বৈতালিক
✍ বৈশাখী রায়
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বিক্রমাদিত্য ফিরে গেলেন গাছের কাছে। গাছ থেকে শব নামিয়ে কাঁধে ফেলে আগের মত নীরবে হাঁটতে লাগলেন। তখন শবেস্থিত বেতাল বলে উঠলো, ” রাজা, অতিরিক্ত কর্তব্যপরায়ণতা দেখাতে গিয়ে আপনি কিন্তু বারবার মূর্খামির পরিচয় দিচ্ছেন। তবে অতিরিক্ত চাতুর্য্য যে অনেক সময় মানুষের বিনাশের কারণ হয় সূর্যতপার গল্প শুনলেই তা বুঝবেন। গল্প শুনতে শুনতে চলতে থাকলে আপনার পথশ্রমও লাঘব হবে, তবে প্রতিবারের মতো এবারও গল্পের শেষে আমি একটি প্রশ্ন করবো। উত্তর জানা শর্তেও যদি আপনি নিশ্চুপ থাকেন, তৎক্ষণাৎ আপনার মাথা চৌচির করে দেবো আমি। আর যদি মুখ খোলেন, তবে আবার ফিরে যাবো গাছে।”
বেতাল শুরু করলো: মণিপুর রাজ্যে সূর্যতপা নামের এক বণিক তাঁর স্ত্রী এবং তিন যমজ কন্যা নিয়ে বাস করতেন। সূর্যতপা ছিলেন অত্যন্ত কৃপণ। যথেষ্ট ধনসম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিতান্তই কায়ক্লেশে দিন কাটাতেন। তাঁর তিনকন্যা মান্ডবী, সূপর্ণা এবং তপবতী রূপে-গুণে, আকারে-গড়নে এবং সাজ-সজ্জায় অভিন্ন ছিল। স্বয়ং সূর্যতপা পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই তাদের আলাদা করতে পারতেন না।
এরই মাঝে কেটে গেল অনেকগুলো দিন। সূর্যতপার তিনকন্যাই এখন বিবাহযোগ্যা, এবং তিন বিবাহের জন্য যে বিপুল অর্থব্যয় হবে, তার কথা ভেবেই সূর্যতপার রাতের ঘুম নিশ্চিহ্ন হলো। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করলেন, তিনকন্যার বিবাহ একজনের সাথেই দেবেন। তাতে যেমন অর্থব্যয়ও কম হবে, তেমনি তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তিও অভিন্ন থাকবে। কিন্তু তৎকালে মণিপুরে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। তাই তিনি ঠিক করলেন কৌশলে তিন যমজ কন্যাকে একজন হিসাবেই উপস্থাপন করবেন। একবার বিবাহ হয়ে গেলে আর কারোরই কিছু করার থাকবে না।
অতঃপর সূর্যতপা স্ত্রী এবং কন্যাদের বিপুল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও দেবসেনা নামের এক বিদেশী যুবকের সাথে তিনকন্যার বিবাহ দিলেন। কৌশলে মাল্যদান করালেন মান্ডবীর সাথে, সিঁদুর দান হলো সুপর্ণার সাথে এবং অগ্নিসাক্ষী রেখে সম্প্রদান করলে তপবতীকে। বিবাহসম্পন্ন হলো।
কথা ছিলো দেবসেনা একমাস শ্বশুর গৃহে থাকবেন, তারপর বধূ কে সাথে নিয়ে ফিরে যাবেন নিজের দেশে। সেই মতই চলতে থাকলো সব। সূর্যতপা পালা করে করে মান্ডবী, সুপর্ণা আর তপবতীকে পাঠান জামাতার শয়নকক্ষে। অচিরেই দেবসেনার মিষ্টি ব্যবহার, মনকাড়া মেজাজ আর মার্জিত রুচি মোহিত করলো তিনবোনকেই। মান্ডবী, সুপর্ণা আর তপবতী ভালোবেসে ফেললো দেবসেনাকে।
অবশেষে দেবসেনার ঘরে ফেরার সময় উপস্থিত হলো, শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে দাস-দাসী-বরকন্দাজসহ যখন তিনি বাড়ির দিকে এগোনোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন, তখন তারসামনে হাজির হলো তিনবোন। একই সাথে, একই সজ্জায় সজ্জিত হয়ে। তাদের দেখে দেভসেনা প্রথমে অবাক, তারপর ভীত এবং সবশেষে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। ধীরে ধীরে সবটা বুঝতে পারলেন তিনি। রাগে অপমানে তার ফর্সা গালে লালচে ছোপ পড়লে, তেঁতে উঠলো কানদুটো।
এই পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সূর্যতপা, ভেবেছিলেন কেঁদে-কেটে; ইনিয়ে-বিনিয়ে ঠিক তিন মেয়েকে গছিয়ে দেবেন দেবসেনার সাথে। কিন্তু বাস্তব যে ভাবনার বাইরে থেকে উঁকি দেয়, তা জানতেন না তিনি। পুত্রসম জামাতার পায়ে পর্যন্ত পড়লেন তিনি, তবুও দেবসেনা রাজি হলেন না, এমনকি যেই সম্পত্তির জন্য এতকিছু তা পর্যন্ত দিয়ে দিতে চাইলেন তিনি। তবুও দেবসেনা অনড়। তাঁর এক কথা- ” আমি একটি কন্যাকেই বিবাহ করেছি, তাঁকেই ঘরে নিয়ে যাবো। এবার আপনি ঠিক করুন কোন কন্যাকে আমার সাথে দেবেন; এবং কেনো সেই কন্যাকে দিলেন, তার কারণও বলবেন। কারণটা আমার মনঃপুত হলেই আমি ঠিক করবো আমার কি করা উচিৎ! মনঃপুত না হলে আমি তিনকন্যাকেই এখানে রেখে চলে যাবো, আর ফিরবো না কখনো।”
অনেক বুঝিয়েও যখন সূর্যতপা কিছু করতে পারলেন না, তখন তপবতীকে দেবসেনার হাতে তুলে দিতে চাইলেন, এবং বললেন, ” প্রজাপতিমতে আমি তপবতীকেই সম্প্রদান করেছি। তাই ওকেই তোমার হাতে তুলে দিলাম।” একথা শুনেই দেবসেনা তৎক্ষণাৎ বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে।
লজ্জায় আর অপমানে মুখ লুকানোর জায়গা না পেয়ে সূর্যতপার স্ত্রী , তিনকন্যাসহ আত্মহত্যা করলেন, আর এই গ্লানি মাথায় নিয়ে বাকি জীবনটা উন্মত্তের মত কাটালেন সূর্যতপা।
গল্পটি শেষ করে বেতাল বলল, “মহারাজ, এবার বলুন, দেবসেনা কেনো একটি কন্যাকেও না নিয়েই চলে গেলেন? এবং এই গল্পে সবথেকে বড়ো দোষী কে?”
একটু চুপ করে থেকে বিক্রমাদিত্য বললেন, ” বিবাহ অনেক প্রকার, যেমন, গান্ধর্ব বিবাহ, পৈশাচিক বিবাহ, আর্য বিবাহ, প্রজাপত্য বিবাহ প্রভৃতি। এক্ষেত্রে সূর্যতপা প্রজাপতি মতে তিনকন্যা র বিবাহ দিয়েছেন, কিন্তু মন্ত্র-আচার সম্পন্ন হয়নি কারোর সাথেই। শাস্ত্র মতে তাঁর তিন কন্যাই অবিবাহিত। তাই যখন তিনি শুধুমাত্র তপবতীকে সম্প্রদানের কথা বললেন, যুক্তিগতভাবেই তা সঠিক মনে হয়নি দেবসেনার । তাই তিনি বেরিয়ে গেলেন।”
“আর আমার মতে এখানে সবথেকে বড়ো দোষী দেবসেনা। সূর্তপারর স্ত্রী এবং তিনকন্যা নিষ্পাপ, সূর্যতপা নিজেও বহুবার ক্ষমা চেয়েছেন। তবুও দেবসেনা নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ় থেকেছেন। ভুল মানুষ মাত্রই করেন। তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়াই পরম ধর্ম। একবার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিলো দেবসেনার। তিনি তো তা দিলেনই না, বরং মৃত্যু মুখে ঠেলে দিলেন চারটি প্রাণকে। দেবসেনা তাই নিশ্চিতরূপেই সবথেকে বড়ো দোষী।
উত্তরটা শুনে মুচকি হাসলো বেতাল, আর তারপরেই উড়ে চলে গেলো আগের গাছটার কাছে। সময় নষ্ট না করে তার পিছু ধাওয়া করলেন রাজা বিক্রমাদিত্য।
–~০০০XX০০০~–