মহাসিন্ধুর ওপার থেকে
✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
সমগ্ৰ বিশ্বমানবতার যে সমুদ্র তার মধ্যে এক একটি মানুষ একটি খন্ড নৌকা।সকলেই পাড়ি দিচ্ছে এই মহাসমুদ্রে।এই চলমানতা অবিচ্ছেদ্য।আপাত এই চরৈবেতির মধ্যে ঘটে চলেছে কত ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা।কখনও শান্ত সমুদ্রে দাঁড় বাওয়া,আবার এই জলপথে বা জীবনের পথে আসে সামুদ্রিক ঝড়।উথাল পাথাল করে দেয় সবকিছু।তবু জীবনের গান বন্ধ হয় না।মহাসিন্ধুর ওপার থেকে সঙ্গীত ভেসে ভেসে আসে।বলে যায় “ভয় নাই ওগো ভয় নাই”।
তবে কি এই জীবন সত্যি পরবাস!মহা সঙ্গীতের সুর কি সকলের কানে প্রবেশ করে না?কিন্তু গোপালগঞ্জের পঞ্চানন।ও কী করে যেন ওই সুরটা শুনতে পেয়েছিল।
আজ একাদশী।পঞ্চাননের বিধবা মা এর নিরম্বু উপবাসনয়।তবে পালনী।পঞ্চাকে বলেছিল “কাঁঠালি কলা এনে দিবি রে “।
পঞ্চার একটা পা খোঁড়া।জন্মের পর থেকেই ।তবে কোনো কাজেই পঞ্চা কে আঁটে না।
সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় ওর সদাহাস্য মুখ।পাড়ার গোষ্ঠ গোয়ালা সেদিন ডাকপাক বলে গেল “জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ।পঞ্চার জয়জয়কার”।
পঞ্চার মা গোরু পোষে।স্বামীর অকাল মৃত্যুতে ভেঙে পড়লে পাড়ার লোক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
আনন্দ মুখুজ্যের বৌ বলেছিল “ভয় কি ছবি।আমরা আছি।আর দুধে বালক ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে তোকে বাঁচতে হবে।”
তারপর ই দুটো বাছুর পোষানি দিয়েছিল পঞ্চার মা ছবি কে।
মুখুজ্যেদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।বেশি লেখাপড়া শেখে নি।তবে স্বপ্ন দেখে ছেলেটাকে পড়াবে।অনেক বড়ো হবে পঞ্চা।কতদিন স্বপ্নে এসব দেখে।পঞ্চাকে বললে ওর হাসিমুখ এ বান ডেকে যায়।
পঞ্চা গুলি খেলায় ওস্তাদ।উড়িশ খেলাতে ওর টিক অব্যর্থ।স’ই পুকুরের পাড়ে ওরা ছেলের দল ঘর কেটেছে।পাশেই গাজি পীরের দরগা।বেশ নিরিবিলি জায়গাটা।
এদিকে ছবিরাণী রেগে টং।গোপাল কে দেখতে পেয়ে বললে “হ্যাঁ রে গোপলা!আমাদের পঞ্চাকে দেখেছিস।সেই সকালে বেইরেচে।কত করে বললেম আজ একাদশী।কাঁঠালি কলা এনে দিবি গঞ্জের বাজার থেকে।আসুক আজ।চ্যালাকাঠ যদি পিঠে না ভাঙি তো আমি ছবিরাণী ন’ই।”
গোপলা বললে “সেই গাজিসাহেবের থানে ওরা গুলির ঘর কেটেছে গো কাকিমা।আমি যেতে পারি নি।আমার গা এ জ্বর।পঞ্চা বললে গোপলা।মা জিগালে বলবি না।”
গোপলা চলে গেলে ছবি আপন মনে কাজ করতে থাকে আর নিজের কপালের মুন্ডপাত করতে থাকে।
গোপাল খবরটা ফিরোজ কে বলে।পঞ্চার অভিন্নহৃদয় বন্ধু ফিরোজ।গাজি পীরের মোল্লাসাহেব ফিরোজের বাবা জাহেদ।ফিরোজ বলে পঞ্চাকে “তুই বাড়ি যা।তোর মা তোকে খুঁজছে।”
ফিরোজের কথায় সম্বিত ফিরে পায় পঞ্চা।রাশিকৃত গুলি ফিরোজকে দিয়ে বলে “এগুলো রাখ।আমি বিকেলে এসে নেবো।এখন ই গঞ্জের হাটে যেতে হবে।কাঁঠালি কলা কিনে না নিয়ে গেলে মা খাবে কি”?
ফিরোজ বলে “তুই একটা বুদ্ধু।টাকা নিয়ে যা।দাঁড়া আমি আব্বাকে বলে নিয়ে আসি”
পঞ্চা ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকলো।মা কে ভয় খায় না ও।তবে ও জানে মা আজ খুব কষ্ট পেয়েছে।মা এর চোখের জল ওকে অস্থির করে তোলে।মনে মনে ভাবে “কেন যে এই গুলির নেশা হল কে জানে”!
ছবি ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল।দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো পঞ্চা।বললে “মা গো!রাগ করিস নি”।
ছবি রেগে মেগে বললে “সৃষ্টিছাড়া ছেলে।ইসস।আবার আদিখ্যেতা।ছাড়।ছাড় বলছি”!
মা কে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে ছেলে।
ছবির রাগ জল হয়ে যায়।বলে “যা খোকা।চান করে আয়।আমি তোকে খেতে দিয়ে চানে যাবো।”
পকেট থেকে চারটে কাঁঠালি কলা বার করে মাকে দিয়ে বলল “তুই ভাত বার।আমি পুকুরে যাবো আর আসবো”।
ছবিরাণী চেঁচিয়ে ওঠে “একদম নয়।যা।সাবান নে যা।অমন সোনার গৌর আমার কালি হয়ে যাচ্ছে”।
ছবিরাণী ভাত বেড়েছে।দাওয়ায় বসে পঞ্চা বলে “কী রাঁদলি রে মা”
হাসতে হাসতে ছবি বললে “উচ্ছে পাতা দিয়ে এটুনি শুক্তো করিচি।আর বড়ি পোস্ত।দুধ টা আজ গোষ্ঠ গয়লাকে দিই নি।ঘন করে জ্বাল দিয়েচি।মায়ে পোয়ে খাবো”।
এই সামান্য কথাগুলো তে পঞ্চা কেন যে এত খুশি হয়।মনে মনে ভাবে বড় হয়ে সে মা কে খুব সুখে রাখবে।তার মা যে জনম দুখিনী।
পঞ্চাকে লেখাপড়া শেখানোর স্বপ্ন মাঠে মারা গেছে।এ ছেলে ভবঘুরে।কখন যে কোথায় থাকে তার ইয়ত্তা নেই।বিকেল হতেই পঞ্চা বাইরে যাবার ফন্দি করছে।মা বললে “কলা কিনলি।টেকা কে দিলে”।
পঞ্চা বলে “ফিরোজের আব্বাজান দিলে।বললে ফেরত দিতে হবে নি”।
ছবি বলে “তা বললে হয়।প্রয়োজনে দেছে।তুই দিয়ে আয় বাবা।”
বন্ধু।কত ছোট্ট শব্দ।তবু কী ব্যাপকতা এই শব্দটির।ফিরোজ পঞ্চার বন্ধু।অভিন্নহৃদয়।যেদিন ফিরোজের জ্বর হয়েছিল সেদিন রাত জেগেছে পঞ্চা।ফিরোজের মাথায় জলপটি দিয়েছে।পঞ্চাকে সবাই কেন যে ভালোবাসে পঞ্চা বুঝতে পারে না।ও ভাবে “ভারি আশ্চর্য!আমাকে সবাই কত ভালোবাসে।মনটাতে আনন্দের বান ডাকে”।
সেদিন সকাল থেকেই বাঁধনছাড়া বৃষ্টি।প্রকৃতি আজ স্ব মহিমায় আসীন।এইসব দিনে পঞ্চা যেন প্রাণ পায়।গাঁ এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মুন্ডেশ্বরী।বর্ষায় যেন উন্মাদিনী।তবে পঞ্চা ওকে তোয়াক্কা করে না।বললে “ডিঙি নৌকাটা নিয়ে নদীতে যাবো”।
ফিরোজ বলে “খবরদার যাবি না।নদী ক্ষেপে আছে।মরার ইচ্ছে না কি”?
পঞ্চা মুচকি হেসে বলে “মরন রে!তুই শ্যামের সমান”।
ছেলেমানুষের হালকা কথা।কেউ আমল দেয় নি।কিন্তু পঞ্চা তার কথা রেখেছে।উন্মাদিনী নদীর মাতলামির সঙ্গী হয়েছে।কোনো কিছু তে ভয় খায় না।পাড়ার বৌ ঝি রা শিবরাত্রিতে ডাব পাড়ার জন্য ওর শরণাপন্ন হয়।খোঁড়া পা নিয়ে অদ্ভুত খেমতা ওর।
কিন্তু আজ কী দেখছে ও।নদীর পাড়ে ন’কড়ি নাপিতের ঘরটা নদীবক্ষে ঢুকে গেল।ওই তো।একটা কান্না।একটা শিশু ভেসে যাচ্ছে।ছুটে আসছে একটা ডিঙি নৌকা।না।বেসামাল নেয়ে।ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে।খোঁড়া পা নিয়ে সাঁতরাচ্ছে স্রোতের বিপক্ষে।বুকে জড়িয়ে নিল শিশুকে।প্রাণ আছে!প্রাণ আছে!ওটাই তো একমাত্র সত্য।বেঁচে গেছে প্রাণ দুটো।মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ওই গানটাই ভেসে আসছে।
সবাই হাসছে।আর গানটা শুনতে পাচ্ছে পঞ্চা
“কেন কারাগৃহে আছিস বন্ধ
ওরে মূঢ়,ওহে অন্ধ”
–~০০০XX০০০~–