে ভাল লাগে,সোনালী রথে করে সূর্যের অবতরণ তেমনই টানে আমাকে , একইরকম তেমনি ভাল লাগে মুক্তোর রথে করে চাঁদের নেমে আসা। জংলী গাছের বুনো গন্ধ আমার যেমন পছন্দ ,তেমনি ভাল লাগে দূরের উপত্যকার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফুলগাছগুলিকে ।তবু বলব, জীবনের থেকে ভালবাসার মুল্য অনেক বেশি, আর মানুষের হৃদয়ের তুলনায় একটা পাখির হৃদপিণ্ডের মুল্যই বা কী ? “
তাই সে তার বাদামী ডানা আকাশের বুকে মেলে বেরিয়ে পড়ল । বাগানের উপর দিয়ে সে ছায়া হয়ে উড়ে গেল আর ছায়া হয়েই খাঁজের ভিতর ঢুকে পড়ল ।
বুলবুল যেমনটি দেখে গেছিল, তরুন ছাত্রটি তখনও ঘাসের উপরেই শুয়ে আছে,আর ওর চোখের জল তখনও শুকায় নি ।
পাখি এবার চেঁচিয়ে বলল , “ এবারটি হাস । তুমি তোমার লাল গোলাপ পেয়ে যাবে । আমি জ্যোৎস্না রাতের বাজনা দিয়ে এটা সৃষ্টি করব আর আমার হৃদয়ের রক্ত দিয়ে একে রাঙ্গিয়ে দেব । বিনিময়ে আমি শুধু চাইব , তুমি একজন সত্যিকারের প্রেমিক হও । জেনে রাখ , দর্শনের থেকেও প্রেম বিজ্ঞ, শক্তির চেয়েও সে বলশালী। ওর ডানা হচ্ছে আগুনরাঙা, ওর শরীর হচ্ছে আগুনের শিখা। ওর ঠোঁট হল মধুর মত মিষ্টি , আর নিঃশ্বাস হল ধুপের সুগন্ধ ।“
ছাত্রটি ঘাসের উপর থেকে মুখ তুলে চাইল , কিন্তু পাখিটার একটা বর্ণও বুঝতে পারল না । আসলে বইয়ের পড়ার বাইরে কোন কিছুর মানে তো সে জানেই না ।
বৃদ্ধ অশত্থ গাছ কিন্তু তার কথাটা বুঝল। তার মনটা খুব ভারি হয়ে গেল , কারন ওর ডালে বাসা বাঁধা ছোট্ট পাখিটাকে বৃদ্ধ খুব ভালবাসত।
“ আমাকে তোমার শেষ গানখানি শোনাও , সে ফিসফিস করে বলল , “ তুমি চলে গেলে আমার খুব নিঃসঙ্গ লাগবে । “বুলবুল তাই অশত্থ গাছের জন্য গাইল। রুপোর পাত্রে জল ফুটলে যেমন আওয়াজ হয়, ওর গলা তেমনি শোনাচ্ছিল।
ওর গান শেষ হতেই ছাত্রটি পকেট থেকে তার নোট বই আর খাতা বের করল । ঝোপের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজের মনে বলতে থাকল , “আঙ্গিক টা তো ঠিকই আছে , সেটা অস্বীকার করা যায় না , কিন্তু অনুভুতি , অনুভুতি কি আছে ওর ? মনে হয় না । আসলে ও আর পাঁচটা শিল্পীর মতই ।স্টাইল ঠিক আছে ,দরদটুকু নেই ।ও অন্যদের জন্য কোন আত্মত্যাগ করতে পারবে না । ও শুধু গানের কথাই ভাবে আর সকলেই জানে , সব শিল্পই আসলে নিজমূখী ,স্বার্থপর। এটা বলতেই হবে যে ওর গলায় সুরের বাহার আছে,কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল এর কোন অর্থ নেই , আর এগুলো কোন কাজেও লাগে না ।“
কথাগুলো বলে ছেলেটি নিজের ঘরে চলে গিয়ে তার ছোট বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার প্রেমিকার কথা ভাবতে লাগল, শেষে ঘুমিয়েও পড়ল এক্ সময়।
যখন রাত্রিবেলা চাঁদ তার মোহিনী মায়া বিছিয়ে দিল , বুলবুল গোলাপ গাছের কাছে গিয়ে নিজের বুকখানি গোলাপের কাঁটার গায়ে ঘেঁষে বসে রইল । সারারাত সে তার বুক কাঁটার সঙ্গে লাগিয়ে গাইতে থাকল , আর স্ফটিকের মত শুভ্র চাঁদ নিচু হয়ে নেমে মন দিয়ে সেই গান শুনতে লাগল ।সারা রাত ধরে সে গাইতে থাকল , আর গোলাপের কাঁটা তার বুকের ভিতরে বিঁধে যেতে লাগল ।ওর শরীরের রক্তের ধারা বইতে থাকল বাইরে ।
প্রথমে সে গাইল একটি ছেলে ও মেয়ের হৃদয়ে ভালবাসার উন্মেষের গান । কিছুক্ষন বাদে গোলাপগাছের সবথেকে উঁচু ডালে একটি অপূর্ব সুন্দর ফুল ফুটল, একটা একটা করে গান হতে থাকল আর ফুলের কলি থেকে এক এক করে পাপড়ি সৃষ্টি হতে লাগল । ফুলটা প্রথমে ছিল ফ্যাকাশে রঙা , ফুলের ছায়া যেমন করে দীঘির উপর পড়ে, যেমন করে রুপোর আয়নায় তাকে দেখা যায়, তেমনি করে সবথেকে উঁচু ডালে ফুলের ছায়া যেন ফুটতে লাগল ।
গোলাপ গাছ কিন্তু তাকে মিনতি করে বলল ,“ বুলবুল সোনা ,আরও,আরও কাছে এস ,না হলে লাল গোলাপ পূর্ণ রূপ নেওয়ার আগেই দিনের আলো ফুটে যাবে।“
তাই বুলবুল কাঁটার আরও কাছে এসে গেল , আরও জোরে সে গাইতে লাগল , এবার সে গাইল নর নারীর মধ্যে ভাল্ বাসার তীব্রতা উন্মেষের গান।
ধীরে ধীরে গোলাপের পাতায় হাল্কা গোলাপি রঙের ছটা পড়তে লাগল ,নতুন বর তার সদ্য পরিনীত বধুর ঠোঁটে প্রথম চুম্বন এঁকে দিলে তার গালে যেমন গোলাপি আভা পড়ে, ঠিক তেমনি সেই রঙের আভাস। কিন্তু কাঁটা তখনও তার হৃদপিণ্ডে বিঁধে যায় নি , তাই গোলাপের হৃদয় তখনও সাদাই রয়ে গেল , কারন এক্ মাত্র বুল্বুলের হৃদপিণ্ডের রক্তই গোলাপের বূকে রক্ত রঙের ছোঁয়া আনতে পারে ।
তাই সে কাঁটার কাছে নিজের বুক আরও এগিয়ে দিল -কাঁটাটি তার বুকে বিঁধে যেতেই একটা তীব্র ব্যাথা সে অনুভব করল ।সাংঘাতিক, সাংঘাতিক সে ব্যাথা ,সেই তীব্র ব্যাথার সঙ্গে তার গানও আরও আরও উদ্দাম হতে লাগল । তখন তার কণ্ঠে এসে গেছে এমনি ভালবাসার গান , মৃত্যু যাকে অমর করে দেয় আর যে ভালবাসা স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে বিনষ্ট হয় না ।
অনিন্দ্য সুন্দর গোলাপটি তখন রক্ত প্রবালের রঙ মেখে নিয়েছে পূব আকাশের গোলাপের মত । তার পাতাগুলি হয়ে উঠল লাল পশমের মত আর ফুলের মধ্যকার হৃদয় যেন হয়ে উঠল রুবি রঙা ।
কিন্তু পাখিটির গলা এবার ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল , ছোট ছোট ডানাগুলি সে ঝাপটাতে শুরু করল। তার চোখের উপর নেমে এল যেন একটি পর্দা। তার গলার স্বর আরও ক্ষীণ হতে হতে সে বোধ করল , গলায় কিছু একটা যেন আটকে আছে ।
তারপর সে নিজেকে উজাড় করে শেষ গান টুকু গাইল । জ্যোৎস্না রাতের চাঁদ সে গান শুনে ঊষার প্রারম্ভে তার হারিয়ে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে আকাশের বুকে জেগে রইল । লাল গোলাপটি সে গান শুনল , গান শুনে সে আনন্দে কেঁপে উঠল , আর তার পাপড়ি গুলো সম্পূর্ণভাবে ভোরের বাতাসের কাছে নিবেদন কর ল। সে গানের প্রতিধ্বনি পৌঁছে গেল পাহাড়র রাজ্যে, সেখানে রাখালদের তাদের স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলল সে গান । নদীর বুকে ভেসে থাকা গুল্ম রাশির মধ্য দিয়ে সে গান পৌঁছে গেল সাগরের কাছে ।
গাছটি বুলবুলকে ডেকে বলল , “দেখ দেখ , ফুলটা কেমন সুন্দর ফুটে গেছে !” কিন্তু বুলবুল কোন জবাব দিল না , কারন ততক্ষনে প্রাণ হারিয়ে কাঁটা বুকে নিয়ে সে ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে ।
দুপুরবেলা ছাত্রটি জানালা খুলে একবার বাইরে তাকাল ।
“ ওমা, কী সৌভাগ্য আমার ! এই তো আমার লাল গোলাপ ! আমার সারা জীবনে এত সুন্দর গোলাপ আমি দেখি নি । এত সুন্দর এটা , নিশ্চয়ই এর কোন লম্বা ল্যাটিন নাম আছে ।“ একটু নিচু হয়ে ফুলটি সে পেড়ে নিল ।
তারপর ফুলটি হাতে নিয়ে , মাথায় টুপি পরে সে অধ্যাপকের বাড়ির দিকে পা চালাল। অধ্যাপক কন্যা বারান্দায় বসে একটা রিলে নীল সুতো পরাচ্ছিল , তার পোষা কুকুরটা তার পায়ের কাছে ঘোরা ঘুরি করছিল ।
ছেলেটি একমুখ হাসি নিয়ে বলল , “ তুমি বলেছিলে তোমাকে একটা লাল গোলাপ এনে দিলে তুমি আমার সঙ্গে নাচবে । এই দেখ দুনিয়ার সেরা রক্ত গোলাপ । তোমার বুকের কাছে আজ রাতে এটা রাখবে , আমরা যখন একসঙ্গে নাচব , তখন এটা তোমাকে জানিয়ে দেবে আমি তোমাকে কতখানি ভাল বাসি ।“
কন্যা তার ভ্রু কুঁচকে উঠল ।
বলল , “মনে হচ্ছে এটা আমার পোশাকের সঙ্গে ঠিক মানাবে না । আর একটা কথা । জমিদারের নায়েবের ভাইপো আমাকে কতগুলো আসল জহরত পাঠিয়েছে।ফুলের থেকে জহরত যে দামি এটা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে ।“
ছেলেটি রেগে মেগে বলল , “ ভালই বোঝা গেল , তুমি খুব অকৃতজ্ঞ!”
সে হাতের ফুলটা রাস্তায় ফেলে দিল, যেটা পড়ল আবর্জনার মধ্যে , আর একটু পরেই উপর দিয়ে একটা গাড়ীর চাকা ফুলটাকে মাড়িয়ে গেল ।
“ হু, অকৃতজ্ঞ ! আমি বলি কী , তুমি খুব অভদ্র ; আর তার উপর তুমি কে হে ? মাত্র তো একজন ছাত্র, তার বেশি কিছু না । আমার তো মনে হয় নায়েব মশায়ের ভাইপোর যেমন রুপোরতৈরি জুতোর ফিতে আছে , তোমার কাছে তাও নেই ।“
এই বলে সে চেয়ার থেকে উঠে বাড়ির ভিতর চলে গেল ।
ছাত্রটি হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনে বলতে থাক ল ,” প্রেম জিনিস্ টাই কেমন বোকা বোকা , এর ব্যবহারিক মূল্য তর্কশাস্ত্রের অর্ধেকও নয়। কারন , এটা কিছু প্রমাণ করতে পারে না- এটা এমন কিছুর কথা বলে যা কিনা হওয়ার নয়, অথচ এমন কিছুতে এ বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে যা কিনা সত্য নয় । আসলে এটা একটা অবাস্তব জিনিস আর আজকের পৃথিবীতে বাস্তবতাই সব কিছু ।যাই , এবার ঘরে গিয়ে অঙ্ক আর মেটাফিজিক্স পড়ি ‘ খন।“
অতঃপর সে তার বাড়ীতে ঢূকে একখানা আকরগ্রন্থ বের করে পড়া শুরু করল ।
–~০০০XX০০০~–