হয়ত প্রলাপ
✍ হৈমন্তী ভট্টাচার্য্য
মিতা,
ধর নিজের থেকে পালিয়ে চলে গেলাম কোনো নাম না জানা আরণ্যক আশ্রয়ে। কাউকে না বলে। কোনো নির্দিষ্ট দিন ঠিক না করে…
জানিসই তো ভিড়ের মধ্যে আমার ভীষণ অসহায় লাগে। খানিকক্ষণ উৎসবের মত মনে হয়, তারপর আমার নিজস্ব নির্জন কোণটার জন্য আমার বড্ড মন কেমন করে। মনে হয় ওও আমার মতই অসহায়, আমার মতই একা। ও আমায় খুঁজছে। আমাকে আমার এতদিনের সঙ্গী নিঃসঙ্গতার কাছেই এবার যেতে হবে। আমি ভীষণ বেমানান বাকিদের পাশে। আমি অন্ধকার নির্জনতায় স্বচ্ছন্দ। তবু বন্ধ জানলার রঙিন কাঁচের ওপর দিয়ে এসে পড়া একটুকরো রঙিন সূর্য আমি ছুঁয়ে অনুভব করার লোভ সামলাতে পারি না। কিন্তু ওই আলোর পথ ধরে বাইরের উজ্জ্বলতায় এসে দাঁড়ানোয় আমার অনন্ত দ্বিধা।
এক এক সময়ে মনে হয়, আমার ওপর নিঃসঙ্গতার জন্ম অভিশাপ আছে।
দোতলা অবধি আলোর মালার ওপরের তিনতলার বারান্দার জমাট অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমি নীচের উৎসব দেখতে ভালোবাসি। বারান্দার কোণের মাধবীলতা আমার মতই একা একা হাওয়ায় দোলায় তার ফুলের উৎসবসাজ। আনন্দের ফোয়ারার বিন্দু বিন্দু কণা এসে আটকে থাকে আমার হাওয়ায় ওড়া চুলে। হঠাৎ চোখে পড়বে নীচের রাস্তায় ঠিক আমার মত দেখতে একটা মেয়ে। অবিকল আমার মত চোখ মুখের রেখা। তার আসমানী জামার চুমকিতে আলো পড়ে সে রাতবাতি হয়ে উঠেছে। আমি তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে চেয়েও পারব না। বুভুক্ষুর মত তার হাত ধরে আলোর দিকে এগিয়ে যাবো। কত কথা কত গানের ভিড় সেখানে। প্রজাপতির মত মেয়েটা আরো এগিয়ে যেতে চাইবে। জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে সমুদ্রস্নানের সোহাগ পেতে চাইবে।কিন্তু নিঃসঙ্গ মেয়েটা তার হাত টেনে ধরবে। তার ভেতরকার ভীত অবুঝ অসহায়তা তিক্ততার বিষ উগরে দেবে। ভিড় সরে যাবে দূরে। নিঃসঙ্গ মেয়েটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। আর রঙিন মেয়েটা চোখে এক সমুদ্র জল নিয়ে সরে যেতে থাকা হাতগুলো দেখবে। তার ফসলে সবুজ মনের মাঠে খরা নেমে আসবে।চোখের কোণে মুক্তো জমে উঠবে। সে চিৎকার করে বলতে চাইবে, “ক্ষমা করে দাও, আর একবার গ্রহণ কর আমায়।” নিঃসঙ্গতা গলা চেপে ধরবে , খল খল করে হেসে উঠবে নিষ্ঠুর ক্ষমাহীনভাবে।
বার বার এমনই হবে। এমনই হয়। এটাই হয়ত ভাগ্যলিপি।
ধুর, কী সব বলছি, সেই রঙিন মেয়েটা কবেই মরে গেছে। কিংবা সে হয়ত কোনোদিন জন্মানোর সুযোগই পায়নি। শুধু ওই অন্ধকারটাই সত্যি। অন্ধকার টানেলে আলো নিভে যাওয়া ট্রেনে দীর্ঘযাত্রা যে তার শেষ হয়ে গেছে, সেটা সে কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারবে না। যদিও পারে, তবুও আলোর সাথে উৎসবের সাথে তার ভাব হয়ত কোনোদিন হবে না।
পৃথিবীর ফিরিয়ে দেওয়া, কারোর কাছে মূল্য না পাওয়া বন্ধুত্ব সবটা সাজিয়ে সে অপেক্ষা করবে তোর জন্য। জনসমাগম যেখানে পৌঁছয় না সেরকম একাকী ভূমিতে। কেউ হয়ত কখনো এসেছিল। তারপর একটা কাঠের বাড়ি বানিয়ে কিছুদিন থেকে ফিরে গেছে। বাড়িটা বড় আশা করেছিল মানুষটা ফিরে আসবে। কিন্তু আসেনি। আমাদের দেখে বাড়িটা আবার হেসে উঠবে। ধুলোমাখা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে পায়ে পায়ে উঠে আমরা ওর বুক জুড়ে বসব। সবজেটে ছায়াঘেরা ঘরে আলো আঁধারি খেলা করবে। নাম না জানা ফুলের উগ্র গন্ধে মোমআলোর মত মায়াবী রাত্রি নামবে। ঘরের কোণে লালচে আগুন জ্বলবে ফায়ারপ্লেসে। তোর চোখের মণিতে বিন্দু বিন্দু আগুন দেখব আমি। সেই আমাদের প্রথম দেখা, কিন্তু আমার একটুও ভয় করবে না তোকে। বা করলেও তুই আমার শীতল হাতটার ওপর তোর প্রবালের আংটি পরা হাতটা রেখে হেসে আমার ভয় ভাঙিয়ে দিবি। আমার হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো একটা একটা করে গেঁথে ফেলবি সোনালী সুতোয়। আমি অপলকে তোর আনত মুখের দিকে চেয়ে থাকব। স্ফটিকের গ্লাসে মদিরার মায়ায় একটু একটু করে আশ মিটিয়ে একটা সুন্দর রাত কেটে যাবে।
সদ্যোজাত শিশুর নরম গালের মত গোলাপি হয়ে উঠবে আকাশ। আমাদের হঠাৎ মনে হবে, এবার তো ফিরতে হবে। তোকে ফিরতে হবে তোর আলোর বৃত্তে, আমায় ফিরতে হবে আমার চেনা একাকীত্বে। ঠিক আমাদের মত দেখতে দুটো মানুষ ফিরে আসবে চেনা ছকের ইমারতে। আমরা একে অন্যের হাত ধরে জঙ্গলে হারিয়ে যাবো। কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের।
(চিত্র মাধ্যম- জলরঙ)
–~০০০XX০০০~–