বহুযুগের ওপার হতে
✍শ্যামাপ্রসাদ সরকার
কিছু বলব বলে –
এ লেখাটি যে বয়সের তখন উদ্যম ছিল বেশী, আত্মপ্রকাশের ছটফটানিও। একটি সদ্যজাত ছোট পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার জন্য বন্ধুরা অনুরোধ করেছিল। অর্থাভাবে সে পত্রিকা যদিও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। সেও প্রায় পনের ষোল বছর আগেকার কথা। আজকের এই কাঁচাপাকা চুলের বয়সটাতে এসে ওই সময়ের কাঁচামিঠা হাতের লেখাটিকে সকলের সামনে এনে আমার প্রথম অপ্রকাশিত উপন্যাসটিকে তার প্রাপ্য পিতৃপরিচয়টুক অন্তত আজ প্রদান করলাম।
*************
চলে আসব যেদিন, সেদিন শুক্রবার। একটু একটু করে শরৎকাল আনন্দভৈরবী বাজাচ্ছে আকাশজুড়ে। নিষ্পাপ মেঘেদের ভীড় আর নীল গালচের মত আকাশ জুড়ে রঙের মেলা। ওরা সবাই বাসে তুলতে এসেছিল, এমনকি আনন্দবাবুও। কিন্তু সুভদ্রা ত্রিসীমানায় ছিল না। বাংলোটা সরকারী বলে বুকিংএর সময় পুরো টাকাই অফিস থেকে দিয়ে দিয়েছিল। আর বাজারখরচ, আর টুকটাক খরচ যা ছিল তাও সময়মতন মিটিয়ে দেবে তারাই। সুভদ্রাকে আলাদা বখশিস দেবার সাহস আমার নেই। তবে ওর বাবার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসলাম ওর বিয়ের যৌতুক হিসেবেই। কিছু কিছু ঋণ শোধ না করার আলাদা আনন্দ আছে তা হয়তো সবার জানা নেই। বাসটা একরাশ ধূলো উড়িয়ে মন্দিরের হাতা ছাড়িয়ে, বাঘমোন্ডা পাহাড়ের ন্যাড়া ন্যাড়া মাথা আর জঙ্গলময় বনপাহাড়ীর এই আজব রূপকথার দেশ থেকে আবার আমায় নকলগড়ের দেশে পথে ভিড়িয়ে নিয়ে চলে গেল নির্মমভাবেই।
লেখাটা আমাদের ছাপার পর কাগজে বেশ প্রশংসাই পেল। ট্র্যাভেলগের বদলে ওতে যে বুনো জংলী গন্ধটুকু যে ধরে রাখতে পেরেছি তাতে নিজেরই ভয় ছিল পরিণতি নিয়ে তাই সকলের পছন্দ হল দেখে বেশ অবাকই হয়ে গেলাম।
কাজের জগতে ফিরে পুর্নমূষিক ভব হয়ে তাড়াতাড়ি কাটতে লাগল ঋতুচক্র। শুধু কয়েকমাসের স্বপনচারণের দিনলিপি হয়ে জেগে থাকল গড়শ্রীখন্ডপুর আর তার অলীক মানুষজন। দুবছর ঘুরে গিয়ে আবার বদলী হল শিলিগুড়িতে। সেই আবার অন্য এক শহর আর পুরনো ফুরিয়ে যাওয়া ফেলে আসা স্মৃতির চিরচেন শহুরে বিস্মরণ।
এরমধ্যে একদিন হঠাৎ কাগজে দেখি গড়শ্রীখন্ডপুর নামটা জ্বলজ্বল করছে।ওই
এলাকায় ব্যাপক পুলিশী ধরপাকড় চলেছে। মাওবাদীদের একটা দল নাকি ধরাও পড়েছে, এমনই লিখেছে। ঠিক সেই সময়ে আমাদের লোকাল করেসপন্ডেন্ট ছেলেটির বউ তখন বাচ্চা হতে হাসপাতালে তাই সেও গেছে ছুটিতে, একটা জম্পেশ স্টোরির লোভ দেখিয়ে ফিল্ড এডিটর সাহেবকে ম্যানেজ করলাম।
ফলতঃ আবার অরণ্যে, আবার সেই গড়শ্রীখন্ডপুরে পুনর্গমন।
উপসংহার
*****
প্রায় আড়াই বছরে অনেকটাই বদল হয়ে গেছে জায়গাটার। একটা অ্যালুমিনিয়াম কারখানা বসানো নিয়ে স্হানীয় বাসিন্দাদের সাথে সরকারের বচসা চলছে। জঙ্গল এর মধ্যেই আধা সাফ। আমার সেই বাংলোটার জায়গায় সরকারী গেস্টহাউস দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক স্থাপত্যের পেলব অহঙ্কারে। সুভদ্রারা আর থাকেনা সেখানে। মহাবীরের বাবা ভক্তরাম মরে গেছে কবেই, দেখলাম শুধু চান্দু আর মুন্তাই রয়ে গেছে চেনা মুখ বলতে। ওদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে ! যুগলরা বোলাঙ্গিরের কাছে হাইওয়েতে নাকি একটা ধাবা চালায় অার লুকিয়ে লুকিয়ে বেআইনী মদ বেচে।
পুরো জায়গাটাই যেন রাতারাতি বিদেশ হয়ে গেছে । সে রাতে আনন্দবাবুর কাছেই আশ্রয় নিলাম। আড্ডা পানের সময় নিজেই বললেন ওই পুলিশী এনকাউন্টারে মহাবীর আর দুজন সঙ্গী শহিদ হয়েছে ওই রেখাই নদীর চরেই যেখানে আমরা সেবার চড়ুইভাতি করেছিলাম। আর তারপর থেকে সুভদ্রাকে এ তল্লাটে আর দেখা যায়নি কোনওদিন। অনেকে বলে হাইওয়ের ধারে ধাবা গুলোয় কোন কাজ টাজ করতে দেখেছে অথবা ধাবায় থামা ট্রাকড্রাইভার বা খালাসীদের…গলা ধরে আসে তাঁর। তরলগরলে চোখমুখ লালচে হয়ে আসে আনন্দবাবুর। উনিও ভি আর এস নিয়ে চলে যাবেন শিগগিরই। এখানকার প্রকৃতির সাথে বন্য অনাঘ্রাত জৌলুস হারাতে বসেছে তার মানুষ গুলোও আর সেই মোহ নেই। অনেকদিন তো পরিবার ছেড়েই কাটিয়ে দিলেন, শেষ পাড়ানির কড়ির ঋণও তো চোকাতে হবে নাকি! আমি পরদিনই চলে যাব স্হির করলাম। প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে প্রেমিকের যেমন অসহায় অনাথ অবস্থা হয় আমার ঠিক সেরকম অস্হির লাগছিল এখানে আসার পর থেকে। যে গড়শ্রীখন্ডপুরকে অামি চিনতাম কখনো, সুভদ্রার মতোই সে যেন নিখোঁজ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।
একরাশ ধূলো উড়িয়ে বাসটা শেষবারের মত আমায় নিয়ে যাবে বলে এসে সেই হাটের সামনে এসে থামল। এবার আর কেউ সি অফ্ করতে আসার কেউ নেই।
সারা রাস্তার যত শুকনো ধূলো সবই উড়ে এসেছে জানলা দিয়ে। অখয়েরি গুন্ডিপানঅ ‘র মৌতাতে ভিতরটা ম-ম করছে। দুপুরবেলা হলেও অভিমানী নবোঢ়ার মত আকাশের মুখ ভার। ঘোলাটে লাগছে দূরের বাঘামোন্ডা পাহাড় আর ফসল কাটার পর খেত জ্বালিয়ে দেওয়া ছাই এর কালচে দাগ গুলো। কি আশ্চর্য সেবার আর এবারের মধ্যের বৈপরীত্যের নির্মমতায়। এইবারে সে সত্যি সত্যি কুমারী অরণ্য হারিয়ে ফেলেছে তার সহজসরল জীবন, হারিয়ে ফেলেছে তার বনবাসর আর তার বনজ গায়ের জংলা গন্ধটাকেও। সুভদ্রা আর মহাবীরের মতোই লুটোপুটি খাওয়া রোদ্দুর মেখে বেড়াতে আসা কাঠবিড়ালীর দলও যেন মুছে গেছে এই বিশ্বপ্রকৃতির আসরের পাতা থেকে। ইঁটকাঠের শুকনো দেখনসর্বস্ব সভ্যতার লিপস্টিক লেগেছে ভূমিজ ধুলো মাখা ষোড়শীর ঠোঁটে পুরু করে। তার মোহময়ী রূপকে বদলে দিয়েছে পেশাদারী লাস্যে।
তবুও আমি এখনো বিশ্বাস করবো যে কোনও এক অলস দুপুরে কুবো পাখির কুব কুব কুব’ করে মনভারী করা ডাকের ফাঁকে ফাঁকে বেঁচে থাকা স্বপ্নময়ী কুমারী অরণ্যের রোদ গলে সোনা হয়ে যাওয়া গাছপালার আনাচে কানাচে চকিতা কালোচোখের হরিণীর মত সুভদ্রা ঠিক একদিন এখানে ফিরে আসবে ! এখানে যে ফিরে ওকে আসতেই হবে!
–:: সমাপ্ত ::–
(কৃতজ্ঞতা – Vedanta Patrika এটিকে পুর্নবার প্রকাশ করতে সাহায্য করায়🙏)